0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in


প্রবন্ধ


কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নিয়ে দুটি কথা
রঞ্জন রায়



না; আমি আধুনিক কবিতা বা চিত্রকলা বুঝি এমন অপবাদ আমার অতি বড় শত্তুরেও দেবে না। তবে সব বঙ্গসন্তানই বড় হয় ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ আর ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ শুনে এবং গোঁফের রেখা দেখা দিতেই লুকিয়ে লুকিয়ে পদ্য লেখে, পাশের বাড়ির রাইকিশোরীর প্রেমে পড়ে। আমিও কোনও ব্যতিক্রম নই।

আমারও অভ্যেস ছিল রবীন্দ্রনাথের কিছু পদ্য ও জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ থেকে কিছু লাইন চুরি করে চিঠির মধ্যে গুঁজে দেয়ার।

কিন্তু এঁদের পরের কবিরা? সত্যিই বুঝতে পারি নি। মানে, কীরকম যেন লেগেছে — ক্যালকুলাসের অংকের মত। তবে সব নিয়মেরই ব্যতিক্রম আছে। প্রথম যৌবনে যে দু’এক জনের কবিতা ভাল লেগেছিল, নীরেন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। 

কেন ভাল লেগেছিল? বুঝতে পারতাম বলে। ভুল বললাম, কবিতা তো বুঝবার জন্যে নয় — বাজবার জন্যে। হ্যাঁ, ওঁর কবিতায় বুকের মধ্যে কিছু একটা বেজে উঠত। শব্দের মায়া ছাড়িয়ে মনে হত ওরা আমার কথা বলছে। আমার কথা? না, শুধু আমার কথা নয়; আমাদের কথা। মানে, ষাটের দশকের শেষের থেকে সত্তরের গোড়ার দিকে রুক্ষচুলে হাওয়াই চটি পায়ে কলকাতা চষে বেড়ানো ছেলেগুলোর কথা। ঠিক তা ও না; গুছিয়ে বললে তাদের চোখে দেখা কলকাতার কথা। 

একটু একটু করে নীরেন্দ্রনাথের কবিতা সেই সময়ের কলকাতার চালচিত্র হয়ে উঠলো।

সেই কলকাতায় বড় বড় শপিং মল ছিল না, ফ্লাই ওভার ছিল না। ঝাঁ-চকচকে গাড়ি, আইনক্সে সিনেমা দেখা – কিছুই ছিল না। আর চাকরিও ছিল না। ভিড় ছিল, ট্রামে বাসে বাদুড়ঝোলা হওয়া, ঘামের টকগন্ধে অভ্যস্ত হওয়া বিধি ছিল। আমরা ছিলাম দিশাহীন। আমরা ছিলাম উচ্ছন্নে যাওয়া। কিন্তু আমরা ভালবাসতাম। কেরিয়ারকে নয়, নারীকে—আসলে কলকাতাকে। সেখানে আমাদের জন্যে ‘বর্তমান মুক্তকচ্ছ, ভবিষ্যত হোঁচটেতে ভরা’।

সেই কলকাতা ধরা পড়ল নীরেন্দ্রনাথের কবিতায়। আমাদের যত ব্যর্থতা, আমাদের যত অভিমান আর হতাশা, সব বেঁচে উঠল, তবে উচ্চকিত নয়, শ্লোগান মুখর মুষ্টিবদ্ধ হাতের উত্তোলনে নয়; বরং সেতারের আলাপের মত আন্তরিক মৃদু আলাপনে।

আমাদের তখন সেই বয়েস, যা নিয়ে পুর্ণেন্দু পত্রী লিখে গেছেন — ‘ফুলের গন্ধ নেবার জন্যে, নারীর স্পর্শ পাবার জন্যে, ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে আমরা যখন যুবক হলাম’। 

এই কবিতাটি দেখুনঃ কলকাতার যীশু; একহিসেবে নীরেন্দ্রনাথের সিগনেচার কবিতা।

“লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের-বেগে-ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল।
ভয়ংকর ভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেম্পো, বাঘমার্কা ডবল ডেকার
‘গেল-গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে 
যারা ছুটে এসেছিল—
ঝাঁকামুটে, ফেরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার-
এখন তারাও যেন শিল্পীর ইজেলে স্থিরচিত্রটির মত
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য-পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।
খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে চৌরঙ্গীপাড়ায়।
এখন রোদ্দূর ফের অতিদীর্ঘ বল্লমের মত
মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে 
নেমে আসছে;
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর।

স্টেটবাসের জানলায় মুখ রেখে 
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে।
ভিখারী মায়ের শিশু,
কলকাতার যীশু,
সমস্ত ট্র্যাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।
জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘষটানি
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নেই;
দু-দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।
যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে
সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেতে চাও হাতের মুঠোয়।
যেন তাই টালমাটাল পায়ে তুমি
পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য কিনারে চলেছ।।

দেখতেই পাচ্ছেন, কীভাবে কবিতাটি সেই সময়ের কলকাতার দৈনন্দিন একটি ঘটনার থেকে শুরু হয়ে এক মহত্তর আবেদনে পৌঁছে গেল।

১৯৬৯ সালে দু’টি শারদীয় সংখ্যায় উনি দু’টি কবিতা লেখেন — একটি উল্লিখিত ‘কলকাতার যীশু’, অন্যটি ‘চতুর্থ সন্তান’।

পরেরটির প্রেক্ষিত নিয়ে দুটো কথা বলি।

আমার প্রজন্মের লোকজনের মনে পড়বে, অর্ধশতাব্দী আগে সরকারী পরিবার পরিকল্পনা প্রোগ্রামের গোড়ার দিকে শ্লোগানগুলি একটু অন্যরকম ছিল। প্রথমে এল ‘দো ইয়া তিন, ব্যস’; তারপরে এল ‘ হম দো, হমারে দো’। শেষে ‘অগলা বচ্চা অভী নহী, দো কে বাদ কভী নহী’।

তো নীরেন্দ্রনাথের কবিতাটি সেই ‘তিন পর্য্যন্ত’ ফরমানের দিনে লেখা। তাতে দেখি-- কোনও পরিবারে জন্মানো অবাঞ্ছিত ‘চতুর্থ সন্তান’ অভিমানে মুখ ফিরিয়ে বসে।

নীরেন্দ্রনাথের সংবেদনশীল কবিমন বলে ওঠে ‘কে তোমাকে চায়!’

কবিতাটির শেষে ওঁর কলমে ফুটে ওঠে প্রাজ্ঞ ঋষির অমোঘ সত্যবচনের মত এই স্টেটমেন্ট — যে পৃথিবী ওই চতুর্থ সন্তানকে তার ইচ্ছের তোয়াক্কা না করে জন্ম দিয়ে এখন দূর-ছাই করছে, কাল সে অভিমানে প্রতিশোধ নিতে এই পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

চমকে উঠে টের পাই ওই শিশুটি তো আমি বা আমরা! 

আমরা যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই; আমরা, যাদের চাকরি নেই, পরিবারে ও পাড়ায় সম্মান নেই। আমরাই তো এক অর্থে শহর কলকাতার চতুর্থ সন্তান। আমাদের মধ্যে রয়েছে নিজেকে ধ্বংস করার প্রবণতা।

উনি চমকে দিলেন আবার—সত্তরের গোড়ায়। আনন্দবাজারের রবিবারের সাময়িকীতে লিখলেন ‘কবিতার কথা’ ধারাবাহিক, ‘কবিকঙ্কণ’ পেন-নেম নিয়ে।

প্রথমে অভিজ্ঞ মাস্টারমশাইয়ের মত ধৈর্য ধরে আমাদের বোঝালেন কবিতা কাকে বলে। অর্থাৎ, কী কী থাকলে একটি লেখা কবিতা হয়ে ওঠে। আবার সেগুলো না থাকলে শুধু মাত্রা গুণে ছন্দ মিলিয়ে অন্ত্যমিল দিয়ে লিখলেও সেটা কবিতা হয় না। উদাহরণ দিলেনঃ

সূর্য ব্যাটা বুর্জোয়াটা
দুর্যোধনের ভাই।
গর্জনে তার তূর্য বাজে
তর্জনে ভয় পাই।।

তবে বই হয়ে বেরোনোর পর বেস্ট সেলার হওয়া এই বইটি নামে ‘কবিতার কথা’ হলেও আসলে ছন্দের কথা-- বাংলা ছন্দের। এখানে আমরা পেলাম ছান্দসিক নীরেদ্রনাথকে।

এই লেখাগুলোর মাঝে প্রখ্যাত ছান্দসিক প্রবোধ চন্দ্র বাগচীর সঙ্গে ওঁর বিতর্ক, থুড়ি... মত বিনিময়, আমাদের মত হরিদাস পালেদের জন্য এক অতীব স্বাদু ও অবশ্য শিক্ষণীয় পাঠ হয়ে গেল। 

আমরা জানলাম – বাংলা ছন্দ মূলত তিনরকমের; অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও মাত্রবৃত্ত। এসব তো স্কুলে কেউ শেখায় নি! উনি এগুলোকে চেনার এবং মাত্রা গোণার পদ্ধতি দেখালেন; এবং বাংলা ছড়ার ছন্দটিও বাদ গেল না — ‘যোমনাবতী সরস্বতী কাল যোমনার বে’।

কবিতার ক্লাসের মাঝে মাঝে পেতাম বিশুদ্ধ হাস্যরসের চৌপদী।

‘ছন্দের গুঁতো খেয়ে পোড়োদের হায়,
চোখ থেকে অবিরল অশ্রু গড়ায়।
কহে কবিকঙ্কণ কান্না থামাও,
ক্লাস থেকে মানে মানে চম্পট দাও।।

নীরেন্দ্রনাথ পরবর্তী কবিতাগুলোতে আরও মিতবাক হলেন। অসহ্য দমবন্ধ সত্তরের দিনের বর্ণনায় লিখলেন—‘ দু’পায়ে ঢুকলে মনে হয় চারপায়ে বেরিয়ে যাই’।

এমন সময় এল বাংলা বানান সংস্কারের আন্দোলন। সংস্কৃতের অন্ধ নকলনবিশী ছেড়ে বাংলা বানান মুখের কথার কাছাকাছি আসতে চাইল। অনেক অপ্রয়োজনীয় মেদ ঝরিয়ে ফেলে তন্বী হল। অনেক র-ফলার পরের যুক্তাক্ষরকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করা হল। অনেক বিতর্ক কমিটি, অনেক ‘পাত্রাধার কি তৈল , নাকি তৈলাধার কি পাত্র’ গোছের নব্যন্যায় শুরু হল। আমরা এ ওর মুখের দিকে তাকাই, বুঝভম্বুল হয়ে দু’দিকেই মাথা নাড়ি।

নীরেন্দ্রনাথ কলম ধরলেন; লিখলেন---‘বাংলাঃ- কী লিখবেন, কেন লিখবেন’।

ব্যস, আমরা হৈ হৈ করে উঠলাম। আধুনিক বাংলা লেখার চেষ্টায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অনেকের কাছেই বইটির স্থান বাইবেলের পরেই।

খবর ছড়িয়ে পড়ল। উনি নেই। কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। বয়স, স্ত্রীবিয়োগ—আর যেন টানতে পারছিলেন না।

তবু সকালবেলা বাঙ্গুর এভিনিউয়ের বি-ব্লকে আমার কাকিমার একতলার বারান্দায় মোড়া পেতে বসলে মনে হয় একটু পরেই দেখতে পাব দীর্ঘদেহী ছিপছিপে পাকাচুলের এক ভদ্রলোককে, ধুতি-পাঞ্জাবী পরে বাজারের থলি হাতে হেঁটে যাচ্ছেন — আদ্যন্ত সুভদ্র নম্রকণ্ঠ এক সংবেদনশীল বাঙালী কবি।

0 comments: