0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in


অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৬

এবারের কিস্তিতে রয়েছে পৃথিবীর সবগুলি মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব: এশিয়া, ইয়োরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং ওসিয়ানিয়া। সব মিলিয়ে ছয় মহাদেশের আটজন কবি।

যুগোস্লাভিয়ার কবি ইভান লালিচের শৈশব কেটেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকার কালো ছায়ায় -- রাত্তিরে তাঁর ঘুম ভাঙতো জঙ্গিবিমানের প্রচণ্ড আওয়াজে। তাঁর প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু হয় নাৎসি বিমানহানায় বোমার আঘাতে -- “মরচে পড়া সূচ“ কবিতার সেটি বিষয়বস্তু। যুদ্ধ শেষের ঠিক পরেই যক্ষ্মারোগে মারা গেলেন তাঁর মা। বিষণ্ণতার স্মৃতি তাঁর কবিতার সর্বাঙ্গে। স্লাভ ভাষায় লেখা তাঁর মণিমুক্তাগুলি ইংরেজি ভাষার পাঠকদের কাছে উপস্থাপিত করেছেন মার্কিন কবি চার্লস সিমিক, যাঁর জন্ম সার্বিয়ায়।

“মৃত্যু এক মহান শিল্প; আমি সেই শিল্পে পারদর্শী,” স্বীকারোক্তি মূলক কবিতায় জোয়ার তুলেছিলেন সিলভিয়া প্লাথ, কিন্তু তাঁকে গ্রাস করে তাঁর মানসিক বিষাদ। বৈদ্যুতিক শক দিয়ে চিকিৎসা করেও কোনো উপকার হয়নি। কবি স্বামী তাঁকে ছেড়ে যাওয়ার পর তাঁর অন্তহীন নৈরাশ্য ঈগলের নখর হয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে তাঁর হৃদয়। আর উপায় থাকে না দৃঢ় পায়ে আত্মহননের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া।

প্লাথের মতোই আরও দুই অকালমৃতা কবি: ইরানের ফরাঘ ফারোখজাদ এবং আর্হেন্তিনার আলেহান্দ্রা পিসারনিক। ইশ্বরের বিধানে তাঁদের তিরিশের দশক পার হওয়া নিষিদ্ধ। তবে শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে পঁচাশি বছর পূর্ণ করলেন ফ্লোর অ্যাডকক। তাঁর লেখনী এখনো সক্রিয়।

রাশিয়া এবং আমেরিকা, এই দুই দেশের মাটিতে বসে লেখা কবিতায় পঞ্চাশটির বেশি কাব্যগ্রন্থ ভরিয়ে ফেলেছিলেন ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো -- কিন্তু তার মধ্যেই সময় করে নিয়েছিলেন চার চারটি বিবাহের এবং আরও অসংখ্য নারী সংসর্গের। বর্ণময় ব্যক্তিত্বের প্রতিবাদী কবি।

সারাটা জীবন প্রতিবাদেই কেটেছে ইন্দোনেশিয়ার ডব্লিউ এস রেন্দ্রা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাডাম স্মলের। একজন একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আর অন্যজন বর্ণবৈষম্যের। দ্বিতীয়জন জীবৎকালেই দেখে গিয়েছেন বর্ণবৈষ্যমের সমাপ্তি।

আসুন, আরও এক ঝাঁক কবির প্রেমের কবিতা পড়া যাক।

ইভান লালিচ: (সার্বিয়া, ১৯৩১-১৯৯৬)

মেলিসা সনেটগুচ্ছ থেকে

।।১।।

মৌমাছি 

মেলিসা, তোমার তনু মেলে ধরে মৌমাছির ডানা।
হে ভীত পুষ্পের ক্ষীণ গোপনতা, বিশুদ্ধ হুতাশ,
হে আঁখি, হে মেঘমেদুর দ্রাক্ষাফল, পেকে ওঠো,
দূরগামী দৃশ্যকুল, নাড়ি ছেঁড়া শিশুর মতন।

ঈশ্বরকে লজ্জা দেয় অন্ধকারে সোনালি শোণিত,
আমাকে অমোঘ হাতে শাস্তি দিল তার উপস্থিতি,
হে ধ্বনি, জড়িত রক্ত, প্রসারিত হোক তব শাখা 
গভীর গোপনে হোক বিয়োগান্ত নব রূপান্তর।

এমন রক্তের রঙে আঁকা হয় গ্রীষ্মের বিকেল 
দৃশ্যের অদূরে রক্ত ঝরে যায় আলোকের থেকে 
আমার অঙ্গুলি ভাঙে ভয়ঙ্কর অলঙ্ঘ্য দেয়ালে 

কিন্তু সে ভঙ্গুর হস্ত আবার কর্মঠ হতে পারে 
সন্ত্রস্ত মূক আননে অলৌকিক স্বর্গীয় শুভ্রতা 
তবে তনুলতা ছুঁলে, আসলে তা মৌমাছির ডানা।


।।২।।

রুটির গোপনতা 

তোমার গোপন বার্তা শোনাও আমাকে, হে মেলিসা,
যে সুখ আবেশ, তাকে ভালোবাসি, তুমি সেই সুখ।
প্রাগৈতিহাসিক স্তম্ভ ধসে যায় শহরে অন্তরে।
অসংখ্য ভুতুড়ে বাড়ি আমার সত্তায় বাস করে।

আকাশের কালো চাঁদ নি:শব্দে নামিয়ে দেয় ঝুরি
শক্ত স্তরে জমে থাকা বংশগত বিষাদকে ছুঁয়ে,
একশৃঙ্গ অহমিকা, রক্তকেশী মাথা রাগে দোলে 
হতবুদ্ধি বিদ্ধ করে নি:শ্বাসের কৃশ এলাকাকে।
সতত গোপন তুমি, হে মেলিসা, বন্ধুদের ডেকে 
বলে দেব, দিগন্তে পাহাড় কাঁপবে তোমার সোহাগে।
পরিণত গুপ্তকথা, প্রয়োজন তার নি:সন্দেহ,

সমুদ্রের দাঁত ঘিরে বৃত্তের মতন জলধারা,
মহৎ সৃষ্টির পূর্বে সংগোপন নিহিত ভূমিকা,
সীমারেখা স্থির নয় ছত্রাক ছড়ানো পীত রুটি।

[সার্বিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রধান কবি। এগারোটি কাব্যগ্রন্থ। যুগোস্লাভিয়ার লেখক ইউনিয়নের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছেন অনেক বছর। ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান ভাষা থেকে অসংখ্য কবিতার অনুবাদ করেছেন মাতৃভাষায়; স্মৃতি এসে ভিড় করে তাঁর কবিতায়: “Memory: fragile in the face of the collapse of civilisations, but all we have. Memory allows the poet to recreate brief instants of personal joy as well as to conjure up a sense of the distant past. It allows each of us, as individuals condemned to solitude, to connect with a shared inheritance and feel, for a moment, part of a larger whole.’’ স্লাভ ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন চার্লস সিমিক।] 

সিলভিয়া প্লাথ: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৩২-১৯৬৩)

চিরকুমারী 

সেদিন, বিশেষ করে সেই মেয়েটি
তার নতুন প্রণয়প্রার্থীর সঙ্গে 
খুব ধুমধামে বেড়াতে গেল বসন্তের বিকেলে 
তারপর হঠাৎ, নিজেকে বাঁধা পড়তে দ্যাখে 
পাখিদের অনিয়মিত কিচিরমিচির 
আর ঝরাপাতার জঞ্জালে।

এই আলোড়নে পীড়িত মেয়েটি 
লক্ষ্য করে তার প্রেমিকের এলোমেলো চলাফেরা,
ঘুচে গেছে তার গতির ছন্দ 
এসেছে ফুল আর লতাপাতার পাগলামি;
সে তাকিয়ে দ্যাখে ফুলের দিশেহারা পাপড়ি,
পুরো ঋতুটাই অসুখী।

তখন শীতের জন্যে তার তীব্র প্রার্থনা!
হিসেবি সাবধানতা চারপাশে ছড়ানো 
বরফ আর পাথরের 
শাদা ও কালো; প্রতিটি ভাবের চতুর্দিকে,
পাড় বসানো আর হৃদয়ের শীতল শৃঙ্খলা 
তুষারপালকের মতন খুঁতহীন।

কিন্তু এখানেই -- উদ্ভিন্ন হয় সে 
বিদ্রোহে, ভালোবাসায় জ্ঞানগম্যি হারায় 
অশ্লীল আনন্দে মাতে --
পৃথিবীতে জন্মানোটাই বেওকুফি; বোকারাই 
ইচ্ছেমতো ডুবে যাক উদ্দাম উল্লাসে;
সে সরে আসে নিখুঁতভাবে।

বিরূপ আবহাওয়ার প্রতিরোধে যেমন 
তার গৃহের চারপাশে সে দেয়াল আর 
কাঁটাতারের বেড়া বাঁধে 
কোনো সাহসীতম পুরুষও তাকে ভাঙতে পারবে না 
শাপশাপান্ত, হুমকি বা ধোলাইয়ের ভয় দেখিয়ে 
এমনকী প্রেম দিয়েও না।

[অকালমৃত কবি, ঔপন্যাসিক ও শিশুসাহিত্যিক। অসম্ভব প্রতিভাবান অথচ মানসিক পীড়াগ্রস্ত। ১৯৫৬ সালে বিয়ে হয় ব্রিটিশ কবি টেড হিউজের (১৯৩০-১৯৯৮) সঙ্গে। তিরিশ বছর বয়েসে তিনি আভেনের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে পুরোদমে গ্যাস চালিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় উপন্যাস “বেলজার” (১৯৬৩) এবং কাব্যগ্রন্থ “এরিয়েল” (১৯৬৫)। কবিতাটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত “কবিতা সমগ্র” থেকে নেওয়া।]

ইয়েভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কো: (রাশিয়া, ১৯৩৩-২০১৭)

প্রেমিকা আসবে 

বেলা আখমাদুলিনার জন্যে 

প্রেমিকা আসবে, প্রেমিকা আসবে দ্বারে,
দুহাতে জড়াবে, দুহাতে জড়াবে আমায়, 
দেখবে কেমন পাল্টেছে পরিবেশ,
বুঝবে আমার হৃদয়ের ওঠানামা।

বাইরে আঁধার, বৃষ্টির ঘনঘটা,
খোলা রয়ে যাবে ট্যাক্সির দরওয়াজা,
লাফে লাফে সিঁড়ি একপা, দুইপা, তিন,
উচ্ছ্বাসময়, কামনায় থরোথরো।

কড়া না নেড়েই ঘরে ঢোকে ভেজা মেয়ে,
কোলে তুলে নেয় আমার উপোসি মাথা,
চেয়ারে এলানো নীল রঙা ফার কোট 
মহাসন্তোষে স্খলিত শান্ত মেঝেয়।

টীকা:

বেলা আখমাদুলিনা (১৯৩৭-২০১০): কনিষ্ঠা রুশ কবি, বান্ধবী, সখা, প্রেমিকা। ১৯৫৪ সালে তাঁদের বিয়ে -- একজনের বয়েস একুশ, অন্যজনের সতেরো। পাঁচ বছরের সন্তানহীন বিবাহজীবন।

বেলার একটি বিখ্যাত উক্তি: কবিতা তখনই লিখবে, যখন আর উপায় থাকবে না, না লিখে। না হলে লিখবে না। “If there is a choice, don’t”.

[কবিতার রচনাকাল ১৯৫৬। রুশ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ আলবার্ট সি টড।]


অপেক্ষা

আমার প্রেমিকা আসবে
দুহাত বাড়িয়ে আমাকে ভরে নেবে তাতে,
অনুভব করবে আমার ভয়, লক্ষ করবে পরিবর্তন।
বাইরের ঘন অন্ধকার থেকে, ঘুটঘুটে রাত্তিরে 
ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করার জন্যে মুহূর্তটুকুও না থেমে 
ভাঙাচোরা বারান্দা পেরিয়ে হে ছুটবে সিঁড়ি বেয়ে 
ভেতরে জ্বলবে প্রেম আর প্রেমের সোহাগ,
ভেজা পোশাকে উঠে আসবে সে, দরজায় ধাক্কা না দিয়েই 
ঢুকবে আর দুহাত দিয়ে ধরবে আমার দুগাল,
তারপর খেয়াল হলে ওভারকোট খুলে চেয়ারে রাখবে,
কিন্তু তা পিছলে পড়বে নীল স্তূপের মতন।

[রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় জন্ম এই কবির। বাবা ছিলেন ভূতাত্ত্বিক। কবিতা রাজনৈতিক এবং বর্ণনাধর্মী -- কবিতার মাধ্যমে গল্প বলেন তিনি -- নিপীড়িত মানুষজনের কথা। বিতর্ক তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফেরে সবসময়। অনেকগুলি গান রচিত হয়েছে তাঁর কবিতায় সুর দিয়ে। পঞ্চাশটির বেশি কবিতার বই, তা ছাড়াও উপন্যাস, গল্পসংকলন ও প্রবন্ধগ্রন্থ। দ্বিতীয় কবিতাটি প্রথম কবিতার পুনর্লিখন, কবিতাটি ১৯৬২ সালে প্রকাশিত “নির্বাচিত কবিতা” থেকে নেওয়া। রুশ ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন রবিন মিলনার গাল্যান্ড এবং পিটার লিভি।]

ফরাঘ ফারোখজাদ: (ইরান, ১৯৩৪-১৯৬৭)

দম্পতি 

রাত আসে
আর রাত পেরিয়ে অন্ধকার
আর অন্ধকার পেরিয়ে 
চোখ 
হাত 
আর নি:শ্বাসের ওঠা, পড়া, ওঠা, পড়া …….
আর জলের শব্দ 
কল থেকে ঝরে যায় ফোঁটার পর ফোঁটা

তারপর 
দুই লাল আলোর বিন্দু 
দুটি সিগারেট 
ঘড়ি টিকটিক 
আর দুই হৃদয় 
আর দুই নীরবতা 
আর দুই নির্জনতা 

[ইরানের নারীবাদী কবি এবং চিত্র-পরিচালক। তাঁর কবিতা প্রতিবাদ জানায় মানবিক উন্মোচনের মাধ্যমে। মাত্র ৩২ বছর বয়েসে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগেই তিনি বিতর্কিত ও সমালোচিত। আয়াতোল্লাহ খোমেইনি ইরানে ক্ষমতা দখল করার পরে তাঁর কবিতা সারা দেশে নিষিদ্ধ করেছিলেন এক দশক। এখন তিনি মধ্যপ্রাচ্যে বহুপঠিত এবং সম্মানিত। কবিতাটির ফার্সি ভাষা থেকে ইংরেজি করেছেন হাসান জাভাদি ও সুসান স্যালি।]

ফ্লোর অ্যাডকক: (নিউজিল্যান্ড, ১৯৩৪- )

সুখী সমাপ্তি 

সঙ্গমের পালা শেষ হলো কি না
প্রেমিকা চাদর টেনে মুখ ঢাকলো
যতক্ষণ না প্রেমিকের জামার বোতাম লাগানো শেষ:
শরীর দেখতে লজ্জা নেই দুজনেরই --
একটু আগেই উদ্দাম হয়েছিল যারা -- এখন
ক্ষমা চাওয়ার দুর্বল প্রচেষ্টা।

এরকম অপরিচ্ছন্ন কাজকর্মে ঘৃণা তাদের
তবু তারা কয়েকদিন পরে আবার দেখা করতে রাজি হয়,
কারণ এই ঘৃণা থেকেই তাদের আকর্ষণ, তখন
হাতে হাত রেখে খুনসুটি, স্মৃতিচারণ
আবার ঘনিয়ে ওঠে শরীরী প্রেম --
আর হয় না অনুকূল পরিণাম, 
অথবা বন্ধুত্ব।

[নিউজিল্যান্ডের কবি, কিন্তু অনেক দশক বাস করেছেন ইংল্যান্ডে। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি শিক্ষক এবং গ্রন্থাগারিকের কাজ করেছেন। নিউজিল্যান্ডের দুই বিখ্যাত লেখকের তিনি সহধর্মিনী। ভূষিত হয়েছেন দুই দেশের নানান পুরস্কারে। দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং মানবসম্পর্কের টানাপোড়েন তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। কবিতাটি ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত “নির্বাচিত কবিতা” থেকে নেওয়া হয়েছে।]

ডব্লিউ এস রেন্দ্রা: (ইন্দোনেশিয়া, ১৯৩৫-২০০৯)

বধূর জন্যে ঘুমপাড়ানি গান 

মেঘ ঝাঁকায়, বৃক্ষ দোলে,
পরিরা উড়ে যায় ডালপালার ফাঁকে:
নির্মল ঘন্টা বাজে দূরে।

আনন্দিত নির্জনতা, মধুর কামনা,
নেশার মত বাসনা, অভিলাষের ধূলি:
আমার বুকে মাথা রেখে শোও, হে প্রিয়তমা!

রক্ত লাল আকাশ, পত্রপুষ্পও গাঢ় লাল,
হৃদয় দোলে গাছের লালচে পাতায়
মন্ত্রের উচ্চারণে বাতাস ভারী।

নবীন স্বপ্ন, চাঁদের মতো স্মৃতিরা,
প্রেমের ব্যথা, উজ্জ্বল, ঝলমলে বিষাদ:
আমার বুকে স্বপ্ন রেখে শোও, হে প্রিয়তমা!

পৃথিবীর ঘুম ভাঙে,
দু:খ গলে গলে যায়:
আমি হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিই তোমায় 

নীরবতা আর ঘুম, ঘুম আর নীরবতা।
নীরবতাহীন মৃত্যু, মৃত্যুহীন নিদ্রা। 
আমার বুকে দু:খ রেখে শোও, হে প্রিয়তমা!

[উইলিব্রোদাস সুরেন্দ্রনাথ রেন্দ্রা ইন্দোনেশিয়ার কবি, নাট্যকার, অভিনেতা, সমাজকর্মী। জন্মসূত্রে ক্যাথলিক, কিন্তু ধর্মান্তরিত হন ইসলামে। সুহার্তো সরকারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেল খেটেছেন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্য খাতায় তাঁর নাম উঠেছে কয়েকবার। ভাষা ইন্দোনেশিয়া থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন বার্টন রাফেল।]

আলেহান্দ্রা পিসারনিক: (আর্হেন্তিনা, ১৯৩৬-১৯৭২)

চিহ্ন 

সবাই সঙ্গম করে নীরবে
তারা নীরবতার প্রতিশ্রুতি দেয় 
আগুনের মতন, ঘরভরা নীরবতা 

হঠাৎ মন্দির হয়ে দাঁড়ায় সার্কাস 
আলোকের ঢাক বাজে।

যৌনতা, নিশীথ 

আবার একবার, কেউ পড়ে যায় তার প্রথম পতনে -- দুই নগ্ন শরীরের পতন, দুটো চোখের, অথবা চারটে সবুজ চোখের অথবা আটটা সবুজ চোখের, যদি আমি আয়নার ভেতরে জন্মানো চোখগুলোকেও ধরি (মধ্যরাতে, বিশুদ্ধতম ভয়ে, সব হারাবার বিষাদে), তুমি চিনতে পারোনি তোমার নিজের অনুভূতিহীন নীরবতার কণ্ঠস্বর, চোখের সামনে ধরে তোমার নিজের পাগলামির অবকাশে লেখা পার্থিব বার্তাসমূহ, তোমার দেহ যেন একটা গেলাস, এবং নিজেদের আর অন্যান্যদের গেলাস থেকে আমরা পান করি এক অসম্ভব পানীয়।

অভিশপ্ত আসবের মতন অভিলাষ ছলকে পড়ে আমার দেহে। আমার এই তৃষ্ণার্ত তৃষ্ণায়, তোমার চোখের প্রতিশ্রুতি ছাড়া বাঁচবো কী করে আমি? আমি যা কিছুর কথা বলি, তারা কোনোমতেই এই পৃথিবীর না। আমি এমন কিছুর কথা বলি, যার অভিপ্রায় রয়েছে অন্য কোনোখানে।

অন্তহীন শুভ্র নিশীথের স্মৃতিতে নগ্ন হয়েছি আমি। আত্মহারা, বিভোর, আর আমি রাত ভরে মেতে থাকি নিবিড় সঙ্গমে, কামুক কুকুরের মতন।

কখনও কখনও একই রাতের অবকাশে, বাস্তবের আতিশয্য আঘাত করে আমাদের। পোশাক ছেড়ে ফেলে, আতংকিত আমরা। আরশির কঠোর পর্যবেক্ষণে কুন্ঠিত আমরা, বুঝতে পারি আমাদের ক্রন্দন, আমাদের গভীর ক্ষত জন্ম নেবে আরশির থেকে।

নিশীথ নিজেকে মেলে ধরে কেবল একবারই। তাই সই। তুমিও দেখো। তুমি তো দেখেছই। দুজনে একান্তে থাকার যে ভীতি, আরশির ভেতর হঠাৎ আমার চারজন। আমরা কাঁদি, আমরা চোখের জল ফেলি, আমাদের ভীতি, আমাদের আনন্দ যা আমাদের ভীতির চেয়েও ভয়ঙ্কর, আমার অশ্লীল চিৎকার, আমার মুখের অপশব্দেরা আমাদের যুগলকে চাবিবন্ধ করে দেয় আরশির ভেতর, কিন্তু কখনও আমাকে একা নয়। আমি জানি এই নিশীথের প্রকৃতি। আমরা পুরোপুরি তার চোয়ালের ভেতর বন্দী, এতটা গভীরে যে তারা অনুধাবন করে না এই ত্যাগস্বীকার, আমার সবদেখা চোখদুটোর এই অপবাদ। একটা আবিষ্কারের কথা না বলে পারিনা: বুঝতে পেরেছি, সঙ্গমের ভেতর আমি আর আমার ভেতরে সঙ্গম। এক মুহূর্তের ভয়ের হাত থেকে বাঁচতে আমি জীবনভর ভয়ের কথা বলে যাই। অনুপস্থিতির গহ্বর। কিন্তু কে বলবে: সারা রাত কেঁদোনা? সব পাগলামি আসলে মিথ্যে। যেমন নিশীথ। যেমন মরণ।

[এসপানিওল ভাষা থেকে প্রথম কবিতার অনুবাদ করেছে সুসান বাসনেট। ফরাসি ভাষা থেকে দ্বিতীয় কবিতার অনুবাদ করেছেন পাত্রিসিও ফেরারি।] 

[আর্হেন্তিনার অকালমৃত কবি। মৃত্যুর পরে প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়েও পাঠক মহলে জনপ্রিয়। এখনো প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত কবিতা, গদ্য, ডায়েরি এবং তাদের নতুন নতুন ইংরেজি অনুবাদ। সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক এই কবি জাতিতে রুশ, ধর্মে ইহুদি আর জন্ম আর্হেন্তিনায়। কলেজে ঢোকার এক বছর পরে প্রথম কাব্যগ্রন্থ: “স্থলভূমি পেরিয়ে” (“লা তিয়েরা মাস আহেনা”, ১৯৫৫)। দর্শনের পড়া শেষ না করেই আর্ট কলেজে শিক্ষা শুরু করেন। পরের বছর আরো একটি কাব্যগ্রন্থ: “অন্তিম অপাপবিদ্ধতা” (“লা উলতিমা ইনোসেনসিয়া”, ১৯৫৬)। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ তিনি বাস করেন প্যারিসে, সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন, সময় কাটান বিখ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্যে। ফরাসি মহিরূহদের কবিতা অনুবাদ করেন এস্পানিওল ভাষায়-- এমে সেজেয়ার, আন্তোনিন আরতো, ইভ বনেফয়, প্রমুখ। দেশে ফেরার পর আরো তিনটি কবিতার বই এবং দেশজোড়া খ্যাতি। ১৯৬৯ সালে গুগেনহাইম ফেলোশিপ, ১৯৭১ সালে ফুলব্রাইট জলপানি -- দুটি ঈর্ষণীয় সম্মান। কিন্তু পরের বছর গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্লিনিকে বন্দী। শরীর একটু ভালো হলে তাঁকে শনি-রবিবার বাড়ি আসতে অনুমতি দেওয়া হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, তিনি বাড়িতে “সেকোনাল” নামক ঘুমের বড়ি প্রচুর পরিমাণে খেয়ে আত্মহত্যা করেন।]

অ্যাডাম স্মল: (দক্ষিণ আফ্রিকা, ১৯৩৬-২০১৬)

আইনের কী হবে রে?

ডায়ানা শাদা চামড়ার মেয়ে 
মার্টিন কালো চামড়ার ছেলে 

তারা প্রেমে পড়লো 
তারা প্রেমে পড়লো
তারা প্রেমে পড়লো

ডায়ানার জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে 
আইনের কী হবে রে?
মার্টিনের জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে
আইনের কী হবে রে?
জনগণ সবাই বললে 
আইনের কী হবে রে?

ডায়ানা বলে, মার্টিন বলে 
কার আইন?
খোদার আইন 
মানুষের আইন 
শয়তানের আইন 
কার আইন?

কিন্তু লোকজন বক্তিমে শুরু করলে 
আইন 
আইন 
আইন 
আইন 
আইনের কী হবে রে?
আইনের কী হবে রে?

ডায়ানা শাদা চামড়ার মেয়ে 
মার্টিন কালো চামড়ার ছেলে

তারা জেলে গেল 
তারা জেলে গেল 
তারা জেলে গেল 

ডায়ানার জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে 
দ্যাখ, আগেই কয়েছিলাম তোদের
মার্টিনের জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে
দ্যাখ, আগেই কয়েছিলাম তোদের
জনগণ সবাই বললে 
দ্যাখ, আগেই কয়েছিলাম তোদের

ডায়ানা বলে, মার্টিন বলে
কী কয়েছিলে তোমরা?
কী কয়েছিল খোদা 
কী কয়েছিল মানুষ 
কী কয়েছিল শয়তান 
কী কয়েছিলে তোমরা?

কিন্তু লোকজন বক্তিমে শুরু করলে 
আইন 
আইন 
আইন 
আইন 
আইনের কী হবে রে?
আইনের কী হবে রে?

ডায়ানা শাদা চামড়ার মেয়ে 
মার্টিন কালো চামড়ার ছেলে

ডায়ানা গলায় দড়ি দিল 
মার্টিন গলায় দড়ি দিল 
দুজনেই গলায় দড়ি দিল 

ডায়ানার জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে 
খোদা রক্ষে করো 
মার্টিনের জ্ঞাতিগুষ্ঠি বললে
খোদা রক্ষে করো 
জনগণ সবাই বললে
খোদা রক্ষে করো 

ডায়ানা ও মার্টিন আইন ভেঙে মরলো 
খোদার আইন 
মানুষের আইন 
শয়তানের আইন 
কার আইন?

আর লোকজন বক্তিমে শুরু করলে 
আইন 
আইন 
আইন 
আইন 
আইনের কী হবে রে?
আইনের কী হবে রে?

[দক্ষিণ আফ্রিকার কবি, নাট্যকার, সমাজসেবী; ইংরেজি এবং আফ্রিকানস, দুই ভাষাতেই লেখেন। শ্বেতকায় সরকারের বর্ণবৈষ্যমের বিরোধিতায় তিনি ছিলেন অনমনীয়। তাঁর লেখা নাটকের অভিনয় দেশের সব রঙের চামড়ার মানুষ একসঙ্গে বসে দেখুক -- এই নিয়ে লড়াই করে সফল হয়েছিলেন তিনি। আফ্রিকানস (Afrikaans) ভাষা থেকে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ক্যারল লাস্কার।]

[ক্রমশ:]

0 comments: