0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in


বংশপ্রদীপ


(১)

জানালার ধারে বসে ছিল রাতুল। বেশ ভিড় ছিল। তবু হালকা হাওয়া খেতে খেতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারেনি। ট্রেন ইছাপুরে ঢুকছে। ব্রিজ পার হওয়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখের পাতা দুটো বার বার পাল্টাতে পাল্টাতে নজর গিয়ে পড়ল হ্যান্ডিক্যাপ্ট সিটের মাথার উপরে। সবুজ কালিতে লেখা নাম ...মিন্টু। এখন নজর আটকে গেল সেই ইংরাজি হরফের সবুজ কালির নামে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত তার সামনে বেশ ভিড় ছিল। নানান লোকজনও দাঁড়িয়ে ছিল। এখন আর ভিড় নেই। এখন ফাঁকা। লেখাটাই তাকে যেন বেশি করে আকৃষ্ট করছে। নজর তার আটকে রইল সেখানে। সেই সবুজ কালির হরফের নামেতে।

একবছর পরে ঐ নামটা এভাবে চোখের সামনে এসে হাজির হবে সে এতদিন ভাবেওনি। এমনকি নামটা ঘটনার ঘনঘটায় প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল।

এখন নামটা হুড়হুড় করে তাকে অনেক ঘটনার, অনেক স্মৃতির সরণিতে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। রাতুল শুধুমাত্র তাকিয়ে রইল জানালার বাইরে। ট্রেন এগিয়ে চলল শিয়ালদার দিকে। রাতের আলোয় বাড়িঘর, দূরের রাস্তা, গাছপালা হুটহাট করে সরে সরে যাচ্ছে। আর তার মন চলছে সেই নামটার টানের প্রবাহে...



রাতুল গিয়ে পৌছালো ঘন বাঁশ ঝাড়ের ভিতর। শীতের পড়ন্ত বিকেল যেন এইখানে একটু বেশি আবছা অন্ধকার ডেকে এনেছে। দু-একটা পাখির কিচিরমিচির, পুরো বাঁশবনে সজীব হয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। শুকনো বাঁশ পাতা পড়ে রয়েছে বিবর্ণ হয়ে। হাঁটু সমান পুরু পুরু পাতাওয়ালা গাছগুলো যেন বাঁশগাছের ডগাগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে অনন্তকাল ধরে। তাদের গায়ে সাদা সাদা চুনের মতো ছোপ ছোপ। আর সারা গা ধুলোয় ভরা। তবুও তাদের কোলের মধ্যে হালকা গোলাপি গোলাপি পাকা পাকা দেশি জামের মতো থোকা থোকা ফল ঝুলে আছে অবলীলায়। যার নজর তাদের উপর একবার পড়বে, তার নজর সহজে আর সরবে না। রাতুলেরও দশা তাই।

কিন্ত সেদিকে তাকিয়ে সে আর কতক্ষণ থাকবে? যাবে তো সে মিন্টুর বাড়ি। কিন্তু এই অপরিচিত জায়গায় সে বাড়ি চিনে উঠবে কি করে? এদিকে রাস্তার লোকও তাকে এই বাঁশবাগানের দিকে দেখিয়ে দিল। এখানে তিন দিকেই পুকুর আর পুকুর পাড়ে পাড়ে কলার ঝাড়। আর তাদের জড়িয়ে ধরে প্রায় ঢেকে ফেলেছে হলকল্মিলতা।

হঠাৎ পিছন থেকে শুকনো পাতা মাড়ানোর আওয়াজ কানে আসছে তার। ঠিক পিছন থেকে তো! পিছন ফিরে কাউকে দেখতে পেল না সে। এপাশ ওপাশ তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু পাতার কড়মড়ানি আরো তার কাছে এগিয়ে আসছে। কিন্তু এখন সেই আওয়াজ কোনদিক থেকে আসছে ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। তার বুক দূর দূর করতে লাগল। একে বাঁশঝাড়ের তলা, তার উপরে সন্ধ্যে নামো নামো। তার মন বলছে পালাই পালাই কিন্তু পা সেই ডাকে সায় দিচ্ছে না। সে পালাবে? না পালাবে না? হঠাৎ তার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। জিভ বের করে একটু থুতু আঙুলের ডগায় ঠেকিয়ে নিয়ে লাগিয়ে দিল বুকে। আর সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠিকই কিন্তু বুকটা দুরদুর করতে লাগল। ভয়ে মনে মনে আওড়াতে লাগলো...

"ভুত আমার পুত, শাকিনী আমার ঝি

রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে ভয়টা আমার কি?”

সঙ্গে সঙ্গে পিছনের দিকে তাকিয়ে তার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। খালি গা, হাঁটু পর্যন্ত ধবধবে সাদা ধুতি পরা একজন বেশ লম্বা গোছের লোক এগিয়ে আসছে সেই পথ ধরে। হাতে একটা পিতলের ঘটি। তার থেকে জল ঢালছে ডান হাতের তালুতে। আর ছিটতে ছিটতে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছেন তার দিকে। মুখে কি একটা বিড়বিড় করছে।

রাতুলকে দেখা মাত্রই আর পা ফেলল না। ডান হাতের তালুর জল শুকনো পাতায় পড়ছে টপটপ করে। সেই নির্জন আবছা আলোয় নিস্তব্ধতায় জলের ফোঁটা ফোঁটা আওয়াজ যেন এই নীরবতা ভঙ্গ করছে।

রাতুলের পা যেন আটকে গেছে। এ কি দেখছে সে? মানুষ তো না অন্য কিছু? এই সময় তো নাকি তেনারাও বাঁশঝাড়ে ফিরে আসেন। জিভ শুকিয়ে যেতে লাগল।

পালাবে না কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে?

কিন্তু যাবেই বা কি করে? জিভ তার আড়ষ্ট হয়ে আসছে। তবুও জোর করে সে আদুল শরীরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল… মি-মি-মিন্টুদের বাড়ি কোনটা? আমি ওর বন্ধু। ক–ক–কলকাতায় আমরা একসঙ্গে থাকি। ওদের...

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সেই লোকটি হাত বাড়িয়ে ঝোপঝাড় পরিবৃত পথটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল।

কিন্তু কিন্তু করে রাতুল এগিয়ে গেল সেদিকে। সামনে একটা বাড়ি। চারদিক দিয়ে বাঁশ আর শিরীষ গাছে ছেয়ে ফেলেছে বাড়িটাকে। বাড়ির পিছনে পানাপুকুর। তার পাড়ে কলাগাছের ঝাড়।

টালির ছাউনি ঘর। পাতা পড়ে তার অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেছে। বাড়িটাকে ঘিরে মাটির পাঁচিল। তার মাথায় খড়ের ছাউনি। যেন পাঁচিলটা নতুন বউয়ের মতো একহাত ঘোমটা দিয়ে মুখে ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। তারই ফাঁকে একটা কাঠের দরজা হাট করে খোলা।

রাতুল একটা সঙ্কোচ নিয়ে ঢুকে পড়ল সেই দরজা দিয়ে। পায়ের ধাক্কায় দরজায় ঠেক দেওয়া ইঁটটা গেল সরে। অমনি পাল্লাটা কোঁঙঙঙঙ করে অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে থমকে গেল রাতুল। পায়ের বুড়ো আঙুলটা চোট পেয়েছে সেই ইঁটে। হেঁট হয়ে তাকিয়ে দেখলো ফেটে গিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে কিনা। কিছুক্ষণ আঙুলের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মুখ তুলে সামনের দিকে তাকাল। চমকে উঠল সে। দেখে, সেই লোকটা এই অন্ধকারময় উঠোনে জলের ছিটে দিয়ে চলেছে। এ কি মিন্টুর কেউ হয় নাকি? নইলে এখানেই বা কেন?এ কেমন যেন রহস্যময় পরিবেশ। কিছু ভাববার অবকাশ দিচ্ছে না যে। ভয়ে কৌতূহলে আরো পা দুয়েক ঢুকেই মিহি অথচ শঙ্কিত গলায় রাতুল ডেকে উঠল …কাকিমা, ও কাকিমা?

একটা ক্ষীণ কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর ভেসে আসছে সেই আবছা অন্ধকার ভেদ করে।

…বউউউ মা, ওওও বউউউ। কে ডাকে দেখো তো?

ঘরের ভেতর থেকে উত্তর আসে …আসছি মা, কে আবার এমন সন্ধ্যেয় এই যম পুরীতে আসবে? সন্ধ্যে নামলে তো এখানে যমে মানুষে টানাটানি চলে।

ওদিকে উঠোনের দক্ষিণ কোণে ঠাকুর ঘর। সেখান থেকে সন্ধ্যারতির ঘন্টা বেজে উঠল। জোরে জোরে উচ্চারিত হলো মন্ত্র। মুখরিত হতে হতে হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য। সেই ধ্বনি মন্দির ছেড়ে উঠোনে, উঠোন ছেড়ে সেই আবছা অন্ধকারে, অন্ধকার ছাপিয়ে ছড়িয়ে গেল বাঁশগাছের মগডাল ছাপিয়ে অনেক অনেক দূরে।

লাল পেড়ে সাদা কাপড় পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল এক মহিলা। হাতে হ্যারিকেন। বারান্দায় রেখে জিগ্যেস করল …কে আবার এল এই ভর সন্ধেয়?

রাতুল বারান্দার দিকেই এগিয়ে এসেছিল।

…ওমা রাতুল যে! আয় আয় উপরে উঠে আয়। তা এই ভর সন্ধেয় কী মনে করে?

রাতুল কেমন যেন ভ্রমের মধ্যে ছিল। মনে মনে স্বস্তি পেল। ভাবল …যাক তবু চিনতে পেরেছে।

কিন্তু উত্তর কোথা থেকে শুরু করবে সে? ঢোঁক গিলে নিয়ে বারান্দায় উঠে গেল সে। এখন কি সে ভনিতা করবে নাকি সরাসরি আসল বিষয়টা জানতে চাইবে? সন্ধ্যা নেমে গেছে। হ্যারিকেনের আলো বেশি দূর ছড়িয়ে পড়ছে না। ওদিকে ধুনোর ধোঁয়ায় সারা উঠোন আরও যেন অন্ধকার ডেকে এনেছে। তাছাড়া তাকেও ফিরতে হবে। তাই সে সরাসরি আসল কথায় ঢুকে গেল। পাতা চাটাইয়ে বসে মৃদু গলায় জানতে চাইলো …কা-কাকিমা, মিন্টু কি বাড়িতে আছে?

…না বাবা, ও তো কালই কলকাতায় গেল।

শুনে কেমন যেন আশ্বস্ত হল সে। কিন্তু যাদের কাছ থেকে সে এসব শুনে এসেছে তারা মিছে কথা বলার লোক নয়। সংশয়ের আবর্তে কেমন যেন পাক খেয়ে গেল সে। তবুও সে কৌতূহলে সংশয় প্রকাশ করল …কি সব রোগ হয়েছে শুনছি? ওকে নাকি কেমো দিতে হচ্ছে?

…ছি ছি রাতুল। এই ভর সন্ধেয় তুই একথা মুখে আনলি কি করে? তোরা না একসঙ্গে থাকিস। তোর মুখে একথা আটকে গেল না? তুই এমন অমঙ্গলের কথা আমার বাড়িতে বসে আমার ছেলের নামে বলতে পারলি?

মিন্টুর মাকে সে আগেও কয়েকবার দেখেছে তাদের কলকাতার ভাড়া বাড়িতে। তার ধারণা ছিল যে মিন্টুর মা বেশ আধুনিকা, এমনকি সময়োপযোগী। সেইসঙ্গে বেশ স্নেহময়ী ও বাস্তববাদীও বটে। কঠিনকে খুব সহজে মেনে নিতে পারে।

কিন্তু আজ সেই মহিলার বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটা সে যেন খুঁজে পেল না। রেগে জোরে জোরে রাতুলের দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে বাড়িয়ে কত কথা বলতে লাগল। চোখ-মুখে যেন তাচ্ছিল্যের ছাপ। একরাশ ঘৃণা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে।

রাতুল কেমন সিঁটিয়ে গেল। যেচে পড়ে সে এসেছিল। চোখে চোখ রাখতে পারল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। মুখের কথা আর বের হল না।

মিন্টুর মার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই মশারির ভেতর থেকে একটা হুঙ্কার আসছে। সেই কাঁপা কাঁপা বয়স্ক মহিলার গলা

…কোন খেয় পোড়া লো? ও লো বউ ওর মুখে ঝাঁটা মার, ঝাঁটা মার না। দে ঝেঁটিয়ে দে।

সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরে ঝাই বাজার আওয়াজ তীব্র ঝংকারে মুখরিত হতে লাগল। হাঁড়ি কাঠে পাঁঠাবলি দেওয়ার আগে উল্লাসে যেমন ঢোল-করতাল-ঝাই একসঙ্গে বেজে ওঠে, রাতুলের তেমন মনে হল। শিউরে উঠল সে। সারা শরীর তার অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল। না আর বসে থাকলে হয়তো এরাই তাকে মেরে ফেলবে। নিমেষের মধ্যে অতি দ্রুত সে বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ল উঠোনে। দিল দৌড়। পেছন থেকে একটা পুরুষের গলা ভেসে আসছে …দাঁড়া, দাঁড়া বলছি।

যেন প্রাণ হাতে নিয়ে রাতুল সেই বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

একটা ক্ষীণ আওয়াজ যেন তখনও সেই অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে …দাঁড়া, দাঁড়া বলছি।



(২)



নির্জনতায় মানুষ নিজেকে জনতার মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলে। নির্জন থেকেও নিজেকে জনতার ভিড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে পরখ করে। হাতড়ে হাতড়ে দেখে তার ফেলে আসাকে ও বর্তমানকে। অনুভব করতে পারে তার আগামীকে। এখন রাতুল শুধু অনুভবে নয়, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তা। ফাঁকা রাস্তায় এসে আবছা আলোয় তার নিজের গালে নিজেই দুটো চড় মারতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে ভাবছে …যেচে পড়ে উপকার করতে এসেছিল। বিপদে কটা টাকা তাদের হাতে দেব। শেষে কিনা অপমান? এমনকি প্রাণ নিয়ে টানাটানি ?

পকেটে হাত দিয়ে সে লজ্জায় পড়ে গেল। টাকাগুলো তার হাতে ঠেকছে। অপ্রতিভ হয়ে পড়ল সে।

সত্যি সত্যিই সে নিজের গালে চড় কষিয়ে দিল …যেচে এসে উপকার? নে, মর এবার। এই রাতে প্রাণ বাঁচিয়ে বাড়ি যা! নিজের ভালো কে না বোঝে?

তবে রাতুল নিজের ভালো বুঝেছিল। কয়েক বছর গেল। মিন্টু, কাজল, প্রতাপদের ছেড়ে সে দূরে চাকরি করতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আজ সেই সব দিনের কথা লাইন দিয়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ...মিন্টুর মা বাবার সেই আগ্রাসী মূর্তিতে আবার তারা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। চোখের সামনে তাদের সেই পুরনো মূর্তিগুলো হাজির হল। তার দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে যেন এগিয়ে এল।

চোখ কড়কড় করছে তার। অথচ এই মিন্টুর জন্য তারা চার বন্ধু মিলে কিনা না করেছে!

একে একে সেই ঘটনাগুলো তার সামনে এসে দরবার করছে।

স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ঘটে চলছে অবিরামভাবে...



ভোরের আলো শেষ হয় হয়। শীতের সকাল। হালকা কুয়াশায় শহর আড়মোড়া দিচ্ছে। রাতুলদের কারো ঘুম ভাঙেনি। দরজার গিলে কেউ একজন ঠুকছে আর মিন্টু রাস্তা লাগোয়া গেটের মুখ থেকে চেঁচাচ্ছে …ওরে ওঠ, ওঠ। এই রাতুল, এই প্রতাপ, ওঠ না রে। আমার পা ভেঙে গেছে। নামা আমাকে। ওঠ না।

কথাগুলো কানে যত না যাচ্ছে তার থেকে দরজার গিল ঠোকার আওয়াজ বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠছে তাদের কাছে।

প্রতাপ ভালো করে কম্বলটা মাথায় ঢেকে নিয়ে জড়ানো জড়ানো গলায় ঘরের সবার উদ্দেশ্যে বলল …দেখিস, শালা আবার কোনো কাণ্ড বাধিয়ে নিয়ে এসেছে।

রাতুল মুখ বাড়িয়ে তাকে সমর্থন করে শোনালো …ঠান্ডার সময় ছ্যাবলামোর একটা সীমা আছে। বেড়াতে গিয়েছিস, গিয়েছিস। ব্যাস। ভোর না হতে হতে, ফিরেই বাঁদরামি শুরু করেছে।

প্ৰতাপ বিরক্ত হয়ে বলল …একটু চেঁচাতে দে, দেখবি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হেদিয়ে পড়বে। ঘুমা সব কেউ উঠবি না।

না, কিছুতেই সেই ডাক ও গিল ঠোকা বন্ধ হল না। প্রতাপ বিরক্ত হয়ে উঠে গেল দরজার দিকে। গজগজ করছে …বাইরে বের হতে দে। শালা গিয়েই ক্যালাব। মালটা কাঁচা ঘুমে বাড়ি দিল রে। আসছি দাঁড়া। তারপর তোর মজা দেখাচ্ছি।

দরজা খুলে বাইরে দেখে সাকসেস কোচিং সেন্টারের মালিক সুবলদা দাঁড়িয়ে। মুখ বাড়িয়ে দেখে একটা রিক্সায় ড্রাইভারের সিটে পা তুলে রিক্সায় বসে হাসছে মিন্টু। পা টা প্লাস্টার করা। দেখেই ঘুম ও বিরক্তি গেল উবে।

এবার সেও চেঁচাচ্ছে …ওরে বাইরে আয় সব। মিন্টুর পা প্লাস্টার করা। ওরে সত্যিই ওর পা ভেঙে গেছে। ওঠ, আয় শিগগির।

সবাই তড়িঘড়ি উঠে তাকে নামিয়ে এনেছিল।

সন্ধ্যের সময় তাদের ঘরে মিটিং হল। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল …ওদের এই ভাড়া বাড়িতে কে তাকে দেখাশোনা করবে? গ্রামে পাঠালে ওর ট্রিটমেন্টের অসুবিধা হবে। তাছাড়া মিন্টুও বাড়ি ফিরতে চায় না। তার বাবা এসব দেখে ভেঙে পড়বে। তাহলে উপায়?

রাতুল বলল …তুই যে বাড়িতে টিউশনি পড়াস, ঐ তপতি বৌদির বাড়িতে থাক না। ওদের সঙ্গে তো তোর বেশ মাখো মাখো সম্পর্ক। ব্যবস্থা সব ওরাই করে দেবে। তাছাড়া ওরা তো তোকে বাড়ির লোকের মতো দেখে। কি বলিস?

প্রতাপ আর বসে থাকতে পারল না। …ঠিক বলেছিস। দাঁড়া, আমি বৌদিকে ডেকে আনি।

মিন্টু না না করে বাধা দিতে চাইলেও প্রতাপ বেরিয়ে গেছে।

শেষ মেষ সেই বাড়িতেই তার ঠাঁই হয়।

সেই থেকেই তারাই তার পাতানো দাদা-বৌদি। তার পা ভাঙা অবস্থায় তাকে স্নান করানো, খাওয়ানো, তার বেড প্যান পরিষ্কার করা সবই তারা করে।

এমনকি কাঁধে করে সাপোর্ট দিয়ে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজও। সেইসঙ্গে গ্যাটের পয়সা খরচা করা। কী করেনি তারা?

কিন্তু একদিন বিবাদ বাধলো। সেটা প্রায় মাস আড়াই পর। এই সেবা শুশ্রূষার ভেতরে ভেতরে কখন যে অসুখ জন্মেছিল তা খুব সহজে ধরা দেয়নি ।

তপতি বৌদির বাবা-মা কাঁদো কাঁদো হয়ে হয়ে এল তাদের ভাড়া বাড়িতে। মিন্টু সেদিন গ্রামের বাড়িতে গেছে। ঘরের মধ্যে কাজল আর প্রতাপ সঙ্গে। রাতুল।

রাতুলই প্রথম মুখ খুলল …একি আপনারা এত রাতে?

প্রতাপ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত শ'এগারোটা। সেও বলে ওঠে …তাই তো। এখন কেন?

রাতুল আবার মুখ খুলল …চন্দ্রিমা, তুই বাইরে কেন? আচ্ছা, ওকে নিয়ে কী কিছু হয়েছে?আয় চন্দ্রিমা ভেতরে আয়। আর আপনারাই বা কাঁদছেন কেন?

এতক্ষণ চন্দ্রিমার দিদা কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল। তাতে তার নাক টানার শব্দ সবার কথার মাঝে মাঝে সজীব হয়ে উঠছিল। কিন্তু রাতুলের প্রশ্নে তপতি বৌদির মা এবার ফোঁপাতে লাগল …নিজের মেয়ের কুকর্মের কথা নিজের মুখে আর কি করে বলি? কিন্তু আর চুপ করে থাকতে পারলাম না বাবা। এই নাতনিটাকে মেরে ঘর থেকে বের করে দিল। আর কি চুপ থাকা যায়?

একটা ঢোক গিলে আবার শুরু করলেন …তোমাদের বলছি, ঐ মিন্টুকে আমরা নিজের ছেলের মতো দেখতাম। এই কয়েকমাস ওকে আমরা কীভাবে টেনেছি তা তোমরা জানো। বলতে নেই তবুও বলছি ওর মা-বাবা হলে এতকিছুর ঝক্কিও নিত না। কিন্তু তুই কিভাবে আমার মেয়ের সঙ্গে দিনের পর দিন… ছি ছি! সে কথা মুখে আনাও পাপ!

কথাগুলো অনুচ্চারিত হলেও কারোর কাছে আর গোপন থাকল না। সবাই মাথা নিচু করে রইল। এ ঘটনা যে শুধু দিনের হিসেবে নয়, কয়েক বছরের, তা এদের কাছে আভাষ ইঙ্গিতে এসে ধরা দিত। বলতে গেলে তা সবার কাছে একেবারে গোপন ছিল না। কিন্তু আজ তা যেন প্রমাণ হাতে নিয়ে এসেছে।

এতক্ষণ চন্দ্রিমার দাদু চুপ করে ছিলেন। কিন্তু আর পারলেন না। এবার স্ত্রীর কথার সমর্থনে নেমে পড়লেন …লজ্জায় মাথা কাটা গেল। এইটুকু মেয়ে দেখে ফেলায় তাকে ধরে মারধর। তোর জন্য আমার নাতনিটা মরবে নাকি? তোমরা বাবা এর কোনো ব্যবস্থা করো। নইলে... বাকিটা অনুচ্চারিত থেকে গেল।

রাতুলরা মাথা নিচু করে বসেছিল। সবাই চুপ করে আছে। মৌনতা ভাঙল প্রতাপ। …ওকে আর আপনাদের বাড়ি যেতে দেবেন না, মেসমশাই। মিন্টুর মাকে ডেকে সব কিছু জানান।

কেউ এই মতে তাঁরা সমর্থন যেন জানাতে পারলেন না। রাতুল চন্দ্রিমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যথেষ্ট বড় হয়েছে। পনের পেরিয়েছে। সবই বোঝে। ক্লাস এইটে পড়ছে। বার দুয়েক ফেল করেছে। নইলে এবছর মাধ্যমিক দিত।

প্রতাপ বলল …আজ রাত অনেক হল। আমার মনে হয় আপনারা বাড়ি যান। কয়েকদিন সময় দিন, আপনারা ও আমরা একটা কিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নেব।

দিন তিনেক গেল না চন্দ্রিমার বিয়ের সানাই বেজে গেল। দূর এক অজ পাড়া গাঁয় গ্রামের বউ হয়ে চলে গেল সে। রাতুলরাও কেউ জানতে পারল না।

পাতাও ঝরল গাছ থেকে। কোকিল ডাকল গাছে। দক্ষিণের হওয়া বইতে শুরু করল ধীরে ধীরে। রাতুলরাও যে যার মতো ছড়িয়ে গেল কেউ চাকরির জন্য, কেউ বিয়ে করে বাড়ি, কেউ অন্যত্র। ভাড়া বাড়ির সম্মুখ সম্পর্ক গেল ছিন্ন হয়ে।



(৩)



সম্পর্ক ছিন্ন হলেও কোথাও একটা প্রচ্ছন্ন যোগ থেকে যায়। সম্পর্ক নেই বলে লোকের কাছে প্রমাণ করতে চাইলেও সেই মানুষ ও সেই দিন, সেই ঘটনার চোরা স্রোতে মনের অগোচরে তাদের প্রবাহে প্ৰবাহিত হয়। তাদের সঙ্গে কিছুই নেই বললেও সেই ব্যক্তিদের নিয়েই কথা বলতে হয়। ঘটনাকে অস্বীকার করতে গেলে তারাই তো আবার এসে পড়ে। তাহলে সেই সম্পর্ক থাকলো না আর কোথায়?

তাই বুঝি ঘটনাক্রমে আজ সকালে অফিস ঢোকার মুখে রাতুলের ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের ওপার থেকে প্রতাপের গলা ভেসে এল

…মিন্টু দুদিন হল নেই, মারা গেছে। ওর মাটা বুঝি পাগল হয়ে যাবে রে!

…বলিস কি! কেন কি হয়েছিল?এ কি খবর শোনালি?

…আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। ওদের পাশের বাড়ির একজন শোনালো।

…তপতি বৌদিরা জানে?

…ওরা জানবে না হয়? ওরাই তো সব করল। এত কথা কি আর ফোনে বলা যায় রে?

…ঠিক আছে, তুই রাখ। আমিও অফিসে ঢুকছি। দেখি, আমি আজ ওদের বাড়ি যেতে পারি কিনা! হ্যাঁ, তুই কিন্তু সঙ্গে থাকিস।

…আচ্ছা

রাতুল অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি করে ফিরছিল। ট্রেনের জানলার ধারে বসেছিল। ঘুম ভাঙার পর ঐ লেখাটা চোখে পড়ে। আর চোখের পাতা এক করতে পারেনি। ট্রেনও আজ অনেক লেট। শিয়ালদা নামল রাতুল। রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। না, মিন্টুদের বাড়িতে ও কোনো মতে যেতে পারবে না।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল স্টেশনে। ওদের ওখানে গেলে এত রাতে কিছুই পাবে না। যাবে কি করে? বেশ কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর হুট করে চড়ে বসল শিয়ালদা সাউথের ট্রেনে। নেমে পড়ল বালিগঞ্জে।

এগারোটা বাজে বাজে ভাব। কিছু আর ভেবে লাভ নেই। বেরিয়ে গেল মেইন রাস্তায়। একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা চলে গেল ওদের সেই তপতি বৌদির বাড়ি।

রাস্তা তখন বেশ ফাঁকা। বালিগঞ্জ ব্রিজ থেকে ইস্টার্ন বাইপাসের দিকে ট্যাক্সি তখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। মনে খটকা লাগছে তার এতদিন পরে। তপতি বৌদি তাকে দেখে আবার কিছু বলে বসবে না তো?

বাড়ির গেটে গাড়ি থামল। অনেক দ্বিধা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বেল বাজালো। …যাই। আবার এখন কে এল? দেখতো বাণী।

বুকটা ছলাৎ করে উঠল রাতুলের, এটা তো তপতি বৌদির গলা। কি জানি কি ভাববে আবার। যা ভাবে ভাবুক। সংশয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাতুল। দরজা খোলার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে বাণী চেঁচিয়ে উঠল …ও মা কাকু! এতদিন পরে! এসো এসো ভেতরে এসো।

…কে কাকু আবার?

আনন্দে ফেটে পড়ল বাণী। …মা রাতুল কাকু।

রান্না ঘর থেকে আটা মাখা হাতে বেরিয়ে এল তপতি।

…আমাদের কথা মনে পড়ল তাহলে।

…না মানে। ইয়ে... আমতা আমতা করতে লাগল রাতুল।

…থাক। আর খাবি খেতে হবে না। তোমাদের সব কটাকে তো চিনি। একটা তো ড্যাং ডিঙিয়ে চলে গেল। তাতে আমার কি? তোমাদের সঙ্গে আমাদের তো আর রক্তের সম্পর্ক নয়!

গলা ভিজে এল তার। আর কথা বলতে পারল না। আটা মাখা হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।

বাণীও শুরু করল …মিন্টু কাকু দুদিন হল মারা গেছে। জানো কাকু, দু'মাস আগে আমাকে একটা জামা কিনে দিয়েছে। ঐ দেখো আলনায় ওটা এখনও সেই রকম ভাবে ঝোলানো আছে। দিয়ে আর এখানে আসেনি। তাই আমি একবারও পরিনি। আমি পরব কেন? ওমনি থাকবে। না আসলে আমি পরবই না।

মেয়ের কথায় তপতিও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল। বাণীও হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। তার চোখ থেকে জল চিবুক বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়ছে মেঝের উপর। কেমন যেন একটা কান্নার আসর জাঁকিয়ে বসল ঘরটাতে।

রাতুলের গলাটা ভারি হয়ে এল। চোখ ছলছল করছে তার। ব্যাগটা সোফার উপর রেখে এগিয়ে গেল বাণীর কাছে। তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল রুমাল দিয়ে মুছে দিতে লাগল।

…সবাই তো চিরদিন থাকে না রে। ও অকালে গেল। আমাদের কি কষ্ট হচ্ছে না? খুব কষ্ট হচ্ছে। কাঁদিস না বাণী। চুপ কর। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল। আবার বলতে শুরু করল …আমি তো আজই শুনলাম। তাই ওদের বাড়িতে যাবো বলে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু ট্রেন খুব লেট করল যে। এত রাতে ওখানে যেতে পারবো না। তাই তোদের এখানে এলাম।

…ভালো করেছো ঠাকুরপো। কালই আমরা ওদের বাড়িতে যাবো। গাড়ি নিয়ে। তুমিও যদি থাকো খুব ভালো হবে।

…কেন কাল কিছু আছে নাকি?

…আর কিছু? শুনলে তোমার মাথা ঠিক থাকবে না। ছেলেটাকে ওরা মেরেই ফেলল জানো! একেবারে শেষ করে দিল।

আবার কাঁদতে লাগল তপতি। কান্নায় কেমন যেন একটা ক্ষোভও বেরিয়ে আসছে তার।

…মানুষ ওরা? এক প্রকারে কেড়ে নিয়ে গেল এখান থেকে। বছর খানেক ধরে ওকে এখানে রেখে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হসপিটালে ট্রিটমেন্ট করালাম। তুমি ভাবতে পারবে না, ওর মা বলে কিনা আমি ছেলেটার মাথা খাচ্ছি। আমি নাকি ওকে শেষ করে দিচ্ছি।

রাতুল বলে ...একদিন আমি ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। সঙ্গে কিছু টাকাও ছিল ওকে দেব বলে। কিন্তু ওর মা বলেছিল ওসব কিছু নয়। আমি নাকি ওর মৃত্যু কামনা করছি। আমার দিকেই যেন তেড়ে এল। ওর বাবার সেকি মূর্তি। আমাকে যেন মেরেই ফেলবে। আমি সে রাতে পালিয়ে আসি। ভর সন্ধ্যায় এমন করে কেউ নিজেই ছেলের নামে মিথ্যে কথা বলে?

তপতি বৌদি এসব শুনছিল একমনে। হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে গেল ওয়ার্ডবের দিকে। সেখান থেকে কয়েকটা প্লাস্টিক বের করে আনল। টেবিলের উপর রেখে একটার পর একটা রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন বের করছে আর বলছে …দেখো, দেখো। এগুলো দেখো আর বল আমি ওর মাথা খাচ্ছি? এগুলো কি সব মিথ্যে? হ্যাঁ, রক্তের সম্পর্কের নেই ঠিকই। কিন্তু এমন ওর কাছের লোকও করবে না।

সেই কান্না মেশা করুণমুখের দিকে তাকাতে পারছে না রাতুল। তার কাছে তপতি বউদির কলঙ্কগুলো যেন কেমন ফিকে হয়ে গেল। লজ্জায় রাতুলের মাথা নত হয়ে এল। মাথা নিচু করেই রইল। কিন্তু বৌদির অন্য কথাগুলো তার কানে আসছে। …জোর করে নিয়ে গেল। নিয়ে গিয়ে কি করল জানো? বিয়ে দিল। ব্যাস। ট্রিটমেন্ট গেল ঘুচে। মেরে ফেলল ছেলেটাকে।

চমকে উঠল রাতুল। মাথা তুলে বিস্ময়ে ফেটে পড়ল।

…সেকি। বিয়ে দিয়েছে?

…বংশপ্রদীপ দরকার না! নাতো ওদের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার হবে না। সগ্গে যেতে পারবে না। বংশ, বংশ, বংশ!

…বলো কি?

…অল্প বয়সী একটা মেয়ের সঙ্গে দিল বিয়ে। বিয়ের পরের দিন ঐ যে বিছানায় পড়ল, আর ওঠে নি। হাউ হাউ করে কাঁদছে তপতি। চোখের ধারা বাধ মানছে না। …এমনকি আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও রাখেনি জানো! মারা যেতে খবর দিল। গেলাম পুড়িয়ে এলাম তাকে। ....খা এবার বংশ ধুয়ে জল খা, সগ্গে যা!

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। রাতুল আর বাণী সোফায় বসে পড়ল। বাণী হেলান দিয়ে রইল রাতুলের গায়ে। তার কান্নার স্বর বের না হলেও মাঝে মাঝে জল গড়িয়ে পড়ছে চোখের কোণ বেয়ে।

…বৌদি, দাদা কোথায়?

…অফিসের একটা ফাইল দিতে গেছে তার এক কলিগের বাড়ি। কাল তো আবার যেতে হবে মিন্টুদের বাড়ি।

…কেন?

…ঐ মেয়েকে নিয়ে বিচার ডেকেছে গ্রামে। ওর মা আমাদের হাতে ধরে কান্নাকাটি করে যেতে বলেছে। তোমার দাদাও যাবে অফিস ছুটি করে। তুমিও এলে খুব ভালো হলো। রাত হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে শুয়ে পড়। ভোর ভোর গাড়ি নিয়ে বের হব।

রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। রাতুলের ঘুম আসছে না। মিন্টুর মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নানা স্মৃতির কথা তাকে যেন ঘুমাতে দিচ্ছে না। রাতও গড়িয়ে চলল। মরা চাঁদের আলো এসে পড়ছে তার বিছানায়। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন রাতুলের চোখ বুঝে গেল সে টের পেল না।



(শেষ)



মানুষ মরে গিয়ে শান্তি পেতে চায়। মৃত্যুর পর নাকি পরম শান্তি মেলে! যে মরে সে শান্তি পায় কিনা জানা নেই! তা জীবিত মানুষের পক্ষে জানবারও কথা নয়।

তবে মিন্টু মরে গিয়ে ওর বাবা-মাকে শান্তি দিয়ে গেল না।

পড়ন্ত বিকেলে ওদের উঠোনে বসেছে গ্রামের শালিশিসভা। দু'গ্রামের মাতব্বরের দল সভায় উপস্থিত, সঙ্গে আরো অনেকে। কারো কারো মুখে জ্বলন্ত বিড়ি। কেউবা ঠোঁট সরু করে তার ধোঁয়া শূন্যপানে আপনমনে কায়দায় ছেড়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেউবা মুখের কাছে দু আঙুলে টুসকি মেরে লম্বা লম্বা ঘুমের হাই ছাড়ছে। থেকে থেকে দু-চার কথা এদিক ওদিক দিয়ে ভেসে আসছে। আর তাদের মাঝখানে সাদা থান পরে বসে আছে এক অল্প বয়সী মেয়ে। কতই বা বয়স হবে, ষোলো কি সতের। চুল উস্কোখুস্কো। আলুথালু বেশ। মাথা নিচু করে বসে কি একটা দিয়ে মাটিতে আঁচড় কেটে চলেছে আনমনে।

সভার লোকজনের কথা যেন তার কানেই প্রবেশ করতে পারছে না। রাতুলের আর বুঝতে বাকি থাকল না যে ঐ মিন্টুর বিধবা স্ত্রী সবিতা। অথচ সভার নানান কথা তাকে কেন্দ্র করে উঠে আসছে। তারই ভবিষ্যত ঠিক করতে সবাই যেন বসেছে এই সভায়। তা আজই তারা ঠিক করেই দেবে। অথচ তারই কোনো হেলদোল নেই।

রাতুলের কেমন মায়া পড়ে গেল মেয়েটার প্রতি। হায়রে, কার বিধিলিপি কারা লিখবে? মনে মনে মিন্টুকে গালাগাল দিতে লাগল। …শালা, জানোয়ার। তোর হাঁটুর বয়সী মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারলি? বিবেকে বাঁধল না তোর? মেয়েটাকে এই ভাবে ভাসিয়ে দিয়ে যেতে তোর বুকটা কি একবার কাঁপেওনি?

ঠিক সেই সময় এক প্রৌঢ়ের নরম সুর সব গুঞ্জনকে টপকে মেয়েটার কাছে গেল। …তুমি কি এখানে থাকতে চাও মা?

মিন্টুর বিধবা স্ত্রীর পাশে বসা এক মাঝবয়সী মহিলা চেঁচিয়ে উঠল …ও কি বলবে শুনি? এটুকু বলে থামলেন না। মিন্টুর মা ঠাকুরঘরের বারান্দায় বসে ছিল। সেই দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে বলতে লাগল …নিজের ছেলেটার মাথা তো খেলি শয়তানি। আমার মেয়েটাকেও খাবি নাকি? ছেলেটাকে খেয়ে তোর সাধ মেটেনি? তোর এই যমপুরীতে আমি এই মেয়েকে রেখে যাব? ভাবলি কি করে লো ছেলেখাকি?

সবাই কেমন চুপ করে রইল। মিন্টুর শাশুড়ির কথাগুলো তাদের কাছে কেমন যেন ফ্যালনা নয়। তাছাড়া ঐ মুখের সামনে দাঁড়াবেই বা কে? কারোর মুখে কোনো কথা নেই। মিন্টুর বাবা গলায় ধুতি ঝুলিয়ে কাছেই বসেছিল। এখন সেই মহিলার দিকে হাত জড়ো করে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছে …তোমার দুটো পায়ে পড়ি, বেয়ান। এমন করে আর বলো না। তুমি আমাকে বলো। ওর কোনো দোষ নেই। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ও কেমন পাথর হয়ে গেছে। ছেলের শোকে নাওয়া খাওয়া ছেড়েও দিয়েছে। দিন রাত ঐ ঠাকুর ঘরের বারান্দায় পড়ে আছে। ওও মরতে বসেছে।

মিন্টুর শাশুড়ি আবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল …আমার মেয়ের সর্বনাশ করে এখন ঠাকুর ঘরে বসে ঢং করছিস? আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি, তুইও মরবি। নিব্বংশ হবি।

মিন্টুর বাবার চোখের জল টপ টপ করে পড়ছে মাটিতে। হাঁটু গেড়ে হাত জড়ো করে নীরবে কাঁদছে। নিচু করা মাথা যেন আরো নিচুতে নুইয়ে পড়ছে। মানুষটার দিকে তাকালে কান্নায় সবার চোখ ভিজে আসছে। ছেলেকে হারিয়ে এ কদিনে যেন কুঁকড়ে গিয়েছিল, আজ যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছে। সমাজের কাছে, এত মানুষের কাছে আজ এমন বেইজ্জতে যেন লজ্জায় একটু একটু করে নুইয়ে পড়ছে সবার সামনে।

কে একজন দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল …নাতিপুতির হাতে জল খেয়ে সগ্গে যাবে! মরা ছেলের বিয়ে দেওয়ার সময় মনে ছিল না? এখন ঠাকুরের কাছে বসে লোক দেখাচ্ছিস? ওরে ছেনালি মাগী তোর ভালো হবে রে? কেউ ওর মাথাটা ধরে দে না ঠুকে।

তপতি আর মিন্টুর পরের বোনটা আর চুপ করে থাকতে পারল না। পিয়ালী তাদের দিকে ক্ষোভ উগরে দিল …তোরা লোভে পড়ে বিয়ে দেসনি? এখন সব দোষ আমাদের, না!

বলতে বলতে বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে গেল তারা। তপতিও রেগে গেল …খবরদার বলছি, মাসিমাকে আর একটা বাজে কথা বলবেন না। আপনাদের এত সাহস হয় কি করে এমন করে এসব কথা বলার?

মিন্টুর শ্বশুরবাড়ি তাদের কয়েকটা গ্রামের পরে। তারা গরিব। কিন্তু তারা দেখেছিল একমাত্র ছেলে। দুটো মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের বয়স একটু বেশি। তা হোক, চাষের জমিও তো কিছু আছে। বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এমন হবে কে জানে? সব যেন কেমন হয়ে গেল। কিন্তু তারা গ্রামের মানুষ। গ্রাম্যতা তাদের পরিবেশগত, মজ্জাগত। সুযোগে তো তারা জ্বলে উঠবেই। মিন্টুর শাশুড়িকে তাই বুঝি আটকানো গেল না। মুখ বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল …তুই কে লো? 'বাজে কথা বলবি না'! তোর মত আর বাজে মেয়ে কেউ আছে নাকি লা? রেখেছিলি তো এতদিন আঁচলে করে। মাথাটা তো এতদিন তুই চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছিলি। আশ মেটেনি, না? আবার এয়েছিস!

চুপসে গেল তপতি। ভরা সভায় বলতে গেলে গ্রামের এতগুলো লোকের সামনে তাকে এমন করে অপমান করবে, সেও ভাবতেও পারেনি। আর কোনো কথা বলতে পারল না সে।

রাতুল বেগতিক দেখে হাত ধরে টেনে নিয়ে এল …দাদা, বৌদিকে চুপ করান। না জানি এরা কি বলতে আরো কি কি বলে ফেলবে। শেষে মান সম্মান আর কিছুই থাকবে না।

বউকে এমন অপমানিত হতে দেখে ক্ষেপে গেল অনিকেত। কিন্তু গ্রামের বিচার সভা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তার। ঝোঁকের মাথায় বলে উঠল …সবাইকে দেখে নেব। যা হবে, এবার আদালতে হবে। আপনাদের নামে আমি মানহানির মামলা করব।

কথাগুলো গ্রামের মাতব্বরের যেন আঘাত করল। উপস্থিত সবাই পরস্পর বলতে লাগল …এতে আমাদের সভাকে অপমান করা হয়। আমাদের গ্রামকে অপমান করা হয়।

…ঠিকই বলেছ কানাই দা।

এক মাতব্বর উঠে পড়লেন। রাগে থরথর করছেন।

…চলো হে, খগেনদা। আমাদের মান থাকল না হে। শহুরে বাবু বলেচেন। চলো হে। আমাদের আক্কেল সেলামি হল।

মিন্টুর শ্বশুরবাড়ির বাড়ির কে একজন উঠে বলল …আদালতে যাবে যাও। জেলের ঘানি তো তোমরাই টানবে, বলে রাখছি । আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা? রোগব্যাধি লুকিয়ে রেখে বিয়ে? সবার কোমরে দড়ি পড়বে জেনে রেখো।

সঙ্গে সঙ্গে সভা ভেঙে যেতে লাগল। নানান কথা ভাসতে লাগল বাতাসে। কিছু বাক্য বান ভিড় পথ অতিক্রম করে বিদ্ধ হল লক্ষ্যে।

…মেয়েটার সর্বনাশ করে দিয়ে আদালত দেখাচ্ছে? কোথাকার হরেশুঁড়ি রে? করে দেখা একবার, তোর ঘোল ডিম ভেঙে দেব, বুঝলি?

…আমাদের মাতব্বরদের অপমান করা ওর ছাড়িয়ে দেব।

…তোদের ঘরের মেয়ে হলে হাড়ে হাড়ে টের পেতিস।

…দে তো শালাদের ঘর দোর ভেঙে। চুরমার করে দে। ওদের একটু সানটিং হওয়া দরকার।

এক মোটা গোছের মহিলা রেগে একজনকে ঠকর দিয়ে বলে …ঐ মাগীটাকে ধরে একটু কড়কে দে না। তোরা না পারিস তো আমার কাছে এনে দে, একটু পিষে দেই। কেউ টেনে আন না।

কেমন একটা হট্টগোল বেধে গেল। ভিড় ঠেলে কে একটা মহিলা এগিয়ে এলে তপতির দিকে। হাত ধরে দিল টান। শুরু হয়ে গেল টানাটানি, চেঁচামেচি, ধ্বস্তাধ্বস্তি। চুলোচুলি।

মৃত্যু শোক কোথায় যেন উবে গেল নিমেষে। সমবেদনা নয়, সহানুভূতি নয়, পরস্পর খন্ডযুদ্ধে মেতে উঠল উঠোন। হঠাৎ সব কিছু ছাপিয়ে একটা তীব্র আর্তনাদ উঠে এল সবার মাঝখান থেকে।

…আঁ-আঁ-আঁ-আঁ…

সেই বেদনাতুর বুকফাটা কান্নার শব্দে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই । থ হয়ে রইল উপস্থিত সকলে। কার এই বেদনাবিহ্বল আর্তনাদ?

মিন্টুর বিধবা স্ত্রী সবিতা। উঠোনে পড়ে বুকফাটা কান্নায় মাথা ঠুকছে মাটিতে। বুকের কাপড় গেছে খুলে। একরাশ চুল গড়াগড়ি দিচ্ছে এলোমেলো হয়ে। কান্নার জলে মাটি মিশে মুখে লেপে যাচ্ছে মলিন ভাবে।

মিন্টুর বাবা কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে পড়ল তার কাছে। অঝোর ধারায় তারও চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। কথা যেন ভারী হয়ে বসে যাচ্ছে গলায় গলায়।

…মা রে, ওঠ মা। এমন করে কাঁদলে আমার ছেলের বুকটাও ভেঙে যাবে। জানিস তো ও তোকে খুব খুব ভালোবাসে। তোর কান্না শুনতে পেলে ওও কাঁদবে। ও-ও মরে গিয়ে শান্তি পাবে না রে। ওঠ মা, ওঠ। এই বুড়ো বাপটার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ। তারও বুকটা ফেটে যাচ্ছে রে।

সবাই সেই করুণ বেদনাতুর বাপ আর মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। কারো চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অঝোর ধারায়। কারো নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিধাতা যেন অন্তরীক্ষে থেকে সেই নির্মল সম্পর্কের লিপি লিখে চলেছে।

…ওঠ, পাগলী ওঠ। আমি কথা দিচ্ছি, আমার সব জায়গা জমি তোর নামে লিখে দেব। ছেলের কাজটা হয়ে যেতে দে। সব সব দেব শুধু এই ভিটেটা ছাড়া। যদি আমার ছেলেটা ফিরে এসে দেখে আমরা নেই, তুই নেই? কোথায় যাবে বল তো? ওও, তুই তো আবার এখানে থাকবি না। কিন্তু আমার ছেলেটার জন্য তুই কি এটুকুও কি ছাড়তে পারবি না?বল না, বল? একটু...

সবিতা হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল মিন্টুর বাবাকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বাপ আর মেয়ের মিলিত কান্নায় গোধূলি আঁধার ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল আরো।

কেউ আর কোনো কথা বলল না। সবাই যেন তা মেনে নিল। একে একে সবাই চলেও গেল।

সন্ধ্যা নামল সারা বাড়ি জুড়ে। তরল অন্ধকার জাপটে ধরল সেই বাড়ির আনাচ-কানাচ। পিয়ালী সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে দিল ঠাকুর ঘরে। মিন্টুর মা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে ঠাকুর ঘরের বারান্দায়। দেখলে মনে হবে সেই মূর্ছিত শরীরের চোখের কোণ বেয়ে জলের ধারা বয়ে চলেছে এখনো।

মিন্টুর বাবা বারান্দায় বসে রয়েছে পাথরের মতো। পিয়ালী তার কাছে গিয়ে বলল …বাবা, চলি তাহলে। অন্যদিন আসব আবার। কাল তোমার নাতির স্কুল আছে যে। আমি না গেলে তার আর স্কুলে যাওয়া হবে না। চলি। মাকে দেখো।

কিন্তু তার বাবার কোনো উত্তর পেল না সে। কিছু একটা বলতে চাইলেও কিন্তু বলতে পারল না। যেন পুরো কথাটা আটকে গেল তাঁর গলায়। শুধু পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইল তার দিকে।



সন্তান শোকাতুর অসহায় মানুষ দুটোকে রেখে বেরতে কারুরই মন চাইল না। তবুও তপতি, রাতুলরা মিন্টুর বাবাকে প্রণাম করে পা ফেলল উঠোনের বাইরে।

নিমেষে ঠাকুর ঘরের প্রদীপটা গেল নিভে। বাইরের অন্ধকারের চেয়ে উঠোনের ভেতরটা আরো ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল।

আঁতকে উঠল সবাই। সঙ্গে সঙ্গে মিন্টুর মায়ের বেদনাদীর্ণ আর্তনাদ ভেসে এল ভেতর থেকে।

…মিন্টু রে। বাপ আমার। ফিরে আয় বাপ। ফিরে আয়য়য়...

সঙ্গে সঙ্গে সারা উঠোনময় একটা কালো ছায়া এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াতে লাগল।

রাতুলরা কেউ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। শিউরে উঠল সবাই। ভয়ে ভয়ে অন্ধকার বাঁশঝাড়ের পথ ধরে এগোতে লাগল তারা। মনে হল কেউ যেন তাদের পিছন পিছন আসছে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল সবার।

পড়িমরি করে সবাই দিল দৌড়। এসে উঠল বড়ো রাস্তায়। হুড়োহুড়ি করে উঠে পড়ল গাড়িতে। গাড়ি ছেড়ে দিল। তখনও সেই ক্ষীণ আর্তনাদ কানে আসছে তাদের...

…মিন্টু রে। বাপ আমার। ফিরে আয় বাপ। ফিরে আয়য়য়...

0 comments: