ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক
(১)
যেই মুহূর্তে খিদিরপুরের জাহাজঘাটা থেকে জাহাজটি নোঙর তুলে নিল, সেই মুহূর্তে অসীম নিবিড় জলরাশি স্থলখণ্ডের সাথে তাঁর শেষতম নাড়ীর টানটাকেও ছিন্ন করলো যেন। নিরুদ্দেশের যাত্রাপথেই আজীবনের চলা তাঁর। দেবানন্দপুর থেকে ভাগলপুর হয়ে কলকাতা। আজন্ম তাঁর যে আরাধ্য, সেই পথের দেবতা অবশ্য তাঁরই মত ছড়িয়ে আাছেন বিশ্বনিখিলে, মানুষের রক্তমাংসের অবয়বেই।
রেঙ্গুনে গেলে জীবিকার একটা উপায় হতে পারে। চিঠিতে মেশোমশায় তেমনই একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেই ভরসাতেই তোরঙ্গ আর হোল্ডঅল বেঁধে দ্বিতীয় শ্রেণীর একটা ভদ্ররকম কেবিনে আপাতত ঠাঁই মিলেছে। এই সাতাশ বছরের জীবনে বিচিত্র মানুষ মানুষীর সম্ভার দেখেছেন অনেক। তাদের কারো কাছে কোথাও দু দণ্ড দাঁড়িয়েছেন, কোথাও তীব্র বিয়োগবিষে নীলকন্ঠ হয়ে জ্বলেছেন, আবার কখনো বা প্রগাঢ় নির্লিপ্তি নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে হয়েছে। সুখের স্থিতি আর গৃহস্থ জীবনের প্রসাদ থেকে আজন্ম দূরেই রয়ে গেলেন। রেলিং-এর ওপারে দেখতে পেলেন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের শ্যামল তটরেখা। ডেকের রেলিং-এ ভর দিয়ে সদ্য অপরাহ্নের বিলীয়মান সূর্যরশ্মিতে অনেকগুলো এলোমেলো ভাবনা আর স্মৃতি মাথায় ঘুরছিল শরৎচন্দ্রের। যে জন্য এতটা দূরের পথ পাড়ি দেওয়া, তার কতটাই বা সফল হবে শেষ অবধি? পকেট থেকে একটি চুরুট বার করে অগ্নিসংযোগ করে অস্তগামী দিগন্তরেখার ক্ষণে ক্ষণে রংবদলের মোহে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন তিনি।
বিকেলের চা খাওয়ার ঘন্টা বাজিয়ে দিয়ে গেল সারেং। শরৎ খাওয়াদাওয়া নিয়ে কখনো কোন বাছবিচার করেন না। এমনকি অভুক্ত হয়েও তিনি রাত্রিযাপন করেছেন বহুদিন। এই সাতাশ বছরের জীবনে সেসব অভিজ্ঞতা তাঁর নেহাত কম নয়। শরীরটা এবার একটু দুর্বল লাগছে যেন। সমুদ্রযাত্রা এই প্রথমবার। ঢেউয়ের দুলুনিটা এতক্ষণে যেন বেশ ভালোমতন বোঝা যাচ্ছে শরীরের মধ্যেও। খাওয়ার রুচিটাও কমে আসছে ক্রমে। এরই মধ্যে একজন মিস্ত্রীগোছের লোক, বেশ নোংরা কাপড়চোপড় আর সঙ্গে একটা বিচিত্রবর্ণের তোরঙ্গ আর দরবেশদের মত একটি ঝোলা কাঁধে তাঁর পাশটিতে এসে বসে। এই লোকটি কি করে এই সেকেন্ড ক্লাসে জায়গা পেল! অপরিচ্ছন্ন হলেও সে আবার বেশ শৌখীন। একটা জাপানী সিল্কের রামধনু রঙের জামা আর বাঘছাপের জংলা রেশমী রুমাল তার গলায় বাঁধা। গা থেকে ভুরভুর করে লেবুর তেল আর দিশী মদের মিশ্রিত উৎকট এক গন্ধ বেরোচ্ছে। অদ্ভূত ব্যাপার এই যে, এত কিছু অভদ্রজনোচিত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও তার চোখদুটি অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল, যেন গভীর এক প্রাণশক্তি তাতে নিহিত আছে। এই বিচিত্রবেশী লোকটিকে দেখে বেশ মজা লাগল তাঁর। শরৎচন্দ্র একরকম গায়ে পড়েই আলাপ জমালেন তার সাথে। লোকটিও বাঙালী, তেলের কোম্পানীর মজুরদের সর্দার। ছুটিতে দেশে এসেছিল, এবারে কর্মস্থলে ফিরছে। নিজেই একটা চুরুট এগিয়ে দিলেন লোকটির দিকে। সে অত্যন্ত নিস্পৃহ মুখে তার ঝোলার ভিতর থেকে একটা গাঁজার কলকে আর কালো কাপড়ের একচিলতে ফালি বের করে দেখাল। কথায় কথায় ভালোই আলাপ জমে গেল। শেষমেশ শরৎ তাকে বললেন 'ভায়া, কদিনই বা বাঁচবে, এই তো তোমার দেহ, ওই নেশাভাঙটি আর করোনা।' পানখাওয়া লালচে দাঁতগুলো বের করে আকর্ণ হেসে সে মাথা দোলায় আর তারপর সাপুড়ের বাঁশীর মত একটা অদ্ভূত বাজনা তার ঝোলা হাতড়িয়ে বের করে আনে ভেতর থেকে।
তরতর করে জলযানটি সাগরের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। দিকচক্রবালে ঢলে পড়ছে একটি অভ্যস্ত দিনের সমাপ্তির ছায়া। লোকটির বাঁশীর সুরটা বড়ো মনখারাপের। এরকম মেঠো সহজিয়া সুর বলেই হয়তো তা বুকের বাঁপাশে এসে ধাক্কা দেয়। এইসব দরিদ্র অথচ সহজতম মানুষদের জীবনের দুঃখ সুখের সুরটি কি ঐশ্বর্যময় পৃথিবীতে আজীবন অশ্রুত আার অব্যক্তই থেকে যাবে?
শরীরটা একটু খারাপ লাগাতে বিছানায় এসে শুতেই হল। নইলে ডেকের ওপর চেয়ার পেতে তাঁর বসে থাকতেই ভাল লাগছিল। কত রকম মানুষজন, কত বিচিত্র জীবনের সমাহার সেখানে। দেবতা বলতে যদি আদপেই কিছু থেকে থাকে তবে তিনি সারাজীবন তাঁকে খুঁজে যাবেন এই ক্ষুধাজীর্ণ, কলঙ্কলিপ্ত, ব্যর্থ জীবনের কাঠামোর ভিতরেই। মানুষের পদচিহ্নমাখা ধূলিময় বেদীতেই প্রতিষ্ঠা করে তাঁর অর্চনা করবেন। মন্দিরের মাল্যচন্দনভূষিত পাথরের নকল ঈশ্বরের প্রতি তাঁর কোন মোহই নেই।
শরৎচন্দ্র নিজেও চিরদিনের ঘরপালানো বাউন্ডুলে। এই তো মাত্র কিছু বছর আগেই হুগলী-আরামবাগ পার করে হাঁটা পথেই পুরীর পথে যাত্রা করেছিলেন একদম একাই। পরণে গেরুয়া ভেক আর হাতে একটা লাঠি। প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ দাড়িগোঁফ, হঠাৎ দেখলে অতি আপনজনও চিনতে পারবে না কেউ। নিরন্ন অবস্থায় অবিশ্রান্ত হাঁটার পর পা ফুলেছে, সঙ্গে গায়ে জ্বর, শরীর টলছে ক্ষুধায়। একটি অচেনা গ্রামে এসে একটি গাছতলায় শেষে গড়িয়েই পড়লেন তিনি। দৈবানুগ্রহের অভিজ্ঞতার প্রথম পাঠটি হল সেখানেই। সেইদিনই বোধহয় আরো নিশ্চিত হয়েছিলেন যে তাঁর দেবতা মন্দিরের নয়, পথের প্রান্তেই তাঁর দেবালয়।
চকমানিকপুর গ্রামেরই এক বালবিধবা যুবতী, তার নাম সাবিত্রী, সেদিনের অসুস্থ তরুণ শরৎকে সেই গাছতলা থেকে তুলে ব্যবস্থা করলেন অন্ন ও আশ্রয়ের দুইয়েরই। সাবিত্রী নিঃসন্তান, দূর সম্পর্কের এক ভগ্নীপতি আর ততোধিক দূরের দেবরের অন্নেই সে প্রতিপালিত। তারা মাঝেমাঝেই মদ্যপ হয়ে এসে সাবিত্রীর দরজায় কড়া নাড়ে মাঝরাতে। দোরে খিল এঁটে ভয়ে কাঁটা হয়ে সাবিত্রীর বিনিদ্র রাত কাটে। শরৎকে যদিও সে বহির্বাটির একটি আলাদা ঘরে রেখেছে, তবুও গ্রাম্য কুৎসার গুঞ্জন তো ওঠেই। দুবেলা রোগীর পথ্য ও সেবার সাথে সাথে দুটো মনের কথাও সে বলে। শরৎের আকাশে তার চিন্ময়ী স্বরূপ একটু একটু করে স্থলপদ্মের মত পাপড়ি মেলে। আর শরৎ অকালবোধনের দেবীকে খুঁজে পায় সেই শুভ্রবসনের নারীটিতে।
এরই মধ্যে একদিন অবস্থা ঘোরতর হয়ে ওঠে। একরাত্তিরে তারা দুই মদ্যপ সদর দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে বচসা শুরু করে। শরৎই সেদিন বাহুবলে নারীত্বের চরম লাঞ্ছনা থেকে সাবিত্রীকে রক্ষা করে। তার কৈশোরের ডানপিটেমো কাজে লাগে এবার। পরদিন ভোরেই অবশ্য সে চলে যাবার জন্যে তৈরী হলে সাবিত্রী তার পায়ে পড়ে। এই কুৎসিত কামনার গ্রাস থেকে বাঁচানোর করুণ আর্তি তার। অন্ততঃ পুরী অবধি তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে কাতর অনুরোধ করে। তার বৈধব্যজীবনের দীর্ঘ শৈত্যের মধ্যে এতদিন পরে শরৎ এসেছিল মুক্তির আনন্দ নিয়ে, ক্লিন্ন দেহজ কামনার অনেক দূরের পথের পথিক হয়ে। তাই সে শরৎের কাছে সদা সংকোচমুক্ত হয়ে এই প্রস্তাবটি করেছে। শরৎ সেই বিপন্ন নারীটির অনুরোধ অস্বীকার করতে পারে না। তাকে সঙ্গী করেই তার সেই অনির্দিষ্ট যাত্রাপথে আবার পাড়ি দেয় নতুন উদ্যমে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়না, ওই দুই দুর্বিনীতের পোষা গুন্ডারা পথে শরৎদের ওপর চড়াও হয়। নিরস্ত্র শরৎকে মাথায় আঘাত করে জখম অবস্থায় পথে ফেলে রেখে তারা সাবিত্রীকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায় হিংস্র শ্বাপদের মতোই। সাবিত্রীর শেষ পরিণতি যে কি হল, তা অনুমান করা গেলেও প্রকৃত সত্যটি আর জানা যায়নি। শেষ পর্যন্ত অশেষ দুর্গতি সহ্য করে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরে রণে ভঙ্গ দিয়ে সেই দেবানন্দপুরেই শরৎকে একদিন ফিরে আসতে হয়। সাবিত্রী চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেও আজও সেই শুভ্রবসনা কল্যাণীমূর্তিটির কথা মনে পড়লে তার নবীন হৃদয় এখনো বেদনায় আর্দ্র হয়ে ওঠে।
জাহাজের খোলের ভিতরে একটানা শুয়ে থাকলে খুব গুমোট লাগে। কিন্তু শরীরটা একদম জুত লাগছে না। বমি বমি পাচ্ছে খুব, সঙ্গে মাথা ঘোরা। অবসন্ন দেহটা টেনে নিয়ে বাইরে যাওয়ার শক্তিটুকুও নেই। শরতের সহযাত্রী এক বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ী। তার নাম গহর মিঞা। কলকাতায় বাঁশ আর কাঠের মাঝারি মাপের কারবার আছে তার। সেগুন কাঠের সরকারী নিলাম হবে বর্মায়। সস্তা দামে মাল বায়নার আশায় সে রেঙ্গুন যাচ্ছে। এরকম তাকে প্রায়ই যেতে হয় বলে সমুদ্রযাত্রায় অভ্যস্ত সে। সমুদ্রপীড়ায় কাবু হয়নি। মাঝে মাঝেই সে গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে। বিছানায় আচ্ছন্ন শরৎচন্দ্রের বেগতিক অবস্থাটা সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে, কিন্তু একজন ব্রাহ্মণ সন্তানকে ছোঁয়াছুঁয়ি করতে গেলে যে একটা অহেতুক বিড়ম্বনা ঘটতে পারে, তা ভেবেই নিজেকে সংযত রেখেছে স্বাভাবিক কারণে। সে রাত্তিরের খাবার মুখেই ছুঁয়েই দেখলেন না শরৎ। মাথার ভিতর যেন পাথর চাপিয়ে রেখেছে কেউ। খুব কষ্ট হচ্ছে শরীর জুড়ে। তবে কি আর জীবদ্দশায় বর্মা মুলূকে পৌঁছানো হবে না? একটা সময় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন তিনি।
জ্ঞান ফিরল বেশ রাতে। চোখ মেলে দেখলেন, তাঁর মাথাটা গহর মিঞার কোলে। গহর পরম স্নেহে একটু একটু করে সুরুয়া চামচে করে শরৎকে খাইয়ে দিচ্ছে পক্ষীমাতার স্নেহে। সম্পূর্ণ অচেনা এক বিধর্মীর মধ্যে আবার সেই আরাধ্য দরদী পরম জনটিকে চকিতে দেখতে পেলেন। তাঁর মহাজনটি জীবনের নিদারুণ নিষ্ঠুরতার মধ্যেও অমলিন বন্ধুত্বের উষ্ণ আলিঙ্গনটুকু শরতের জন্য ঠিক জমা রেখে গেছেন। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল আসে শরতের।
জাহাজে চড়ে বর্মা যাওয়ার অভিজ্ঞতা এই কদিনে শরৎকে যে অন্য দুনিয়ার সাথে একটু একটু করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, গহর মিঞা তাদের মধ্যে অন্যতম। গহরের সখ্যঋণ অপরিশোধ্য। সেই রাত্তিরে গহর একপ্রকার শরৎকে নতুন জীবনদান করেছে। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা এক মানুষ কিভাবে আরেক আর্ত জনের সহায় হয়ে ওঠে, এ যেন অবিশ্বাস্য ব্যাপার। গহরের কাঠের ব্যবসাটা পৈতৃক। ওর দাদারাই সামলান ওদিকটা, কেবল বর্মার নিলামের সময় ও আসে। এই কদিনে বুঝেছে যে মানুষটা আপনভোলা, কবি স্বভাবের ও সুগায়কও বটে। তার লেখা দু একটি পদও সে শরৎকে পরম উৎসাহে শোনাতে ব্যগ্র হয়। নিজে মুসলমান হয়েও তার কোনও জাতের বিচার নেই। তার গলায় সুমধুর কীর্তন শুনে শরৎ অবাক হন। গহরের গ্রাম রূপনারায়ণের তীরে দেউলটিতে। সে বলে, ওখানে এক বোষ্টমদের আখড়ায় সময় পেলেই পড়ে থাকে নিজের গাঁয়ে গেলেই। মোহান্ত বিনোদদাস বাবাজীও বেশ স্নেহ করেন ওকে। এসব গান ওর ওখানেই শেখা। একসময় শখের যাত্রাদলে নাকি গান বেঁধে গহর গাইতোও রীতিমত। সমুদ্রপথের বাকি দিনগুলো গহরের সাহচর্যে শরৎের বেশ ভালই কাটতে থাকে। 'আপনি' থেকে 'তুমি' সম্বোধন 'তুই'তে নেমে আসে নিজেদের অজান্তেই। শরৎ জানেন যে রেঙ্গুনে পৌঁছে বা দেশে ফিরে গেলে এই গহরের সঙ্গে হয়তো আর তাঁর কখনোই আর ইহজীবনে দেখা হবে না, কিন্তু স্বল্পকালের বন্ধুত্বের যে বন্ধনে এই কবিস্বভাবের সুহৃদটি তাঁকে বাঁধল, তা আজীবন শরৎের স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়েই থেকে যাবে।
গত চারটি দিন বাংলার কোমল পল্লীময় ক্রোড় থেকে নির্বাসিত শরৎ। অবিরাম জলধিতরঙ্গ যেন বড়ই ক্লান্তিকর। এরই মধ্যে কোথাও মাঝে মাঝে শুশুক লাফিয়ে উঠলে হাততালি দিয়ে শরৎ শিশুর মত আহ্লাদিত হয়ে ওঠেন।
একাকী যাত্রাপথে বহুবিচিত্র চিন্তার জাল আচ্ছন্ন করে মনোভূমিকে। বাল্য, কৈশোর আর প্রথম যৌবনের অনেক ঘটনাই সারিবদ্ধভাবে চিত্রার্পিত হয়ে সামনে আসে। ভাগলপুর আর দেবানন্দপুরের সেই সব দিন মহাকালের কালস্রোতে আজ হারাতে বসেছে। প্যারী পণ্ডিতের পাঠশালায় কত দুরন্তপনা, বাল্যসঙ্গীদের সঙ্গে পুকুর-ঝাঁপানো দুপুরগুলো আর প্রিয়তম বন্ধু রাজুর সাথে সেই মাঝরাত্তিরে নৌকো বেয়ে জেলেদের জাল থেকে মাছ চুরি করতে যাওয়া - এ সবই তাঁকে কোথাও না কোথাও ঋদ্ধ করেছে অনুভূতির স্তরে। তিনি বিশ্বাস করেন যে কখনো সুযোগ জুটলে তা কলম কাগজের সম্মিলিত যুগলবন্দী রূপে একদিন প্রকাশ পাবেই। অবশ্য কিছুদিন আগেই একটি ছোট গল্প কুন্তলীনের প্রতিযোগিতায় দিয়ে এসেছেন বেনামে। একটু একটু করে সাহিত্যরসে জারিত হচ্ছেন নিজেও। আজকাল অবসরে হোমিওপ্যাথি শিক্ষা আর এমিল জোলা'র বইটি আত্মস্থ করছেন। এছাড়াও সঙ্গে আরও কিছু বিবিধ বিষয়ক বইপত্তর আছে অবশ্য।
জাহাজে আর একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটলো সেদিন। আপনমনে বই পড়ছেন শরৎ, হঠাৎ একটি নারীমূর্তি কেবিনের সামনে। শরৎ যে একটুআধটু হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি জানেন, সেটা কেমন করে ওই মহিলা জানতে পেরেছে। একবার যদি শরৎ ওই মহিলার সঙ্গে আসেন, তবে এক রোগীর দুর্দশা কিছুটা ঘোচে। শরৎ বিস্মিত হন অযাচিত প্রস্তাবে। তবুও বাক্সটি সাথে করে চলেন অন্য কেবিনটিতে। একজন পুরুষ, সম্ভবতঃ মহিলার স্বামীই হবেন, ওই একই সমুদ্রপীড়ায় কাতর। শরৎ বাক্স থেকে ওষুধ বের করে লোকটিকে দিলেন। সম্ভাব্য চিকিৎসাও বলে দিলেন বধূটিকে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় মেয়েটি ঢিপ্ করে একবার প্রণাম করলো। হরিণকালো দুচোখে তার কৃতজ্ঞতার ভাষাটি শরৎ টের পান। বধূটির নাম মহামায়া, সে নতমস্তকে জানায় তার সঙ্গী ওই পুরুষটি তার স্বামী নয়, বিশেষ এক পরিচিতজন। বউটির স্বামী বর্মায় রেলওয়েতে চাকরী করে। দীর্ঘদিন দেশে আসেনি। খবর এসেছে, সে নাকি আবার একটি বর্মী মেয়ে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে। মহামায়া আর তার দূরসম্পর্কীয় দাদা রোহিণী দুজনে যাচ্ছে হাতে পায়ে ধরে সেই পতিদেবটিকে ফিরিয়ে আনতে। এমনকি সতীন নিয়েও সে ঘর করতে রাজি। স্বজনহীনা মহামায়ার অসহায় অশ্রুবিন্দু শরৎের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে। অন্য এক পুরুষের সাথে কলঙ্কযাপনের অপবাদের বিনিময়েও সে আপ্রাণ এক পতিব্রতা আদর্শ নারী হতে চায় শেষ পর্যন্ত। এই আশ্চর্য বৈপরীত্যটি শরৎকে বিস্মিত করে। স্বামীটিকে নিয়ে দেশে না ফিরতে পারলে হয়তো বেচারীর আত্মঘাতিনী হওয়া ছাড়া আর কোনও পথই তার খোলা থাকবে না। শরৎ ভাবেন, এ দেশের নারীদের সার্থকতা সতীত্বের যাথার্থ্যে নাকি মনুষ্যত্বের অর্জনে, তার উত্তর আজ দেবে কে? পাথরের দেবতার নিশ্চুপ অভিব্যক্তি তাঁকে আজন্ম ব্যথা দেয়। এই সব ম্লান মুখে জোগানোর ভাষা আদৌ কি শরৎ কখনো খুঁজে পাবেন?
0 comments: