0

প্রবন্ধ - ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in


প্রবন্ধ


গীতারহস্যামৃতম 
ধ্রূবজ্যোতি চক্রবর্তী 


(১০) 
এরই মাঝে একবার অর্জুনকে Veiled threat-ও দিয়েছেন (মোক্ষ যোগ – ৫৮নং শ্লোক)- 

“মচিত্তঃ সর্বদুর্গাণি মৎপ্রাসাদাত্তরিষ্যসি। 
অথ চেত্ত্বমহংকারান্ন শ্রোষ্যসি বিনংক্ষসি।।“ 

(মৎ চিত্ত হলে সর্ব-দুর্গতি আমার প্রসাদে তরে যাবে। আর যদি তুমি অহংকার বশে 

((আমার উপদেশ)) না শোন, তবে বিনষ্ট হবে) 

এরপর শ্রীকৃষ্ণ মোক্ষযোগে ৬৬টা শ্লোক অর্জুনকে শুনিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এবার বলা শুরু করলেন ৬৭নং শ্লোক থেকে। 

“ইদং তে নাতপস্কায় নাভক্তায় কদাচন। 
ন চাশুশ্রুষবে বাচ্যং ন চ মাং যোভ্যসুয়তি।। 

(এসব কথা তোমার কদাচ তপস্যাহীনকে অ-ভক্তকে বক্তব্য নয়, 
যারা শুনতে চায় না তাদেরকেও নয়, যে আমাকে অসূয়া করে তাকেও নয়।) 

এটা পড়ে মনে হয় শ্রীকৃষ্ণের মনে একটা ইনসিকিউরিটি বোধহয় কাজ করত। তাই অর্জুনকে দিয়ে এই প্রমিসটা তিনি করিয়ে নিয়েছিলেন যাতে তাঁর সমালোচকরা তাঁকে ক্রিটিসাইজ করার সুযোগ না পায়। এই সেন্স অফ ইনসিকিউরিটি আজকের দিনের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও দৃশ্যমান বলে আমার মনে হয়। তাই আমরা দেখতে পাই যে বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করে অথবা কার্টুন ছবি এঁকে সাধারন মানুষকে জেলে যেতে হচ্ছে! 

এছাড়া সুচতুর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দিয়ে আরও একটা রি-কনফার্মেসন নিয়ে নিতে ভোলেন নি পাছে অর্জুন আবার মত চেঞ্জ করে বসেন। দেখা যাক সেই শ্লোকটাতে শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছেন (মোক্ষযোগ – ৭২ নং শ্লোক)- 

“কচ্চিদেতং শ্রুতং পার্থ ত্বয়ৈকাগ্রেণ চেতসা। 
কচ্চিদজ্ঞানসন্মোহঃ প্রণষ্টস্তে ধনঞ্জয়।। 

(হে পার্থ, তোমার দ্বারা একাগ্রচিত্তে এইসকল শ্রুত হল কি? 
হে ধনঞ্জয়, তোমার অজ্ঞানজাত সন্মোহ প্রনষ্ট হল কি?) 

সবশেষে অর্জুন কনফার্ম করলেন (মোক্ষযোগে -৭৩নং শ্লোক)- 

“নষ্টো মোহঃ স্মৃতিলর্ব্ধা তৎপ্রসাদান্ময়াচ্যুত। 
স্থিতহস্মি গতসন্দেহ করিষ্যে বচনং তব।। 

(হে অচ্যুত, মোহ নষ্ট হল, তোমার প্রসাদে আমার ধর্মজ্ঞান লব্ধ হল; 
আমি প্রকৃতিস্থ গতসন্দেহ হয়েছি; তোমার বচন পালন করব।) 

এতক্ষণে কৃষ্ণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন এবং তারপর শুরু হল পৃথিবীর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। 

তা এই হল গিয়ে তার্কিকদের গীতা-বিশ্লেষন। 

এইভাবে যদি গীতাকে কেউ ব্যাখ্যা করতে চান তবে এক সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের কুটিল রাজনিতীর প্রকাশ বলে হয়ত মনে হতে পারে, তবে এটাই শেষ কথা নয়। 

তাই আগেই বলেছি এতকিছুর পরেও যা অবশিষ্ট থেকে যায় তা এক কথায় অনবদ্য। 

এবার সেই আলোচনাটা শুরু করা যাক। 

আঠারো অধ্যায় সমৃদ্ধ গীতা পাঠের পর ম্যাঙ্গোপিপলদের প্রতিনিধি পটলবাবু হঠাৎ যদি প্রশ্ন করে বসেন,”সবই তো বুঝলাম জ্ঞানের হ্যানে-ত্যানে, কিন্তু গুরু বুঝাও দেখি মোরে, হেই, সব ছেড়ে মুই গীতা পড়ব ক্যানে?” 

(১১) 
সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, আমার মতন পটলবাবুদের পক্ষে সঠিক গুরুবিহীন অবস্থায় গীতা পাঠে অতীব হতবুদ্ধিহীন দশা প্রাপ্ত হতে পারে। গুরু বলতে এখানে আমি গীতা মহাগ্রন্থে প্রদর্শিত পথের সঠিক ঠিকানা যিনি বলতে পারবেন, সেইসব পথপ্রদর্শকদের বোঝাতে চাইছি। শ্রীকৃষ্ণের বহু উপদেশ মেনে নিয়ে সংসার ধর্মপালন করা একপ্রকার অসম্ভব বলেই মনে হবে। তাই সর্বাগ্রে চাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশগুলির বর্তমান কালের পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক ব্যাখ্যা। 

বর্তমান সময়োপযোগী গীতা নির্দিষ্ট পথের যিনি সন্ধান দিতে পারবেন, তিনিই আসল গুরু। তেনাকে যে গেরুয়াধারি দাড়িগোঁফ যুক্ত বয়স্ক ব্যক্তি হতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বর্তমানকালে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি থ্রী-পিস স্যুট-টাই বা বারমুডা পরিহিত কোনো জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত ব্যক্তি অথবা পশ্চিমী পোশাক পরিহিতা কোন ঘোর সংসারী ভদ্রমহিলা হলেও তাঁদের আত্মত্যাগী ও দশের জন্য নিয়োজিত প্রাণ হতেও বাধা নেই। 

যুগ-যুগান্ত ধরে দেখে আসা সেই একঘেয়ে ছাঁচে গড়া গেরুয়াধারি গুরু সকল আজকের দিনে ম্যাঙ্গোম্যান পটলবাবুদের জন্য আর একান্ত ভাবে মোক্ষ লাভের পথ নির্দেশক নন। 

যাইহোক এই প্রসঙ্গে আবার পটলবাবুদের মনে উঁকি মারা প্রশ্নটাতে ফিরে আশা যাক - মহাগ্রন্থ গীতায় যে শিক্ষা আছে তার উদ্দেশ্য কি? 

শ্রীমদ্ ভগবদ্গীতা’র অনুবাদক রাজশেখর বসু ভূমিকায় বলেছেন যে গীতার উদ্দেশ্য অতি অবশ্যই দুঃখের হাত থেকে মুক্তি অথবা মোক্ষ অর্থাৎ ব্রহ্ম-নির্বাণ। তিনি আবার একই সঙ্গে বলেছেন যে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে হতাশাগ্রস্ত অর্জুনকে যুদ্ধে উদবুদ্ধ করার জন্য কৃষ্ণ যে সকল উপদেশ দিয়েছেন তা একান্ত ভাবে মোক্ষ লাভের উপায় বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। 

মোক্ষ হয়ত চরম লক্ষ্য, তবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে যে পথের সন্ধান গীতায় পাওয়া যায় তা একথায় অমূল্য। এই পথ পরিক্রমায় প্রত্যেকটি মাইল ফলকেই আত্মোন্নতির (জীবনদর্শণ, মানসিক এবং শারীরিক) যে উপলব্ধি প্রাপ্ত হয় তা এককথায় অনবদ্য। 

তবে শ্রীকৃষ্ণের যে শ্লোকটি সবচেয়ে বেশি আমজনতাকে কনফিউজ করে সেটা হচ্ছে, কর্ম করে যাও কিন্তু ফলের আশা কোর না। অনাসক্ত হয়ে কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করাই গীতার মূল বক্তব্য। 

রাজশেখর বসু এই প্রসঙ্গে বলছেন যে নিস্কাম কর্মের অর্থ লক্ষ্যহীন কর্ম নয়। মানুষ সজ্ঞানে কোনও কর্ম বিনা উদ্দেশ্যে করতে পারে না। 

তিনি বলছেন যে অনাসক্ত নিস্কাম কর্মের অর্থ – ব্যক্তিগত স্বার্থহীন। বহুজনের মঙ্গল ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়। নিজেকে সুস্থ্য রাখাও নিস্কাম কর্ম, কারণ, প্রত্যেকের স্বাস্থ্য নিয়েই বহুজনের স্বাস্থ্য এবং এতেই দশের ও দেশের উন্নতি। 

এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে স্বামী বিবেকানন্দের সেই বিখ্যাত উক্তিটি (স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে ভেবে ওনার উক্তিটি নিজের মত করে ভেঙে লিখছি) যখন তিনি বলেছিলেন যে তরুণ প্রজন্ম গীতা না পড়ে ফুটবল খেললেই দেশের উন্নতি সম্ভব। 

কলকাতার ও তার পার্শবর্তি এলাকার ইয়ং বেঙ্গলের দল সেই সময়ে খ্রীষ্ট ধর্ম, ব্রাহ্ম ধর্ম আর হিন্দু ধর্মের চাপে দিশাহারা অবস্থা। ধর্ম-অধর্মের চাপ না নিয়ে বরং শরীর আর মনের উন্নতি কর্মেই সমাজ আর দেশের উন্নতি সম্ভব এটাই মনে হয় স্বামীজীর বক্তব্য ছিল। 

কাজেই কোন ব্যক্তি যদি দশের মঙ্গলহেতু কর্ম করেন এবং তাঁর ফলস্বরূপ নিজেও উপকৃত হন তবে তাও নিস্কাম কর্ম হিসেবে পরিগনিত হবে। 

(১২) 
কিন্তু পটলবাবুদের মুশকিল হল যে তাঁরা এত কিছু ভেবে সতর্ক হয়ে কর্ম করেন না। তাঁরা যদৃচ্ছা কর্ম করে যান। কিন্তু তাঁরাও উন্নততর অবস্থায় পৌঁছতে চান তাই তাঁদের গীতায় নির্দিষ্ট সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। পাছে নানারকম তত্ত্ব কথার আলোচনায় সাধারণ মানুষ যাতে রাস্তা হারিয়ে না ফেলেন তাই প্রয়োজন একজন সঠিক পথ প্রদর্শকের। 

যেমন ছিলেন অর্জুনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ। 

অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকার রাত্রে মহাকাশে অসংখ্য তারার ভিড়ে সঠিক পথের সন্ধান ধ্রূব তারার দ্বারাই সম্ভব। 

গীতার মতে জ্ঞানযোগী সন্ন্যাসীর চেয়ে কর্মযোগী শ্রেষ্ঠ (কর্মসন্ন্যাসাৎ কর্মযোগো বিশিষ্যতে – সন্ন্যাসযোগ – ২নং শ্লোক)। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কর্মযোগকে এগিয়ে রেখেছেন এবং অর্জুনকে সমস্ত অবসাদ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তাঁকে তাঁর ক্ষত্রিয় ধর্ম পালনের জন্য বারংবার যুদ্ধে নিয়োজিত হতে বলেছেন। 

এই কর্মযোগ ব্যাপারে মহাগ্রন্থ গীতায় শ্রীকৃষ্ণের একটা Catch22 উপদেশ আছে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, কর্মে কৌশল প্রয়োগই যোগ। মনেহয় মডার্ণ ম্যানেজমেন্ট গুরুর মত তিনি Hard Work আর Smart Work-এর প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। কাজের সাথে বুদ্ধির মিশ্রণ ছাড়া সিদ্ধিলাভ অসম্ভব। এই আলোচনায় যদি সাংখ্যযোগের ৪৮-৪৯-৫০তম শ্লোক তিনটির দিকে নজর দেওয়া যায় তবে বোধহয় বিষয়টার ওপর হয়ত একটু আলোকপাত করা যেতে পারে – 

“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্তা ধনঞ্জয়। 
সিদ্ধ্যাসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।। (৪৮তম) 

দূরেণ হ্যবরং কর্ম বুদ্ধিযোগাদ্ধনঞ্জয়। 
বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতব।।(৪৯তম)
 
বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে। 
তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।। (৫০তম) 

(৪৮তম - হে ধনঞ্জয়, যোগস্থ হয়ে আসক্তি ত্যাগ করে 
সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে সমান হয়ে সকল কর্ম কর; সমত্বকে যোগ বলে।) 

(৪৯তম – হে ধনঞ্জয়, বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা কর্ম নিতান্ত নিকৃষ্ট; 
বুদ্ধির শ্মরণ অন্বেষণ কর; ফলাকাঙ্খীরা কৃপণ।) 

(৫০তম – বুদ্ধিযুক্ত ব্যক্তি ইহলোকে সুকৃত-দুষ্কৃত উভয়ই পরিহার করে; 
অতএব যোগের জন্য উদযোগী হও; কর্মে কৌশলই যোগ।) 

গীতায় অনেক জায়গায় যোগ আর যোগী ব্যবহৃত হয়েছে। প্রয়োগ অনুসারে একেক জায়গার মানে এক এক প্রকার। উপরিউক্ত শ্লোকগুলোর কথাই ধরা যাক। একেক জায়গায় একেক অর্থ বোঝচ্ছে। এর রহস্য উদ্ঘাটন আমার মত পটলবাবুর পক্ষে এক কথায় অসম্ভব। 

আমি শুধু রাজশেখর বসু মহাশয়ের আক্ষরিক অনুবাদগুলোই আমার এই রচনাটিতে টুকে দিয়েছি। আর সেই সঙ্গে রামকৃষ্ণ মঠের স্বামী অপূর্বানন্দ কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বইটিতেও চোখ বুলিয়ে নিয়েছি। দুজনেই মাঝে মাঝে অনেক ব্যাখ্যা-টিকা ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করেছেন। যে কোন উৎসাহী পাঠক / পাঠিকা নিজজ্ঞানে তার শরণ নিতে পারেন কারন 

এই রচনাকারের পক্ষে মহাগ্রন্থ গীতার সম্যক বিশ্লেষণ শুধু অসম্ভবই নয় বরং আয়ত্তের বাইরে। 


(১৩) 
শুধু সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি পটলবাবু হিসেবে গীতা মহাগ্রন্থ সম্পর্কে এই রচনাকারের দৃষ্টিভঙ্গিই বিবৃত হয়েছে মাত্র। এর না আছে কোন সাহিত্য মুল্য, এতে না আছে কোন দার্শণিক চিন্তার গভীরতা। 

যাইহোক, মূলপ্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। 

ব্যপকার্থে রাজশেখর বসুর মতে যোগ শব্দের অর্থ মোটামুটিভাবে নির্বিকার ভাবে একাগ্রচিত্তে নিষ্ঠা সহকারে নিষ্কাম লোকহিতে আত্মনিয়োগ এবং সেইসঙ্গে আত্মোন্নতির চেষ্টা। তিনিই যোগী যিনি এই প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছেন। 

বিভিন্ন মতভেদে গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কথিত শ্লোকগুলির বিভিন্ন অর্থ নিরূপিত হতে পারে এবং তারফলে পটলবাবুরা দিশেহারা বোধ করতে পারেন। শুধু তাই নয়, ধর্মব্যবসায়ীরা তেনাদের বিপথেও চালিত করতে পারেন। এইসব সুযোগ সন্ধানী ধর্মব্যবসায়ীদের জন্যেই আজ আমাদের সাধের পৃথিবী এত দূর্বিসহ হয়ে উঠছে। 

তাই মহাগ্রন্থ গীতার শ্লোকের সঠিক অর্থ নির্ধারণে সঠিক গুরুর প্রয়োজন। 

গীতার শিক্ষা কি? এক কথায় বলা তা অসম্ভব। নানামুনির নানামত। 

যদিও গীতার বহু শ্লোকে “স্থিতপ্রজ্ঞ, সুখে-দুঃখে সমভাবাপন্ন, নির্বিকার চিত্ত, সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে সমভাবাপন্ন, আসক্তিহীন, নির্লিপ্ত, শীতগ্রীষ্মে সমান সুখ-দুঃখদায়ক, দুঃখে অনুদবিঘ্নমনা আর সুখে বিগত স্পৃহা, স্থিতধী, লোষ্টপ্রস্তর-কাঞ্চনে সমদর্শী” ইত্যাদি বহু শব্দ, বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে, তবুও আমার মনে হয় গীতা মহাগ্রন্থের যেটা সবচেয়ে বড় শিক্ষা সেটা হল আমজনতার সংযমী জীবনধারণ করার দিকর্নিনয় এবং তার ফলস্বরূপ পূর্বে উল্লেখিত একটি সুস্থ্য, উদ্বেগহীন, সুখী উন্নততর মানবজীবন প্রাপ্তি। 

গীতায় কখনই নির্বিচারে সর্বতোভাবে ভোগ বর্জন করতে বলা নেই। সংসার ধর্ম পালন না করে সমাজত্যাগী কৃচ্ছ্রসাধক তপস্বী হবার কথাও বলা নেই। গীতায় যিনি শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ প্রুষ হিসেবে সন্মানিত হয়েছেন তিনি হচ্ছেন রাজর্ষি জনক –“কর্মেণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতাঃ জনকাদয়ঃ – জনকাদি কর্মদ্বারাই সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। কর্মযোগ – ২০তম শ্লোকের মুখরা। আর জনক রাজার সঙ্গে একমাত্র যিনি সমানে সমানে “রাজর্ষি” খেতাবটার জন্য লড়ে যেতে পারেন তিনি হচ্ছেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট রাজর্ষি উপন্যাসের নায়ক মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য - যিনিই একমাত্র বলতে পেরেছিলেন যে মুকট পড়া সহজ কিন্তু ত্যাগ করা কঠিন। 

এই দুই চরিত্রের একজন হচ্ছেন এক মহাকাব্যের নমস্য রাজপুরুষ আরে অপরজন হলেন গিয়ে এক বিখ্যাত উপন্যাসের চরিত্র। যেহেতু এই দুই চরিত্রই বর্তমানে আমজনতার ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তখন পটলবাবুদের অতীব সঙ্কটমোচনের জন্য গীতা মহাকাব্যের অভ্যাসযোগের বা ধ্যানযোগের ১৬তম এবং ১৭তম শ্লোক দুটির দিকে নজর দিতে পারেন – 

নাত্যশ্নতস্তু যোগোহস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ। 
ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জুন।। (১৬তম) 

(১৬তম - হে অর্জুন,অতিভোজীর এবং একান্ত অনাহারীরও সিদ্ধি হয় না; 
অতিনিদ্রাশীলেরও নয় , অতি জাগ্রতেরও নয়।)

0 comments: