0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


সংস্কৃতি, সভ্যতা ও হিংসা
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় 




আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছ’ দশক আগের কথা। আমাদের পুরনো বাড়িতে দুর্গা পুজোর সময় পাড়ায় ক’ঘর তাঁতি বাড়ি থেকে বরণের ‘শ্রী’ গড়ে দিত। তারা কিন্তু ঠাকুর দালানে উঠত না। পুরোহিতের মানা ছিল। আমার ঠাকুমা ছিল সেই পুজোর সর্বেসর্বা। পুজোর গোছগাছ থেকে শুরু করে ভোগ রান্না, সবই ঠাকুমা করত। সেই বছর অষ্টমীর দিন পুজো শুরু হবার আগে যখন তাঁতি বাড়ির মেজ বৌ ‘শ্রী’ গড়ে নিয়ে এসে ঠাকুমার হাতে দেয়, তখন ঠাকুমা তার হাত ধরে ঠাকুরের সামনে নিয়ে এসে বলে, “মেজ, আজ তুই বরণডালা সাজাবি”। ঠাকুরমশাই হাঁ হাঁ করে উঠতেই ঠাকুমা তাকে বলে, “আজ থেকে সবাই এখানেই এসে অঞ্জলি দেবে, এই আমার বিধান। এতে যদি তোমার অসুবিধে থাকে, তুমি যেতে পার।”

না, কুলপুরোহিত যায় নি। ঠাকুমার কথা মেনে নিয়েছিল। আর পাড়ায় মেজদি, মানে আমার ঠাকুমা, সে সময়ে হিরো। সেই থেকে পুজোয় আর কোন বর্ণভেদ থাকল না। আমার তখন দশও পেরোয় নি। ঠাকুমা বলেছিল, এসবের কোন মানে নেই; কোনও মানুষকে ছোট করলে নিজেকেই ছোট হয়ে যেতে হয়। ধর্ম যে সংস্কৃতি শেখায়, তা হল সবাই মিলেমিশে থাকতে। আর এই সংস্কৃতিই সভ্যতা। তখন এসব কিছু বুঝিনি। অনেক পরে শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যখন ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতার উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাস জানলাম, তখন অনুভব করলাম এত বৈজ্ঞানিক তথ্য পড়ে আমি যা শিখলাম, একজন ক্লাস সেভেন অবধি পড়া মহিলা ভরা যৌবনে বিধবা হয়ে অক্লান্ত জীবনযুদ্ধে যুঝতে যুঝতে ছ’টা ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে কত সহজে জীবন দিয়ে তা আয়ত্ত করেছে। ভাবতে অবাক হয়ে যেতে হয়, বিংশ শতাব্দীর মধ্যলগ্নে কলকাতা শহরের প্রান্তিক আধা গ্রাম্য পরিবেশে বাস করে ঠাকুমা কী করে এত অফুরন্ত শক্তি ও আত্মমর্যাদা অর্জন করে সমাজের মাথাদের অসামাজিক বিধানের বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তি দিয়ে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। আজ যখন ধর্ম ও সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে সভ্যতা এক সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন মনে হয় স্বার্থহীন শুভবুদ্ধি মানুষ সত্যিই এক বিপন্ন প্রজাতি। 

যাতে ধারণ করে, তাই ধর্ম। সে ব্রহ্মাণ্ডই হোক আর জড় বা প্রাণীই হোক, সবারই একটা ধর্ম রয়েছে। সব কিছু একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে দিয়ে চলেছে। সে অণু-পরমাণু বা ইলেকট্রন হোক অথবা আস্ত একটা মানুষ। একটা নির্দিষ্ট আবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে সব। এই আবর্তনটাই ধর্ম। উপযুক্ত পরিবেশে একটা ধর্ম থেকে বিবর্তিত হয়ে আর একটা ধর্মে গিয়ে যখন পড়ে, তখন হয় নতুনের সৃষ্টি। নতুন নবধর্মে উদ্ভাসিত। এভাবেই এগিয়ে চলেছে সব। বিবর্তনের হাত ধরে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর থেকে আমাদের সৌরজগৎ ও পৃথিবী। আবার বিবর্তনের হাত ধরেই নিউক্লীক অ্যাসিড থেকে অ্যামিবা বা এক কোষী প্রাণী থেকে মানুষ। প্রত্যেকটা প্রাণী তার নিজস্ব ধর্মের মধ্যে বেঁচে থাকে। এই ধর্মটা কি? উপযুক্ত পরিবেশ ও খাদ্য। এটা থাকলেই ওরা আছে, না থাকলে নেই। তবে এত সহজে থাকা যায় না। প্রতিটা মুহূর্তে জীবনযুদ্ধে লড়াই করে বাঁচতে হয় প্রতিটা প্রাণীকে। আর যারা না পারল, বিশেষ করে কোনও কারণে পরিবর্তিত পরিবেশে, তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পরিবর্তিত পরিবেশে কি করে বাঁচবে? নিজেকে বদলে ফেলে, স্বভাব ও খাদ্যাভাস পাল্টে। এর ফলে জিনে পরিবর্তন হয় আর প্রাণীটির বিবর্তন হয়ে নতুন প্রজাতি বা গণ জন্ম নেয়। তারপর নতুন ধর্মে নতুন প্রাণী লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। এই নতুন প্রাণীটির মধ্যে কিন্তু আগের প্রাণীর জিন রয়ে গেছে, যার ফলে তার অনেক গাঠনিক চরিত্র শরীরে বর্তমান। এভাবে দেখলে দেখা যাবে মানুষের মধ্যে রয়েছে সেই আদিম অ্যামিবার জিন এবং তার পরবর্তী সব প্রাণীর জিন। আশ্চর্যের বিষয়, মানুষের নিজস্ব জিন বা ডি এন এ-র আনুপাতিক হার খুবই কম। প্রায় সব কিছুই পূর্ববর্তী কোনও না কোনও প্রাণীর থেকে চলে এসেছে। 

দু-একটা ছোট উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যে মেরুদণ্ডের ওপর ভর দিয়ে আমরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, প্রাণীজগতে তার আবির্ভাব প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর আগে। আমরা মুখে খাবার দিয়ে চিবাই, তার জন্য আমরা চোয়াল ব্যবহার করি। কেবলমাত্র নিচের চোয়াল ওপর-নীচ ওঠানামা করে। প্রাথমিক চোয়ালের উদ্ভব হয় মাছে প্রায় বিয়াল্লিশ কোটি বছর আগে। কিন্তু এর পাঁচ কোটি বছর পরে যে মাছ বিবর্তন হয়ে এল, তার চোয়াল শক্ত এবং নিচের চোয়াল নাড়িয়ে খাবার খেত, দাঁতও ছিল কামড়াবার ও ছেঁড়বার জন্য। নিচের চোয়াল নাড়িয়ে খাওয়া ও দাঁত দিয়ে কামড় বা ছেঁড়ার পদ্ধতি পরবর্তী সব উন্নত মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে দেখা গেছে। মানুষের তো বটেই। জলে থাকার ফলে জল থেকে অক্সিজেন নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালানোর জন্যে মাছেদের কানকো তৈরি এবং খাদ্যের জন্যে জলে চলাচল করতে তাদের শক্ত মাংসপেশির পাখনার উদ্ভব। একসময় সমুদ্রের জলের মাত্রা নেমে গেলে মাছ সমেত অন্য তীরবর্তী জলজ প্রাণীদের খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সে সময় তাদের ডাঙায় পোকা খাবার জন্যে আসতে হত। তখন বাতাস থেকে অক্সিজেন নেবার জন্য তৈরি হোল ফুসফুস। একই প্রাণীর কানকো ও ফুসফুস নিয়ে উভচর প্রাণীর জন্ম হোল। এভাবে প্রয়োজনের তাগিদে পরিবর্তন ও সেই থেকে বিবর্তিত হতে হতে মানুষ তার পূর্বসূরীর অনেক কিছুই শরীরে বহন করছে। প্রাণী বিবর্তনের ইতিহাসে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা উন্নত মানের বলে ধরা হয়। মাতৃস্তন থেকে নির্গত দুধ সন্তান পান করে বলে স্তন্যপায়ী। এদের প্রজনন প্রক্রিয়ার বিবর্তন ঘটেছে সময়ের সাথে। তিন ধরনের প্রজনন দেখা যায়। প্রাথমিক কালে ডিম পেড়ে সন্তান আনার পর তাকে দুধ খাওয়াত। অস্ট্রেলিয়া, নিউ গিনিতে আজও এই গোষ্ঠীর শজারু ও প্ল্যাটিপাস বর্তমান। দ্বিতীয় পর্যায়ে সন্তান গর্ভে জন্মালেও খুব প্রাথমিক অবস্থায় প্রসব হয় এবং মায়ের পেটের নিচে একটা থলিতে বাড়তে থাকে। ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা এই গোষ্ঠীভুক্ত। সবশেষ ধাপে সন্তানের বৃদ্ধি মায়ের গর্ভে সম্পূর্ণ হলে প্রসব হয়। যেমন বেড়াল, গরু, মানুষ। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাইমেট এবং উন্নত প্রাইমেটের স্তনের অবস্থান পেটের নিচ থেকে সরে বুকে এসেছে বসা অবস্থায় সন্তানদের দুধ খাওয়ানোর সুবিধের জন্যে। 

ধর্ম প্রাণীকে বাঁচার জন্যে ধারণ করছে, সেই প্রাণী যখন তার পরবর্তী প্রজন্ম বা প্রজাতি বা বর্ণে তার ধর্ম চারিয়ে দেয়, তখন সেটা হয়ে যায় সংস্কৃতি। বাঁচার ধর্ম সমবেত কাজে পরিণত হলে সেটা সংস্কৃতি। ফলে প্রতিটা প্রাণীর যেমন ধর্ম আছে, তেমন প্রত্যেক প্রাণীগোষ্ঠীর আছে তার নিজস্ব সংস্কৃতি। খাদ্যের প্রয়োজনে অনেক প্রাণীকেই একসাথে থাকতে দেখা যায়, যেমন মাছের ঝাঁক। আবার শিশুদের রক্ষার জন্য উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে থাকে, যেমন হাতি। এটা সংস্কৃতি। বাঁচার প্রয়োজনে যার শুরু সেটা ক্রমে সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। প্রাইমেটদের ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকা উন্নত ধরনের। আবার খাদ্যের জন্য শিকার করাটাও সংস্কৃতি। মাটিতে হিংস্র প্রাণীদের থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য বানরদের বৃক্ষবাসী হওয়া আর গাছের ফল তখন তাদের খাবার হয়ে যাওয়া। সে সময়ে অনুকূল আবহাওয়ায় গাছের প্রাচুর্য ছিল। পরে আবহাওয়া পরিবর্তনে গাছের ঘনত্ব কমে যাওয়ায় প্রাইমেটদের পরবর্তী প্রজন্মরা মাটিতে নামে ও চতুষ্পদী থেকে বিবর্তিত হয়ে দ্বিপদী হয়। গাছে থাকা সুবিধেজনক ও নিরাপদ করার জন্য বানরদের অনেক শারীরিক পরিবর্তন হয়। যেমন, গাছের ডাল ধরে ঝোলার জন্য হাতের বুড়ো আঙুলের অবস্থান বদলে অন্য চারটে আঙুলের বিপরীতে এসে গ্রিপ তৈরিতে সুবিধে করে। লম্বা শুণ্ড ছোট হয়ে যায় ও নাকের দুপাশে থাকা চোখ সামনে চলে এসে স্টিরিও দৃষ্টি তৈরি হয়, যার ফলে সঠিক দূরত্ব ও উঁচু-নিচুর আন্দাজ অনুমান করতে সক্ষম হয়। এর জন্যে এক ডাল থেকে অন্য ডালে ঝাঁপ দিয়ে যেতে আর দুর্ঘটনা ঘটে না। চোখে রেটিনার পেছনে দণ্ড ও শঙ্কু পেশি উদ্ভাবনের ফলে বানররা তিনটে রঙ আলাদা করে চিনতে শিখল। খাবার জন্যে ফল চিনে নিতে আর অসুবিধে রইল না। আদি বানর থেকে বিবর্তন হয়ে পরের প্রাণীদের শিরদাঁড়া ক্রমে ছোট হতে হতে লেজহীন ও ভার বহন করার মত শক্ত হয়েছে। তারপরেই গিবন শিম্পাঞ্জীরা দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। প্রাইমেটদের মাথা শিরদাঁড়ার ওপর অবস্থান করে। স্নায়ুর শিরাগুলো একটা মহাবিবরের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় অবস্থানে পৌঁছেছে, যার ফলে মাথা ঘাড়ের ওপর সোজা থাকে। এটা সোজা হয়ে বসতে বা দাঁড়াতে সহায়ক। প্রাক-প্রাইমেট স্তন্যপায়ীদের মহাবিবরের অবস্থান মাথার পেছনে ছিল এবং তারা ছিল প্রধানত ঘ্রান নির্ভরশীল। বানরদের থেকে প্রাইমেটরা দৃষ্টি-নির্ভর হয়ে গেল, ঘ্রান শক্তি ক্রমশ হ্রাস পেল। দৃষ্টি অনেক বেশি তথ্য আহরণ ও সঞ্চয় করে বলে মস্তিষ্কে আর তার জন্য জায়গার পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে মস্তিষ্কের আয়তন পরবর্তী প্রজাতি ও বর্ণে বাড়তে বাড়তে মানুষে এসে থামে। শিম্পাঞ্জির ৪০০ ঘন সেন্টিমিটার থেকে ক্রমোন্নতি হতে হতে মানুষের ১৩৫০ ঘন সেন্টিমিটারে এসে ঠেকেছে। জটিল স্নায়ুতন্ত্র তার নিজের কাজের প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিয়েছে মস্তিষ্কের আয়তন। এরকম অনেক গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক পরিবর্তন প্রাণীদের ক্রমে ক্রমে ব্যবহারিক, সামাজিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রসার ও বিবর্তনে সাহায্য করেছে। এর থেকে উদ্ভব হয়েছে প্রযুক্তি আবিষ্কার, যুক্তি ও বিচার প্রসারণ।

প্রাইমেটদের সেরা মানব, আর মানবের সেরা মানুষ। তাই প্রাণীদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ। এই সেরার শিরোপা ক্রমে ক্রমে উন্নত প্রাণীর মাথায় চাপছে, তার কারণ ক্রমোন্নত সংস্কৃতি ও সামাজিক শিক্ষা। এক এক ধাপে সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রাণীকে আরও আরও উন্নত করেছে। আর এটা পরিণতি পেয়েছে মানুষে। আজ মানুষের সংস্কৃতি যেখানে দাঁড়িয়ে, তার পেছনে সমগ্র প্রাণী জগতের অবদান। একমাত্র ভয়াবহ হিংসা ছাড়া। 

শিম্পাঞ্জি, গিবন, ওরাং ওটাং-দের পেরিয়ে এল অস্ট্রালোপিথেকাস। অনেক বিজ্ঞানীর অনুমান তারা পাথর ছুঁড়ে হিংস্র প্রাণীদের ভয় দেখাত বা ছোট প্রাণী মারত। তার মানে আত্মরক্ষার জন্য বা শিকারের জন্য পাথর ব্যবহার করা যায়, মাটি নয়, সেই প্রযুক্তিগত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান চল্লিশ লক্ষ বছর আগে তারা জেনেছিল অথবা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে দেখেছে পাথর অনেক ভারী এবং ছুঁড়লে অনেক বেশি দূর অবধি যায়। এখান থেকেই প্রযুক্তিগত সংস্কৃতির শুরু। এখান থেকেই সংস্কৃতি সভ্যতার স্তরে উন্নীত। এই উন্নত ধারণা নিয়েই ছাব্বিশ লক্ষ বছর আগে মানব গণের প্রথম প্রজাতি হোমো হ্যাবিলিসের আবির্ভাব পূর্ব আফ্রিকায়। এবার তারা পাথরকে পাথর দিয়ে ভেঙে ছুলে চেঁচে ঘসে অস্ত্র বানাল। শুরু হোল প্রস্তর যুগ। শুরু হোল অস্ত্র সংস্কৃতি। আত্মরক্ষা ও শিকার, উভয় কাজেই ব্যবহার হতে লাগল এই অস্ত্র। এই অস্ত্র তৈরি করতে আনুসঙ্গিক শারীরিক পরিবর্তন বিবর্তিত হয়েছে পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে ও অবশ্যই পরবর্তী প্রজাতিতে। যেমন হাতের দুটো হাড় আর কব্জির হাড় শক্ত ভাবে জোড় লেগে কব্জির জোর বেড়ে গেল। এরপর পরবর্তী মানব প্রজাতি আরও উন্নত পাথুরে অস্ত্র তৈরি করেছে। আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে গেছে, প্রয়োজনানুসার নতুন পাথরে নতুন অস্ত্র তৈরি করে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। পঞ্চাশ হাজার বছর আগে মানব নিয়েনডারথাল ছুরি, ব্লেড ইত্যাদি ধারালো অস্ত্র তৈরি করেছে। সাধারণ একঘেয়ে প্রযুক্তি ও তার উপকরণ অভ্যাস ছেড়ে মানব ক্রমশ জটিল প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রবৃত্ত হয় সেই সময় থেকেই। এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে মানুষের মধ্যে। সংস্কৃতিতে প্রাথমিক পরিবর্তন দেখা যায় কিছু ক্রিয়া-কলাপের ভেতর, যেমন মৃত শরীর কবর দেওয়া, পশুর লোমশ চামড়া দিয়ে দেহ আবরণ, ফাঁদ পেতে অথবা উঁচু টিলা থেকে তাড়িয়ে নিচে নামিয়ে পশু শিকারের মত বুদ্ধিদীপ্ত কাজ, পাথর ও হাড়ের গয়না ও মূর্তি বানানো, গুহায় পাথরের গায়ে ছবি আঁকা এবং বিনিময় প্রথায় বাণিজ্য। 

আর এক মানব হোমো ইরেকটাস বিশ্বপরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ে। নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশ ও বিচিত্র আবহাওয়া তাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে। এই সময়ে তাদের সংস্কৃতিতে নতুন সংযোজন ঘটেছে। আত্মরক্ষার স্বার্থে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকার সুবিধে তারা বুঝেছিল। শিশুদের মায়ের কাছে রেখে পুরুষেরা শিকারে যেত। বিপদের সময় বিভিন্ন সঙ্কেতবাহী আওয়াজ করতে শিখল। নিঃশ্বাসকে নিয়ন্ত্রন করে ভিন্ন প্রয়োজনে ভিন্ন সঙ্কেতবাহী আওয়াজ করার এই প্রথা স্বরযন্ত্রের আদি সূত্র। হিংস্র পশুদের থেকে বাঁচতে তারা জঙ্গলের প্রান্তে থাকা শুরু করে। জঙ্গলে আগুন লাগা দেখে প্রথমে দূরে পালাত। আগুন কমে গেলে ভেতরে ঢুকে দেখল আধপোড়া পশুর দেহ অন্য পশুরা খাচ্ছে। ওরাও তখন খেল এবং বুঝতে পারল এই ঝলসানো মাংস সহজে হজম হয়। শুকনো ডাল দিয়ে আগুন জ্বালানো সহজ এটাও জানলো। এবার তারা আগুন জ্বালিয়ে মাংস পুড়িয়ে খেতে লাগল। এ ছাড়াও তারা দেখল আগুন দেখে অন্য পশুরা কাছে আসে না, পালিয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা রাতে থাকার জায়গার কাছে আগুন জ্বালিয়ে হিংস্র পশুদের দূরে রাখতে সক্ষম হল এবং নিশ্চিন্তে ঘুমলো। সংস্কৃতি এক ধাপে অনেকটা এগিয়ে গেল আগুনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আয়ত্ত করার পর। সেই সাথে মানব সভ্যতা। মনে রাখতে হবে তখনও মানুষের জন্ম হয়নি। পাথর দিয়ে মৃত প্রাণীর মাথা ভেঙে ঘিলু অথবা হাড় থেঁতলে মজ্জা বের করে খাওয়ার শুরু এই ইরেকটাসের সময়েই। এটাও একটা বৈবর্তনিক প্রথা। এর থেকে তারা বেশি প্রোটিন পেত, বেশি শক্তি অর্জন করত। পশুদের দেখে শিখে তারাও শীতের সময় আচ্ছাদিত গুহার ভেতরে থাকতে শুরু করে। অনেক সময় পশুদের তাড়িয়ে আশ্রয় নিত। তবে কোনও প্রচেষ্টাই একবারে সফল হয়নি। বারবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চেষ্টা চালিয়ে তবেই এই সব সাফল্য। এর জন্যে বহু জীবন বলি দিতে হয়েছে। আগুন ও আশ্রয়ের উন্নত সংস্কৃতি আজ আমাদের সভ্যতার অঙ্গ।

গুহাবাস সফল করার অনেক পর আর এক মানব প্রজাতি হাইডেলবারজেনেসিস পাথরের ঘর বানালো। পাথরের ভাঙা স্ল্যাব দিয়ে গুহার মত নকল করে দেয়াল ও ছাদ বানালো। শখে নয়, অতি প্রয়োজনে। কারণ এদের সময় পৃথিবী জুড়ে চলছিল হিমবাহ-আন্তর্হিমবাহ খেলা। শীতল-উষ্ণের এই চক্রাকার পরিবর্তন তাদের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা বাড়াচ্ছিল আর তারা সেই অভিজ্ঞতা প্রজন্ম ধরে বাহিত করছিল। উত্তরপ্রজন্মও এই শিক্ষা গ্রহণ করে কাজে লাগায়, আর তার ফলস্বরূপ পরীক্ষা করতে করতে একদিন তারা কাঠের ঘরও বানিয়ে ফেলল। জাপানের শিশিবু অঞ্চলে সেই স্বাক্ষর আজও শোভা পাচ্ছে। সাংস্কৃতিক বিবর্তনে এ এক বিশাল পদক্ষেপ এ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ইরেকটাসের উদ্ভাবনী সঙ্কেতবাহী আওয়াজ এবার হাইডেলবারজেনেসিসের মুখ দিয়ে ছোট ছোট সাঙ্কেতিক শব্দ উচ্চারণে রূপ পেল। এটাই হল যোগাযোগের ভাষা। মানবেতর প্রাণীরাও আওয়াজ করে, কোনও বার্তা প্রেরণ করে নিজেদের মধ্যে আবার অন্য গণের প্রাণীদেরও। কিন্তু ইরেকটাসের আওয়াজ ছিল উন্নত মানের আর হাইডেলবারজেনেসিসের শব্দ তো ইরেকটাসের চেয়েও উন্নতই শুধু নয়, রীতিমত ব্যঞ্জনবর্ণের শব্দ উচ্চারণ। স্বরবর্ণের প্রয়োগ অবশ্য অনেক পরে হবে। কিন্তু এই শব্দ উচ্চারণের সংস্কৃতি সভ্যতাকে আরও অনেকটা এগিয়ে দিল। প্রায় ছ’ লক্ষ বছর আগে তারা আফ্রিকা ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ে এবং ইওরোপে চলে আসে। এদের এসব যুগান্তকারী আবিষ্কার ও অস্ত্র প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবন বিরল। এগুলোই পরবর্তী প্রজাতি নিয়েনডারথাল ও মানুষকে অনেক অনুকূল ও আধুনিক পরিবেশে উদ্ভবে সাহায্য করবে। এত কিছু জ্ঞান নিয়ে মানুষ যখন আসবে তখন তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রগতির গতি অনেক দ্রুত যে হবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। 

মানুষ বা হোমো সেপিয়েনস মানব গণের এবং প্রাণীজগতের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও বুদ্ধিমান জীব। বিবর্তনের ধারা মেনেই বুদ্ধিমান হয়েছে। প্রকৃতির পরিবর্তনে সাড়া দিয়ে অনেক প্রাণীই তার সংস্কৃতি বদলেছে। সহজ সামাজিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে। বিবর্তনের ফলে ক্রমাগত শারীরিক গঠণের পরিবর্তন এবং ক্রমোন্নত জটিল মস্তিষ্কের ও জটিল স্নায়ুতন্ত্রের উদ্ভাবন মানুষের মস্তিষ্কর আয়তন বাড়িয়ে ১৩৫০ ঘন সেন্টিমিটার হওয়ার দরুন মানুষ বহুমুখী সংস্কৃতিবান হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতিকে শুধু বজায়ই রাখেনি, তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। 

মানুষের বয়স মাত্র দু লক্ষ বছর। আর তার তিরিশ হাজার বছর আগে আসে নিয়েনডারথাল। এই দুই হোমো প্রজাতির প্রায় এক সময়ে উদ্ভব হলেও তাদের বিবর্তন ও জীবনধারন ঘটেছে সমান্তরাল ও ভিন্ন পরিবেশে, আবহাওয়ায় ও ভৌগোলিক অবস্থানে। নিয়েনডারথালের আগমন প্রধানত ইওরোপ ও তার সংলগ্ন এশিয়ায় এবং তখন পৃথিবী ছিল উষ্ণ। আর সেপিয়েনস সেই পূর্ব আফ্রিকায় বিবর্তিত হয়ে জন্মায়, কিন্তু পৃথিবী ততক্ষণে কঠিন হিমাবাহের কবলে। মানব বিবর্তনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দুটো ভিন্ন মানব প্রজাতি দুভাবে সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তবু মানুষের ক্ষেত্রে কাজটা হয়ে দাঁড়াল কঠিন। শুষ্ক আবহাওয়া বনাঞ্চল এলাকা কমিয়ে দিয়ে খাদ্যাভাব দেখা দিল। একদল মানুষ এক লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার ইথিওপিয়া ছেড়ে বেরিয়ে এশিয়া ও ইওরোপে চলে আসে। এখানে এসে নতুন পরিবেশ, আবহাওয়া, খাদ্যসম্ভার, অপরিচিত পাথর যা দিয়ে অস্ত্র বানাবে দেখে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় নেয়। আর সর্বোপরি তখন সে ইরেকটাস, হাইডেলবারজেনেসিস ও নিয়েনডারথালের সম্মুখীন। প্রায় নিজেদের মতন দেখতে কিন্তু তাদের গোষ্ঠীর নয়। তবু নিজেদের মত ব্যবস্থা করে পূর্ব এশিয়ায় ঢুকে পড়ে। ভারতের সুরাত অঞ্চলেও চলে আসে। সেই সময়, সত্তর হাজার বছর আগে, ইন্দোনেশিয়ার টোবায় অগ্ন্যুৎপাত হয় এবং তার ছাই সারা আকাশ ঢেকে দেয়। অচিরেই প্রভূত খাদ্যসংকটের সম্মুখীন হয়ে সে সময়ে তারা পিছু হটে। অগ্রগতি স্তব্ধ হয়ে যায়। একেকটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে আর ততই তার বুদ্ধিকে উন্নত করে। এরপর আবার তারা আফ্রিকা ত্যাগ করে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। তখন কিন্তু পৃথিবীতে হিমবাহ শুরু হয়ে গেছে। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে অন্তত মেরু থেকে চল্লিশ ডিগ্রি অক্ষাংশ অবধি প্রচণ্ড শৈত্য প্রবাহ চলছে। সমুদ্রের জল টেনে নিয়ে মেরুতে বরফ জমছে। সমুদ্রের পতন হল ১২০ মিটার। কিন্তু মানুষ এবার সব বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয় তার পূর্ব সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে। বিচিত্র ও ক্রমপরিবর্তিত আবহাওয়া ও পরিবেশ মানুষকে নানা উপায়ে জীবনধারণ করে চলতে শেখায়, মানুষ নিজেকে রক্ষা করতেও শেখে। এবার আর তার আগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা তার পূর্ব প্রজাতিদের বাধা। হ্যাঁ, বাধা পেতেই পারে কারণ প্রবল শৈত্য প্রবাহ খাদ্য ভাণ্ডারে খামতি ঘটাবেই। খাদ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতা শুরু হোল। মানুষ-পূর্ব প্রজাতিরা অত সহজে তাদের খাবার মানুষের হাতে নিশ্চই তুলে দেবে না। অযথা প্রতিযোগিতার মধ্যে, খুন-খারাপির মধ্যে না গিয়ে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ সেই সময় নিরক্ষরেখা আর চল্লিশ ডিগ্রি অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থান করে পৃথিবী জয় করছে, কারণ সে জেনেছে এই অঞ্চলে শীতের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম আর তাই খাদ্যের ততটা অভাব নেই। শস্য, ফল ও শিকারের যথেষ্ট যোগান আছে। 

সমাজবদ্ধ স্বভাব ও প্রযুক্তির ক্রমোন্নতি সংস্কৃতি বিবর্তনের ধারা বজায় রেখে মানুষ আরও উন্নত শিক্ষা অর্জন করেছে, যা মনুষ্যেতর প্রাণীদের দ্বারা সম্ভব হয় নি। জীবনযুদ্ধে প্রত্যেক প্রাণীই কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে। এই শিক্ষা দু প্রকার – সামাজিক ও ব্যক্তিগত। এইবার একটি প্রাণী তার অর্জিত শিক্ষার কতটা সামাজিক শিক্ষায় রূপান্তর ঘটাতে পারে তা নির্ভর করছে মস্তিষ্কের গঠণ ও ব্যবহারের ওপর। ব্যক্তিগত শিক্ষা প্রজন্ম ধরে বাহিত হতে হতে একসময় জিনে প্রবেশ করে। তখন সেটা সামাজিক শিক্ষায় পরণতি পায় যা প্রজন্ম ধরে বাহিত হয়, এমনকি পরের প্রজাতির মধ্যেও থাকে। মানুষের উন্নত মস্তিষ্কের জন্য সামাজিক শিক্ষার প্রচলিত হার অনেক বেশি। আর ভাষা হল সামাজিক শিক্ষার চূড়ান্ত রূপ। মানব সংস্কৃতির মতই ভাষা বিবর্তনের ধারা বয়ে এসেছে। 

সামাজিক শিক্ষা ও তদ্ভূত সংস্কৃতি জিন দ্বারা ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ, সীমিত ও সময়সাপেক্ষ হলেও স্নায়ুতন্ত্র অতিরিক্ত সক্রিয় হওয়ায় গভীরতা আছে, কিন্তু ব্যাপ্তি কম বলে জিনে প্রবেশ করতে পারে না। অন্যদিকে সামাজিক শিক্ষা অল্পায়াসে নকল করেও শেখা যায়। বিস্তার থাকায় নির্ভরযোগ্য। উন্নত প্রাইমেটদের মধ্যে নকলের প্রবণতা বেশি, যার জন্য শিম্পাঞ্জিদের এপ বলা হয়। প্রত্যেক উচ্চ বর্ণের প্রাণী তার আগের প্রজন্ম বা প্রজাতি বা বর্ণের প্রাণী থেকে নকল করে। কিন্তু নিম্ন প্রজাতির প্রাণীরা তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত মস্তিষ্কের উচ্চতর প্রাণীদের দেখে নকল করতে পারে না। ফলে জন্মের সময় থেকেই সে অনেকটা শিক্ষিত এবং আরও শিক্ষিত হয়ে ওঠায় কোনও বাধা থাকে না। দেখে দেখেই নকল করে শিখে যায়। যেহেতু মানুষ এখনও পর্যন্ত বিবর্তনের শেষ প্রজাতি, তাই সে প্রথমেই সকল প্রাণীর কার্যকলাপ ও ব্যবহার দেখে দেখেই অনেকটা শিক্ষিত হয়ে গেছে। তার ওপর রয়েছে নিজের অভিজ্ঞতা। তথ্য সংগ্রহের পরিমাণ ও গুণ উত্তরোত্তর বেড়েছে। তবে এসবের সাথে মানুষের দ্রুত অগ্রগতির জন্য প্রধান দায়ী স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বরযন্ত্র, তার জন্যে স্বরক্ষেপণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে স্বরবর্ণ যুক্ত করে কথা বলা, যা তাকে পূর্বের প্রজাতিদের থেকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। অস্ত্র তৈরিতে নিয়েনডারথাল মানুষের সমপর্যায়ভুক্ত হলেও শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা মানুষকে উন্নততর করেছে। আর তখনই মানুষ তার প্রতিবেশীদের প্রতিপক্ষ মনে করে তাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে, এমন কি শত্রু মনে করে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করেনি। আর এখান থেকেই হিংসা ইন্দ্রিয়ের সূত্রপাত বলে মনে করা হয়।

এ যাবৎ প্রাণীরা অন্য প্রাণীকে হত্যা করত তাদের খাদ্যের জন্য। প্রাণীদের মধ্যে খাদ্য ও খাদকের সম্পর্ক আদিকাল থেকেই চলে আসছে। এতে প্রাণীজগতে সাম্য নষ্ট হয় নি। বাঘ, সিংহ ইত্যাদিদের আমরা হিংস্র প্রাণী বলি বটে কিন্তু এরা খাদ্যের অতিরিক্ত একটা বেশি প্রাণীও হত্যা করে না। অবশ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য বহু প্রজাতির প্রাণী নির্মূল হয়ে গেছে, কিন্তু দুই প্রজাতি প্রাণীর যুদ্ধে কোনও একটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি। প্রাইমেটদের মধ্যে দেখা যায় সন্তান গর্ভে ধারন করার পর থেকে সন্তান জন্মাবার পরও অনেক দিন পর্যন্ত স্ত্রী প্রাণীরা যৌন সঙ্গমে আনীহা দেখায়। এর জন্য পুরুষেরা তাদের সন্তানদের মেরে ফেলে। একটি স্ত্রী প্রাণীর সাথে যৌন মিলনের জন্য একাধিক পুরুষের লড়াই, এমনকি হত্যা পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু স্রেফ নিজের অধিকার কায়েম করার জন্য শত্রুকে শেষ করে ফেলার আজকের যে প্রবণতা মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তার সূত্রপাত সম্ভবত মানুষই করেছে। আমার মতন যাকে দেখতে নয়, আমার বিধর্মী, আমার স্বজাতি নয়, আমার বর্ণের নয় এরকম নানা অ-সম মানুষই আমার শত্রু আর শত্রু মানেই হত্যা। এই হিংসা মানুষ শুরু করে আফ্রিকা থেকে নির্গমেনের পর এশিয়া ও ইওরোপে এসে।

সামাজিক শিক্ষায় উন্নত ও অভিজ্ঞ অভিবাসিত মানুষ নতুন জায়গায় এসে পূর্ব প্রজাতিদের থেকে বাধা পায় প্রধানত এলাকা দখল ও খাবারে ভাগ বসানোর জন্য। আক্রান্ত ও কোণঠাসা মানুষ তার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে নতুন জায়গায় প্রাপ্ত উপাদান দিয়ে উন্নত মানের অস্ত্র তৈরি করে আত্মরক্ষা ও শিকার উভয়েই অসামান্য সাফল্য পায়। মানুষের অস্ত্র তৈরির কৌশল ও তার যথাযথ প্রয়োগ করার কৌশল তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে উন্নত হওয়ায় এবার তারা বিপন্ন হয়ে পড়ে। মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ভয়ে পালিয়ে যায়। গুহায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ন, হিংস্র মানুষ তাদের ক্ষমা করে না। হত্যা করে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয় পৃথিবীর মাটি থেকে। তারাও যে এই প্রকৃতির একজন, সে বুদ্ধি মানুষের ছিল না। এখনও কি আছে? মানুষ প্রথমে ইরেকটাস ও পরে নিয়েনডারথালকে শেষ করে মাত্র তিরিশ হাজার বছর আগে। অথচ দ্রুত পরিবর্তিত আবহাওয়ায় তারা নিজেদের কত কষ্ট করে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল, তার স্বাক্ষর আজও রয়েছে। নিয়েনডারথালই প্রথম পশুর চামড়াকে গাত্রাচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করে শৈত্য প্রবাহের সময়ে। 

এরপর থেকে মানুষের জনসংখ্যা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অগ্রগতি অব্যাহত থাকে। এদের বিস্ফোরণ ঘটে হিমবাহ যুগের শেষে বারো হাজার বছর আগে পৃথিবী যখন আবার গরম হতে শুরু করে। প্রথাগত চাষ দশ হাজার বছর আগে শুরু হয়। নগর সভ্যতা, লিপির উদ্ভব, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, বিনিময় প্রথা ও সাহিত্য একের পর এক মানব সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে অনেক দূর নিয়ে গেছে। আর এগিয়ে নিয়ে গেছে মানুষের সেই হিংস্র স্বভাবকে যার জন্যে সভ্যতা আজ বিপন্ন। মানুষ যখন দেবতা সৃষ্টি করল, তখন তারা একই সাথে দানব, রাক্ষস বা অসুর বানিয়ে ফেলল এবং তারা দেবতাদের শত্রু বলে চিহ্ণিতও হল। স্ব-জাতির মধ্যে এই অদ্ভূত বিভাজন চিরকালের জন্য মানুষের মধ্যে বিভেদ সঞ্চার করে দিল। নানা দেশের পৌরাণিক কাহিনীতে এবং তদ্ভাবাপন্ন সাহিত্যে দেবতা ও দানবের যুদ্ধ এবং শেষে দেবতার জয়োল্লাস নিয়ে দীপাবলি। নাম দেওয়া হল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয়। অথচ প্রাথমিক হিংসা-উদ্রেক করা অন্যায় তো সেই মানুষই করল।

মানুষের মনে দু ধরনের চিন্তার জগৎ - মৌলিক ও সম্ভ্রান্ত। দুটোই আত্মসচেতনতার অনুগত এবং জিন বাহিত। প্রথমটার উপাদান ষড় রিপু। প্রতিহিংসা, বিতৃষ্ণা, গর্ব, অহং, এগুলো সব মানুষের মধ্যেই আছে। আর সম্ভ্রান্ত বা উদার আবেগের মধ্যে আসে প্রেম, করুণা, সহানুভূতি, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, শান্তি। একটা ভাল, সুস্থ, সুন্দর, নৈতিক সমাজ পত্তনের আকাঙ্ক্ষা। প্রতিটি মানুষের ভেতরেই এই দুটো আবেগের সত্তা আছে এবং এদের মধ্যে অনবরত দ্বন্দ্ব হয়েই চলেছে। কিছু ব্যক্তির মনে মৌলিক আবেগ দখল করে বসে আছে আবার কারোর মধ্যে মহৎ আবেগ প্রাধান্য পায়। যুক্তিবাদীরা স্থান, কাল, পাত্র হিসেবে আবেগ প্রকাশ ও নিয়ন্ত্রন করে। যুক্তিহীনদের কেউ ভাবের আবেগে ভেসে যায় আবার কেউ হিংস্র হয়ে হত্যালীলায় মেতে ওঠে। এও মানব সংস্কৃতি ও সভ্যতার অঙ্গ। আজ বুঝি ঠাকুমার সেই যুক্তিবাদী কথা যে, সংস্কৃতি ও সভ্যতা সবাইকে মিলেমিশে থাকতে শেখায় কারণ, আমরা সবাই প্রকৃতির অংশ। সত্যি হলেও বাস্তবে অমিল।

0 comments: