গল্প - সনাতন সিংহ
Posted in গল্প
গল্প
অনভিপ্রেত
সনাতন সিংহ
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। গাছের পাতারা ফাল্গুনের পড়ন্ত বিকালে একটু একটু করে শরীর ধুয়ে নিচ্ছে অকাল বৃষ্টিতে।
ধুলো বালি ভরা রাস্তা, বৃষ্টির জলে প্যাচ প্যাচ করছে। হুস হাস করে দু একটা ছোটো ছোটো গাড়ি ছুটছে এদিক ওদিক। লোকজন কম। তরতর করে বাতাস বইছে। ফাল্গুনের মাঝামাঝি। পড়ন্ত সূর্যের আলো একটু আধটু নেমে এসেছে উত্তাপহীন লাবণ্যে বড় বড় বাড়ির গায়ে, কোথাও বা গাছদের গায়ে। রাস্তার সারি সারি পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু তারই ছটায় চিক চিক করছে আর মাথা দোলাচ্ছে ধীরে ধীরে।
রক্তিম অপেক্ষা করছিল বের হবে বলে। বৃষ্টি-বাতাস থামতেই সন্ধ্যার মুখে সাইকেল নিয়ে নামল রাস্তায়। একটু এগিয়ে এসে চমকে ওঠে। পথে পলাশের নরম দেহগুলো গাড়ির চাকায়, পায়ের চাপে প্রায় মিশে গেছে। প্যাচ প্যাচে পিচের উপর দলা পাকিয়ে অনেক দূর দূর তার সাক্ষী বহন করে নিয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়েছে হিংসার লীলাখেলায়।
ঝরা পলাশের এমন অবস্থা আর কাউকে এমন করেছে কিনা তা তার জানা নেই। কিন্তু তাকে ভেতরে ভেতরে বেশ কষ্ট দিতে লাগলো।
এই অকাল বৃষ্টি-হাওয়ায় কেমন বিষণ্ণতা চেপে ধরেছে তাকে।
একটু গিয়ে বাঁ দিকে ঘুরলো সে।
অনিতাদের পাড়ার দিকেই যাচ্ছিল। পাড়ায় ছোটো বড় বাড়িগুলোর উল্টো দিকের রাস্তার পাশেই অনিতাদের পাড়া। বস্তি পাড়া বললেও চলে। ওদের পাড়ার মুখটায় বেশ কয়েকজনের জটলা। দেখে সাইকেলের গতি কমায় রক্তিম। পরিচিত ছাত্রটা তার দিকে দৌড়ে যায়।
--জানো দাদা, অনিতার মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরুচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। ওর বাবা-মা খুব কাঁদছে। কি হয়েছে কি জানি?
সাইকেল থেকে নেমে রক্তিম তার সঙ্গে হনহন করে অনিতাদের বাড়ি যায়। বাড়ির সামনে বেশ কয়েকজনের ভিড়। কেউ হা-হুতাশ করছে। কেউ বিচলিত হয়ে উঠেছে। কেউ কি করবে বা করা উচিৎ তাই নিয়ে কথা বলছে। তাকে দেখে সবাই পথ ছেড়ে দিল।
ঘরে ঢুকে দেখে অনিতার মাথাটা তার মাসির কোলে। পাশেই থাকে। কাঁদছে আর ডাকছে --অনিতা, মা কথা বল। চোখ খোল।
অনিতার মুখ থেকে সমানে ফেনা বেরিয়ে আসছে। কাঠের চৌকির উপর শোয়ানো। তাদের ঘিরে রয়েছে কয়েকজন। মাসি আঁচল দিয়ে মুখ মুছে মুছে দিচ্ছে বারবার।
রক্তিমকে দেখে অনিতার মা জোরে কেঁদে ওঠে --আমার কি সর্বনাশ হল গো। ওকে আমি কি করে বাঁচাবো! ওকে ছাড়া কি করে বাঁচবো আমরা?
খাটের কাছে এগিয়ে যায় রক্তিম। মাসির উদ্দেশ্যে বলে --কি ব্যাপার? কি খেয়েছে ওর? হয়েছেটা কি?
একের পর এক প্রশ্নে মহিলা উত্তর দেবে কি? শুধু কেঁদেই চলেছে। পাশ থেকে কে যেন চুপ করে না থাকতে পেরে জানাল --সাপে কেটেছে।
--কি সাপ? কখন কামড়েছে?
--কি সাপ জানিনা বাপু। ওর মা জানে। সেই বুধবার সন্ধ্যায়। দুদিন হয়ে গেল। মেয়েটাকে মেরেই ফেলল।
--ডাক্তার দেখায়নি?
--ওর বাবাই তো ওকে খালপাড়ের জগাইয়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। কে যেন ক্ষোভে ফেটে পড়ল।
--কামড়েছে সাপে, তা জগাই গুনীন কি করবে শুনি?
জগাই এ তল্লাটে বেশ নাম করা গুনীন। শুধু খালপাড়ের মানুষগুলো নয়। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত তিন টাইমে কি বিশ্বাসে আচ্ছা আচ্ছা বাবু-শিক্ষিত লোকেরাও হাজির হয়, কে জানে? নানান লোকের নানান সমস্যা। জল পড়া থেকে মাদুলি, আরো কত কি সব করে দেয় গুনীন। কলকাতার বুকে এ বিস্ময়লাভার চোরাস্রোত বইতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
……ওষুধ দিয়ে ছিল। খেলে ভালো হয়ে যাবে বলেছিল। দুদিন তো ভালো ছিল।
কাঁদতে কাঁদতো অনিতার মা এসব বলেছে আর কি একটা খুঁজছে টেবিলের উপর।
এতক্ষণ রক্তিম একবার এর কথা একবার ওর কথা শুনছিল।
একটু জল চাইল সে। অনিতাকে সোজা করে বসাতে বলল।
কিন্তু তার গায়ে কেউ হাত দিচ্ছে না। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। ওই মহিলাও তার কোল থেকে অনিতাকে তুলতে পারছে না। ওর বাবা এসব দেখেও কেমন হতভম্বর মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
অনিতার মা কাগজে মোড়া কি একটা এনে রক্তিমের হাতে দিল।
……এর মধ্যে শিকড় আছে। বেটে খাইয়েছি। ভালো ছিল।
রক্তিম অবাক হয়ে বলল
……এই শিকড় খেলে সাপে কামড়ানো ঠিক হয়ে যাবে? সেই বুধবার কামড়েছে। এখনো কেউ ফেলে রাখে। ওই গুনীন করলে হবে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
রক্তিম চৌকির উপর উঠে পড়ে। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে অনিতাকে টেনে ওর মাসির গায়ে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দেয়। নিঃশ্বাস যেন পড়ছে না। নাড়ি টিপে দেখে। ধিক ধিক করছে। ততক্ষণে জলের গ্লাসটা কে যেন হাত বাড়িয়ে দেয়। সে জল ছিটিয়ে দিল জোরে জোরে।
……অনিতা, অনিতা।
না কোনো সাড়া দিচ্ছে না। এত গুলো মানুষের বিষণ্ণ মুখও তার দিকে তাকিয়ে আছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। আবার জল ছিটিয়ে দেয়। থুতনিটা ধরে বারবার নাড়া দিচ্ছে
….…অনিতা, অনিতা, কথা বল! চোখ খোল।
……উঁ
……অনিতা, কথা বল! চোখ খোল।
……উই
ওর মাসি চেঁচিয়ে ওঠে
……ওই তো কথা বলছে। ওরে ট্যাক্সি নিয়ে আয় কেউ।
সঙ্গে সঙ্গে অনিতার বাবা কাছে চলে আসে।
……না না, এখন হাসপাতালে নয়, ওকে আর একবার জগাইয়ের কাছে নিয়ে যাব। রিকশা ডাক।
রক্তিম খেপে যায়। ওর বাবার কথায় মাথা ঠিক রাখতে পারল না।
……মেয়েটাকে মারবেন। আগে ওকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন। গুনীন পরে হবে।
অনিতার মাও তাই চায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অসহায় মার কথা কে কবে শুনেছে?
একমাত্র মেয়ে অনিতা। এইবার মেয়ে মাধ্যমিক দেবে।
ছেলেটা বছর সাতেকের। সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। দু স্বামী-স্ত্রী মিলে সবজির দোকান চালায়। কিন্তু নিয়তি আড়ালে থেকে তাদের বুঝি এমন দিন দেখবে কে জানতো।
……ওগো, রক্তিম যা বলছে তাই করো। হাসপাতালে নিয়ে যাও।
……নাড়ি ক্ষীণ হয়ে আসছে। বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। ফেনা বেরনো বন্ধ হচ্ছে না। হুঁশ নেই। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
অনিতার বাবা রক্তিমের এই কথায় কান দিল না। মরিয়া হয়ে উঠে মেয়েকে এখন পাঁজা কোলা করে তোলার চেষ্ঠা করছে। জগাই গুনীনের কাছে নিয়ে যাবেই। কারো কথায় কানে নিচ্ছে না।
রক্তিম এদের বাড়িতে নেহাত পড়াতে আসে। অনিতার সঙ্গে ওর মাসির ছেলে শ্যামল, আর পাশের বাড়ির পলা একসঙ্গে পড়ে তার কাছে। শুধুমাত্র সে এখানে পড়াতে আসে। অধিকার ফলাবে কিসে?
নইলে আজই অনিতার বাবার সঙ্গে তার কিছু একটা হয়ে যেত। না পারছে বাধা দিতে, না পারছে চোখের সামনে এমন ঘটতে দেখে নিজেকে প্রবোধ দিতে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে।
……মাসি, এরা মেয়েটাকে মেরে ফেলবে। তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিচ্ছে ও। এখনও তবু একটু আশা আছে।
বাড়িতে বাড়িতে শাঁখে ফুঁ পড়ছে। ঝম ঝম করে জাইয়ের শব্দ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে নিদারুণ আর্তনাদে। ভ্যানে করে অনিতাকে নিয়ে চলল ওর বাবা। ওর মাসির কোলে অনিতার মাথা। পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছে ওর বাবা। সঙ্গে মাসির ছেলে শ্যামল। সাইকেল নিয়ে তাদের পিছনে রক্তিম।
জগাই গুণীনের বাড়িতেও তখন লোকের ভিড়। ধুনর গন্ধ আর ধোঁয়ায় ঘর, উঠন ভরপুর। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে উঠোনের দিকে মুখ করে মাদুর পেতে বারান্দায় বসে আছে গুনীন জগাই। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। মাথার চুল মেয়েদের মত মাঝ পিঠে নেমে এসেছে। তাকে ঘিরে নানান বয়সের মানুষের ভিড়। কে কত সমস্যা নিয়ে এসেছে কে জানে?রোজই এমন হয়। আজ তার অন্যথা হয়নি। গুনীন জগাইয়ের সামনে লাল কাপড়ে কি একটা মোড়া। দুটো ঘটি বসানো। একটাতে ডগার আমপাতা ঘটের মত করে রাখা। জল তার বোঁটা ছুঁয়ে আছে। পাতার ওপরে কয়েকটা জবাফুল। জগাইয়ের কপালে চন্দনের লম্বা ফোঁটা। দুই ভ্রুর মিলনস্থল থেকে মাঝ বরাবর মাথার উপরের দিকে চুল স্পর্শ করেছে। গায়ে সাদা পাঞ্জাবির উপর একটা লাল কাপড় চাদরের মত জড়ানো। হাতে পুঁথির মালা ও লাল সুতো কয়েক প্যাঁচ দেওয়া। সঙ্গে পিতলের মোটা গোল বালা তাঁর কঠিন হাতে স্বমহিমায় বিরাজমান।
……বাবা, আমার মেয়েকে বাঁচান। সাড়া নেই। দুদিন ভালই ছিল। সন্ধ্যের আগে ঝিমিয়ে পড়ে। মুখ থেকে গাঁজা বেরুচ্ছে।
অনিতার বাবা দৌড়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তাঁর সামনে। উৎকন্ঠায়, ভয়ে, অসহায়ের মত এক নাগাড়ে এসব বলতে বলতে প্রায় তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে।
……কই নিয়ে আয় তাকে।
না না, গলার স্বরে কোনো গাম্ভীর্য নেই। নেই কোনো উদ্বিগ্নতা। অবিচল সিদ্ধান্তে সমাধানের উপকরণ নিয়ে যেন বসে আছেন অনন্তকাল থেকে। পৃথিবীর
কোনো কিছুই যেন তাকে টলাতে পারবে না।
গেটের বাইরে ভ্যানের উপর শোয়ানো অনিতা। সঙ্গের কেউ তাকে ছুঁতেও চাইছে না। এমনকি তার বাবাও না। রক্তিম আসতে চাইছিল না এদের এমন ঘটনার সাক্ষী থাকতে হবে বলে।
তার পরিচিত স্থানীয় এক পিসি
জোর করেই তাকে ঠেলে পাঠিয়েছে। সঙ্গে অনিতার মার করুন আকুতি তাকে যেন আসতে বাধ্য করল।
কিন্তু এতবড় মেয়ের গায়ে হাত দিতেও যেন কোথায় বাঁধছে। হোক না তাকে পড়ায়। তাই বলে তাকে কোলে করে নিয়ে যাওয়াটা বেশ বেমানান দেখায়। তার বয়সও খুব বেশি নয়। যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে এম এ পার্ট ওয়ানের ছাত্র। বুদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রক্তিম।
কেউ কিছুই করছে না দেখে অনিতার মাসিই নিরুপায় ভাবে রক্তিমকে অনুরোধ
করে।
……ওর বাবা পারবে না। তুই ওকে একটু কোলে করে নিয়ে যা না বাবা।
কোলে নিতে গিয়ে পেরে উঠছে না রক্তিম। অনিতার ভারে তার হাত নেমে আসছে।
শেষে কাঁধে করে নিয়ে চলল সে। অনিতার বুকের নরম স্পর্শ অনুভূত হচ্ছে তার পিঠে। অপ্রতিভ, লজ্জিত হলেও চৌকাঠ ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বারান্দার দিকে উঠোন দিয়ে। পা কোথায় পড়ছে তার খেয়াল নেই।
বিনুনি করা চুল লুটিয়ে পড়েছে অনিতার মাথা থেকে রক্তিমের হাঁটুর কাছ পর্যন্ত। মুখ থেকে লালা টপে টপে পড়ছে। ধুনর গন্ধে উঠোন ভরপুর।
ঘরের ভেতর থেকে শাঁখ-ঝাঁই-ঘন্টা মুখরিত হচ্ছে মুহুর্মুহু।
রক্তিম দূত পদসঞ্চারে এগিয়ে যাচ্ছে বারান্দার দিকে। সেই শাঁখ-ঝাঁই-ঘন্টার মুখরিত ধ্বনি যেন তাকেই স্বাগত জানাচ্ছে....
চাম্পেয়গৌরার্ধা শরীরীকায়ৈ কর্পুরগৌরার্ধ শরীরকায়
ধম্মিল্লকায়ৈ চ জটাধরায় নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়।
অনিতাকে শুইয়ে দিল গুণীনের সামনে। অচৈতন হয়ে পড়ে আছে মাদুরের উপর। অসাড়।
পরনের চুড়িদার আলুথালু। চোখের কাজল মুছে মুখটা কালো হয়ে উঠেছে।
……এই সরলা ধুনচিটা এদিকে নিয়ে আয়।
হুঙ্কার দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল গুনীন জগাই।
সরলা চমকে ওঠে। ঘরময় ধুনোর ধোঁয়ার ভেতর থেকে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে বছর ত্রিশেকের এক মহিলা বেরিয়ে আসছে। দেখে যেন মনে হচ্ছে কোনো সন্ন্যাসিনী তপস্যার স্থল থেকে এইমাত্র উঠে আসছে ধীর পদক্ষেপে। হাতে জলন্ত ধুনিচি। গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। হাত ঘোরানোর পাকে পাকে তা বারান্দা পরিব্যাপ্ত করে নিকষ সাদায় ভরিয়ে তুলছে।
ধুনিচতে কি একটা দিয়ে বলল
……তুলে বসা। ধর এটা, ওর নাকের কাছে।
নেতিয়ে পড়ছে অনিতা। বসাতে পারছে না করে।
আবার শুইয়ে দিল।
জগাই গুণীন দু হাতে চোখ টেনে টেনে দেখে শান্ত অথচ হতাশ সুরে বলে
……নারে ওকে নিয়ে যা। ঠাকুর বুঝি চায় না। আর আমারও কিছু করার নেই। যা, যা, নিয়ে যা!
অনিতার বাবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মাসি অনিতাকে পাঁজা করে কোলে তুলে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
বাড়িটা নিমেষে বিষণ্নতায় ভরে ওঠে। সবার চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
রক্তিম পাশেই ছিল। অনিতাকে মাসির কোল ছাড়িয়ে কাঁধে তুলে নেয়।
……শ্যামল ট্যাক্সি ডাক।
ট্যাক্সি আনার আগেই আরো কয়েকজন অনিতাদের পাশের বাড়ির থেকে কয়েকজন চলে এসছে। সকলে মিলে ট্যাক্সিতে তুলেই হাসপাতালের দিকে রওনা দিল।
রাত প্রায় সাড়ে আটটা। হাসপাতাল চত্বরে লোকজন ঘোরাফেরা করছে যে যার মত ব্যস্ত। ওদের ট্যাক্সি গিয়ে থামল ইমারজেন্সির সামনে। দেখেই একজন ট্রলি ঠেলে নিয়ে এল ওদের গাড়ির কাছে। ঠেলে নিয়ে গেল ভেতরে।
ডাক্তার চোখ টেনে দেখছে। নাড়ি দেখছে।
……কি হয়েছে ওর?
ওর বাবা যা শোনালো তা হল এই
….....গত বুধবার সাপে কামড়েছে অনিতাকে। ঠাকুর দিতো গিয়ে ছিল সন্ধ্যায়। ঠিক তখন। কি সাপ তা দেখতে পায়নি। তবে সেটা যে সাপ তা পরিষ্কার।
ডাক্তার দেখেই ফিমেল ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিল। গার্জেনকে ওপরে যেতে বলল।
……মাসি তুমি সঙ্গে যাও।
……না না বাবা তুইই যা। আমি মুখ্য মানুষ কি বলতে কি করবো?তুই যা।
অনিতার বাবা তার হাতটা ধরতে,
বাধ্য হয়ে রক্তিম অনিতার বাবার সঙ্গে উপরে গেল।
ফিমেল ওয়ার্ড। ষোলখানা বেড। এদিকে আটটা, ওদিকে আটটা। তাদের বাঁম দিকে শেষের বেডে অনিতাকে শোয়ানো আছে। দুটো ইনজেকশন দিয়েছে। ঝাট খেয়ে পড়ে আছে। কুঁকড়ে যাচ্ছে তার শরীরটা।
নার্স আর জুনিয়র ডাক্তারদের চেম্বার সেই ওয়ার্ডেই।
রক্তিম তার একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মুহূর্তে অন্য পেশেন্ট দেখার কোনো বিষয় নয়। রুটিন চেকআপ তাদের হয়ে গেছে। ঘরের আলোগুলোর দু একটা একটা জ্বলছে। একটা আলো আঁধারি পরিবেশে মিশে রয়েছে ঘরটায়। পেশেন্টদের কেই কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ জেগে তাকিয়ে রয়েছে অনিতার দিকে। একটা নার্স আর জুনিয়র ডাক্তার অনিতাকে নিয়ে রসালো কথা বলছে।
……যাও, যাও দেখে এস। কচিমাল। দেখলে তো জিভের রস গড়াবে।
নার্সটা এটুকু বলে যেন তৃপ্তি পেল না। মুচকি মুচকি হেসে তাদের ইশারা করে বলল
……এখন তো পোয়া বারো। জ্ঞান নেই। দেখে নিও কত সাইজ।
কথার সঙ্গে সঙ্গে তাদের গায়ে ঢলে পড়ল।
……বলছ, চল দেখি, একটু টেস্ট করে আসি।
……আজ রাতটা বেশ কাটবে বল।
হাসতে হাসতে দুজন স্টেথো গলায় ঝুলিয়ে অনিতার দিকে এগিয়ে গেল।
অনিতার বেডে ওর বাবাই পাশে বসে ছিল।
……ও আপনি কি ওর বাবা? উঠে যান।
বেড থেকে উঠে অনিতার বাবা তপু
কেঁদে কেঁদে ডাক্তারকে বলছে
……ওর কিছু হবে না তো ডাক্তার বাবু? ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা পারবো না।
সরে গিয়ে নিথর দেহটার একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে অনিতার বাবা।
……আগে তো দেখি। এই চোখ খোল। এইই ইইই চোখ খোল। জিভ বের কর।
……ওভাবে হবে না। আমি দেখছি।
স্টেথো ডান হাতে ধরে বাঁ হাতে চোখ টেনে টেনে দেখছে।
……চোখ খোল, চোখ খোল বলছি। জিভ দেখা।
এবার ডান হাতে স্টেথো ধরে অনিতার উন্নত সুডোল বুকের উপর চেপে চেপে নরম স্পর্শে কিশোরী শরীরের যৌন সুখ অনুভব করছে। বক্ষ বিভাজিকার লোলুপ পথ অনুসরণ করে হাতের আঙ্গুল ব্রায়ের ভেতরে বিচরণ করছে অনাবিল ভাবে। অনিতার অসাড় শরীর যেন কোথায় বাধা দিচ্ছে।
এসব দেখে রক্তিম আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।
……কি করছেন আপনারা। কি করছেনটা কি?
……জি-জিভ খুলছে না। তা-তাকাচ্ছেও না।
কেমন যেন অপরাধীর মত তারা সরে দাঁড়িয়ে রইল।
……ঐ ভাবে চাপলে কেউ সাড়া দেবে।
আমি দেখছি।
……আপনি কে? ফিমেল ওয়ার্ডে আপনি কি করছেন এখন?
……আমি ওকে পড়াই। সরুন আমি দেখছি। অনিতা, অনিতা, একটু জিভ বের করতো। জিভ বের কর। কি হল জিভ বের কর।
দুটো ইনজেকশন পেয়ে তার শরীর একটু একটু করে সাড়া দিচ্ছে। ট্যাক্সি করে আসার সময় অনিতাকে রক্তিম ঘুমিয়ে পড়তে দেয়নি। জ্ঞান হারালে আঙ্গুলে চিমটি কেটে জাগিয়ে রেখে ছিল তাকে। পথে অনিতার কানে শুধু রক্তিমের স্বরটাই প্রাণের জিয়ন কাঠি হয়ে তাকে জাগিয়ে রেখে ছিল। এখনও চোখ তার বুজে রয়েছে।
রক্তিমের সেই স্বর অনুসরণ করে অনিতা কোনোক্রমে একটু জিভ বের করল বটে।
ডাক্তাররা মুখে টর্চ মেরে বলছে
……আর একটু বের কর। আর একটু।
অনিতা তাদের কথায় আর বের করে না।
……ভালো করে না দেখলে কি ট্রিটমেন্ট করবো।
রক্তিম আবার মৃদু স্বরে বলছে
……অনিতা, অনিতা একটু বড় করে জিভ বের করতো। বড় করে।
রক্তিমের কথায় জিভ করছে দেখে
ডাক্তাররা চোখ টেপাটেপি করে চেম্বারে ফিরে গেল। অনিতার বাবা দূর দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে অপলকে তাকিয়ে ছিল। এসব কিছু দেখে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিল না।
……ওর শীত করছে মনে হয়। একটা কম্বল ওর গায়ে দিন। না থাকলে ওদের কাছ থেকে চেয়ে এনে ওর গায়ে দিন।
পাশের বেডের মহিলার কথা শুনে ওর বাবা চোখ মুছতে মুছতে চেম্বারের দিকে গেল। কম্বল চাইতে।
রক্তিম তার পিছু নিল
……দিদি, ওকে একটু খেয়াল রাখবেন তো, আমি আসছি।
অনিতার মাসি আছে নিচে। তার গায়ে চাদর দেখেছিল রক্তিম। লিফ্ট দিয়ে নিচে যেতে চাইল। কিন্তু থমকে গেল।
চেম্বার থেকে ডাক্তার আর নার্সদের কথা কানে আসছে।
……মনে হয় ওই মাস্টারের সঙ্গে ফষ্টি নস্টি আছে। সাপের কাপড় কিছু নয়।
……আমাদেরও তাই সন্দেহ হচ্ছে ওই মালটা বলতে জিভ বের করছে। আমরা বললে জিভ বের করছে না।
……ওই মাস্টারের বয়সও কম। হলেও হতে পারে।
……এসব তো এখন হামেশাই ঘটছে।
দেখো কিছু ঘটিয়ে রেখেছে কিনা?সাপে কাটলে কখন পগারপার হয়ে যেত!
কয়েক পা পিছিয়ে এল রক্তিম। দেখে
জুনিয়র ডাক্তারদের একজন কানে রিসিভার নিয়ে বলছে
……চন্দ্রিমা, উপরে আয়। বেশ ইন্টারেস্টিং একটা কেশ এসেছে। দেখে যা রে।
রক্তিম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ডাক্তার-নার্সদের নিয়ে অনেক কদর্য গল্প সে যে আগে শোনেনি তা নয়। কিন্তু নীচ, লোলুপ, হীন মানসিকতার নিদর্শন সে এই প্রথম দেখছে। নিজেকে সংবরণ করে নিল। কাছে গিয়ে শোনালো
……দেখুন, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। ওকে সাপে কামড়ে ছিল। বেশ, সেটার ট্রিটমেন্ট করুন।
যে নার্সটা বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলছিল। তার মুখ গেল লাল হয়ে। ঝাঁঝিয়ে উঠল
……বন্ডে সই করুন। কি হয় আমরা দেখে নেব।
……ওর বাবা আসুক। উনি সই করবেন।
সঙ্গে সঙ্গে অনিতার বাবা কোথা থেকে একটা কম্বল এনে অনিতার গায়ে ঢাকা দিচ্ছে।
একজন নার্স চেঁচিয়ে ডাকছেন
……আসুন, এদিকে। বন্ডে সই করুন
আর সই করে নিচে যান। ডাকলেই যেন পাই।
বন্ড সই করার কথা শুনে তপুর হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। বন্ড সইয়ের কথা লোকের মুখে শুনেছে কিন্তু নিজের মেয়ের জন্য এখন তা করতে হবে…………তা ভেবেই তাঁর হাতের শিরা অবশ হয়ে আসছে।
এ যেন যমের কাছে দস্তখত দেওয়া।
……বাবা, রক্তিম সইটা তুমিই করে দেয় না বাবা!
……না না আমি কেন? আপনি বাবা। এটা আপনাকে করতে হবে।
কাগজে হাত রেখে কলমখানা ধরতেই হাত সজোরে কাঁপতে শুরু করেছে। সে যেন মেয়ের কফিনে শেষ পেরেকটা পুততে চলেছে।
……মেয়ের জন্যে সব পারি এটা করতে পারবো না। এটা করতে পারবো না।
বলেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে সোজা নিচে নামতে শুরু করল।
অগত্যা রক্তিম বাধ্য হয়ে নিজের নামটা বন্ড পেপারে সই করে দিয়ে অনিতাকে দেখে নিচে নেমে গেল।
নিচে নেমে দেখে শ্যামল আর অনিতার মাসি তপুর মাথায় জল ঢালছে। অনিতার বাবার কাছ থেকে কিছুই তারা জানতে পারেনি। তারা বেশ উদ্বিগ্ন। পড়শিরা যারা এসে ছিল একে একে তাকে ঘিরে ধরে।
উৎকণ্ঠার মুখ গুলো দেখে রক্তিম তাদের কাছে এসে বলে
……আছে এক প্রকার। ডাক্তার বলেছে রাত না কাটলে কিছু বলা যাবে না।
……বিপদ হবে না তো?
.......এখন একটু একটু সাড়া দিচ্ছে। রাতে ওর কাছে কাউকে থাকতে দেবে না। যেকোনো সময় বাড়ির কাউকে ডাকতে পারে। তাই নিচে অপেক্ষা করতে হবে।
কে কে থাকবে ঠিক করে নিন। সবার থাকার প্রয়োজন নেই।
অনিতার মাসি বলে
…....আমি মেয়ে মানুষ। আমি রাতে থেকে কি করবো। শ্যামল তুই তোর ছোটো মেসোর সঙ্গে থাক। কিছু দরকার পড়লে ও মেয়ের শোকে ও কিছু করতে পারবে না।
……তবে একজন মেয়ে থাকলে ভালো হতো। বেশ। তাই হোক। চলি, কাল সময় পেলে আসবো। উঠি ।
রক্তিম উঠতেই তপু পড়িমরি করে তার কাছে আসে। তার হাত দুটো ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
……তুমি আমার ছেলের মত। তুমি না থাকলে ও এতক্ষণে মরেই যেত। আমার মাথা কাজ করছে না। তুমি থাকো না বাবা।
তপুর চোখের জল ফোঁটা ফোঁটা করে রক্তিমের হাতের উপর ঝরে পড়ছে।
অনিতার মাসি তার গালে চুমু খেয়ে
আবদার মেশানো কান্নায় অনুরোধ করছে
……থাক না বাবা। তুই থাকলে একটু বেশি ভরসা পাবো যে। দেখলি না নিজেই নিজের হাতেই মেয়েটাকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছিল।
রক্তিম মনে মনে ভাবছে তাকে যেন কোনো ফ্যাসাদে ফেলা হচ্ছে। সত্যিই যদি ঐ মেয়ে কারোর সঙ্গে কিছু ঘটিয়ে থাকে!নার্স ও ডাক্তারদের অনুমান যদি সত্যিই হয়।
না এ কি সমস্যায় সে জড়িয়ে যাচ্ছে। আর তার বাড়ির লোকজন যদি শুনে যে, কে না কে, তার জন্য হাসপাতালে রাত কাটাচ্ছে সে!তারা এটা ভালো চোখে নেবে না। না না রাতে থাকাটা ঠিক মানানসই হবে না।
……না, না। আপনারাই থাকুন। রাতে মনে হয় কিছু হবে না। তেমন দরকার হবে বলে তো দেখলাম না।
তপু হাত ছাড়েনি। কান্নার রোল তাঁর এখন যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
……তোমার বাড়ির কেউ হলে তুমি কি এইভাবে ফেলে যেতে পারতে? অন্তত ওর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে যাও না বাবা।
সত্যিই তো যদি তার বাড়ির কেউ হতো। অনিতার মায়ের করুণ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেই অসহায় করুণ ভয়ার্ত মুখটা তাকে যেন বিহ্বল করে তুলছে। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত অন্যরাও চেপে ধরে, সে যেন থেকে যায়। সে আর না করতে পারল না।
একটু শীত শীত মনে হচ্ছে। রাত তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই। যারা এসেছিল সবাই চলে গেছে। হাসপাতাল চত্বরে এখন দু একটা কুকুর এপার ওপার ঘুরছে। যারা দূর থেকে এসেছে, যাদের পেশেন্ট আছে, তারা কেউ কেউ মশারি টাঙিয়ে শুয়েছে। কেউ কেউ মশার অত্যাচারে শুয়ে বসে উসপাশ করছে, ডিমের ট্রে ধরিয়ে মশা তাড়াচ্ছে ।
রক্তিমের সঙ্গে আছে শ্যামল, আর অনিতার বাবা। রাস্তায় গাড়ি নেই বললে চলে। আমের মুকুলের গন্ধ রাতের শরীরে মিশে দূর দূর ছড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ একটা এম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে বাজিয়ে ইমারজেন্সির সামনে পেশেন্ট নামিয়ে দিয়ে হুুঁঁস করে চলে গেল। অনিতার বাবা থামের গায়ে হেলান দিয়ে শূন্য পানে অপলকে তাকিয়ে আছে। চোখের জল নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কোলের উপর। দেখলে যেকোনো কারোর কষ্ট হবেই।
এদিকে পেট চোঁ চোঁ করছে। খাবার ইচ্ছা না থাকলেও রক্তিম আর সহ্য করতে পারছে না। এমন অবস্থায় খাবার দিয়েও যাবেই বা কে?শ্যমলকে ডেকে নিয়ে চলল খাবারের সন্ধানে। রুটি তড়কা কিনে এনে অনিতার বাবাকে এক প্রকারে জোর করেও খাওয়াতে পারল না। নিজেরা খেল।
রাত কাটছে না। ফাল্গুনের কুয়াশা ঢেকে দিচ্ছে কলকাতার অলিগলি। আবছা আলোয় কুয়াশার সাদা তরলের মত হয়ে হালকা বাতাসে সরে সরে যাচ্ছে। টুপটাপ করে শিশিরের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। মাঝে মাঝে নেড়ি কুত্তাদের কামড়াকামড়ির আওয়াজ ভেসে আসছে এপার ওপর থেকে।
হাসপাতাল চত্বর ঘুরে ঘুরে রক্তিম ও শ্যামলের পা টনটন করছে।
সিকিউরিটির কাছ থেকে পেপার চেয়ে নিয়ে এল। একটা ফাঁকা জায়গায় খুঁজে সিঁড়ির একটু দূরে পেপার পেতে দুজন প্রথমে বসে ছিল। তাও কেমন অসহনীয় হয়ে উঠল। এবার চিৎ হয়ে শুয়ে কপালের উপর হাত রেখে একটু চোখ বন্ধ করল রক্তিম। অনিতার বাবা ওর মাসির চাদর গায়ে দিয়ে একটু দূরে থামের গায়ে হেলান দিয়ে ঝিম মেরে আছে।
কিন্তু ঘুম আসছে না রক্তিমের। শ্যামল ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাক্তার-নার্সদের কথা গুলো এখন মাথায় তোলপাড় করছে। চিন্তা কিন্তু মাথা থেকে সরছে না। অনিতাও যে ভালো আছে, তা নয়। তাছাড়া জুনিয়র ডাক্তারদের সেই নোংরামি, অনিতার অচৈতন্য ভাব, নার্সের অশ্লীল ইঙ্গিত শিরায় শিরায় তীব্র যন্ত্রনায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এই বুঝি রগ ফেটে বেরিয়ে আসবে। মেয়েটার প্ৰতি কেমন মায়া হতে লাগলো তার।
রাত প্রায় শেষের প্রহর গুণছে। হাসপাতালের পাকা রাস্তা শিশিরে ভিজে গেছে। শুকনো পাতা নরম হয়ে শরীরের কাঠিন্য হারিয়েছে। দু'একটা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।
সিকিউরিটি এসে ডাকছে
……দুশো একের তিন নম্বর পেশেন্ট পার্টি কেউ আছে। ওয়ার্ডে চলে যান।
রক্তিমের কানে কথাগুলো এসে লাগছিল। কখন চোখ বুজে গিয়েছিল সে টের পায়নি। মেঝের ঠাণ্ডায় পিঠটা কেমন শির শির করছে। কুয়াশা মেশা ঠাণ্ডা বাতাস নাকে ঢুকে নাকটা সাঁ সাঁ করেছে এখন। চোখটা জ্বলছে, তাকাতে পারছে না। জোর করে তাকিয়ে দেখে অনিতার বাবা মরিয়া হয়ে তাদের টপকে পড়িমরি করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে দৌড়ে গেল।
শ্যামলকে ঠেলা দিচ্ছে সে। কিন্তু শ্যামল উঠতেই চাইছে না। এপাশ ওপাশ করছে।
……এই তোর মেসো উপরে গেছে। অনিতাকে দেখতে যা তো একবার। কি হচ্ছে গিয়ে দেখ তো!
সে ঘুমের ঘোরে বলছে
……কে-কে-কেন? কিছু হল নাকি?
……যা না, দেখ কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
সকাল পৌঁনে ছ'টা বাজে। ডাক্তার দেখানোর জন্য জনা চারেক লোক লাইনে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কয়েকজন মশারির ভেতর উঠে বসে আছে।
এদিকে কেউ ফিরছে না দেখে রক্তিম সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা ফেলে পা নামিয়ে নিল। একে ফিমেল ওয়ার্ড, তারপর ওদের সেই নোংরা ইঙ্গিত তার পা নামিয়ে নিতে বাধ্য করল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
……না, না, আর অপেক্ষা নয়।
দৌড়ে ওয়ার্ডে ঢুকে গেল। দেখে, অনিতার বাবা মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদছে। অনিতার গায়ের কম্বল নেই। শরীরটা টানটান হয়ে আছে। নিথর। মুখটা ফ্যাকাশে। চোখ দুটো অর্ধনির্মিলিত। সেই চোখে অসহায় করুন বেদনার আর্তিতে কিছু যেন একটা বলতে চাইছে।
পাশে দাঁড়ানো নার্স একটা কাগজ নিয়ে তার বাবার হাতে দিল। সেটা হাতে ধরে অনিতার বাবা বুকফাটা কান্নায় চিল চিৎকার করছে। মুঠো মুঠো করে মাথার চুল ছিঁড়ছে।
কান্নার আওয়াজ ঘরের দেওয়ালের এখানে ওখানে ধাক্কা খেয়ে ভারী হয়ে ফিরছে। শ্যামল দেওয়াল ধরে সমানে কাঁদছে আর চোখ মুছছে।
অনিতার বিবর্ণ মুখটা দুহাতের তালুর মধ্যে ধরে অঝর ধারায় কাঁদছে তপু। তাঁর চোখের জল টপটপ করে পড়ছে মেয়ের মুখে। দেখে যেন মনে হচ্ছে অনিতাও কাঁদছে অঝর ধারায়। বাবার দুঃখ সে যেন সহ্য করতে পারছে না। সেও যেন বাবাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। বাবা-মেয়ের এমন বেদনাঘন বিচ্ছেদ এই হাসপাতালে আর কেউ কোনোদিন দেখেছে কিনা তা কেউ জানে না। কিন্তু এমন দৃশ্য দেখে পাশের বেডের দিদিটাও মুখে কাপড় চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
সকালে ঘরটা বেদনার ভারে থমথম করছে। কান্নার রোল ডুকরে ডুকরে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরের কণায় কণায়।
ট্রলিটা ক্যাঁচ কোঁচ করতে করতে ঘরে ঢুকছে।
তার পিছনে দুজন।
……মর্গের পাঠাতে হবে। সরুন সরুন।
রক্তিমের চোখটা করকর করছে। কাউকে কিছু না বলে দৌড়ে নিচে নেমে এল।
গলা ভারী হয়ে আসছে তার। অনিতার অর্ধনির্মিলিত ফ্যাকাশে মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। বুকটায় চাপা বেদনা চেপে বসছে। এতদিন মেয়েটাকে সে পড়িয়েছে। আজ থেকে আর সে তার কাছে পড়বে না……মেনে নিতে পারছে না। কিছু একটা নেই নেই মনে হতে লাগল। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। জোর করে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে,
ফাল্গুনের সকালটা এখন আরো আরো ঘন সাদা চাদর গায়ে দিয়ে ঘিরে ধরেছে হাসপাতালটাকে।
জমাট বাঁধা শিশিরের ফোঁটাগুলো গাছের পাতা থেকে এখনও ঝরে পড়ছে। তার টুপ টাপ শব্দে অনুরণিত হচ্ছে……
অবিদ্যায়াং বহুধা বর্তমানা
বয়ং কৃতার্থা ইত্যভিমন্যন্তি বালাঃ।
0 comments: