ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
আহিরণ নদী সব জানে
রঞ্জন রায়
৫) 
ভরদুপুরে ছুরিগাঁয়ে সবার ভাতঘুম ছুটে গেল এক বিকট শোর-শরাবা আর হেঁড়ে গলার আওয়াজে। 
সবাই উৎকর্ণ, আওয়াজটা কিসের? কোত্থেকে আসছে? 
সপুরণ দেবাঙ্গন পান্তাখেয়ে জানলা দিয়ে আসা রিমির ঝিমির বৃষ্টির ছাঁট আর জোলো হাওয়ায় কাঁথা গায়ে টেনে শুয়েছিল।  বৌয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে চোখ লেগে গেছল।  ধড়মড়িয়ে উঠে বৌকে হাঁক পাড়ল।  কাহে কি চিঁ-পোঁ? 
আওয়াজ এগিয়ে আসছে রহসবেড়া পাড়ার দিক থেকে, ক্রমশঃ মন্দিরের কাছ দিয়ে এসে বাঁয়ে ঘুরে গেল। 
কানহাইয়া অগরওয়াল আটা পেষার চাক্কি বন্ধ করে ক্যাশ মেলাচ্ছিল।  চটপট তিজোরিতে চাবি লাগিয়ে বারান্দায় এল।  আওয়াজ চলে গেছে লাইনপাড়ার দিকে। 
ধীরহে মাস্টারজি স্কুল সেরে বাড়ি এসে হাত-পা ধুয়ে সবে খেতে বসেছেন এমন সময় সেই আওয়াজ।  মেয়েকে বললেন –দেখ না ও সুরভি, ই কা তামাশা হ্যাঁয়? 
লাইনপাড়ায় গায়ে গায়ে বাড়ি।  সবার খাপরার ছাত, মাটির দেয়াল ও উঁচু বারান্দা, জঙ্গলের চুরির কাঠ দিয়ে তৈরি থাম, কড়িবরগা,দরজা।  দরজা ও চৌকাঠে গাঁয়ের ছুতোরের হাতে তৈরি লতাপাতার নকশা।   কারো কারো বারান্দার দেয়ালে নীল-হলুদ রঙে আঁকা ফল খাচ্ছে টিয়ে পাখি বা কেওটের নৌকো করে নদী পেরোচ্ছেন রাম-সীতা।  দুই সারি বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে চিলতে পায়ে চলার গলি, ঢালু হয়ে নেমে গেছে আহিরণ নদীর পাড়ে। 
গলির মধ্যে সেই বিকট হেঁড়ে গলার আওয়াজ ও তার সঙ্গে গাড়াবাজার আওয়াজ  দু’পাশের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠছে। 
লজঝরে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বাঁধা অ্যামপ্লিফায়ার,  হাতে চোঙা, পঞ্চায়েতের চৌকিদার বনরাজ সিং ঠাকুর ঘোষণা করছে—‘সুনো  সুনো! সারে গাঁওয়ালে সুনো’। 
পেছন পেছন আসা গাঁড়াপাড়ার মহেশ আর শীতল দুটো নাগাড়া, সঙ্গে ইস্পাতের পাতলা তলোয়ারের লম্বা বাঁকানো ফলা, হাতে সাইকেলের টায়ারের টুকরোর মত কিছু দিয়ে পিটছেঃ ডুম ডুম ডুম, ডুমক-ডুম। 
‘ পরশো এতোয়ারকে দিন—ডুম ডুম ডুম—হমারে গাঁও মেঁ—ডুম ডুম- এক ব্যাংক খুলেগী—ডুমডুম ডুডুম ডুম।  ব্যাংক কা নাম –ডুম ডুম--গ্রামীণ ব্যাংক—ডুডুম ডুম। 
কলেশরাম গৌটিয়াকে মকান মেঁ—ডুম ডুম ডুম।   মন্ত্রীজি আহি—ডুডুম ডুডুম ডুডুম--রাজধানী দিল্লি লে—ডডম ডডম ডডম, সারে গাঁওয়ালে আও, মাইপিলা আও, ডম ডমা ডম,ডম ডমা ডম। গাঁওকে ইজ্জত কা সওয়াল। 
ডুম ডুম ডুম, ডুমক-ডুম।  ডুম ডুম ডুম, ডুমক-ডুম। 
এবার দুই গাঁড়া মহেশ আর শীতল তলোয়ার যুদ্ধের ভঙ্গিতে পাঁয়তারা কষে নাচছে। 
দুপাশে বারান্দায় সারি সারি মেয়েমদ্দর ভীড়। সবাই জানতে চায় হলো টা কী? 
গর্বিত মুখে বনরাজ সবাইকে দেখে। আজ ওর দিন; সহজে মুখ খুলবে না। পঞ্চায়েতের নগণ্য কর্মচারি বটে, কিন্তু আজ ওর দিন। সরকারি ঘোষণা করার বরাত পেয়েছে। ভাল হোক সরপঞ্চ সায়েবের।  উনি কুমারসায়েব, কিন্তু গরীব ভাইকে ভোলেন নি। রক্তের টান বলে কথা। 
যাহোক, সবাই অনুনয় বিনয় করলে ও ঢোঁক গিলল, কিন্তু কী বলবে? ও নিজেই ভাল বোঝেনি। ফলে ঢ্যাঁড়া পেটার সময় যা বলেছিল তাই একটু ঘুরিয়ে বলল—মন্ত্রীজি আওথে; গাঁও কে ইজ্জত কা সওয়াল। সব্বোজন আইহ, ইতোয়ার কে দিন, সুবহ দশ বাজে। 
কিন্তু জনগণের কৌতুহল বড়ো বিষম বস্তু।  মন্ত্রীজি আহি? সচ্চি মেঁ? হমন কে  ছুরি গাঁও মা ? কাবর ? হমন লা কা মিলি? 
আরে কৌন মন্ত্রী? ভূপালওয়ালে কি দিল্লিওয়ালে? ইঁহা আকে কা করহি? 
কা করহি? ব্যাংক খোল দেহি।   ও কা চীজ হোথে? 
মন্ত্রী সত্যি আসছেন? আমাদের এই গাঁয়ে,কেন বল দেখি? আমরা কী পাবো? আর কোত্থেকে আসছেন? ভোপাল নাকি দিল্লি? এই ব্যাংক কাকে বলে? 
বনরাজ সিং এর ওর মুখের দিকে তাকায়। তারপর ধীরহে গুরুজিকে দেখতে পেয়ে পাবলিককে বলে—মোর মুড়ি লা ঝন খাবে।  যাও, মাস্টারলা পুছিহ।  ওহ জরুর জানথে। 
আমার মাথা খেও না,মাস্টারকে শুধোও। ও নিশ্চয় জানে। 
মাস্টার বিরক্ত; কিন্তু বনরাজকে মানা করতে পারে না। কারণ, মাস্টারের ঘরের পেছনের আঙিনায় তৈরি হয় মহুয়ার মদ। লাইনপাড়ার ঘরে ঘরে এটা সাইড বিজনেস।  কিন্তু ধীরহে গুরুজির ঘরের জিনিস এখানে ব্র্যান্ডের সুখ্যাতি পেয়েছে।  একেবারে জল মেশানো নেই।  আঙুল ডুবিয়ে মাচিস মারলে প্রদীপ হয়ে জ্বলবে। বনরাজ শুধু ওর নিয়মিত গ্রাহক নয়, আবগারী বিভাগ থেকে যখন রেইড হয়, তখন বনরাজ খবর পেয়ে আগেভাগে গুরুজিকে সতর্ক করে দেয়।  তাই কিছু হিংসুটে মাস্টার গোপন শিকায়ত করেও গুরুজির একগুছি ‘বাল ভি বাঁকা নহী কর সকে’। 
আসলে উচ্চবর্ণের লোকেরা অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের লোকেদের বাড়বাড়ন্ত দেখতে পারে না।   তাই প্রমোশনের সময় এলে একমাস আগে ডি ই ও,অর্থাৎ জেলা শিক্ষা অধিকারীর অফিসে বেনামী কমপ্লেনের লাইন লেগে যায়।  অথচ, এরা অনেকেই সন্ধ্যের দিকে গুরুজির ঘরে এসে বোতল নিয়ে যায়; অবশ্যি কনসেশন দামে। 
বনরাজ ও উচ্চবর্ণের; তবে ও অন্যদের মত নয়। মনটা ভালো। সেবার গুরুজির বৌ ঘরের তৈরি মাল টেনে পুরো টল্লি হয়ে ঘরের মধ্যে আঃ আআজা অঙ্গভঙ্গি করে গাইতে থাকলে গুরুজি বনরাজকে খবর দেয়। ও একঘন্টার মধ্যে কাঠঘোরা মহকুমা হাসপাতাল থেকে ডাক্তার নিয়ে আসে। ডাক্তার অবস্থা দেখে বললেন—পেট থেকে পাম্প করে অ্যালকোহল বের করতে হবে; তোমরা পেশেন্টকে চেপে ধর। 
ডাক্তারের সঙ্গে আসা ড্রেসার বয় পাম্প বের করল। দুজন মিলে রোগিণীকে চেপে ধরল। কিন্তু ডাক্তার যেই পাম্প নিয়ে এগিয়েছেন মহিলা এক ঝটকায় তার রোগাপটকা স্বামী শুদ্দু সবাইকে মাটিতে ফেলে দিয়ে খাটে উঠে সবাইকে চ্যালেঞ্জ করতে লাগল আর গালাগালির তুবড়ি রোঘা- বেররা ছাড়িয়ে উচ্চমার্গে পৌঁছে গেল। 
তখন বনরাজ পেছন দিয়ে এসে জাপটে ধরে ওর হাতদুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল।  ডাক্তার ও তার সঙ্গী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। 
গুরুজি অকৃতজ্ঞ নয়। সাতদিন পরে বনরাজকে ডেকে এক বোতল ‘ফিরি’তে দিয়েছিল। 
এবার সবার চোখ ফিরল ধীরহে গুরুজির দিকে। 
উনি স্কুলে সামাজিক বিজ্ঞান পড়ান; তবে নীচু ক্লাসে। 
আমতা আমতা করে বললেন যে ব্যাংক খুব জরুরি জিনিস।  ওখানে টাকাপয়সা রাখলে চোরডাকাত কিছু করতে পারে না। কারণ গরমেন্টের গার্ড পাহারা দেয়। 
একটা সমবেত দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। 
গাঁয়ের ভাঁড় রসেলুর গলায় আক্ষেপ ফুটে উঠল- ই সব আমিরলোগ কে বাত।  হমার ঘর মা ফুটি কৌড়ি নহি তো কা ধরকে ব্যাংক যাবো? 
সবাই সায় দিল—হঁয় হঁয়; হ-হো, হ-হো! 
ধীরহে গুরুজি সামলানোর চেষ্টায় বললেন—আরে জরুরত কে সময় কর্জা পাবে গা। 
রহেলুর সখী শিবরাম ওরফে ঠিবু মুচকি হাসে।  গুরুজির ঝাঁসেবাজি কে পাত্তা দিও না। কেউ মিনি মাগনা কর্জা দেয় না,গাঁয়ের ধন্নাশেঠও না। সবাই জমানতদার নেয়, ঘরবাড়ি লিখিয়ে নেয়।  কোন বছর যদি ফসল মার যায় তো ব্যাংকের লোক এসে তোমাদের গরুবাছুর নিয়ে যাবে, ঘরবাড়ি কুর্কি কয়রে নেবে।  সরকারি ব্যাপার। পুলিশ আদালত সব সরকারের।  তোমরা ভেবে দেখ। 
জনতা বিপন্ন; জনতা মাথা চুলকোয়। 
গুরুজি ও বনরাজ একে অন্যকে দেখে। 
শেষে গুরুজি গলা তোলে- এই ঠিবু হচ্ছে দিল্লাগি -মাস্টার। সবকথায় বাগড়া দেওয়া ইয়ারকি মারা ওর স্বভাব।  ওর কথা বিশ্বাস না করে সেদিন চলে এস ব্যাংকের সভায়। সোজা মন্ত্রীজিকে জিগ্যেস করে নিও। 
কলেশরাম গৌটিয়ার বাড়িতে হইচই। যেন মেয়ের বিয়ে। 
সরপঞ্চ কুমারসায়েব থেকে শুরু করে সবার নাওয়া খাওয়া বন্ধ হবার উপক্রম।   এই এলাকার কোন গাঁয়ে কেউ আজ অব্দি কোন জলজ্যান্ত মন্ত্রী চোখে দেখে নি।  অন্ততঃ দিল্লিওলা মন্ত্রী।  রাজ্যের রাজধানী সেই ভোপালে ট্রেনে যেতে প্রায় আঠেরো ঘন্টা।  আর গরীবগুর্বোর দৌড় বিলাসপুর পর্য্যন্ত; খুব বেশি হলে রায়পুর যা ছত্তিশগড় অঞ্চলের রাজধানী। একমাত্র সরপঞ্চ কুমারসায়েব আর লাক্ষার ব্যাপারী দীনেশ অগ্রওয়াল জীবনে দু’বার ভোপাল গেছে, রায়পুর বিশবছরে বারপাঁচেক আর জেলাসদর বিলাসপুর মাসে-দুমাসে একবার। 
জেলা কলেক্টর খবর পাঠিয়েছেন যে উনি আসবেন; আসবেন জেলার পুলিশের সুপারিডেন্ট, ওদের প্রতিনিধি হয়ে কটঘোরা মহকুমা সদরের হাকিম বা সিটি ম্যাজিস্ট্রেট রোজ একবার করে ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন। 
যেন কোন খ্যানত না হয়।  যেন খাতিরদারি সুরক্ষা সব নিয়মমত হয়।  কলেক্টর মহকুমা হাকিমকে বলেছেন যে যদি কোন ভুলচুক হয় তো কলেক্টরের সি আর এ আঁচড় পড়বে।  তাহলে মহকুমা হাকিম ও বাদ যাবেন না।  ওঁর ট্রান্সফার হবে অম্বিকাপুরের অন্তর্গত সুরজপুরে, আদিবাসী বনাঞ্চল।  হাকিম তাঁর আমলাদের বললেন খ্যানত হলে উনি সবকটাকে হয় লেলুঙ্গা, ধরমজয়গড় নয় নাগলোক বলে কুখ্যাত তপকরাতে পাঠাবেন। 
তাই সরপঞ্চ ও অন্যান্য পঞ্চ এবং কাপড়চোপড় তথা হরেকরকম্বা ব্যবসায়ের সিন্ধি ও অগরওয়াল দোকানদারদের চৌপাল বসেছে কলেশরামের বাড়িতে।  ক’টা লোহার চেয়ার লাগবে কত দরি বা সতরঞ্চি বিছাতে হবে, মন্ত্রীজির সঙ্গে কয়জন পাত্র-মিত্র-অমাত্য আসবেন, নাস্তা-জলপান ইত্যাদির খরচ কে দেবে, ইতরজনের জন্যে মাটির খুরিতে চা- তার ব্যবস্থা কী হবে ? তারপর আছে রঙিন কাগজের মালা দিয়ে সজাবট ও ফুলদানি এবং পুষ্পহার দিয়ে স্বাগত করার প্রোগ্রাম।  স্কুলের দিদিমণিরা কিছু ছাত্রীদের নিয়ে ‘স্বাগতম, সুস্বাগতম’ গান গেয়ে অভ্যর্থনা করবে।   আর মাইক ও ফোটোগ্রাফার? কোরবা থেকে আনতে হবে। 
এমন সময় বিলাসপুর-কোরবা রুটের অশোক বাস সার্ভিসের নতুন চালু হওয়া বাস থেকে নামল একটি বছর পঁচিশের ছেলে।  সে বাসের খালাসিদের দিয়ে ছাদ থেকে নামাল একটা সদ্য রঙ করা সাইনবোর্ড, যাতে হলুদ রঙের পৃষ্ঠপটে নীল রঙ দিয়ে লেখা “ বিলাসপুর রায়পুর ক্ষেত্রীয় গ্রামীণ ব্যাংক”,মাঝখানে গরুর গাড়ির চাকা—বোধহয় ব্যাংকের লোগো।  তার নীচে ছোট্ট করে লেখা ‘ভারতীয় স্টেট ব্যাংক দ্বারা প্রায়োজিত’। 
ছাত থেকে নেমেছে ছোট বড়ো আরও কয়েকটি প্যাকেট।  আর পেছন পেছন পাজামা শার্ট পরা একটা ঢ্যাঙা মত লোক। 
ভাদ্রমাসের গরমে এরা ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত।  কিন্তু পাজামা-শার্ট লোকটি বেশ চালাকচতুর। সে কমবয়েসি ছেলেটিকে আশ্বস্ত করল—পরেশান মৎ হোইয়ে স্যারজি, সব ঠিক হো জায়েগা। ম্যায় হুঁ না! 
ছেলেটির চেহারায় টেনশন আগের মতই।  সে রসেলুর দোকানের বেঞ্চিতে বসে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল-- কড়িমিঠি চায়, দো’কাপ। 
রসেলু ধূর্ত চোখে এই নতুন চিড়িয়াকে জরিপ করে কথায় কথায় জেনে নিল যে এই ছোকরা নতুন ব্যাঙ্কের শাখা প্রবন্ধকজী আর মাত্র ছ’মাস হলো চাকরিতে জয়েন করেছে।  হেড আফিস ওকে এই শাখা ‘উদঘাটন’ এর জন্যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে।  আর পাজামা শার্ট হলো হেড অফিসের একজন চাপরাশি, যে অনেক অভিজ্ঞ এবং এইসব শাখার ‘উদ্ঘাটন’ সমারোহ ওর জন্যে বাঁয়ে হাত কা খেল। এর জন্যে সম্ভাবিত সব সমস্যা ও চুটকি মেঁ নিপটা সকতে হ্যাঁয়।  তাই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন,সব ব্যবস্থা আগাম দেখে নিতে। 
রসেলু ওদের চায়ের সঙ্গে দু’প্লেট গরম ভাজিয়া দিল।  ছেলেটি বিপন্ন চোখে তাকাল, এর অর্ডার তো দেয় নি! 
আরে খাইয়ে, খাইয়ে। রসেলু বরাভয় দেয়।  সেই সাতসকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। আর বিলাসপুর থেকে এখানে আসতে আসতে বাসের ঝাঁকুনিতে সেসব কখন হজম হয়ে গেছে। 
ওরা কৃতজ্ঞ চোখে তাকায়, খেতে শুরু করে। 
রসেলু জেনে নেয় হেড অফিসের চাপরাশি তো সেদিনের পর বিলাসপুর ফিরে যাবে। কিন্তু একজন স্থায়ী পিওন তো চাই ! সে তো স্থানীয় হলেই ভাল হয়। 
ছোকরাটি মাথা নেড়ে সায় দেয়।  বলে পার্মানেন্ট কোন পিওন এখন সম্ভব নয়। দৈনিক চারটাকা মজুরিতে লোক নেওয়া যেতে পারে,পদনাম—‘সুইপার কাম ওয়াটারম্যান’। 
কাজ? কাজ বলতে ব্যাংক ঝাঁট দিয়ে মুছে তকতকে কয়রে রাখা। কাছের হ্যান্ডপাম্প থেকে বালতি করে পানীয় ও কাজের জল নিয়ে আসা।  অফিসের সময় গ্রাহকদের ও ব্যাংক স্টাফকে ভাউচার, লেজার ইত্যাদি যুগিয়ে দেওয়া।  ম্যানেজার বললে নাস্তা-চায় নিয়ে আসা।  ব্যাংকের স্টেশনারি গুছিয়ে রাখা, রোজকার ভাউচার সংখ্যা মিলিয়ে সুতোয় গেঁথে তারিখের লেবেল লাগিয়ে সামলে রাখা।  ফিল্ড ভিজিটের সময় সঙ্গে তল্পিবাহক হিসেবে যাওয়া।  রোজ সাইকেলে করে দশকিলোমিটার দূরে ডাকঘর যাওয়া; গ্রাহকদের বাড়ি গিয়ে নোটিস সার্ভ করে আসা,--এককথায় জুতোসেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবই। ও হ্যাঁ, এই পিওনকে অন্ততঃ ক্লাস এইট পাস হতে হবে। 
বটেই তো, বটেই তো! রসেলু বুঝদারের মত মাথা নাড়ে। 
ব্যাংক হলো গে’ লিখাপড়ি জানা লোকের জায়গা। 
এবার ও সাইনবোর্ডটি মন দিয়ে দেখে। জানতে চায় অন্য প্যাকেটগুলিতে কী আছে। 
আছে লেজার, ক্যাশ রেজিস্টার, ক্যাশবুক ও পাসবুক।  মন্ত্রীজি সেদিন নিজের হাতে কিছু নতুন গ্রাহকদের পাসবুক দেবেন। 
আখবরওয়ালারা ফোটো খিঁচবে? পরের দিন পেপারে ছাপা হবে? 
নিশ্চয়ই। 
এবার রসেলু নববিবাহিত নারীর মত ব্রীড়াবনত  হয়ে নীচু গলায় বলে—আমার বচত খাতা  না কী বলে,সেটা খুলে দিন। আমি সকাল থেকে যত বিক্কিরি হয়েছে সেই রোকড়া গোটাটা দিয়ে গ্রাহক হতে চাই। 
নতুন শাখা প্রবন্ধকের চোখে বিদ্যুৎ খেলে যায়। 
সে বলে যে খাতা খোলা হবে কাল।  এখনও দুদিন সময় আছে। ও কথা দিচ্ছে যে এই ব্যাংকের প্রথম গ্রাহক হবে রসেলু।  আর মন্ত্রীজির হাত থেকে প্রথম পাসবুকটি ওই নেবে। ওর অ্যাকাউন্ট নম্বর হবে ১/১। 
হতভম্ব রসেলু জানতে চায় যে দুটো ১ কেন? আরে ছুরি গাঁয়ের সূচক সংখ্যা ১; ছোটকি ছুরি ২ এইরকম। তবে ওর খাতা নম্বর থাকবে সেই ১। 
শুধু একটা কথা, রসেলু কাল-পরশুর মধ্যে আরও পাঁচটা গ্রাহক নিয়ে  আসুক।  ওর আত্মীয়, ভাই বেরাদর, বন্ধুবান্ধব—যেই হোক। 
রসেলুর মুখে ছায়া ঘনায়। চেষ্টা করব, কিন্তু যদি না পারি? 
কথা বন্ধ; দুজন দুজনকে অপলক দেখে। ছোকরা হেসে ওঠে। 
কোঈ বাত নেহি। হমারী দোস্তি বনে রহেগী। পর আপ কোশিস তো করো। 
এবার ওরা ওঠে। ছেলেটি পকেটে হাত দিতে গেলে রসেলু হাত চেপে ধরে বলে আপনি গাঁয়ের মেহমান,আজ প্রথম দিন। আপনার থেকে চায়-নাস্তার পয়সা নিলে অধর্ম হবে। 
ছেলেটি কঠিন গলায় বলে – আমি বিনেপয়সায় খাবার খাইনে। 
রসেলু  হেসে ওঠে। ঠিক আছে।  পরে আমার খাতায় জমা করে দেবেন। 
ও আওয়াজ দেয়—একটি বছর ষোল’র ছেলে বেরিয়ে আসে।  ও আদেশ দেয় যে এইসব সাইনবোর্ড ও স্টেশনারি যেন কলেশরামের বাড়িতে নয়া ব্যাংকের কামরায় পৌঁছে দেওয়া হয়। 
ওরা রওনা দেয়। রসেলু পেছন পেছন দশ কদম চলতে চলতে বলে—এ আমার ছেলে ঠুল্লু; চালাকচতুর, পরিশ্রমী। একে আজকে কোন পয়সা দিতে হবে না।  আর ও মিডল স্কুল পাস,একটু দয়াদৃষ্টি রাখবেন।
 

 
 
 
 
 
 
 

 
  

0 comments: