0
undefined undefined undefined

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in


মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার ইতিহাস ও ৩০ লাখ শহীদের গল্প


বাংলার সবুজ মাঠকে লাল করে দিতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলি। তার ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, ‘Paint the green of East Pakistan red.’ আর তা তিনি দিয়েও ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ইতিহাসের বাইরে রয়েছে বর্বরতার এক বিশাল ইতিহাস। এই দেশের এমন কোনো জেলা নেই, এমন কোনো থানা, ইউনিয়ন বা গ্রাম নেই, যেখানে পাকিস্তানী বাহিনী নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ করেনি। 

গণহত্যার সংজ্ঞা খুঁজতে গেলে জানা যায়, কোনো জাতি, আদিবাসী গোষ্ঠী, বিশেষ বর্ণের জনগোষ্ঠী অথবা কোনো ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করে দেবার উদ্দেশ্যে তাদের উপর হামলা চালানো হলে, সেটি গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হবে। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ থেকে প্রকাশিত দলিলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করেছে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। 

১৯৭১-এর মার্চের ২৫ তারিখ থেকে পরবর্তী নয় মাসে পরিকল্পিতভাবে বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে, তিন লক্ষেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়াসহ অপহরণ, গুম ও বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। আর এসব হামলায় পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে বাঙালি-অবাঙালি সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা।

আন্তর্জাতিক মহলের মতে, ১৯৭১-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তিন মিলিয়ন বা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। ‘৩০ লাখ’ সংখ্যাটির সমর্থন রয়েছে ‘এনসাইক্লোপেডিয়া আমেরিকানা’, ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন’, ‘টাইম’ ইত্যাদি ম্যাগাজিনে। এদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে নাজি বাহিনীর বর্বরতার চাইতেও ভয়াবহ।

২৫ মার্চের গণহত্যা দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বাঙালি নিধনের শুরু। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার ও পিলখানায় সেনা-অভিযান চালায় তারা। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের হত্যা করতে শুরু করে। কত ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-ইপিআর-সাধারণ মানুষ সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন তা গুনে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমগুলোও সেদিন রেহাই পায়নি। পাকিস্তানী হানাদাররা সেই রাতে আগুন দিয়ে ও মর্টার সেল ছুঁড়ে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসক্লাব ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকেও। অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকা ‘হেরাল্ড ট্রিবিউনে’র রিপোর্ট অনুসারে, শুধু ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরেই ১ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

এ তো গেলো শুধু একটি শহরের একটি দিনের হিসেব। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের প্রতিটি দিনেরই এমন অনেক হিসেব রয়েছে। আজো দেশের আনাচে কানাচে খুঁজে পাওয়া যায় বধ্যভূমি-গণকবর, যেগুলো পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের দেশীয় দোসরদের সংঘটিত গণহত্যার দগদগে প্রমাণ হাজির করে। 

২০১৮ সালে ‘১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ তাদের একটি জরিপ সম্পর্কে জানায়, জরিপে তারা শুধু ১০ জেলাতেই ১,৭৫২টি গণহত্যার তথ্য পেয়েছেন। সেই ১০টি জেলা হলো নীলফামারি, বগুড়া, নাটোর, কুড়িগ্রাম, পাবনা, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, নারায়ণগঞ্জ, ভোলা ও খুলনা। দশ জেলার মধ্যে গণহত্যার সবচেয়ে বেশি ঘটনা পাওয়া গেছে খুলনায়। সেখানে ১,১৫৫টি গণহত্যা, ২৭টি বধ্যভূমি, ৭টি গণকবর এবং ৩২টি নির্যাতন কেন্দ্রের তথ্য পাওয়া গেছে। এখনো জরিপ কাজ চলমান রয়েছে। 

এর আগে ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ বাংলাদেশে প্রায় ৯৪২টি বধ্যভূমি সনাক্ত করে, যার মধ্যে চট্টগ্রামেই রয়েছে ১১৬টি। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমির শুধু একটি গর্ত থেকেই স্বাধীনতার পর ১১০০ মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি দামপাড়া। ১৯৭১ সালে এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেনা পাহারায় ৫/৬টি ট্রাকবোঝাই জীবন্ত মানুষ ধরে নিয়ে আসা হতো। লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর তাদের মাটিচাপা দেওয়া হতো। ধারণা করা হয়, এখানে আনুমানিক ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। রাজশাহীর একটি বধ্যভূমিতে একশটি গণকবর থেকে দশ হাজার মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। স্বাধীনতার পর খুলনার গল্লামারী বধ্যভূমি থেকে প্রায় পাঁচ ট্রাক ভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। ওখানে আনুমানিক ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। 

শুধুমাত্র খুলনার চুকনগরেই ১৯৭১ সালের ২০ মে, একদিনে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার রেলব্রিজটি লালব্রিজ নামে পরিচিত। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনারা ট্রেন থামিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে ব্রিজের পাশে জমিগুলোতে পুঁতে রাখতো। পুরুষদের হত্যা করা হতো, আর নারীদের ক্যাম্পে এনে দিনের পর দিন নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটিচাপা দিত বর্বর পাকিস্তানী সেনারা। ১৯৭১ এর ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গায় তিন হাজারেরও বেশি বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করে। 

ঢাকার মিরপুরে স্বাধীনতার পর ১০টি বধ্যভূমির সন্ধান মেলে। কালাপানি বধ্যভূমি, রাইনখোলা বধ্যভূমি, শিরনির টেক বধ্যভূমি, সারেং বাড়ি বধ্যভূমি, গোলারটেক বধ্যভূমি, বাংলা কলেজের আমবাগান বধ্যভূমি, আলোকদি বধ্যভূমি, মুসলিম বাজার বধ্যভূমি, শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি। এরমধ্যে রায়েরবাজার এবং জল্লাদখানার মতো বধ্যভূমির মোট লাশের সংখ্যা কখনোই নির্ণয় করা সম্ভব হবে না।

অধ্যাপক আনিসুর রহমান ঢাকার শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি দেখে এসে বলেছিলেন- ‘কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্তকে কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। ... আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তীর্ণ বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল। পা বাঁচিয়েও হাড়হীন মাটির ওপর পা ফেলতে পারিনি। দেখেছি কুয়ায় কুয়ায় মানুষের হাড়।’

নয় মাসের গণহত্যার তালিকায় বধ্যভূমি আর গণকবরগুলোতে ঘুমিয়ে থাকা শহীদরাই নন, তাদের পাশে আরো আছেন বিভিন্ন পাকিস্তানী ক্যাম্পে নৃশংস নির্যাতন, ধর্ষণের শিকার হওয়া অসংখ্য নারীরা, নৃশংস ধর্ষণের পর যাদের আরো নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। আর আছেন তৎকালীন পূর্ববাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পতাকাবাহী, মুক্তিযুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা।

ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে পাকিস্তানী বাহিনী ও আলবদরের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রকৌশলী।

এখানেই শেষ নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা এবং গবেষকদের গবেষণা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৭১ সালে ভারতে চলে যাওয়া প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শরণার্থীর ভেতর ৬ থেকে ১২ লাখ মানুষ পথকষ্ট, খাদ্যাভাব, অপুষ্টি ও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া ডায়েরিয়া-কলেরায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

বাংলাদেশে নিজেদের পরাজয়ের কারণ বের করতে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান ‘হামাদুর রহমান কমিশন’ গঠন করে। ২৮ বছর সে রিপোর্ট লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছিল দেশটি। ২০০০ সালে গণমাধ্যমে এই কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দেখা যায়, কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সিনিয়র পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারা প্রায় সবাই-ই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছেন।

১৯৮১ সালে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে, সবচেয়ে স্বল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। গড়ে প্রতিদিন ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। গণহত্যার ইতিহাসে প্রতিদিনের এই গড় হিসেবই এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি। গণহত্যার এই ইতিহাসের কথা তেমন করে বলা হয়ে ওঠেনি আজো। অথচ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বুকে যে গণহত্যা চালিয়েছিলো সে রকম আরেকটি গণহত্যার উদাহরণ খুঁজে বের করা প্রায়ই অসম্ভব।

0 comments: