0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক


সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত

৫ 

পরদিন সকালে ফ্রান্সেস্কো নিয়মমাফিক গির্জাঘরে সমবেত উপাসনায় পৌরোহিত্য করবার পরে, অল্প দুটি কিছু মুখে দিয়ে নগরপালের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। সকাল সকাল না গেলে নগরপালকে ধরা যাবেনা। কারণ, সে প্রতিদিন লুগানোতে চলে যায়। লুগানো হ্রদের পাশে, জনবহুল ব্যস্ত এলাকায় তার একটা নামকরা বিপণি আছে যেখানে খুচরো কিংবা পাইকিরি দরে ইতালিয়ান টিসিনো চীজ বিক্রি হয়। রোজ সকালে ট্রেন ধরে সে সোয়ানা থেকে লুগানোতে যায়। 

সূর্যের আলো এসে পড়েছে চৌমাথার মোড়ের চেস্টনাট গাছগুলোর গায়ে। রাস্তার দু’ধারের গাছগুলোতে তখনও বসন্তের নতুন পাতা আসেনি। এই রাস্তাটা গির্জার থেকে বেরিয়ে সোজা গিয়েছে গ্রামের একদম কেন্দ্রে, ফাঁকা মাঠের দিকে। বাচ্চারা মাঠে খেলছে। পাশে পাহাড়ি ঝর্ণা বয়ে চলেছে। গ্রামের মায়েরা এবং বড় মেয়েরা সেই জলে কাচাকুচি সেরে নিচ্ছে। মাটিটা তখনও ভিজে ভিজে রয়েছে, কারণ আগের দিনই প্রবল শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। এই সবকিছুর পাশে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে মাউন্ট জেনারাসোর টাটকা তুষারে ঢাকা শিখর, পাশে গভীর দুর্গম গিরিখাতে পাহাড়ের চুড়ার ছায়া পড়েছে। 

যারা কাচাকুচি করছিল সেই মহিলাদের পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছিল ফ্রান্সেস্কো। তাকে দেখে সবাই চঞ্চল হয়ে উঠছিল। যাজককে ‘সুপ্রভাত!’ ইত্যাদি নানা শুভেচ্ছায় সম্ভাষণ করছিল। বারে বারে উচ্চস্বরে ভেসে আসা শুভেচ্ছাবার্তার উত্তরে মাথা নাড়ছিল সে। মাঝে মাঝে চশমার ভারি কাচের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে, একটু একটু মুখ তুলে হাত নাড়ছিল সে। 

গ্রামে চওড়া রাস্তা সেরকম নেই বললেই চলে। প্রধান মাঠ থেকে বেরিয়ে কিছু সরু সরু রাস্তা গিয়েছে পাড়াগুলোর মধ্য দিয়ে। গ্রাম বাইরের রাস্তা ভীষণরকম খাড়াই। কোনো গাড়িঘোড়া চলা প্রায় অসম্ভব। শুধু কিছু পাহাড়ি মালবাহী খচ্চর নিয়ে চলা যেতে পারে সেই দুর্গম পথে। গ্রামের একদম প্রান্তে সরু রাস্তার ধারে একটা টুকিটাকি জিনিসের দোকান আছে; আর আছে একটা পোস্ট অফিস, অবশ্য সেটা ইতালির মধ্যে নয়, সেটা সুইজারল্যান্ডের সীমানার মধ্যে। 

পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে বেরোবার সময় পোস্টমাস্টার ফ্রান্সেস্কোকে শুভেচ্ছা জানালো। ফ্রান্সেস্কো প্রত্যুত্তর দিলো। কিন্তু বোঝা গেলো কোথায় যেন একটা নিরাপদ দুরত্ব আছে। লোকটা ধর্মভীরু, সেইজন্য যাজককে শুভেচ্ছা জানালো। ফ্রান্সেস্কো তার স্বভাবগত ঔদার্যে উত্তর দিলো, কিন্তু সেখানেও একটা দুরত্ব ছিল। আসলে এই পোস্টমাস্টার ফ্রান্সেস্কোর পূর্বসূরির বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিল।

পোস্টঅফিস ছাড়িয়ে ফ্রান্সেস্কো একটা সুঁড়িপথ দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে লাগলো ধাপে ধাপে পাহাড়ের গা বেয়ে। সেই পথের গায়ে গায়ে পাহাড়ের গুহা দেখা যাচ্ছিল। সেই গুহাগুলোর কোনো জানালা নেই, নোংরা, শীতল, অপরিসর, অন্ধকার। সেখানে কি কোনো মানুষ থাকতে পারে? মুরগির ডাক শোনা যাচ্ছিল, পচে ওঠা আধখাওয়া ভুট্টার শিষের স্তুপের উপরে বিড়াল বসেছিল; ছাগল, ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছিল- যেগুলো কোনো কারণে চওড়া সবুজ উপত্যকার দিকে যেতে পারেনি। ব্যা-ব্যা আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। 

যে কেউ অবাক হয়ে যাবে, যখন কেউ ওরকম একটা নোংরা, দুর্গন্ধময় পরিবেশের মধ্য দিয়ে হেঁটে এসে নগরপালের প্রাসাদোপম বাড়িতে ঢুকবে। ঢুকবার পথ অপরিসর হলেও পাহাড়ের ধাপে চওড়া একটা অংশে নগরপালের বাড়ি। বসবার ঘরের সিলিং টিপোলোর বিখ্যাত শিল্পীদের করা রঙিন পেইন্টিং দিয়ে সাজানো। উঁচু ছাদ, আলোকিত ঘরে কাচের বিশাল বিশাল জানালায় ভারি ভারি লাল পর্দা ঝুলছে। সামনের চওড়া খোলা আঙিনায় কাঠের বেঞ্চ, পুরানো আমলের কাঠের কাজ করা আসবাব। পিছনে আল্পসের দৃশ্য, আবহে ভেসে আসছে ঝর্ণার কুলুকুলু ধ্বনি। 

নগরপাল মধ্যচল্লিশের এক শান্ত সুবেশ সুপুরুষ। সবে মাসতিনেক হল সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। তার বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে ফ্রান্সেস্কো প্রথমেই দেখতে পেলো নগরপালের বছর বাইশের সুন্দরী সদ্যতরুণী স্ত্রীকে; সে আঙিনার সামনে খোলা রান্নাঘরে, প্রাতরাশ বানাতে ব্যস্ত ছিল। ফ্রান্সেস্কোকে সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে গেলো তার স্বামীর কাছে। নগরপালের কাছে ফ্রান্সেস্কো গত সন্ধ্যার ঘটনা জানালো। জানালো সেই অদ্ভুত বুনো দেখতে মানুষটার কথা, চিরকুটে লেখা সেই নামটাও দেখালো। সব জেনে এবং দেখে নগরপালের মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো। তবুও গাম্ভীর্যের আবরণটা পুরোপুরি সরে গেলনা তার মুখমণ্ডল থেকে। রহস্যময় সেই অদ্ভুত মানুষটি সম্পর্কে যা জানে, সে সেটাই বলতে শুরু করলো ফ্রান্সেস্কোকে। 

‘লুসিনো স্কারাবোটা’... বলে উঠলো নগরপাল... ‘লোকটার নাম লুসিনো স্কারাবোটা যে আগের সন্ধ্যায় দেখা করতে এসেছিল আপনার সঙ্গে। নিঃসন্দেহে লোকটা গরিব! একেবারে হতদরিদ্র!’ থামেনা নগরপাল... ‘তবে ওর যা অবস্থা, সেটা সমাজের অনেকেরই মাথাব্যথার কারণ! কিন্তু শেষ অবধি ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা আমরা কেউ জানিনা! লোকটা এখানকার আদি বাসিন্দা। সম্ভবত মিলানের বিখ্যাত স্কারাবোটা বংশের রক্ত আছে লোকটার শরীরে। যারা চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর বিখ্যাত কোমো ক্যাথিড্রাল বানিয়েছিল, তাদের কেউ হবে। বুঝতেই পারছেন যাজকমশাই, আমাদের সোয়ানা এইরকম ছোট জায়গা হলেও, এইসব আদি এবং বিখ্যাত লোকেদের নাম ধাম অনেকেই জানে।’ কথা বলতে বলতে নগরপাল কাচের দরজাটা খুলে সামনের খোলা আঙিনায় বেরিয়ে এলো। হাত সামান্য তুলে অঙ্গুলিনির্দেশ করে দেখালো জলপ্রপাতের উৎসের দিকে। সেখানে পাহাড়ের গায়ে কিছু গুহার মধ্যে এবং আশেপাশে ডেরা আছে, হয়তো চাষাভুষো মানুষেরা থাকে সেখানে। কিন্তু ঐরকম উচ্চতায়, গ্রাম থেকে দূরে, উপরে দুর্গম জায়গায় ঘরগুলো থাকা সত্যিই অদ্ভুত। দূর থেকেই ফ্রান্সেস্কোর মনে হল ঘরগুলো খুবই ছোট এবং একেবারে সাধারণ! 
-‘দেখছেন? ঐ যে’ আঙুল তোলে নগরপাল, ‘ঐখানে, ওইখানে থাকে স্কারাবোটা!’ 

-‘আমার একটু আশ্চর্য লাগছে যাজকমশায়, যে আপনি এখনো আল্পসের এই অঞ্চল সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন না!’ নগরপাল বলে যায়... ‘আপনি হয়তো জানেন না যে ওদের ব্যাপারে আশেপাশের মানুষ ভীষণ অসন্তুষ্ট! হ্যাঁ, প্রায় এক যুগ ধরেই মানুষ ক্ষেপে আছে। দুর্ভাগ্যবশত, মানুষকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায়না। ঐ পরিবারের মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। বিচার অবধি গড়িয়েছিল ব্যাপারটা। আপনি জানেন না সে এক সাঙ্ঘাতিক অদ্ভুত কাণ্ড! সেই মহিলা স্বীকার করেছিল যে যার সঙ্গে সে বসবাস করে, সেই লোকটি তার সাত বাচ্চার বাপ নয়। হ্যাঁ, সেই লোকটা নয়, বরং, যেসব সুইস ট্যুরিস্টরা গ্রীষ্মে আল্পসে বেড়াতে যায়, মানে জেনারাসোর পর্বতারোহী যেসব যায় প্রতি মরশুমে, তারা... হ্যাঁ, তারা... মানে বুঝতে পারছেন তো? তার উপরে সেই ডাইনিটা নাকি ভীষণ নোংরাভাবে থাকে, গায়ে নরকের দুর্গন্ধ এবং দেখতেও খুব কুৎসিত। ... না, এটা নিশ্চিত যে, যে লোকটা গতকাল আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল সে ঐ বাচ্চাগুলোর বাপ নয় এবং আরেকটা ব্যাপার হল যে ঐ লোকটা নাকি আবার সম্পর্কে ডাইনিটার আপন ভাই হয়।’ 

তরুণ যাজকমশায়ের ফ্যাকাসে মুখ ক্রমে আরও ফ্যাকাসে হয়ে যেতে লাগলো। 

…‘অবশ্যই আপনি জানেন যে সারা পৃথিবীতে এইরকম পাশবিক মানুষদের সমাজে একেবারে বর্জন করা হয় কিংবা একঘরে করে রাখা হয়। আর তাছাড়া সংখ্যাগুরু মানুষের ইচ্ছেটাই এখানে মেনে চলা হবে, তাই নয় কি?’ নগরপাল আরও ব্যাখ্যা করতে থাকে… ‘এদের বাচ্চাদের লোকে দেখলেই ঢিল মারে। কোনো গির্জায় এদের ঢুকতে দেওয়া হয়না। এটা নিয়ে দুবার বিচারসভা বসেছিল; ঐ বদমাশ ভাই- বোনকে জনতা এমন হেনস্থা করেছিল যে ওরা কোনো গির্জায় আসবার সাহস পাবেনা আর!’ 

‘… আর তাছাড়া আপনি কি মনে করেন যে এতে কেউ মত দেবে?’ নগরপাল থামেনা… ‘ভদ্র সভ্য ক্রিশ্চান পরিবারের বাচ্চাদের পাশে এক বেঞ্চিতে ঐ অভিশপ্ত জানোয়ারের বাচ্চাগুলোকে আমাদের গ্রামের গির্জার পাঠশালায় কেউ বসতে দেবে? আমরা কি চাইবো যে আমাদের গ্রামের পরিবেশ ঐ জঘন্য, কুৎসিত নোংরা পশুদের জন্য দূষিত হয়ে যাক?’ 

(চলবে) 
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 

0 comments: