গল্প - মনোলীনা রায় কুণ্ডু
Posted in গল্প
কাঠের পাল্লাটা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন অসীমা। ঢুকলেন তাঁর চল্লিশ বছরের সংসারের গন্ধমাখা ঘরে। ঘরটা একই রকম আছে, কিন্তু কাল থেকে আর থাকবে না। পায়ে পায়ে সোফাটার কাছে এগিয়ে গেলেন। স্প্রিং ভাঙা সোফা, মাটির ভাঁড়ে টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন, সোফা কাম বেড! যে দিন ঘরে এল, বুবুলের কী আনন্দ! সে রাতে ওটাতেই শুতে হয়েছিল ছেলেকে নিয়ে। মশারি টাঙাতে কী বেগই না পেতে হয়েছিল, ঘরের মাঝে কাঠের খুঁটিতে রাত দুপুরে পেরেক পোঁতা! হাতুড়ির শব্দে পাশের বাড়ির জানালা খুলে খোকনদা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কী হল গো বুবুলের মা?’’ উত্তর দিয়েছিল বুবুলের বাবা, ‘‘মায়ে-পোয়ে এ বার নড়বড়ে বাড়িটাকে ভাঙবে বলে উঠেপড়ে লেগেছে দাদা।’’ তার হাসিটা শুনতে পেল বুবুলের মা। ও মা, এত দিন এ সব কিছু তো মনে পড়েনি! মনের ভেতর ঘাপটি মেরে ছিল না কি! পা উঁচু করে পেরেকটাকে এক বার ছুঁয়ে দেখলেন বুবুলের মা। অনেক দিন পরে ওটাকে ছুঁলেন, ইদানীং ওটাকে ছোঁয়ার দরকারই হত না আর।
দুটো ঘর, বাইরের ঘরের ওই সোফাটার পাশেই কাচের শোকেস। বাড়িতে মিস্ত্রি ডেকে বানিয়েছিল বুবুলের বাবা, সেই ঠকঠকাস আজ কত দিন পরে শুনতে পাচ্ছেন অসীমা! মিস্ত্রির ফেলে যাওয়া পেরেক ফুটেছিল পায়ে, হঠাৎ সেই ব্যথায় অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল, বহু দিন আগে হারিয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্নটাকে পায়ের তলায় খোঁজেন অসীমা।
শোকেসটা ভরে উঠছিল বুবুলের প্রাইজে। বুবুল তখন ক্লাস ফাইভ, ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছিল। প্রাইজ নিয়ে ফিরল, আর সে দিনই সেই ভয়ংকর খবরটা সংসারে আছড়ে পড়ল। ফুসফুসে মারণ রোগ ধরা পড়ল বুবুলের বাবার। শোকেস খুলে প্রাইজটার গায়ে হাত রাখলেন অসীমা আজ, কত দিন পর! ঘুমন্ত বুবুলের পাশে বসে সে রাতে অঝোরে নিঃশব্দে কেঁদেছিল বুবুলের বাবা-মা, জড়িয়ে ছিল দুজন দুজনের হাত। ‘যেতে দেব না’ আর ‘যেতে দিও না’র আকুলিবিকুলি। খোলা জানালা দিয়ে নিঃশব্দে জ্যোৎস্না মশারির ভেতরে এসে বুবুলকে কেমন ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। আজ এ সব কেন মনে পড়ে যাচ্ছে! উঃ,কী কাশির শব্দ! কত নির্ঘুম রাত, বিছানায় ক্রমশ ছোট হয়ে যেতে থাকা একটা মানুষ! মাত্র দুটো মাস! ওই ব্যথানীল ঠোঁট, ওই আদরমাখা ঠোঁট আজ পঁচিশ বছর পর কেন ছুঁয়ে যেতে চায়? কোথায় ছিল এরা এত দিন? উঃ, ওই অসহ্য যন্ত্রণার শব্দ থেকে পালাতে এক চিলতে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালেন অসীমা। গ্যাসের ওভেনটা নেই, টেবিলের গায়ে পঁয়ত্রিশ বছরের স্মৃতির দাগ শুধু। বাসনের তাকটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। ব্যবহৃত, অব্যবহার্য, অপ্রয়োজনীয় কত কিছুর স্তূপ, সব ঝকঝকে। কোথাও যাওয়ার আগে একটা কাপড় দিয়ে তিনি ঢেকে যান বাসনগুলোকে। নন-স্টিক বাসন সবে উঠেছে তখন, মিলি দিয়েছিল। মিলি, অসীমার ননদ। মিলি, মিলি, কত্ত দিন মিলিকে দেখেন না অসীমা! সে এখন শয্যাশায়ী। ওই নন-স্টিক কড়াইটাও আর ব্যবহারযোগ্য নেই, নীচের কোটিং উঠে গেছে, বুবুলের বকুনিতে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই কাঁধভাঙা হাঁড়িটাও রয়ে গেছে। বিয়ের পর বুবুলের বাবার সঙ্গে মার্কেটিং... এখন সবাই অবশ্য শপিং বলে। আচ্ছা, শপিং বলে কেন? অনেক শপ নিয়েই তো মার্কেট, মানুষ কি একটাই দোকানে যায়? ধুর, যত্ত আজেবাজে ভাবনা। ওই মার্কেটিংয়ে গিয়ে হাঁড়ি আর কড়া কিনেছিলেন, খুন্তিও বোধহয় একটা, ঠিকঠাক মনে পড়ছে না। চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করলেন অসীমা। রিকশায় বরের সঙ্গে যাওয়া, উনি বলেছিলেন নীল তাঁতের শাড়িটা পরতে! সব মনে পড়ে যাচ্ছে। তখনও এ বাড়ি কেনা হয়নি, ভাড়া থাকতেন। যখন কেনা হল, শাশুড়ি আর দেওর এসেছিল দেশের বাড়ি থেকে। সবাই মিলে দুটো ঘরে। তখনও দেওরের ছেলেপুলে হয়নি। বুবুলকে নিয়ে দুই জা এক ঘরে, আর এক ঘরে মাকে নিয়ে দুই ভাই। দুই জায়ে মিলে শাশুড়ির নিন্দেমন্দ করেছিল, বেশ মনে পড়ে যাচ্ছে। একচোট হেসে নিলেন অসীমা।
স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তারজালি ঘেরা বারান্দার ও পারে এক চিলতে উঠোন, ওইখানটাতেই শেষ শুয়ে ছিল মানুষটা। সাড়ে পাঁচ ফুটের মানুষটা ছোট্ট হয়ে শুয়ে আছে, দেখতে পান অসীমা, কড়া ধূপকাঠির গন্ধটা অসীমাকে জাপটে জড়িয়ে উঠছে! উঠোন-ভর্তি বিরাট ঘাসের জঙ্গল, তার ভেতরে লুকিয়ে আছে ওই মাটিটুকু, ওই মাটিটুকু ছুঁয়েই তো শেষবারের মতো বেরিয়ে গেল মানুষটা। দরজার তালা খুলে উঠোনে পা রাখেন অসীমা। মাথার উপরে দুপুরের কড়া রোদ্দুর, ঘাসের আবরণ ভেদ করে ওই মাটিটুকুকে আর একবার, আর একবার, বারবার ছুঁতে চায় প্রাণ। কই,এত বছরে এ রকম করে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করেনি তো! বুক ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আজ! সেদিনও বুকভাঙা কষ্ট ছিল, কিন্তু তার উপরে ছিল ভয়! বুবুলকে বড় করার চিন্তা অস্থির করে তুলেছিল অসীমাকে। বুবুলের বাবার অফিসে চাকরিটা জুটে গিয়েছিল, শোকের দিকে তাকাবার আর সময়ই হয়নি! শোকও অভিমান করে দূরে সরে গিয়েছে। আজ একটু স্পর্শ পেতেই অভিমান ভুলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে তাঁকে, আজ বুক ফাটিয়ে জমাট কান্নাগুলোকে বার করে দিতে ইচ্ছে করছে অনেক দিন বাদে। কিন্তু ওই যে, অনভ্যাস! সেই শোকের কাছ থেকে পালানোর অভ্যাস! অসীমা ছুটে এসে দাঁড়ান বুবুলের ঘরে। বুবুল-বুবুল-বুবুল, এত বছর তো শুধু ওর জন্যেই বাঁচা। মাধ্যমিকে জেলায় প্রথম বুবুল— ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র বুবুল— লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক বুবুল— কলেজে জি এস বুবুলের পড়ার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ান বুবুলের মা। বুবুলের খাট, বুবুলের আলমারি! টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া ছেলেকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে অসীমার, পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে কড়া লিকার চা চাই ছেলের! অসাবধানে হাত লেগে চায়ের কাপটা উল্টে গেছিল একদিন, দাগটা রয়ে গেছে এখনও! দাগের গায়ে হাত বোলান অসীমা, কে বলে জলের দাগ স্থায়ী নয়! বুবুলের ঘরের পাশে এক চিলতে জায়গায় বুবুলের চাকরির টাকায় কেনা ফ্রিজ। মায়ের জন্মদিনে হঠাৎই ডেলিভারি হয়েছিল। বুবুল তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে। ভারী বকেছিলেন তিনি, রাগ করতেই ছেলে কোলে তুলে বাঁইবাঁই করে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ‘‘ওরে বাবারে’’— চিৎকার করে উঠলেন অসীমা, বন্ধ ঘরের দেওয়ালে ঝমঝমিয়ে উঠল কথাগুলো। পরের মাসেই টিভি, সাদাকালো বদলে রঙিন। খেলা আর সিরিয়াল নিয়ে মায়ে-পোয়ে সে কী ঝগড়া! একদিন ‘জননী’ সিরিয়াল দেখছেন, কথা নেই বার্তা নেই ছেলে এসে চ্যানেল ঘুরিয়ে দুম করে খেলা চালিয়ে দিল। রেগে রিমোট ছুড়ে ফেলেছিলেন অসীমা। বুবুল হাসতে হাসতে কেমন ক্যাচ ধরে নিয়েছিল, দৃশ্যটা মনে পড়তেই ফিক করে হেসে ফেললেন।
বুবুল যেদিন তিতলিকে প্রথম নিয়ে এল, সেদিনটাও বেশ মনে পড়ছে। ওদের সঙ্গেই চাকরি করে ছিপছিপে তিতলি, ছটফটে তিতলি— ভালই লেগেছিল অসীমার। সঙ্গে অবশ্য একটু মনখারাপও। বুবুলের ঘরে যখন-তখন আর ঢোকা যাবে না। তবে... না! তিতলি কখনওই বুবুলের ঘরের পাহারাদার হয়ে ওঠেনি অসীমার কাছে, বরং সঙ্কুচিত অসীমাকে দুজনের মাঝে টেনে নিয়েছে ওই বড়লোকের মেয়েটা। কী বিরাট বাড়ি থেকে এসেও স্যাঁতসেঁতে ঘরে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে, দেওয়ালের নোনায় ওর শাড়িগুলো যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, সেটাও খেয়াল করেনি সময়মতো! বুবুলের তো এই ছোট্ট শহরে আর কিছু করার ছিল না! কৃতী ছাত্রদের উপায় নেই নিজের ঘরটুকুতে থাকার। বুবুল পাড়ি দিল বম্বে— ‘মিম’ তখন পৃথিবীতে আসবে বলে জানান দিচ্ছে! তিতলিকে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, একলা বাড়িতে তিতলিকে নিয়ে থাকতেও ভয় লাগে অসীমার, কি জানি রাতবিরেতে যদি কিছু হয়, শুরু থেকেই কত রকম যে সমস্যা তিতলির! অতএব তিতলি গেল তার বাপের বাড়ি। বুবুল নেই, তিতলি নেই, অসহ্য একা হলেন অসীমা, এই প্রথম। একা এবং একা! সাজানো-গোছানো বাড়ির সব কিছুই সারা দিন নিশ্চল। জামাকাপড় ছেড়ে কেউ ছড়িয়ে রাখে না, ভিজে গামছা বিছানার উপর ফেলে রাখে না কেউ, অকারণে পাখা চলে না, বাতি জ্বলে না। রাগ নেই, ঝগড়া নেই, খাওয়া নিয়ে হুজ্জতি নেই! তিতলি প্রায়ই ফোন করে বলেছে, ‘‘একা একা কী করছ মামণি? এখানে চলে এস। একা থাকতে থাকতে অসহ্য হয়ে না তিতলির ডাকে, কী জানি কেন— তিতলিদের বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছেন। কী সুন্দর, বিরাট বাড়ী ওদের! মা-বাবা, দাদা-বৌদি, সকলেই বড্ড ভাল। ওদের উপরোধে দু’দিন থেকেও গিয়েছেন কখনও-সখনও। কিন্তু তার পরেই ওই একলা ভাঙা ঘরদোর কেবলই ডাকতে থাকে, আর থাকা হয় না! নিজেকে বলেন, ছিঃ, ছেলের শ্বশুরবাড়িতে বেশি দিন কেউ থাকে না কি? আর বেয়ানকে বলেন, ‘‘না দিদি, আর নয়! বোঝেন না, দিনকাল খারাপ, খালি বাড়ি ফেলে রাখাটা ঠিক নয় মোটেই।’’ বলতে বলতে মনে মনে হাসেন অসীমা, ও বাড়িতে চোর ঢুকলে বেচারা চোরের যে কী লোকসান!
মিম জন্মানোর দিনটাও আজ বেশ মনে পড়ে যায়। সম্ভাব্য তারিখের সাত দিন আগেই চলে এসেছিল বুবুল। তার ছোট্ট বুবুলকে বাবা হওয়ার টেনশনে থাকতে দেখেছিলেন অসীমা। জোর করে তিতলির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিতলি যেদিন নার্সিং হোমে ভর্তি হল, অসীমাও চলে গিয়েছিলেন। অবাক হয়ে দেখছিলেন অসীমা, কেমন অস্থির হয়ে বুবুল পায়চারি করছিল ও.টি-র সামনে। মিমকে দেখাল নার্স, বিছানায় শুইয়ে দিল তিতলির পাশে, পরম মমতায় সদ্য মা-হওয়া তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বুবুল, কী পরিপূর্ণ সুন্দর লাগছে ওদের তিনজনকে, চোখ ভিজে যায় অসীমার। কোনও এক রং চটে-যাওয়া, অনেক পুরনো একটা ছবিকে দেখতে পান।
পনেরো দিনের মাথায় মিমকে নিয়ে কর্মস্থলে চলে গেল সস্ত্রীক বুবুল, সঙ্গে অসীমা। বেশ কিছু দিন, প্রায় মাস ছয়েক মিমকে বড় করেছেন, তিতলির সঙ্গে ঘুরেও বেড়িয়েছেন এদিক-সেদিক! কিন্তু ওই যে, ওই ভাঙাচোরা বাড়িটা আবার কেঁদে কেঁদে ডাকে অসীমাকে। বাড়ি যাওয়ার অছিলা খোঁজেন অসীমা। ছেলেকে চুপিচুপি বলেন, ‘‘আমি ক’দিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসি, তুই এবার তিতলির মাকে আসতে বল, তারও তো নাতির কাছে থাকতে ইচ্ছে করে!’’
মুখে প্রসাদের ছোট্ট অনুষ্ঠানে তিতলির বাড়ির লোকেরা এলে ওঁর দাদার সঙ্গে ফিরে এলেন অসীমা, এক রকম জোর করেই। বলে এলেন বেয়াই-বেয়ানকে, এবার নাতিকে আপনারা সামলান কিছু দিন। মিম যখন এক বছরের, বিদেশে চলে গেল বুবুলরা। মাঝের চার-চারটে বছরে একবার মাত্র আসতে পেরেছিল বুবুল। কী আশ্চর্য! বুবুলকে ছাড়াও বাঁচতে শিখে গেলেন অসীমা! তবে না, দেশে ফিরে এসেছিল বুবুল। এবার ওর ঠাঁই ব্যাঙ্গালোর। দেশে ফিরে বাড়িতে এসেই অস্থির হয়ে উঠেছিল।এ কী অবস্থা বাড়ির! চাল ফুটো হয়ে গেছে,পাঁচিল গেছে ভেঙে। এত কিছু সারাবার সময় কই? এত টাকা খরচ করার সময় কই? ওরা চলে যেতেই অসুখে পড়লেন অসীমা। ছেলে আর দেরি করেনি, উড়ে এসে মাকে নিয়ে গেছে নিজের কাছে।
এবার বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন অসীমা। একলা বাড়ি বারবার ডেকেছে তাঁকে, তবু তড়িঘড়ি সাড়া দিতে পারেননি। বলেছেন তাকে, ওরে দাঁড়া, আসছি, একটু সেরে নিই। এখানেও একাকিত্ব। মিম স্কুলে যায়, বুবুল-তিতলি অফিসে। অসীমার রান্না করারও দরকার পড়ে না। ছেলেমেয়েদুটো কী সব ডিম-পাঁউরুটি, ফল-ওটস এসব খেয়ে আপিসে যায়। সারাটা দিন বাড়ির ভাত পেটে পড়ে না। একদিন এ কথা বলতেই হেসে গড়িয়ে পড়েছিল তিতলি, ‘‘অফিসে লাঞ্চ দেয় মামণি!’’ ছাত্রবয়সে বুবুলকে রোজ ভাত মাখন আলুসেদ্ধ ডিমসেদ্ধ খাইয়ে পাঠাতেন, পরীক্ষার দিনগুলোতে তো খাইয়েও দিতে হয়েছে, এখনও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে! দুপুরে তিনি আর মিম, কোন সকালে ইস্কুলে যায় বাচ্চাটা। রান্নার লোকের রেখে যাওয়া রান্না দুজনে খান, মিমের ইস্কুলের গল্প শোনেন, বিছানায় শুয়ে মিমকে তার বাবার ছোটবেলার গল্প শোনান। দেওয়ালজোড়া টিভিতে কার্টুন দেখেন আর হেসে হেসে গড়িয়ে পড়েন টম আর জেরির কাণ্ড দেখে।
সেদিন বুবুল অফিস থেকে এসে অসীমাকে বলে, ‘‘মা, খোকনজেঠু ফোন করেছিল। বাড়ির প্রাচীরটা নাকি একেবারে ভেঙে গেছে, বাড়িতে এত ঘাস গজিয়েছে, সাপখোপের উপদ্রব। সময় করে গিয়ে বাড়িটার একটা হিল্লে করতে হয় এবার। তোমাকে আমি আর ওখানে একা থাকতে দেব না কিছুতেই। আর ওই বাড়ি ঠিক করতে যে সময় লাগবে, ততদিন আমি ওখানে থাকতে পারব না, অসম্ভব!’’ অসীমা মিনমিন করে বলেছিলেন, ‘‘আমি বরং যাই, কিছু দিন থেকে বাবুয়াকে ডেকে ঠিকঠাক করাই—’’ কথাটা শেষ করতেও পারেননি, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি ওখানে গিয়ে একা থাকবে আর আমি এখানে দুশ্চিন্তায় মরব, একে অফিসে চাপ, তাতে এই অশান্তি— হার্ট অ্যাটাক হবে এবার!’’ চুপ করতে বাধ্য হয়েছিলেন অসীমা। তিতলি এসে মধ্যস্থতা করেছিল, ‘‘আরে বাবা, এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? মাকে বলো না, এখানেই একটা বড় ফ্ল্যাট নিচ্ছ! মা নির্দ্বিধায় নিজের একটা ঘরে থাকতে পারবে, আর কেউ এলেও জায়গার অভাব হবে না, তার চেয়ে বরং ক্রিসমাসের ছুটিতে এবার বাড়িতে যাই, সেখানে সব দেখেশুনে একটা ব্যবস্থা করা যাবে।’’
অনেক আলোচনার পরে স্থির হল, এই জরাজীর্ণ বাড়িটা ভেঙে, জমিটা বিক্রি করে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে নেবে পাড়ার বড় রাস্তার দিকে। সত্যিই এ প্রস্তাবে সায় না দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই অসীমার। সরু গলির এই বাড়িতে গাড়ি ঢোকে না, জল ওঠে। বিস্তর অসুবিধা। আশেপাশে বড় বড় বাড়ি উঠে যাওয়াতে বড্ড স্যাঁতসেঁতে হয়েছে এখন! না কি আগেও ছিল, বুঝতেই পারেননি!
এই সব কারণেই প্রায় বছরখানেক বাদে ছোট্ট শহরটাতে পা রেখেছেন অসীমা। না, বাড়িতে উঠতে দেয়নি খোকনদারা। তাদের দোতলা বাড়ির নীচের তলায় দিন পনেরোর জন্য ভাড়া চেয়েছিল বুবুল। খোকনদা রাজি হয়নি কিছুতেই, ‘‘চলেই তো যাবি বাবা আমাদের ছেড়ে, এই ক’টা দিন নাহয় আমাদের কাছেই থেকে যা, ভাড়া দিতে চাস না।’’ খোকনজেঠুর অনুরোধ ঠেলতে পারেনি বুবুল, গ্যাস আর কিছু বাসন নিয়ে জেঠুর একতলাটায় আশ্রয় নিয়েছে। এসে ইস্তক ব্যস্ত ছেলে। বাড়ি বিক্রির জন্য লোক দেখা, খোঁজ পাওয়া ফ্ল্যাটগুলোর দেখাশোনা, উকিলের কাছে ছোটা। এখানে এসেও কাজ থেকে রেহাই নেই। মিমকে নিয়ে তিতলি দু’দিনের জন্যে গিয়েছে বাপের বাড়ি। অনেক, অনেক দিন পরে মায়ে-পোয়ে সংসার। কিন্তু সংসারটা কেমন যেন দানা বাঁধে না। বুবুল এখন মিঃ অনির্বাণ বোস, কিন্তু অসীমা যে কেন সিনিয়র মিসেস বোস হয়ে উঠতে পারেন না, কে জানে! এখনও ‘বুবুলের মা’ হয়েই রয়ে গেলেন!
বুবুল কাল বলেছে, ‘‘যারা পুরনো বাড়িটা দেখে গেছে তাদের জমিটা পছন্দ হয়েছে। আসবাব সমেতই ওরা কিনে নেবে সব, হয়তো পরশু থেকেই বাড়ি ভাঙার কাজে হাত দেবে। ওই সব জিনিস, ঘুণে ধরা, টেনে ব্যাঙ্গালোর তো নেওয়া যায় না! আর তোমার ওই দুই কামরার নতুন ছোট্ট ফ্ল্যাটে অত বড় খাটও ঢুকবে না। তাই ওরাই ওসব নিতে রাজি হয়ে গেছে। ভালই হল, তুমি একটু দেখে নিও। যা যা নেওয়ার নিয়ে নিও।’’
দুপুরের খাওয়া সেরে অসীমা তাই এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর ফেলে যাওয়া সংসারটার মধ্যিখানে। কাল থেকে আর কিছু থাকবে না! তার এত দিনের পরিশ্রমের গন্ধ, একলা লড়াই জেতার উচ্ছ্বাস, আকুল যন্ত্রণার ইতিহাস, সর্বস্ব হারানো পঁয়ত্রিশ বছরের একটা মেয়ের কৃতী সন্তানের জননী হয়ে ওঠার গল্প— সব লেখা আছে ওই ভাঙা বাড়ির খাঁজে খাঁজে! ওরা সবাই ডাকছে অসীমাকে, জড়িয়ে ধরছে, আদর করছে, কিছুতেই যেতে দিতে চাইছে না যে! কী করেন অসীমা, যদি এখানেই চিরতরে থেকে যান! বুবুল, বুবুলের কী হবে! না, বুবুল তো এখন একা নয়! বুবুলের জন্যে অত অস্থির হবার দরকার কি আছে আর? কী করবেন অসীমা! ওরা আসবে কাল, সব চিহ্ন গুঁড়িয়ে যাবে, জীবনটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে অসীমার। না। এখানেই থাকবেন অসীমা। নিজেকে চিরতরে এই বাড়িতেই বন্দি করে দেবেন, ওই স্মৃতিদের সঙ্গে নিজেও মিশে থাকবেন স্মৃতি হয়ে। সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকান অসীমা। অবহেলায় পড়ে থাকা পুরনো একটা শাড়ি, কাঠের টুলটা টেনে আনেন ফ্যানের নীচে। শীতের স্থির ধুলোমাখা ফ্যান, আনত হয়ে আছে তার দিকে, আর দেরি কেন?
‘‘ঠাম্মি, কোথায় তুমি? আমি ঠিক জানি, তুমি এখানে! তুমি বলেছিলে না পাপার লুকোচুরি খেলার জায়গাগুলো দেখাবে, চলো এখন।’’ ও কী! দরজার সামনে মিম দাঁড়িয়ে! দরজাটা কি খোলাই ছিল তবে! পিছনে পর্দাটা দুলছে। পাঁচ বছরের ছোট্ট বুবুল, সেই কোঁকড়া চুল, বড় বড় চোখ, শ্যামলা রঙ। ‘‘চলো না ঠাম্মি, একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে, পাপার দুষ্টুমির জায়গাগুলো দেখাবে চলো, মাম্মাম তোমাকে চা খেতে ডাকছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে, চলো না!’’
সেই ঝুলোঝুলি। বুবুলের মতো। আর একটা বুবুলের জীবন ডাকছে অসীমার বাকি জীবনটুকুকে, এ ডাকও যে বড় উষ্ণতার, বড় মমতার, বড় নির্ভরতার। লোভ হল অসীমার, বড্ড লোভ হল। মিমের হাত ধরলেন, অস্থায়ী বাড়িতে ঢুকলেন এসে। তিতলি এসেছে, চা নিয়ে বসেছে দুটিতে। —‘‘কিছু নিয়ে এলে মা, ও বাড়ি থেকে?’’
‘‘তিতলি, গিয়ে নিয়ে আসিস যদি কিছু লাগে। আমার কিছু নেওয়ার নেই।’’
ঘর থেকে একটা চাদর নিয়ে দু’জোড়া বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে মিমের হাত ধরে বেরিয়ে আসেন অসীমা। বাইরে শীতের বিকেল নামছে, পড়ন্ত রোদের সঙ্গে হিমেল হাওয়ার বোঝাপড়া। গরম চাদরটাকে ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নেন অসীমা।
0 comments: