গল্প - শ্যামা প্রসাদ সরকার
Posted in গল্প
অন্নপূর্ণা
পটাশপুর বয়েজ' ক্লাবের মাঠটায় ফি বচ্ছর মেলাটা বসে শীতকালে। মাঠের কাছেই বারুই নদী। নদী না ছাই! শ্যামপুর ক্যানালের জলটুকু ছাড়লে বর্ষাকালে তবে না নদী? অন্যসময় চর পড়া মাটি, বাঁজা মেয়েছেলের মত অদরকারী। পা'য় মাড়িয়ে সকলে চলে যায়। নদীর জল আর মেয়েছেলের যৌবন না থাকলে তারা গুরুত্ব হারায়, এটাই জগতের নিয়ম।
মেলাটা আর পাঁচটা গ্রাম্য মেলার মতোই। গোটা দশেক বাসনকোসনের চালা, খেলনা পাতির দোকান, রংবেরংএর ইমিটেশনের হরেকমাল, ঘুঘনি, এগরোল, পাঁপড় জিলিপি কটকটিভাজার দোকান আর বাহারি ঘরসাজানোর প্লাস্টিকের মালের পসরা, ব্যস এটুকুই। পঞ্চু শেখ এখনো আদ্যিকালের কাঠের নাগরদোলাটা রংচং করে আনে বলে বাচ্চাগুলো ওতে চড়তে পায়। মাঠের একদম শেষপ্রান্তে কালুর চোলাই আর ছোলাসেদ্ধর ঠেক। থানা এখান থেকে তিরিশ মাইল। একটা ফাঁড়ি আছে শুধু পটাশপুরে। গুঁফো হাবিলদার তালুকদারকে দশদিনে একশো করে 'দিন' ধরিয়ে দিলে কোনও ঝামেলা নেই আর। এই চোলাই ঠেকের পিছনে খড়ের গাদা বিছানো একটা ঘর আছে। হ্যারিকেন জ্বলে সেখানে টিমটিমিয়ে। চোলাইয়ের পর আরও বাড়তি কিছু চাইলে তারও বন্দোবস্ত আছে। রেট ওই পঞ্চাশ থেকে পাঁচশো। তার বেশী চাহিদা আর জোগান দুটোর কোনওটাই এখানে নেই। কালুর ভাই ধলা এদিকটা দেখে। টোয়েন্টি পার্সেন্ট টাকা কাজের আগে আগাম জমা দিতে হয় আর বাকীটা ধস্তাধস্তির পর সরাসরি দিলেই চলে। ওইটাই কমিশন। দু একটা নষ্ট মেয়ে জ্যালজ্যালে সিন্থেটিক শাড়ি আর সস্তার পাউডার মেখে হয় মেলায় ঘোরে নয় কালুর ঠেকে লক্ষ্মীঠাকরুণ হয়ে বসে থাকে। দরাদরি হবার পর সোজা খড়ের বিছানায় বাসররাত!
মহাদেব কিছুদিন ঘরামির কাজ করতো। তারপর কখনো সখনো রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ের কাজ করতে একসময় সুরাট, বোম্বাই এসব দূর দূরান্তেও সে গেছে। এখন আর এসব পারে না। বুকে জল জমেছে। ছ'মাস আগে এক্সরে তে ধরা পড়লেও তা সারানোর টাকা তাদের নেই। সরকারি ডিসপেন্সারীর ওষুধে যদ্দিন চলে আর কি! আসলে আজ নয় কাল সে পা বাড়িয়েই আছে বলে শুধু শুধু চিকিচ্ছের জন্য টাকা নষ্ট করতে তার সোজা বারণ। তার বদলে ফি সন্ধে একটা ছোট দেশী পাঁট আর ছোলাসেদ্ধই ভালো। কুড়িটাকায় হয়ে যায়। মহাদেব লোক ভালো, বউ অন্নপূর্ণা আর দুটো ছেলেকে সে খুব ভালবাসে। কদিনবাদেই সে মরতে চলেছে বলে বউকে আর রাত্তিরে হ্যাঁচোরপ্যাঁচোর করে টেনে ধরে না যদি রোগ ছড়িয়ে যায়! অন্নপূর্ণা তাই ছ'মাস ধরে ওসব ব্যাপারে উপোসী হয়ে নিজের মনেই ফোঁসে। ইচ্ছে করে মানুষটাকে ধাক্কা দিয়ে জাগাতে। খড়কাটা মেশিনের মত হাঁপের আওয়াজ শুনে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
ছেলেদের নিয়ে অন্নপূর্ণা একবার মেলার মাঠে চক্কর দিতে আসে সন্ধেবেলাতে। ছোটটাকে বড়টার হাত ধরিয়ে দিয়ে সে নিজে বড়ছেলেকে নজরে নজরে রেখে মেলা ঘোরে। অতিকষ্টে সে তিরিশটা টাকা এবছর মেলা দেখতে আসার পুঁজি জুটিয়েছে একটু একটু করে। এর আগে মহাদেবের কাজ ছিল যখন, তখন একবার মেলার মাঠে এগরোল কিনে খেয়েছিল দুটিতে। ছোটটা তখন পেটে। দিনভর পেটের ভিতরটা খাইখাই করতো সে সময়।
ছেলে দুটোকে দুটো খেলনা কিনে দিতে খরচ হল পনের টাকা। একটা মা কালীর ছবি পাঁচটা টাকা নিল। মহাদেবের জন্য নিল আরো পাঁচ টাকার ঘটিগরম, মালের সাথে যদি বা ছোঁয় মানুষটা! তারপর লুব্ধ দৃষ্টিতে অক্ষম ক্রেতার মত সে সারাটা মেলা ঘুরতে ঘুরতে একটা বাসনের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। একখানা স্টীলের ছোট পাতিল হাঁড়ি কি সুন্দর দেখতে। অভাবী ঘরণীর চোখ ওতে বসে যায়। কিনতে পারবেনা জেনেও দাম জানতে চায় একবার। দোকানীও এ গাঁয়েরই লোক, বলে নিলে দাম কমিয়ে দুশো থেকে দেড়শো করে দেবে সে। দেএএএএড়শোওওও টাকা! কোথায় পাবে সে! কতদিন দু'পাঁচশ টাকাই চোখে দেখেনি অন্নপূর্ণা একসাথে তা সেই জানে।
আস্তে আস্তে ভীড়টা পাতলা হয়ে আসছে মেলায়। চরের শুকনো ঠান্ডা হাওয়া গায়ে ছোবল বসাচ্ছে। কালুর ঠেকের পিছনের ঘরটা থেকে আড়াইশ টাকা গুনতে গুনতে অন্নপূর্ণা বেরিয়ে আসে। তিনশ' টাকায় আড়তদার শুকদেব সিং তার ছমাসের উপোসী শরীরটাকে একটু আগেই নেড়েচেড়ে দেখেছে। অনেকদিন পর শরীর জাগলে কেমন ঝিম্ ধরা লাগে! এখন আবার বাসনের দোকান থেকে ছেলে দুটো'কে নিয়ে ঘরের দিকে যেতে হবে। আর হ্যাঁ অভাবের সংসারে একদিন ভরপেট ভাত রেঁধে খাওয়ার জন্য ওই স্টীলের পাতিল হাঁড়িটাও কিনতেই হবে তাকে।
0 comments: