অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য
Posted in অন্তরমহল
দ্য আনডিটেক্টেড রেপিস্ট
সালটা ১৯৭৬। লস এঞ্জেলেসের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ভারি অদ্ভুত এক বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এরকম, "আপনি কি ধর্ষক? বিশিষ্ট গবেষক আপনার ইন্টারভিউ নিতে চান। কল করুন এই নম্বরে, ২২১৩/...... সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে যে কোন সময়ে। পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে।" বিজ্ঞাপনদাতা স্যামুয়েল ডি. স্মিদাইম্যান ভেবেছিলেন একটাও ফোন আসবে না। ধর্ষক ফোন করে নিজের অভিজ্ঞতা জানাবে, এ যেন মূর্খের স্বর্গে বাস। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সফল হলেন গবেষক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট স্যামুয়েল। একে একে বেজে উঠল ফোন। একবার নয়, দুবার নয়, দুশোবার বাজল ফোন। বড়ো লম্বা সে লিস্ট। কে নেই তাতে? আছে কম্পুট্যার প্রোগ্রামার, আছে আর্টিস্ট, মায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোড়লও। ঋতুবদল হওয়ার আগেই স্যামুয়েল নিয়ে ফেললেন পঞ্চাশ জনের ইন্টারভিউ। যার ওপর ভিত্তিকরে তিনি লিখলেন তাঁর পেপার, 'দ্য আনডিটেক্টেড রেপিস্ট'। স্যামুয়েল লিখে ফেললেন পেপার, এই বিষয়ে গবেষণাও চলল আরও বিশ বছর। অনেক নতুন তথ্য উঠে এল তাতে। দেখা গেল, ধর্ষণ করে সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকের সংখ্যা ধরা পড়া ধর্ষকের তুলনায় অনেক বেশি। তাদের "দ্য আনডিটেক্টেড রেপিস্ট" আখ্যা দেওয়া হল।
কেমন তাদের ব্যক্তিত্ব?
এদের পৌরুষ শিশ্নের আগায় বাস করে। এই সব পুরুষ ওঁৎ পেতে থাকে শিকারের আশায়, এরা চতুর, এরা কখনো শিকারকে অতিরিক্ত আঘাত করে না। শুধু আত্মতুষ্টির জন্য যেটুকু দরকার অতটুকু ভয় দেখিয়ে, সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। এরা বিশ্বাস করে একজন নারীর অবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজের কাম চরিতার্থ করাই পুরুষার্থ। কখনও কখনও এমনও দেখা গেছে, এই সব পুরুষের মনের গভীরে গাঢ় হয়ে জমা আছে নারীবিদ্বেষ আর নারীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ভয়। তাই প্রতিবার ধর্ষণে তার জিৎকেই সুনিশ্চিত করতে চায় সে। কোনও নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার অদম্য চাহিদা থেকে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সে করেই চলে। এদের ব্যক্তিত্বে আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রায় থাকে না। লোকচক্ষুর অন্তরালে একের পর এক ধর্ষণ করে এরা সিরিয়াল রেপিস্টে পরিণত হয়। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা আকছার ঘটে। এই ধরণের আচরণ যৌন বিকার পেডোফিলিয়ার জন্য হতে পারে। যারা পেডোফিলিক তারা শিশুদের প্রতি তীব্র যৌন আকর্ষণ অনুভব করে। অবশ্য যারা শিশু ধর্ষণ করে তারা সবাই যে পেডোফিলিক, এমন বলা যায় না। অনেক সময় সহজলভ্যতার কারণে আর শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বলে তারা আক্রান্ত হয় বেশি।
ভারতে অবস্থা কেমন?
বিশ্বায়ণ আর পণ্যায়ণ যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ। বিশ্বায়নের পালে লেগেছে হাওয়া। ভোগবাদী দর্শনের তরী তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভোগবাদী দুনিয়ায় নারী হল অন্যতম সহজলভ্য পণ্য। ভারতীয় সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। নারীর অবস্থান এখানে পুরুষের নীচে। একই নারীতে আসক্তি ভারতীয় পুরুষের ক্ষেত্রে দুর্বলতার লক্ষণ। এই বিশ্বাস যে সমাজের গোড়ায় সেঁধিয়ে আছে সেখানে ধর্ষণ সত্যিই কি অপরাধ? তারা বিশ্বাস করে, নিজের ইচ্ছা চরিতার্থ করতে যে কোনও সময়ে তারা যে কোনও নারীকে জোর করে সম্ভোগে বাধ্য করতেই পারে। নার্সিসিস্টিক অর্থাৎ আত্মমগ্ন ব্যক্তিত্বই এর জন্য অবশ্যই দায়ী। নিজের সুবিধার্থে নারীকে ব্যবহার করার নজির এমনকি রামায়ণ মহাভারতেও পাওয়া যায়। যে দেশে নিজের স্বামী পাশা খেলায় সমস্ত সম্পত্তি হেরে স্ত্রীকে দাঁও রাখে, যে দেশে দ্রৌপদীর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারীর বস্ত্র হরণ হয়, সে দেশে সাধারণ মেয়েদের অবস্থা কি হতে পারে! এহেন বিশ্বাসে বিশ্বাসী যারা, তাদের মেয়েদের সম্মতি সম্বন্ধে ধারণাও যে বিকৃত হবে সে আর অস্বাভাবিক কোথায়? এই সব পুরুষ যখন কামতাড়িত জন্তুর মতো কোন নারী সঙ্গ কামনা করে, তাতে সেই নারী অসম্মতি জানালে সে নিজের মতো করে যুক্তি সাজিয়ে তোলে। মেয়েদের 'না' নাকি আসলে 'হ্যাঁ'। যদি মেয়েরা পশ্চিমী ধাঁচে সাজগোজ করে তার মানে তারা খারাপ চরিত্রের মেয়ে, কাজেই তাদের ধর্ষণ করা চলতেই পারে। এ ছাড়া আরও শত কোটি সামাজিক ও ব্যবহারিক কারণে সমস্ত পৃথিবী জুড়েই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। ভারতে অবস্থা তো বেশ শোচনীয়।
পুরুষ যখন ধর্ষিত
চমকাবেন না। 'দ্য আনডিটেক্টেড রেপিস্ট' এর লিস্ট বেশ লম্বা। সম্প্রতি দিল্লির এক সিভিল সোসাইটির সার্ভে রিপোর্ট বলছে, অংশগ্রহনকারী ১৮ শতাংশ পুরুষ কোনও না কোনও সময়ে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে বা জোরের মুখে সঙ্গমে বাধ্য হয়েছে। আরও চমকপ্রদ তথ্য হল তাদের মধ্যে ষোল শতাংশ নারী দ্বারা ও মাত্র ২ শতাংশ পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিত। সরকারী পরিসংখ্যান বলছে, শিশুদের মধ্যে ছেলেরাই (৫৭%) মেয়েদের (৪২%) থেকে বেশি যৌন হেনস্থার শিকার হয়। তবেই বুঝুন, আনডিটেক্টেড রেপিস্টের তালিকায় মেয়েরাও আছে। বিদেশে তো বটেই, দেশেও তারা কম যায় না।
আমি জানি নারীবাদীরা হই হই করে উঠবেন। সত্যি কি অত্যাচারিত মেয়ের তুলনায় সংখ্যাটা নগন্য নয়? আমি সে কথা মোটেও অস্বীকার করি না। পুরুষশাসিত ভারতীয় সমাজে স্বভাবতই ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ধর্ষিত পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি।
নারী ধর্ষণে এদেশে মোমবাতি মিছিল হয়, মিডিয়া কভারেজ হয়, মায় আইনকানুনের মুখে ছাই দিয়ে পুলিশি এনকাউন্টারও হয়। সে নিয়ে বলার কিছু নেই। শুধু এ কথা ভুললে চলবে না, ধর্ষণের যন্ত্রনা পুরুষ নারী নির্বিশেষে সমান। দেখা গেছে আক্রান্ত পুরুষ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। ডিপ্রেশন, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস, আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা, অপরাধবোধ, লজ্জা – এসব ধর্ষণ পরবর্তী সমস্যা লিঙ্গভেদ মানে না। ব্যথার বোধ দু পক্ষেই সমান, শুধু কেউ কাঁদে, কারোর চোখের জল ফেলতে মানা। অথচ জানেন কি, আমাদের আইনে ধারা ৩৭৫ অনুযায়ী ধর্ষণ কেবলমাত্র পুরুষই করতে পারে। পুরুষ ধর্ষিত এ যেন কল্পনার অতীত। কে জানে এখানেও সেই পুরুষতন্ত্র কথা কইছে কিনা! নারীর হাতে পুরুষ নির্যাতিত, এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে।
নাহ আমার লিস্ট এখনও শেষ হয় নি। আনডিটেক্টেদের লিস্টে আরও আছে। ভারতীয় আইনে বিবাহিত স্বামী নাকি স্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই সঙ্গম করতে পারে। তা নাকি ধর্ষণের আওতায় পড়ে না। স্ত্রীর বয়স ১৮ বছর হলেই হল। প্রতিনিয়ত কত যে ভারতীয় নারী ধর্ষিত হচ্ছেন স্বামীর দ্বারা, তার কি কোনও রেকর্ড আছে? আইন যাই বলুক, এমন সব স্বামীর দল নিশ্চিতভাবেই আনডিটেক্টেড রেপিস্টদের দলভুক্ত।
ধর্ষক জন্মায় কেন?
এত কথার পরে একটা প্রশ্ন উঠেই আসে, ধর্ষক হয়ে কি কোন মানুষই জন্মায়? ধর্ষকও একদিন শিশু ছিল। একজন শিশুর ধর্ষক হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীটি কি? পুরুষ ও নারী পরস্পরের পরিপূরক। দু'য়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে সুস্থ সমাজ, এগিয়ে চলবে সৃষ্টি। যদি শিশু ছোট বয়স থেকে এই শিক্ষা না পায়, তবে জন্ম নেয় ধর্ষক। যদি সে নিজে কোনও না কোনওভাবে হেনস্থার শিকার হয়, তবে জন্ম নেয় ধর্ষক। মানুষের অধিকার যে পায় নি, শিশু অবস্থায় সমাজ যাকে যথেষ্ট সুরক্ষা দিতে পারে নি, সে যে সহজেই অন্যকে আঘাত করবে, যৌন হিংসায় লিপ্ত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই পোড়া দেশের নেতারা হুঙ্কার ছাড়ে – বেশি প্রতিবাদ করলে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেব। যেন পুরুষাঙ্গ থাকলে আর কোনও অস্ত্র লাগবে না মেয়েদের আঘাত করতে। সিনেমার মতো শক্তিশালী গণ মাধ্যমে বিবেচনাহীনভাবে ধর্ষণের ঘটনাকে তুলে ধরা হয়। জন্ম নেয় সম্ভাব্য ধর্ষক। সংস্কৃতি, সমাজ, মানসিকতায় জন্ম নেয় ধর্ষক। শিশুর নির্মল মানসে জোর করে প্রবেশ করানো হয় যৌন হিংসার গরল। তাই আমার লিস্টে এই বিকৃত সমাজ সংস্কারও "দ্য আনডিটেক্টড রেপিস্ট"।
0 comments: