প্রবন্ধ - অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
বাঙালি এবং বাংলা ভাষায় ধর্ম-সংকট
(তৃতীয় পর্ব)
উনিশ শতকের বাঙালি সাহিত্যিক বঙ্কিমবাবু অনুধাবন করেছেন, বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য নিদারুণ সংকটে। তিনি বঙ্গদর্শনের লিখছেন – “ইংরাজিপ্রিয় কৃতবিদ্যগণের প্রায় স্থির জ্ঞান আছে যে, তাঁহাদের পাঠের যোগ্য কিছুই বাঙ্গালা ভাষায় লিখিত হইতে পারে না। তাঁহাদের বিবেচনায়, বাঙ্গালা ভাষার লেখকমাত্রেই হয়ত বিদ্যাবুদ্ধিহীন, লিপিকৌশলশূন্য; নয়তো ইংরাজি গ্রন্থের অনুবাদক। তাঁহাদের বিশ্বাস যে, যাহা কিছু বাঙ্গালা ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়, তাহা হয়ত অপাঠ্য, নয়তো কোনো ইংরেজ গ্রন্থের ছায়ামাত্র; ইংরাজিতে যাহা আছে, তাহা বাঙ্গালায় পড়িয়া আত্মাবমাননার প্রয়োজন কি? সহজে কালো চামড়ার অপরাধে ধরা পড়িয়া আমরা নানারূপ সাফাইয়ের চেষ্টায় বেড়াইতেছি, বাঙ্গালা পড়িয়া কবুল-জবাব কেন দিব!” বঙ্কিমের ভাষায় একটা বিষয় স্পষ্ট – সেসময় বাঙালিদের ইংরেজ-প্রেম ও ইংরেজি ভাষাপ্রেম অবিসংবাদিত হয়ে উঠেছিল। এতটাই অবিসংবাদিত হয়ে উঠেছিল যে, তারা নিজের মাতৃভাষা ও নিজের জাতিকেই ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন – “লেখাপড়ার কথা দূরে থাক, এখন নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন কাজই বাঙ্গালায় হয় না। বিদ্যালোচনা ইংরাজিতে। সাধারণ কার্য, মিটিং, লেকচর, এড্রেস, প্রোসিডিংস সমুদায় ইংরাজিতে। যদি উভয় পক্ষ ইংরাজি জানেন, তবে কথোপকথনও ইংরাজিতেই হয়; কখন ষোলো আনা, কখন বারো আনা ইংরাজি। কথোপকথন যাহাই হউক, পত্রলেখা কখনই বাঙ্গালায় হয় না। আমরা কখনও দেখি নাই যে, যেখানে উভয় পক্ষ ইংরাজির কিছু জানেন, সেখানে বাঙ্গালায় পত্র লেখা হইয়াছে। আমাদিগের এমনও ভরসা আছে যে, অগৌণে দুর্গোৎসবে মন্ত্রাদিও ইংরাজিতে পঠিত হইবে।…..এক্ষণে ইংরাজিতে না বলিলে ইংরাজে বুঝে না; ইংরাজে না বুঝিলে ইংরাজের নিকট মানমর্যাদা হয় না; ইংরাজের কাছে মানমর্যাদা না থাকিলে কোথাও থাকে না, অথবা থাকা না-থাকা সমান। ইংরাজ যাহা না শুনিল, তাহা অরণ্যে রোদন; ইংরাজ যাহা না দেখিল, তাহা ভস্মে ঘৃত।” এ কৃতিত্ব অবশ্যই শুধু হিন্দু বাঙালিদের। এতে মুসলমান বাঙালিরা ছিলেন বহু যোজন দূরে। হিন্দু বাঙালিদের ইংরেজিপ্রেম আজও অব্যাহত। তবে এটা পরিষ্কার, সে সময় শাসক কে, শাসকের ধর্ম কী, শাসকের জাতি কী তা নিয়ে মোটেই মাথাব্যথা ছিল না। মাথাব্যথা ছিল কতটা দাসত্ব মেনে নিলে কীভাবে শাসকের কাছাকাছি থাকা যায়, কীভাবে রাজানুকূল্য পাওয়া যায়, কীভাবে উপাধি-শিরোপা পাওয়া যায়, তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা। হিন্দুদের সেই চরম আনুগত্যে মুসলিম শাসকরা দীর্ঘ ৮০০ বছর এবং ব্রিটিশরা ২০০ বছর ভারত-শাসন করতে পেরেছিল। মুসলমান শাসকদের ব্রিটিশরা ক্ষমতাচ্যুত করেছিল ভারতে ব্রিটিশ-উপনিবেশ করে সম্পদ লুঠ করার জন্যে, আর ব্রিটিশরা ক্ষমতাচ্যুত ভারতীয়দের অন্যায়ভাবে অকথ্য অত্যাচার করার জন্য। ব্রিটিশরা যদি ভারতীয়দের এভাবে অকথ্য অত্যাচার না করত, তাহলে হিন্দুদের সহযোগিতায় হাজার বছর শাসন করাটা অবলীলায় ঘটত। ভারতের ভাষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য সব চুলোয় যেত। ভারতে আর-একটা আয়ারল্যান্ড তৈরি হত।
অপরদিকে মুসলমান শাসনকালে মুসলিমরা আরবি-ফারসি ভাষা চর্চা করতই, হিন্দুরাও করত। মুসলমান আমলে কত আরবি-ফারসি শব্দ যে বাংলা হয়ে গেছে, তা আর বলার নেই। জমি থেকে ফসল পর্যন্ত কৃষি সংক্রান্ত প্রায় সব কথাই হয় ফারসি নয় আরবি। জমি ও জমিদারি সংক্রান্ত সব কথাই ওই আরবি-ফারসির দান। আইন-আদালত, ও তার ভাষাও আরবি-ফারসি। ‘আর্জি’ থেকে ‘রায়’ ‘ফয়সালা’ পর্যন্ত মামলার আদ্যোপান্ত সব ভাষাই মুসলমানদের দান। একদা ইংরেজ বিচারপতিরা ডিক্রি দিতেন বটে, কিন্তু তা ‘জারি’ করতে ইংরেজি ছেড়ে ফারসির শরণাপন্ন হতেন। সে সময় থেকেই বাংলা ভাষা বিদেশি ভাষা বেমালুম আত্মসাৎ করেছে। সেকালে বাংলা ভাষা মুসলমানদের কাছ থেকে কর্মের ভাষা নিয়েছিল, পোর্তুগিজ-ফরাসিদের কাছ থেকে নিয়েছিল জিনিসপত্রের নাম, আর ইংরেজি থেকে ও দুই জাতীয় কথা তো নিচ্ছিই, উপরন্তু তার জ্ঞানের ভাষাও আত্মসাৎ করেছি। প্রমথ চৌধুরী ‘আমাদের ভাষা সংকট’ গ্রন্থে লিখেছেন –“মুসলমানরা আমাদের দেশে যেসব নতুন কছমের আদালত-কাছারি আইন-কানুন এনেছে তাদের সঙ্গে তাদের বিদেশি নামও এসেছে। এবং সেই আইন-আদালত যেমন সমাজের উপর চেপে বসেছে, তাদের নামও তেমনি ভাষার ভিতর ঢুকে বসেছে। ফিরিঙ্গিরা যেসব নতুন জিনিস এ দেশে নিয়ে এসেছে আর আমাদের ঘরে ঘরে যার স্থান হয়েছে, তাদের নামও আমাদের মুখে মুখে চলেছে। তাস হিন্দুরা খেলত না, তারা খেলত পাশা; মুসলমানরাও খেলত না, তারা খেলত হয় সতরঞ্চ নয় গঞ্জিফা। ফিরিঙ্গিরা যখন দেশে তাস আনলে তখন শুধু বিন্তি নয় প্রমরা খেলতেও আমরা শিখলুম, ফলে ফরাসি কথা জুয়ো বাংলা হয়ে গেল, আর সেইসঙ্গে জুয়ো-খেলিয়ে বাঙালিরা ফরাসিতে যাকে বলে জুয়াড়ি তাই হয়ে উঠল।”
১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলায় পাঠান যুগের অবসান হল। শুরু হল মোগল যুগ। মোগল যুগে ফারসি ভাষার চর্চা ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। ১৫৭৬ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ – এই দীর্ঘ ১৮১ বছর বৃহৎ বাংলার সাধারণ মানুষ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তাদের জীবনযাপনে ফারসি ভাষাকে আত্মীকরণ করতে থাকে। কেন-না জীবনজীবিকার তাগিদে ফারসি ভাষা শিখতেই হত। এখন যেমন হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা শিখে নিতে হয়। যদিও হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার কোনোটাই ভারতের রাজভাষা বা রাষ্ট্রভাষা নয়, কিন্তু মোগল আমলে ফারসি ভাষাই সরকারি ভাষা বা রাজভাষা ছিল। ফারসি ভাষা এতটা আত্মীকরণ করে নিয়েছিল সাধারণ মানুষ যে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষরাও ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণ করে গ্রন্থ পাঠ করত। শুধু ভাষা ক্ষেত্রেই নয়, মুসলিম শাসনকালে হিন্দু জীবনে পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, নিত্য আচার-অনুষ্ঠানেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। যেমন মুসলিম সমাজের বোরখা বা পর্দারীতিতে হিন্দুসমাজে ঘোমটা রীতির প্রচলন হয়েছিল। ঘোমটার দৈর্ঘ্য এতটাই ছিল যে মহিলাদের মুখ দেখাই যেত না। দীর্ঘ ঘোমটা মহিলাদের বলা হত ‘কলাবউ’। মোগল যুগে ফারসি ভাষা চর্চা প্রসঙ্গে ডঃ মোহম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘মুসলিম বাঙ্গালা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন – “শাহি ফরমানা ফারসি, ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতে ফারসি, রাজস্ব বিভাগে ফারসি, শিক্ষা-দীক্ষা এবং আলাপ-আলোচনায় ফারসি দেদার চলিতে লাগিল। বিদ্যাবত্তা, চাকরি-বাকরি, এমনকি সভ্যতা-ভব্যতার মাপকাঠিও অচিরেই ফারসি হইয়া উঠিল।” বৃহৎ বঙ্গে আরবি-ফারসির চর্চা ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিঙ্কের আমল পর্যন্ত মানুষের ভালোবাসার ভাষা হয়ে বিরাজ করলেও ব্রিটিশ তথা ইংরেজদের উপনিবেশ ভারতে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলে আরবি-ফারসি ভাসা দ্রুত সংকুচিত হতে থাকল, বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে। হিন্দু জনগোষ্ঠী ইংরেজদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ভাষা পরমাদরে গ্রহণ করে নব্য ইংরেজ হয়ে ওঠার বাসনা জ্ঞাপন করল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ যখন বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি হাতিয়ে নিল, তখন থেকেই ফারসি ভাষা অস্তমিত হতে থাকল। তারপর বাঙালি হিন্দু কে কতটা ইংরেজ হয়ে উঠতে পারল তারই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল হিন্দুসমাজে। অপরদিকে মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ তথা ইংরেজদের গ্রহণ করতে পারল না বা গ্রহণ করল না। ইংরেজরাই ভারত থেকে মুসলিম শাসনের চির-অবসান ঘটিয়েছে, মুসলিমদের ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সেই কারণেই বোধহয় মুসলিমরা ইংরেজ সংস্কৃতি বর্জন করেছিল। এর ফলে অবশ্যই মুসলিম সমাজে প্রভূত ক্ষতিসাধন হয়েছিল। হিন্দু জনগোষ্ঠী থেকে শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতিতে মুসলিম জনগোষ্ঠী ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকল। হিন্দু সম্প্রদায়রা কথ্যভাষা থেকে আরবি-ফারসির বিদায় দিতে সক্ষম হলেও মুসলিমরা আরবি-ফারসির ব্যবহার বেশি বেশি করে করতে থাকল স্বতন্ত্রতা রক্ষার তাগিদে। সেই কারণে বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলিমদের ভাষা বাংলা হলেও অনেকটা পৃথক হয়ে গেল। সৃষ্টি হল হিন্দুয়ানি বাংলা ও মুসলমানি বাংলা। আমরা অনেকেই শুনেছি ‘হিন্দুয়ানি বাংলা’ এবং ‘মুসলমানি বাংলা’ পরিভাষা দুটি। বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রচর্চার উপর যখন বিধিনিষেধ আরোপ করল, তখন শাসকগোষ্ঠীর স্বাভাবিক প্রতিক্রয়া থেকেই মুসলমানি বাংলার উপর এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি ভাষার সমস্যা, নাকি রাজনীতির? তবে মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, কোথা থেকে এল এই পরিভাষা দুটি? উপনিবেশের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল?
সুধাকর গ্রুপের বাইরেও কিছু মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) তাঁদের একজন। তিনি তাঁর লেখা ‘ভূগোলশাস্ত্রে মুসলমান’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় -- ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে নিজের রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি পশ্চিমী ইতিহাসবিদ এবং তাঁদের এদেশীয় হিন্দু দোসরদের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে ভারতে মুসলিম শাসনকে দানবীয়ভাবে উপস্থাপনের বিরুদ্ধেও ইসলামাবাদী তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চালিয়ে গেছেন নিরলসভাবে। এর মাধ্যমে তিনি বেঙ্গলের সাম্প্রদায়িক হিন্দু লেখকদের বর্ণিত ধারার ইতিহাসের বিপরীতে ‘সঠিক ধারা’র ইতিহাস পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন।
ঊনিশ শতকে খ্রিস্টধর্মের আগ্রাসন থেকে ইসলাম এবং মুসলমানদের বাঁচাতে বাংলায় বই-পুস্তক রচনায় এগিয়ে আসা মুনশি বা মাওলানাদের কেউই ইংরেজি শিক্ষিত ছিলেন না। তাঁদের বেশিরভাগই আরবি এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। ফলে তাঁদের লিখিত বাংলা গদ্য হিন্দু লেখকদের দ্বারা লিখিত গদ্যের চেয়ে ভিন্নতর হওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। যখন হিন্দুদের লিখিত গদ্য ছিল সংস্কৃত-প্রভাবিত, এমনকি আরবি-ফারসি মৌল থেকে উৎসারিত খুবই পরিচিত শব্দগুলোও তাতে পাওয়া যেত না, তখন মুসলিম লেখকদের লেখা হয়ে ওঠে আরবি-ফারসির বাহুল্য। যতদূর সম্ভব সংস্কৃত শব্দকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা স্পষ্ট লক্ষ করা যায় মুসলিম লেখকদের কলমে।
একইভাবে বাক্যগঠন রীতি, শব্দার্থগত দিক এবং উপজীব্যের দিক থেকেও উনিশ শতকে গড়ে ওঠা বাংলা গদ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে -- হিন্দুয়ানি এবং ইসলামি। এই বিভক্তি বাঙলার হিন্দু এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিভক্তির দেয়ালকে আরও উঁচু করতে ভূমিকা রেখেছে।
ফারসি মোগল সাম্রাজ্যের ভাষা থাকার কারণে এবং পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহানের সময়ে সেনাদের মধ্যে ঊর্দুর ব্যবহারের ফলে ইংরেজদের হাতে পড়ার আগেই বাংলায় অনেক আরবি-ফারসি শব্দ ঢুকে পড়ে, পোশাক-ধর্ম পাল্টে, কিংবা আরবি-ফারসি হিসাবেই। আঠারশো শতাব্দীর প্রথমদিকের লেখার নমুনা --- “হোমাঙু বাদসাহের ওফাত হইলে হিন্দোস্তানে বাদসাহ হইতে ব্যাজ হইল, আপনারদের মধ্যে আত্মকলহ কইয়া বিস্তর২ লড়াই কাজিয়া হইল।” পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষায় এই আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার কমতে শুরু করে। ভারতভাগের পরে খানিকটা ধর্মীয় কারণে সংস্কৃতায়িত বাংলা (যা অনেকে হিন্দুয়ানি বাংলা বলে মনে করে) ছেড়ে আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্যে এক ধরনের (এসলামি) বাংলার প্রচলন ঘটে বা ঘটানো হয়। এসময় এরকম ধরনের প্রস্তাবও ছিল যে ‘অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ না-লিখে ‘অনেক পিরে মাজেজা নষ্ট’ বলা হোক। বলা হোক, ‘রাখে হরি মারে কে’ পরিবর্তে ‘রাখে আল্লা মারে কে’ ইত্যাদি। মুসলমানি বাংলার আরও দু-একটি উদাহরণ -- “ফজরের আউয়াল ওয়াকতে উঠিয়া ফুফু-আম্মা চাচাজিকে কহিলেন, আমাকে জলদি এক বদনা পানি দাও। আমি পায়াখানা ফিরিয়া গোসল করিয়া নামাজ পড়িয়া নাশতা খাইব।” বা “গোজশ্তা এশায়াতে আমরা অতীতে বাংলা ভাষার নানা মোড় পরিবর্তনের কথা মোখ্তাসার ভাবে উল্লেখ করেছিলাম।” অথবা “শহর কলকাত্তায় শেফাউল মুল্ক্ তশরিফ রাখিতেছেন না বহুত রোজের কথা। আর তশরিফ রাখিলেই ফায়দাই-বা কী? সে ছিল এক জামানা। ওজারতের তেজারত আর তেজারতের ওজারতে সুবে বাঙ্গলা ছিল সরগরম।”
সংস্কৃত, আরবি-ফারসি, ফরাসি, পর্তুগিজ, তুর্কি, বর্মি সব ভাষার শব্দ নিয়েই বাংলা ভাষার, তার হিন্দুয়ানিও নেই মুসলমানিও নেই। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের আগের বাংলায় যেমন আরবি-ফারসি ও সংস্কৃত শব্দ পাওয়া যায়, তার পরেও ঠিক তেমনই পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার প্রকৃতি বজায় রেখে সহজে খাপ খেয়ে যায় এমন ভাবে বিদেশি শব্দের ব্যবহার বাংলায় ঢের সাহিত্যিকের লেখায় পাওয়া যায়। যদি কোনও ক্ষেত্রে ধর্মীয় কারণে লেখায় বা বাচনে সংস্কৃত বা আরবি-ফারসি শব্দের আধিক্য দেখা দেয়, তাহলে তা ভাষাপ্রকার (register) হিসেবে চিহ্নিত হবে।
বাঙালি হিন্দুরা বলে ‘উপোস’ বা ‘উপবাস’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘রোজা’। বাঙালি হিন্দুরা বলে ‘নমস্কার’, বাঙালি মুসলিমরা বলেন ‘আদাব’। বাঙালি হিন্দুরা বলে ‘নিমন্ত্রণ’, বাঙালি মুসলিমরা বলেন ‘দাওয়াত’। বাঙালি হিন্দুরা বলে ‘বৈধ’, বাঙালি মুসলিমরা বলেন ‘জায়েজ’। বাঙালি হিন্দুরা বলেন ‘মৃত্যু’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘ইন্তেকাল’। বাঙালি হিন্দুরা বলেন ‘আকাশ’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘আসমান’। বাঙালি হিন্দুরা বলেন ‘স্বর্গ’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘বেহেস্ত’। বাঙালি হিন্দুরা বলেন ‘নরক’, বাঙালি মুসলিমরা বলে ‘দোজখ’। বাঙালি হিন্দুরা ‘প্রাক্তন’ বলে, বাঙালি মুসলিমরা ‘সাবেক’ বলে। বাঙালি হিন্দুরা ‘জলখাবার’ বলে, বাঙালি মুসলিমরা ‘নাস্তা’ বলে। বাঙালি হিন্দুরা ‘স্নান’ বলে, বাঙালি মুসলিমরা ‘গোসল’ বলে। বাঙালি হিন্দুরা ‘জল’ বলে, বাঙালি মুসলিমরা ‘পানি’ বলে। কিন্তু বাঙালি হিন্দুরা একসময় ‘জলপানি’ বলত, এখন সেটা হারিয়ে ‘স্কলারশিপ’ হয়েছে। ‘জলপানি’ শব্দটার ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে। জলপানির কথা যখন উঠলই, তখন জল ও পানির তফাৎটা কেন একটু দেখে নেওয়া যাক।
এক শ্রেণির উগ্র বাঙালি হিন্দুত্ববাদী বাঙালি মুসলমানদের প্রশ্ন করে – আপনারা যে নিজেদের বাঙালি বলে জাহির করেন, আপনারা কীসের বাঙালি? আপনারা বাঙালি মোটেই নন, আপনারা মুসলিম। তাই আমরা জলকে ‘জল’ বলি, আপনারা জলকে ‘পানি’ বলেন।” সেইসব উগ্র বাঙালি হিন্দুত্ববাদীরা জানেনই না, প্রাচীন বাংলায় বাঙালিরা জলকে যেমন ‘জল’ বলত, আবার ‘পানি’ও বলত। এই সময়কালে রচিত চর্যাপদে দেখুন ‘পানি’ শব্দের ব্যবহার : “তিণ ন চছুপইী হরিণা পিবই ন পাণী।/ হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী।।” (সংস্কৃত) পানীয় --> (পালি) পানীয় --> (প্রাকৃত) পাণিঅ --> (বাংলা) পাণি/পাণী --> আধুনিক বাংলা পানি (অতীতে পানী বানানও প্রচলিত ছিল)। পানি ও জল – দুটোই ভারতীয় ও তথাকথিত হিন্দু শব্দ। ‘পানীয়’ শব্দটি (সংস্কৃত ধাতু ৴পা + অনীয়) সামান্য পরিবর্তিত হয়ে ‘পানি’ শব্দটি তৈরি হয়েছে। ‘পানি’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি হল সংস্কৃত ধাতু ৴পানি + অ = পানি হচ্ছে। একই প্রাকৃত শব্দ "পাণিঅ" থেকে হিন্দি, ঊর্দু, মারাঠি, গুজরাতি, মৈথিলী ও ওড়িয়া ভাষাতেও ‘পানি’ শব্দটি প্রবেশ করেছে। পানির সঙ্গে আরবি বা ফারসি ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই। আরবিতে জলকে বলে ‘মাউন’ এবং ফারসিতে জলকে বলে ‘আব’ (আব থেকেই আবহাওয়া, অর্থাৎ জলহাওয়া। আব থেকে সংস্কৃতে ‘অপ’ – ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম)। সুতরাং ‘পানি’ শব্দটি মুসলমানরা এখন ব্যবহার করে বলে এটা অবাঙালি হতে পারে না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় একসময় এর ব্যবহার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালিই করতেন। চর্যার পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একটি বড়ো উপাদান হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। সেখানেও জল শব্দের পরিবর্তে পানির ব্যবহার লক্ষণীয় -- “কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।/কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।/আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।/বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।/কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।/দাসী হুআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।/কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।/তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোন দোষে।/আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।/বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।”
বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যে এই দুই শব্দ পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন – “তোহ্মার বোলে কেহো কাহ্নাঞি না বহিব পাণী।/ উচিত নিফল হৈব তোর জল ভাবি বুঝ চক্রপাণী।।” (যমুনাখণ্ড) বড়ু চণ্ডীদাস অসংখ্যবার পাণী (বা পাণি) ব্যবহার করেছেন জল, পানীয় বা বৃষ্টির প্রতিশব্দ হিসাবে (এখনও মুর্শিদাবাদের মুসলমান জনগোষ্ঠীর কথায় পানি = বৃষ্টি। ‘রোদ হ’চে পানি হ’চে/ খ্যাক শিয়ালের বিহে হ’চে’।)। মধ্যযুগের কবিরা অবলীলায় চয়ন করছেন এই দুটি শব্দ। চণ্ডীমঙ্গলে পাচ্ছি, “বিরহ-জ্বরে পতি যদি মরে/ কোন ঘাটে খাবে পাণী/ কাঁখে হেমঝারি মেনকা সুন্দরী/ জল সাধে ঘরে ঘরে” (কবিকঙ্কণ)। চৈতন্যমঙ্গলে – “এ বোল শুনিয়া পুনঃ প্রভু বিশ্বম্ভর। কান্দয়ে দ্বিগুণ ঝরে নয়নের জল।।” এবং “মুখে নাহি সরে বানী/ দু নয়নে ঝরে পানি...” (লোচনদাস)। এমনকী সৈয়দ আলাওল, যাঁকে আপামর বাঙালি ‘মুসলমান কবি’ হিসাবেই চেনে, তিনিও ‘জল’ ব্যবহার করেছেন। পড়ুন -- “শীর্ষের সিন্দুর নয়ানের কাজল/ সব ভাসি গেল জলে।” অথবা “না ভিজয় জলেত অগ্নিত না পোড়য়” (পদ্মাবতী)। খনা জল ও পানি উভয়ই লিখতেন। খনার বচনে আমরা পাচ্ছি – “খনা বলে শুন হে স্বামী/ শ্রাবণ ভাদরে হবে না পানি” এবং “রান্ধি বাড়ি যেবা নারী পুরুষের আগে খায়/ ভরা কলসীর জল তার তরাসে শুকায়।” অন্যদিকে লোকসাহিত্য যখন যেটা জুতসই মনে করেছে, তখন সেটা ব্যবহার করেছে। যেমন – “থির পানী পাথর সয়” এবং “জলেই জল বাধে”; “হাতি ঘোড়া গেল তল/ মশা বলে কত জল”; “ধরি মাছ, না ছুঁই পানি”; “ধন জন জোয়ানি/ কচু পাতার পানি”; “হালে পানি নেই”।
বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের বাড়িতে অযত্নে রক্ষিত রাধা-কৃষ্ণের এই লীলাকাহিনিতে মুসলমানরা কী উদ্দেশ্যে উর্দু পানি ঢোকালেন বলতে পারেন? এই পুরানো পুঁথিগুলি আবিষ্কৃত না-হলে মনে হয় বাংলার মুসলমানদের বাঙালিত্ব প্রমাণ করতে জীবন দিতে হত। জল একটি তৎসম শব্দ, যা সংস্কৃত ‘জলম্’ থেকে সরাসরি এসেছে। আদি বাংলায়, প্রাকৃত পানির ব্যবহার ছিল প্রমাণিত। তৎসম জলের ব্যবহার ছিল কি না প্রশ্নযুক্ত। আর যদি আদিকালে ‘পানি’ ও ‘জল’ দুটি শব্দের ব্যবহার থেকেও থাকে, এটা আপনাকে মানতেই হবে তখন বাংলার মানুষ পান করার জন্য ব্যবহৃত জলকে পানিই বলত।
আমি তখনের কথা বলছি, যখন ভারতে তথা বাংলায় ইসলাম আসেনি। সেইসব উগ্র বাঙালি হিন্দুত্ববাদীরা ভুলেই যান উত্তর ভারতীয় হিন্দুরা কেউই জলকে ‘জল’ বলে না, ‘পানি’-ই বলে। এমনকি সেইসব উগ্র বাঙালি হিন্দুত্ববাদীরা যখন উত্তর ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলেন, তখন অবলীলায় পরমানন্দে তাঁরা ‘পানি’-ই বলেন। আবার ওড়িয়ারাও ‘জল’ ও ‘পানি’ উভয়ই বলে সবাই, অসমীয়ারাও ‘পানী’ (পানি নয়) বলে। এরা কেউই হিন্দি বলয়ের নয়, আবার মুসলমানও নয়। তাহলে ‘পানি’ কোনোভাবেই মুসলমানি শব্দ নয়। ‘পানি’ বলছে মানে সে মুসলমান, একথাও বলা যায় না। বাঙালি না-হলেও ‘পানি’ হিন্দুরাও ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে অবাঙালিদের মুসলমানদের কোনো সমস্যা নেই। কারণ অবাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়ই জলকে ‘পানি’ বলে। কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়, বাঙালির প্রশ্নে বাঙালি হিন্দুরা যেমন ‘পানি’ বলে না, ঠিক তেমনি বাঙালি মুসলমানেরাও জল বলে না। কিন্তু ইংরজির ধর্মের বাঙালিরা একেবারে এক পথে, উভয় ধর্মাবলম্বী মানুষ ইংরেজি ভাষায় জলকে ‘Water’ বলে। এক্ষেত্রে উভয়ের ভাষাই খ্রিস্ট ভাষা – না রইল হিন্দুয়ানি, না রইল মুসলমানি।
তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের গোঁড়ামির জন্যে বাংলা ভাষা ও বাঙালি প্রশ্নচিহ্নে মুখে, ধর্মীয়ভাবে বিভাজিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের এক লেখকের (লেখকের নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। দুঃখিত) বয়ানে একটা ঘটনা বলি -- রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটি হয়তো অনেকের মনে আছে, যার দ্বিতীয় পঙক্তিটি এমন ছিল – “বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে৷” ক্লাসের স্যার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কবিতাটি পড়াতেন। এমনিতে সব ঠিকঠাক ছিল। শুধু দুটি বিষয়ে রবীন্দনাথের সঙ্গে স্যারের বিরোধ ছিল। এক : দ্বিতীয় ও দশম পঙক্তিতে তিনি ‘জল’ শব্দ বদলে দিয়ে ‘পানি’ দিয়ে পড়াতেন। তাহলে কী দাঁড়াল? -- “বৈশাখ মাসে তার হাঁটুপানি থাকে”…“গামছায় পানি ভরি গায়ে তারা ঢালে”। এ ব্যাপারে স্যারের একটা ব্যাখ্যাও ছিল। স্যার বলতেন -- হিন্দুরা পানিকে ‘জল’ বলে, মুসলমানেরা ‘জল’ বললে মুসলমানিত্ব চলে যাবে। দুই : এটি ছিল স্যারের ব্যাখ্যামূলক পার্থক্য। কবিতাটির তৃতীয় প্যারার প্রথম লাইন ছিল এ রকম -- “তীরে তীরে ছেলেমেয়ে নাহিবার কালে…”। স্যার বলতেন, ‘নাহিবার কালে’ মানে ‘গোসলের সময়’। জেলেপাড়ার এক সহপাঠী হাত তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার, ‘সিনানের (স্নান) সুমায়’ বললি হবিনানে?” স্যারের গুরুগম্ভীর উত্তর -- “ওটা কেবল তোরাই বলিস।” এ তত্ত্বে বাংলা ভাষা থেকে এ সকল শব্দ হারিয়ে যায়নি, যাবেও না। কিন্তু, আমাদের অনেকের দৈনন্দিন ব্যবহার থেকে ‘জল’ ও ‘স্নান’ শব্দ দু’টির চিরনির্বাসন হয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে এ লিস্টে আরও কিছু শব্দ যোগ হতে থাকে -- দাদা-বৌদি (তবে পিতামহ অর্থে ‘দাদা’র ব্যবহার আছে), মাসি, পিসি, ঠাকুরপো, ঠাকুরঝি, জলখাবার, সন্ন্যাসী ইত্যাদি ইত্যাদি। শব্দের ধর্মভেদ -- আজব এক সংস্কৃতি !
পানির সঙ্গে সম্পর্কিত অনেকগুলো বাংলা শব্দ। যেমন -- পানাহার, পান করা, পানকৌড়ি, পান্তা, পানীয়, পানসে, পানিফল ইত্যাদি। আচ্ছা, জল ও পানিতে বাঙালিত্বে যখন এত সমস্যা, তখন পানাহারের পরিবর্তে হিন্দুরা জলাহার বলবে, কিংবা জলকৌড়ি, পান্তার বদলে জলতা, পানীয়র বদলে জলীয়, পানিফলের বদলে জলফল? আচ্ছা, মুসলিমরাও কি মুসলমানিত্ব রক্ষা করতে জলীয়, জলতরঙ্গ, জলজ, জলবায়ু, জলপরী, জাল, জেলে শব্দগুলির পরিবর্তে পানি জুড়ে দেবে? জলপরি কি পানিপরি হয়ে যেতে পারে? কিংবা পানিপুরী হবে কি জলপুরী? না, আসলে আমরা উভয় ধর্মের মানুষরা দৈনন্দিন জীবনে আমি পানি আর জল একাকার করে ফেলি। কেবল ধর্মভেদে নয়, অনেক সময় অঞ্চলভেদেও পানি এবং জল বলায় বৈচিত্র্য দেখা যায়। চট্টগ্রামের হিন্দুরা পানি বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন বলে মনে হয়েছে, আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমরা জল শব্দটি ব্যবহার করেন। দুটো শব্দই বাঙালিদের আপন। তবে ভারত বিভাজনের রূপরেখা দ্বিজাতিতত্ত্বকে টিকিয়ে রাখার তাগিদ থেকে, জল আর পানিকে ধর্মীয় সীমারেখা টানার একটি উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয় বলে অনেকে মনে করেন। এই অকারণ জলপান বন্ধ হোক। জল আর পানি ধর্মীয় জায়গায় আটকে না থাকুক। পানির অপর নাম জীবন। জলের অপর নামও জীবন। জীবন কি ধর্মভেদে আলাদা? যদি না হয়, তবে কেন বাঙালির বাঙালিত্ব ধর্মভেদে আলাদা হবে?
‘নাস্তিকের ধর্মকথা’ নামে এক ব্লগে এক আলাপচারিতায় ব্লগার বাঙাল তানেন বাঙালি মুসলমান প্রসঙ্গে কী বলছে, একটু দেখি – ‘‘‘বাঙালি মুসলমান’ শব্দটাতেই আমার আপত্তি। মুসলমান -- ইংরেজ, রাশান, ইন্দোনেশিয়ান, বাঙালি কোনোটাই হতে পারেনা। হওয়া সম্ভব না। ইংরেজ ক্রিকেট টিমের ‘রশিদ’ কিন্তু ইংরেজ হয়ে উঠতে পারেনি, মুসলমানই রয়ে গেছে। তাই তাঁর নামটা ইংরেজদের মতো না, মুসলমানের মতো ‘রশিদ’। অথচ ইংল্যান্ডের অধিবাসী হিসাবে তাঁর ইংরেজ নাম হওয়া উচিত ছিল। একইভাবে বাংলাভাষীদের নাম বাংলায় হওয়ার কথা থাকলেও মুসলমানেরা নামটা পর্যন্ত আরবিতে অর্থাৎ মুসলমানের কথিত ভাষাতেই রাখে। বাংলায় রাখে না। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ দেশে দেশে স্ব স্ব কৃষ্টি, ভাষা, জাতি বোধে পরিচিত হলেও একমাত্র মুসলমানেরা পৃথিবীর যেখানেই যাক, যেখানেই থাক কেবলমাত্র মুসলমান পরিচয়েই থাকতে চায়, মুসলমানিত্বই মানতে চায়। তাই মুসলমানের ইংরেজ, রাশান, ভারতীয়, বাঙালি হওয়া হয় না, সে কেবলমাত্র মুসলমানই থাকে ! মুসলমানিত্ব যেমন বাঙালিত্বকে ধারণ করে না, ধারণ করা সম্ভব না। তেমনি মুসলমান যেখানেই যাক বা থাকুক না কেন সেখানকার অর্থাৎ সে মাটির সে হয়ে উঠতে পারে না, আরবের মরু-সংস্কৃতি আমদানি করে মুসলমানিত্বের নামে এবং সেটাকেই তার নিজস্বতা মনে করে। ‘রশিদ’-এর ইংরেজি তর্জমাকৃত নাম গ্রহণ কিন্তু সম্ভব। কিন্তু নেওয়া হবে না, কেন-না এতে করে মুসলমানিত্ব থাকে না। প্রত্যেক আরবি নামের বাংলা তর্জমাকৃত বা সুন্দর সুন্দর নিজস্ব বাংলা নাম গ্রহণ সম্ভব ছিল। অন্তত, বাংলায় বাংলা নামগ্রহণই তো স্বাভাবিক ছিল। ধর্মান্তরিত নিম্নবর্ণের হিন্দুর জন্য কিন্তু সেটা করা হল না কেবলমাত্র 'মুসলমানিত্ব' গ্রহণ করবার কারণে। অর্থাৎ আপনার নিজ অঞ্চলের স্বকীয়তা থেকে আপনার মূলোৎপাটন শুরু করা হল। এভাবে অন্যান্য সকল জায়গাতেই এবং এসবের সবকিছুই ইসলামের কারণে। আমি বলতে চাইছি মুসলমানিত্ব নামের বায়বীয় কিন্তু একরোখা চাপানো মরু-সংস্কৃতির কারনে মুসলমানদের আর ইংরেজ, রাশান, ভারতীয় বা বাঙালি হওয়া হয়ে উঠে না। তাঁরা পৃথিবীর যেখানেই থাকুক কেবলমাত্র মুসলমান হিসাবেই রয়ে যায়।”
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুসলমানদের নামকরণ সবই আরবিতে, বাংলায় নয়। নামগুলি বাংলা হরফে লেখা হয় ঠিকই, কিন্তু উৎস বাংলার নয়। মুসলমানদের এই আরবি নামকরণের জন্য অ-মুসলমানদের কাছে মুসলমানরা বাঙালি হয়ে উঠতে পারল না। সেই কারণেই বোধহয় অ-মুসলিম বাঙালিরা বলে থাকে -- আমরা বাঙালি, ওরা মুসলমান। একজন মুসলমানের নাম শুনে কখনোই অনুমান করা যায় না -- সে কি বাঙালি, সে কি বিহারি, সে কি গুজরাটি, সে কি আফগানি, সে কি তুর্কি, সে কি ইরাকি, সে কি সোদি, নাকি সে আমেরিকান? কিন্তু তিনি যে মুসলমান সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু নাম-পদবি দিয়ে চেনা যায় কে বাঙালি হিন্দু, কে বিহারি হিন্দু। কে গুজরাটি হিন্দু, কে তামিল হিন্দু ইত্যাদি। বাঙালি বৌদ্ধদেরও সহজেই চিনে নেওয়া যায়। ধর্মান্তরিত হলেও বৌদ্ধদের পূর্ব-পরিচয় হারিয়ে যায় না। ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে অমুসলমানের পূর্ব নাম-পদবি সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে ইসলামিক হয়ে যায়। অর্থাৎ পূর্ব-পরিচয় আর থাকে না। যেটা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও পূর্বনাম সম্পূর্ণ না বদলালেও চলে। যেমন – মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কেতকী কুশারী ডাইসন ইত্যাদি। ধর্মান্তরিত হলেও অরিজিন হারিয়ে যায় না। তাই মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও কেতকী কুশারী ডাইসন উভয়কেই বাঙালি ভাবতে ভুল হয় না। তবে সময় বদলেছে। ধর্মান্তরিত হলেও পূর্বনাম আজকাল রাখা হচ্ছে। সুমন চট্টোপাধ্যায় ধর্মান্তরিত হয়ে কবীর সুমন হতে পারে। বিবাহ সূত্রে হিন্দু মেয়ে মুসলিম যুবককে বিয়ে করলেও পূর্বনাম হারাচ্ছে না। যেমন -- জারা সোমা, মৌসুমী বিলকিস ইত্যাদি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর পরিবারের নামকরণে বাঙালিয়ানা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। ইসলামিক পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি পরিচয়ও অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন হিন্দু মেয়ে প্রমীলা দেবীকে। প্রমীলা দেবীর নতুন নাম ইসলামিক বিধান অনুসারে নার্গিস আসার খানম হলেও প্রমীলা দেবী হিসাবেই থেকে গিয়েছিলেন। এইখানেই শেষ নয়, তিনি তাঁর সন্তানের নামও খাঁটি বাঙালি রূপে দিলেন। তাঁর সন্তানদের নাম যথাক্রমে – কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নাগরিকরা নামকরণের ক্ষেত্রে নজরুলকে অনুসরণ করেনি। তবে কেউই অনুসরণ করেনি, একথা বললে নির্জলা মিথ্যা বলা হবে। অনেক মুসলমানই খাঁটি বাংলা নাম ব্যবহার করে। বাংলাদেশে আমার বান্ধবী আছেন, তাঁর নাম লতা খানম। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন আমি চিনি, যাঁদের নাম খাঁটি বাংলায়। যেমন – মোহম্মদ অনির্বাণ ইসলাম, নীলাঞ্জন সৈয়দ, অনির্বাণ ইসলাম সাগর, মোহম্মদ আলি ইসলাম নির্বাক, মোহম্মদ লিখন ইসলাম, মোহম্মদ রাজু ইসলাম, মোহম্মদ বকুল ইসলাম, আবীর ইমতিয়াজ দাস প্রমুখ। সংখ্যায় কম হলেও বাংলা নামেও নামকরণ মুসলমানরা করেন।
তবে রাসেল, জন, জেনি, জেমি, মিল্টন প্রভৃতি নামও মুসলমানরা ব্যবহার করছেন। আরেকটা চল দেখি, অনেকে নামের প্রথম পার্ট বাংলা শব্দের সঙ্গে পারিবারিক অংশ দিয়েও (যেমন আহমেদ, ইসলাম, চৌধুরী) শেষ করে। নাম রাখার আর্জ তৈরি হলে আরও বেশি বাংলা নাম রাখার রেওয়াজ তৈরি হবে। একসময় সেই আর্জটাই তো ছিল না। ফলে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে বাংলা নাম কম দেখা যায়। কেন বিশুদ্ধ বাংলা নাম কম দেখা যায়? দুটো কারণ বলে মনে হয় – (১) একদম শুরুর দিকে নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই প্রধানত মুসলমান হয়। তাঁদের ক্ষেত্রে হিন্দু নাম বিদায় দেওয়াটা জরুরি মনে করেছিল বর্ণহিন্দুদের প্রতি ঘৃণা থেকে। হিন্দু-পরিচয়ের নাম-ও-নিশান মিটিয়ে দেওয়ার তাগিদে সম্পূর্ণ আরবি নাম বরণ করে নিয়েছিল। যে হিন্দু নাম তার নিম্নজাতের পরিচায়ক ছিল, যে নিম্নজাতের হওয়ার কারণেই তাদের ধর্মত্যাগ, সেই নাম তারা বহন করবে কেন? সেই জায়গা থেকেই নামের মাধ্যমে মুসলমানদেরও পরিচয়সূচক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার চেষ্টা থাকাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। (২) বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত যে ইসলামি/ আরবীয় (এমনকি উর্দু, ফারসি) নাম রাখলে আল্লাহ খুশি হবেন, এটা ভেবেও অনেকে বাচ্চাদের জন্যে ইসলামি নাম খোঁজে।
যেসব মুসলমানরা খাঁটি বাংলায় নামকরণ করেন, তাঁরা নিশ্চয় ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠেই করেন। কিন্তু খাঁটি বাংলায় নামকরণ করেন না, তাঁরা নিশ্চয় ধর্মীয় কারণেই করেন না। তাঁরা নিশ্চয় বাঙালি পরিচয়ের আগে ধর্ম-পরিচয় রাখতেই পছন্দ করেন। তাঁরা ভাষায় বাঙালি হলেও নামকরণে বাঙালি হতে একদম রাজি নন। তাহলে মুসলমানিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে করেন। বিশেষ করে যেসব মুসলমানরা কওমি বা খারিজি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা আরবি নামকে আঁকড়ে ধরেন। কারণ হুজুররা মনে করেন, বাংলা হরফে শয়তানির আছর আছে। এ ভাবনার শুরু ১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ শিক্ষক-ছাত্র-জনতার সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের আট দফা চুক্তি হয়। এ চুক্তির পর সরকার লোক-দেখানো কিছু পদক্ষেপ নেয়। আপাত দৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনও কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে বলে মনে হলেও ছাত্র-জনতা ভাষা আন্দোলনের চেতনা ঠিকই জিইয়ে রেখেছিল। ওদিকে পাকিস্তান সরকারও বাংলার বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেল।
0 comments: