ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে
Posted in ঝরনাতলার নির্জনে
ঝরনাতলার নির্জনে
জোড়াসাঁকো জংশন জেনএক্স রকেটপ্যাড- ১২
শিবাংশু দে
'এই দুর্ভাগা দেশকে আপনার কণ্ঠমাধুরী ও কলাসিদ্ধির দ্বারা আনন্দিত করুন, সুস্থ করুন। বিশেষত যখন রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি শ্যামার কথা ভাবি তখন আমি অভিভূত হয়ে যাই। এই সূক্ষ্ণ জটিল নানাবিপরীত অনুভূতির টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত নারীকে আপনি ছাড়া আর কে এমন সার্থক রূপ দিতে পারত? এই পাপিষ্ঠাকে রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্জ ট্রাজিক মহিমা দান করেছেন। কিন্তু আমাদের ও কবিরমাঝখানে একজন interpreter আবশ্যক ছ্ল। সেই সুযোগ্য interpreter কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনার কাছ থেকে আমরা অনেক পেয়েছি।'
(একটি চিঠিতে আবু সয়ীদ আইয়ুব)
'শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির আশ্রয়ে বড় হয়ে উঠেছি আমি। আমার সম্পদ রবীন্দ্রনাথের গান…আমার জীবন, আমার গান, আমার বেড়ে ওঠা, আমার বেঁচে থাকা, আমার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবেজড়িত হয়ে আছে শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়, আমারও একান্ত শান্তিনিকেতন।'
লিখেছিলেন তিনি। মনে হয় এর থেকে নিখুঁতভাবে তাঁর সাঙ্গীতিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতটিকে বর্ণনা করা যায়না। একজন শিল্পী কী জন্য একটি বিশেষ শিল্পমাধ্যমকে আত্মস্থ করেন, তার নানা কারণথাকতে পারে। প্রথম শর্ত তো অবশ্যই শিল্পটিকে ভালোবাসা। কিন্তু তা একা যথেষ্ট নয়। শিল্পের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের যে ইচ্ছে, তা সফল হবার আগে নানা রকম ব্যক্তিগত সংগ্রাম, অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়েযেতে হয় ইচ্ছুক ব্যক্তিটিকে। এই যুদ্ধ বহিরঙ্গে হতে পারে, অন্তরঙ্গেও। যাঁরা পেশা হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক শিল্পমাধ্যমটিকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের সামনে ছিলো অনন্ত চ্যালেঞ্জ।
দেবব্রত বিশ্বাস বা সুচিত্রা মিত্রের লড়াইটি দেখলে তার কিছু সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এতোটা খ্যাতনাম যাঁরা ন'ন, সেরকম বহু নিবেদিত রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধকদেরও পেরিয়ে আসতে হয়েছিলো পতন-অভ্যুদয়বন্ধুর পন্থা। যে চর্যাটি তাঁকে বিক্ষিপ্ত করেনি। তিনি আশ্রমবালিকার অমলিন সারল্যকে পুঁজি করে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর গানের সেটাই প্রধানতম লক্ষণ। তাঁর অনর্গল পরিবেশনার ভিত্তিভূমি।
১৯৩৫ সালে পিতৃদত্ত 'অণিমা' নামটি বদলে 'কণিকা' রেখেছিলেন স্বয়ং কবি। তাঁর ইচ্ছাপত্রের সঙ্গে কবি আরও লিখেছিলেন
' আমার নামের আখরে জড়ায়ে আশীর্ব্বচনখানি ,
তোমার খাতার পাতায় দিলাম আমি।'
এই ঘটনাটি উল্লেখ করা জরুরি। স্বয়ং কবি ও তাঁর শান্তিনিকেতনের সঙ্গে কণিকার অঙ্গীকৃত অস্তিত্ত্বটিই তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি। বাকি সব কিছু নিতান্ত গৌণ, অপ্রয়োজনীয়। তাঁর দাদামশাইরাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০২ সাল থেকে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর সূত্রে তাঁদের পরিবারের বহু সদস্যই পরবর্তী প্রজন্মে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর সঙ্গেনানাভাবে যুক্ত ছিলেন। মায়ের ডাকনাম সোনা, দিদির গিনি, তাই তিনি মোহর। শান্তিনিকেতনে আদি গুরুপল্লীতে পাশাপাশি খোড়োচালের মাটির কুঁড়েঘরে থাকতেন নন্দলাল বসু, প্রভাতকুমারমুখোপাধ্যায়, প্রমদারঞ্জন ঘোষ, জগদানন্দ রায়, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন, নেপালচন্দ্র রায়, নিত্যানন্দ গোস্বামী, সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়। সত্যচরণ মোহরের পিতৃদেব। রবীন্দ্রপ্রভাবে মগ্ন এইমানুষগুলি পরবর্তীকালে আমাদের সভ্যতার বাতিঘর হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। প্রাচীন আর্ষ ইতিহাসে চিরকালীন আশ্রমিকজীবনের যে বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়, অবিকল সেই ছাঁচে কবি গড়েছিলেনশান্তিনিকেতনে তাঁর 'স্বর্গরাজ্য'। যেখানে কাঞ্চনমূল্যে কিছুই মাপা হতোনা। প্রতিভা ও সৃজনশীলতাই ছিলো মানুষকে মূল্যায়ণের চাবিকাঠি। এই রকম একটি আবহ থেকে রস আহরণ করে যে যাপনটিগড়ে ওঠে তার স্বরূপটি ভিন্ন তো হবেই।
শৈশবে এক কালবৈশাখীর সন্ধে বেলা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দুটি মেয়ে 'শ্যামলী'র বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলো। সেখানে তারা দেখতে পায় জানালার পাশে একজন 'সাদা চুল, সাদা গোঁফ-দাড়ি, বড় বড় চোখ।যেন তুলি দিয়ে আঁকা' মানুষ বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। কিন্তু কিছুই যেন দেখছেন না। একটু পরে শিশুদুটি তাঁর নজরে পড়ে। তিনি তাদের ডেকে পাঠান। প্রশ্ন করেন, 'গান জানিস?' তাঁদেরমধ্যে একজন শিশু পরবর্তীকালে লিখেছেন, ' তিনি গান শোনাতে বললেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়ে দিলুম। কোনও দ্বিধা বা জড়তা কাজ করেনি। তিনি যে আমার কাছে গান শুনতে চেয়েছেন, তাতেইআমি ডগোমগো। আর, শান্তিনিকেতনের মাটিতে আমার কোনও লজ্জা ছিল না গান গাওয়ার। এটা তো আমাদেরই জায়গা। ঘুরতে, ফিরতে গান করি। গুরুদেবকেও শুনিয়ে দিলাম সদ্য শেখা একখানাগান। মনে হল, তিনি খুশি হয়েছেন। ‘…. কালবৈশাখীর বিকেলের এই একটুকরো ঘটনায় যেন অনেকখানি পাল্টে গেলাম আমি।' কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নপদ্ধতি বা কৌশল নিয়ে বিচারকরতে গেলে এইসব পটভূমি স্মরণে রাখতে হবে।
তেরো বছর বয়সে, ১৯৩৮ সালে তাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। না, রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়। নীহারবিন্দু সেনের লেখা, হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে দু'টি গান। তার পরে একটি গীতিনাট্যে কণ্ঠ দেন 'কুমারীকণিকা'। সে বছরই তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রাকাশ পায়। 'ডাকব না, ডাকব না' আর 'মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে'। হিন্দুস্তান রেকর্ডের 'রেকর্ড পরিচয়ে' বলা হয়েছিলো 'কুমারী কণিকা মুখার্জিরপ্রথম রেকর্ডখানি সকলের তৃপ্তি সাধন করিয়াছে। এবার তাহার আর একখানি রেকর্ড বাহির হইল। এই গান দুখানি শুনিয়া সকলেই প্রীতিলাভ করিবেন।'
১৯৩৯ সাল থেকে কণিকাগীত রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড মোটামুটি নিয়মিত প্রকাশ হতে থাকে। ১৯৩৯ সালে 'ঐ মালতীলতা দোলে' এবং 'ঘরেতে ভ্রমর এল'। ১৯৪২শে 'ওগো তুমি পঞ্চদশী' ও 'এসোশ্যামলসুন্দর'। প্রথম রেকর্ডের গান থেকে ধরলে তাঁর সক্রিয় গায়নজীবনের বিস্তার পঞ্চান্ন বছর। দেশে-বিদেশে নানা সংস্থা তাঁর রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি ইত্যাদি প্রকাশ করেছে। সংখ্যাগতভাবে তাঁর ডিস্কোগ্র্যাফির নিখুঁত হিসেবে করা সম্ভব নয়। এতো জায়গায় এতোভাবে তারা ছড়িয়ে আছে যে সংবদ্ধ সূচি সংকলন করা শ্রম ও গবেষণাসাপেক্ষ। এগুলি অবশ্য নিতান্ত 'কাজের কথা'। পরিসংখ্যান দিয়েআমাদের মননে কণিকার ছড়ানো রাজ্যের পরিধি ঠিক মাপা যায়না।
প্রথম পর্যায়ে আমরা দেখেছি তিনি শৈশব কালেই স্বয়ং কবির নির্দেশে নতুন গান শিখে নিতেন। শুধু তাই নয়, কবির সঙ্গে তিনি সারাদেশে বিশ্বভারতীর দলের সঙ্গে গান গেয়ে বেড়াতেন। ১৯৪০ সালেবোলপুরে টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধন উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হয়েছিলো, সেখানে কবি তাঁর স্নেহের মোহরকে আলাদা করে 'ওগো তুমি পঞ্চদশী' শিখিয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানটির প্রায় তিন বছর আগে১৯৩৭ সালে স্বয়ং কবির সঙ্গে তিনি কলকাতায় প্রথম অনুষ্ঠান করতে আসেন। তাঁর বয়স তখন তেরো। কলকাতায় জোড়াসাঁকো বাড়ির এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াতেন। যে অনুষ্ঠানে গান গাইতে তাঁরকলকাতায় আসা, তার শীর্ষক ছিলো 'বর্ষামঙ্গল'। সেখানে শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের সঙ্গে কলকাতার শিল্পীরাও আসতেন। তাঁদের জমকালো শাড়ি আর বিভিন্ন সুরভির ব্যবহার শান্তিনিকেতন থেকে আসাবালিকা মোহরের জন্য ছিলো একটি চমক। যদিও সেবার মঞ্চে 'ছায়া ঘনাইছে বনে বনে' গাইবার সময় শুনতে পান স্বয়ং কবি তাঁর সঙ্গে গাইছেন। সেই অনন্য অভিজ্ঞতা ছপিয়ে কিন্তু তাঁর মনে থেকেগিয়েছিলো কলকাতার লোকের জাঁকজমক। পরিণত বয়সে স্বীকার করেছিলেন 'কলকাতা নিয়ে ভীতি আমার কখনও কাটেনি।' এই স্বীকারোক্তিটি তাঁর শিল্পীসত্ত্বা ব্যাখ্যার ক্রমে অত্যন্ত জরুরি একটি বিন্দুহতে পারে।
গানের পরিবেশ ছিলো পারিবারিক পরিমণ্ডলে। দিদিমা ভালো গান গাইতেন। বাবা এসরাজ বাজাতেন। কবির বলয়ে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও এই সুবিধেটি মোহরের ছিলো। এছাড়া 'দিনুদা' বা 'বিবিদি'রপ্রত্যক্ষ নির্দেশনায় গান গাইবার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তাঁকে নির্মাণ করেছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। 'নিবিড়ভাবে শিক্ষা পেয়েছি শৈলজাদা, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে। তাঁরকথা কতবার বলেছি। তাঁর ঋণ কখনও শোধ করা যাবেনা। হাতে ধরে, বকেঝকে, ভালবেসে কতভাবে তিনি গান শিখিয়েছেন অমাকে। নিজে যতক্ষণ না সন্তুষ্ট হচ্ছেন আমার গান শুনে, ততক্ষণ আমারমুক্তি নেই। আমার ধৈর্যচ্যুতি হলেও শৈলজাদা ধৈর্য হারাতেন না কখনও।' এর সঙ্গে আবার উল্লেখ করেছেন 'শিখেছি শান্তিদার (শান্তিদেব ঘোষ) কাছে। শিখিয়েছেন খুকুদি (অমিত সেন), নুটুদি (রমা কর)।' এই তালিকা থেকে স্পষ্ট সেকালে শান্তিনিকেতনে থেকে যে শ্রেষ্ঠ তালিম ভাবা যেতে পারে, তা কণিকার অর্জন হতে পেরেছিলো। এছাড়াও তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম পেয়েছিলেন হেমেন্দ্রলাল রায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভি ভি ওয়াঝেলওয়ার, পি এন চিনচোড়ে, ধ্রুবতারা যোশি প্রমুখ সুখ্যাত কলাবিদদের কাছে।
ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা অমিতা সেন আশৈশব মোহরকে চিনতেন। তিনি লিখেছিলেন, 'খুব ছোট থেকেই মোহরের যেমন গানের গলা, তেমনি দেখতে সুন্দর। অসম্ভব গুণী ছিল। গুরুদেবও খুবভালোবাসতেন। বড়দের সঙ্গে ওকেও ডেকে পাঠাতেন গান শিখতে, বাড়ির জানালা দিয়ে কতদিন দেখেছি মাঠের মধ্যে দিয়ে মোহর ছুটছে গুরুদেবের কাছে। রাস্তা দিয়ে যেত না, পাছে দেরি হয়ে যায়।মাঠের ধারে একটা বনপুলকের গাছ ছিল, বসন্তে ফুল ফুটলে চারিদিক ভরে উঠত। তার তল দিয়ে মোহর দৌড়াচ্ছে, তাড়াতাড়িতে ফ্রকের পিঠের সব বোতামও লাগানো হয়নি-এ ছবি আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।'
শিল্পীসত্ত্বা বিকাশের পথে মানুষের পারিপার্শ্বিক আর আবহ বড়ো ভূমিকা পালন করে। মহানগরবাসী, যাঁরা সমষ্টির সঙ্গে ওতপ্রোত জীবনযাপন করেন, তাঁদের অনুপ্রেরণার মূলে বহির্ভুবনের ঘটনাবহুলঘাতপ্রতিঘাতের স্রোত একটি মুখ্য উৎস হয়ে দাঁড়ায়। শিল্পীর অন্দরমহল, বহিরঙ্গের প্লবতা এড়িয়ে যেতে পারেনা। বাহিরের প্রতিক্রিয়াই তাঁর আয়না। তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জ। কিন্তু 'আশ্রম'আবহে স্বচ্ছন্দশিল্পীর সৃজনশীলতা বিকশিত হয় অন্তরঙ্গ যাপনে। তাঁর আয়না তিনি নিজে। শিল্পের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন, বীক্ষা বা প্রয়োগপদ্ধতি, সবই একান্তভাবে অন্তর্মুখী, আত্মমগ্ন। শিল্পীর অন্তর্মুখিন প্রস্তুতিরএকটি আদর্শ উদাহরণ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে সারা বিশ্বজোড়া শ্রোতাসমূহের অতি প্রেয়, প্রার্থিত এবং শ্রদ্ধেয় মহান পারফর্মার। আপাতভাবে প্রায় অসম্ভব একটি সেতুবন্ধন করেন তিনি অপরিমেয় সাঙ্গীতিক সিদ্ধির জাদুমন্ত্রে।
এই সাফল্য কিন্তু অন্তরীক্ষ থেকে ঝরে পড়েনি। আত্মকথায় তিনি লিখেছিলেন, 'খুব ছোটবেলা থেকেই সমালোচনায় কুঁকড়ে যেতাম আমি।' কিশোরী বয়সে একবার কলকাতা বেতার কেন্দ্রে খুব উৎসাহিত হয়ে গেয়েছিলেন 'মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে'। কয়েকদিন পরে একটি পত্রিকায় তাঁর গান প্রসঙ্গে লেখা হলো 'গলা বিশ্রী'। এই জাতীয় মন্তব্য পড়ে তাঁর প্রতিক্রিয়াটি ছিলো এরকম। ' আগে যেমন গান গাইতাম নিজের মনে, সেদিন যে কাঁদলাম সেও নিজের মনে, লুকিয়ে লুকিয়ে। গলা যখন 'বিশ্রী', তখন কেন সবাই গান গাইতে বলে? ঠিক করলাম কলকাতা আর যাব না। আঘাত? পরে দেখেছি সেই আঘাতটাই আমার জীবনে পুরস্কার হয়ে ফিরে এসেছে বারে বারে।'
বহিরঙ্গ আর অন্তরঙ্গ জীবনের মধ্যে যে হাটের ধূলা একজন নাগরিক শিল্পীর ক্ষেত্রে হয়তো জীবনের অঙ্গ, কিন্তু তা একটি অন্তর্মুখী আশ্রমবালিকার স্পর্শকাতরতাকে বিড়ম্বিত করে। তাঁকে নিজস্বশিল্পবস্তুকে বাজারজাত করা বা বিজ্ঞাপন করার ক্লিষ্টতা স্বীকার করতে হয়নি। তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন শান্তিনিকেতনের পরিচিত আবহে, গুণগ্রাহী শ্রোতাদের মাঝে নিজেকে প্রতিভাসিত করার অভ্যস্ত খেলায়।১৯৭৯ সালে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, রেডিও বা রেকর্ড করতে তাঁর তখনও ভালো লাগে। কিন্তু ফাংশন বা বড়ো অনুষ্ঠানে গান গাইতে তাঁর আর ভালো লাগেনা। আমি ১৯৭৫ সালেজামশেদপুরে একটি বড়ো অনুষ্ঠানের আগে তাঁকে বলতে শুনেছি গোরা সর্বাধিকারীর উপরোধে তিনি এই সব অনুষ্ঠানে গাইতে আসেন। নিজের ভালো লাগেনা। সেই অনুষ্ঠানেই গান শুনতে গিয়ে আমারমনে হয়েছিলো তিনি খুব উৎফুল্ল বোধ করছেন না। পরিবেশনে একটি যান্ত্রিক মাত্রা কাজ করছে। সত্যি কথা বলতে কী, তিনি রেডিও ও রেকর্ড মাধ্যম দুটিতেই স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠা, খ্যাতিএসেছে এই দুই মাধ্যমে পরিবেশনের সূত্রেই। সাক্ষাৎ শ্রোতা হিসেবে তাঁকে শান্তিনিকেতনেই পূর্ণ মাত্রায় পাওয়া যেতো। জনসংযোগের ক্ষেত্রে তিনি চিরকালই আড়ষ্ট বোধ করেছেন। সুচিত্রা মিত্র একবার শ্রদ্ধেয় সুধীর চক্রবর্তীকে একটি সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেছিলেন 'সুদীর্ঘকাল ধরে যে গান গাইছি, গানের মাধ্যমে কি স্বদেশে কি বিদেশে যে বিভিন্ন ধরনের শ্রোতার সঙ্গে র্যাপোর্ট ঘটেছে সেটাই আমি মনেকরি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ও স্বীকৃতি।' সুচিত্রা সহজাত উদ্দীপ্ত ভঙ্গি তাঁর সব পরিবেশনায় অন্যতর মাত্রা যোজনা করতো। কিন্তু কণিকা নিজে স্বীকার করতেন উদ্দীপনার ভাব তাঁরস্বতঃস্ফূর্তভাবে আসেনা। তিনি সহজ থাকতে পারেন টপ্পাঙ্গে বা টানা, ঢিমে তালের রবীন্দ্রসঙ্গীতে। 'নীলাঞ্জন ছায়া', 'দূরে কোথায় দূরে দূরে', 'বন্ধু রহো রহো সাথে', 'আমি রূপে তোমায় ভোলাব না', 'তবু মনে রেখো', 'বাজে করুণ সুরে' এবং এজাতীয় অসংখ্য গান তাঁর কণ্ঠে অন্য মাত্রা, অন্য অনুভূতি নিয়ে আসে।
বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে কণিকার স্বাভাবিক কণ্ঠ পেলব, ললিত ও মাধুর্যময়। শৈশব থেকেই তিনি নিজের কণ্ঠ বা স্বরপ্রয়োগের সঙ্গে স্বচ্ছ্ন্দ গানগুলিতে সাফল্যলাভ করে এসেছেন। তাঁর গুরুরাওতাঁকে স্বরাজ্যে স্বরাট থাকারই শিক্ষা দিয়েছিলেন। যেসব গানের লয় বা ওজস্বিতা তাঁর কণ্ঠ বা গায়নরীতির সঙ্গে বেমানান, তিনি সাধারণভাবে সেই সব গান এড়িয়ে এসেছেন। তাঁর এই বিবেচনা তাঁকে যে শুধুস্বাচ্ছন্দ্য বা আত্মবিশ্বাস দিয়েছে তাই নয়, শ্রোতাদের জন্যও তা স্বস্তি ও শান্তির আশ্বাস বয়ে এনেছে। তাঁর অনন্যতা, অকারণ 'পরীক্ষা'র দ্বিধায় ব্যাহত হয়নি। তাঁর প্রথম জীবনের বালিকাসুলভ আধোউচ্চারণ বা অতিরিক্ত ললিত সুরক্ষেপ কীর্তনাঙ্গ গানগুলিতে মানিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে গীত গভীর ভাব ও দ্যোতনাময় গানগুলির জন্য তা ছিলো অনুপযুক্ত। সময়ের সঙ্গে তাঁর গায়নভঙ্গি, উচ্চারণ,উদ্দীপনা ক্রমাগতভাবে পরিশীলিত হয়েছিলো। তাঁর কণ্ঠের টিম্বার অবিশ্বাস্যভাবে বয়স ও দেহকষ্টকে অস্বীকার করে একইরকম স্ফূর্ত থেকে গিয়েছিলো। তাঁর গুণমুগ্ধ অপার শ্রোতাসমূহ কখনও তাঁরনিবেদনে বিন্দুমাত্র আলস্য বা আতিশয্য খুঁজে পায়নি।
তাঁর স্বভাবধর্ম সমকালীন শান্তিনিকেতনের স্থিতধী, শান্তিকল্যাণ আবহের পুণ্যে গড়ে উঠেছিলো। বহির্জগতের ঘটনার ঘনঘটা বা অস্থির চাঞ্চল্য, তাঁর আত্মমগ্ন শিল্পীসত্ত্বার অন্দরমহলে কখনও বিড়ম্বনা ঘটায়নি। ফলত তাঁর গীতনিবেদনে স্থৈর্য, শান্তি বা স্বস্তির ইশারা সর্বময়। শ্রোতাদের বিক্ষিপ্ত, অশান্ত চিত্ত বা শ্রবণে তা শুশ্রূষার আশ্বাস এনে দিতো। তাঁর এই সিদ্ধির গভীরে ছিলো আজন্মকাল কবিপ্রস্তাবিত'আনন্দ সর্বকাজে' মন্ত্রটির প্রতি প্রশ্নহীন সমর্পণ। শান্তিনিকেতন নামক ছোট্টো ভৌগলিক আবেষ্টনীটির মধ্যে সারাবিশ্বকে নীড় বেঁধে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন কবি । তার ফলে পরবর্তীকালে ঐসেরিব্রাল আবহে একধরনের ব্যতিক্রমী, গভীর আনন্দধ্বনি প্রত্যক্ষ হয়েছিলো। কণিকা ছিলেন সেই আবহের পূর্ণ পুণ্যভাগী। তিনি আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছিলেন অবলীলায়। নিজস্ব গুণবত্তা ও শ্রমেসেই সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতেও তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।
তাঁর কণ্ঠস্বরে সুর লাগানোর অননুকরণীয় ভঙ্গিটি বিষয়ে অতনু চক্রবর্তীর ভাবনা লক্ষণীয়। 'কণিকার সহজাত কণ্ঠ তন্ত্রবাদ্যের বিধিগত বৈশিষ্ট্যের অনুসারী। শৈশব থেকেই পিতৃদেবের এস্রাজবাদন শ্রবণেরসূত্রে বা পরবর্তীকালে বিশিষ্ট এস্রাজবাদক অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তালিমের সুবাদে এবং শৈলজারঞ্জনের বিশ্বস্ত যন্ত্রটির সান্নিধ্যে থাকার ফলেই হয়তো এস্রাজের ধ্বনিময়তা, সুরের তীক্ষ্ণঅন্তর্মুখীভাব কণিকার কণ্ঠে গেঁথে গেছে।'
দীর্ঘকাল ধরে রসিকজনের, যেমন মনস্ক শ্রোতা ও মেধাবী গুণীজন, উভয়ের আপ্লুত সাধুবাদের পরম্পরা লক্ষ্য করলে বোঝা যায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাঙ্গীতিক সিদ্ধি কোনও আকস্মিক উপলব্ধি নয়। তিনি একবার বলেছিলেন, 'আমি যেন দুটি সত্তার মধ্যে আন্দোলিত-যখন প্রাত্যহিক প্রয়োজনের মধ্যে জড়িয়ে থাকি তখন একরকম, আর বাইরে বেরিয়ে শান্তিনিকেতনের পথে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে, গানের মধ্যে ডুবে থাকার সময়ে আরেকরকম।' এই সাঙ্গীতিক বোধ ও পথ নির্মাণের উৎস ছিলো কবির গান নিয়ে তাঁর নিজস্ব দর্শন ও প্রয়োগকৌশল। তিনি কবির গানকে বৃহত্তর অর্থে প্রকৃতির হাতে গড়া একটি শিল্পসুষমা হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর উক্তিটি অনুধাবনীয়। ' আমি তো শুধু তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই। তাঁর গান যখন গাই, তখন সেই সুরের সঙ্গে, কথার সঙ্গে আর প্রকৃতিরসঙ্গে যেন কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনা।'
তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো, 'গান থেকে অবসর নেবেন কবে ভাবছেন?' তিনি আর্তকণ্ঠে বলেছিলেন,' অবসর নেবার কথা ভবতে পারিনা। গান আমাকে গাইতেই হবে। গান ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই নেই।'
প্রশ্নকর্তা সুধীর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, 'এমন মর্মস্পর্শী সত্যভাষণ জীবনে বেশি শুনিনি।'
0 comments: