0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in
আহিরণ নদী সব জানে


তৃতীয় অধ্যায় 

১ 

পৌষ-ফাগুনের পালা 

কেটে গেছে আরও দুটো বছর। কাঠঘোরা-ছুরি-কোরবা যাওয়ার ভাঙাচোরা ইঁটের টুকরো বের করা আঁকাবাঁকা রাস্তাটি এখন মসৃণ পিচঢালা ঝাঁ-চকচকে রাজপথ। দুপুরের রোদ্দুরে মনে হয় এক ক্লান্ত অজগর পেটপুরে খেয়ে একটু গড়িয়ে নিচ্ছে। সেই অজগরের পিঠ বেয়ে দৌড়য় অনেক গাড়ি। বেড়ে গেছে বাসের সংখ্যা। সাপ্তাহিক বাজার-হাটের জন্যে ছুরির দোকানিদের মাল যায় বাসের মাথায় চড়ে, ট্রাক্টর চেপে। কিছু কিছু যায় গরুর গাড়ি বা সাইকেলের পেছনে ঝুড়ি চাপিয়ে।কয়েকজন মোটরবাইক চেপে। 

এই উন্নয়ন বা পরিবর্তনের কারক তত্ত্বটি হল এক ন্যাশনাল গ্রিডের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবির্ভাব। রাস্তার ওপারে দশ কিলোমিটার দূরে এনটিপিসি বা ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের ২১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ তাপচুল্লী (থার্মাল পাওয়ার স্টেশন) তৈরির কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠছে যমুনানগর বলে বিশাল আধুনিক নগরী। তাতে থাকছে বিভিন্ন শ্রেণীর অফিসার ও শ্রমিকের থাকার জন্যে নানান ধাঁচের কোয়ার্টার, সেন্ট্রাল স্কুল, স্টেডিয়াম, আধুনিক হাসপাতাল, জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা এবং পণ্যদ্রব্যের বিপণি। এসে গেছে কফিহাউস, গেস্ট হাউস, কমিউনিটি হল এবং সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা। ময়দানবের ছোঁয়ায় রাতারাতি জঙ্গল, ক্ষেতখার, সাপের গর্ত, উইয়ের ঢিবি সব সমতল হয়ে যমুনাবিহার নামক নগরীটি জেগে উঠে আড়মোড়া ভাঙ্গছে । লোকের মুখে বা সাইনবোর্ডে নতুন নামটি অনবরত চোখে পড়ছে । স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এলাকাটির প্রাচীন গাঁয়ের নামগুলো—জমনীপালী, দররি, টাঙ্গামার,গেবরা নামগুলো। বুলডোজারের বিশাল চাকায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে দেয়ালে নীল রঙে রামসীতা, ফুল্পাখি আঁকা মাটির বাড়িগুলো, যাতে ভোরিয়া জনজাতির তিনপুরুষের বাস। 

এসবই হয়েছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক নামক সংস্থাটির বদান্যতায়। তারা এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পটির জন্যে সস্তাদরে ঋণ দিয়েছে সরকারকে। 

অধিকাংশ চাষি ছেড়ে দিয়েছে জমি। বদলে পেয়েছে ক্ষতিপূরণ, জমির জাত, নাড়িনক্ষত্র, রাশি এবং গণের বিচার করে। যেমন বহেরা বা ধানের ক্ষেতের উপযুক্ত কি না , অথবা টিকরা বা শুধু সাগসব্জী ফলাতে কাজে আসে। আবার জমিতে কুয়ো আছে নাকি টিউবওয়েল, পাকা ঘর অথবা কাঁচা , জমিতে আম-জাম-কাঁঠাল গোছের ফলদার গাছ রয়েছে নাকি সেগুন, শিশু গোছের ইমারতী লকড়ির গাছ। 

এই সব ডামাডোলের মাঝে বেড়ে ওঠে দলাদলি। গজিয়ে ওঠে নতুন নতুন কিছু নেতা , তারা ভরসা দেয় যে কোম্পানি অনেক কম ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে; এদের পতাকার নিচে জড়ো হলে কোম্পানি চাপে থাকবে, উগরে দেবে আরও কিছু, অন্ততঃ প্রত্যেক পরিবারে একজনের চাকরি। পাড়ায় পাড়ায় সন্ধ্যে বেলায় বৈঠক হয় । এরমধ্যে প্রায় ভগবানের সম্মান পেয়ে যায় ঝাড়ুরাম পাটোয়ারি। ওর জমিমাপার চেনের টানে বা নকশা বানানোর সময় কলমের এক খোঁচায় পতিত জমিতে গজিয়ে ওঠে আমগাছ, পাথুরে জমিতে পুকুর, এবং খোড়ো চালাঘর হয়ে যায় ইঁটের গাথনি। কুলোকে বলে যে ঝাড়ুর কৃপায় টাকমাথায় চুল গজায়, বাঁজা মেয়ে ছেলে কোলে নিয়ে বাপের বাড়ি আসে। 

নতুন সময় জন্ম দিচ্ছে নতুন জীবনধারার, নিত্যনতুন কিছু শব্দ ভান্ডারে উড়ে এসে জুড়ে বসছে। দুটো শব্দ রূপেশের কানে খট করে বেঁধে। ‘ফলস মানি’ আর ‘ডুপ্লিকেট আদমি’। এসব ওকে শিখিয়েছে ঝাড়ুরাম পাটোয়ারি। কোন বিকেলে ব্যাংকে এসে বেঞ্চিতে বসে এক গেলাস জল চোঁচোঁ করে শেষ করে, তারপর কাঁধের গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বলে ওঠে—সাব, ও যো ব্যানার্জি সাহাব হ্যায় না , ও হ্যায় বহোত ডুপ্লিকেট আদমি। উনকে পাস অকুত ফলস মানি হ্যায়। 

রূপেশ বুঝে নেয় যে ‘ডুপ্লিকেট আদমী’ মানে বেইমান বা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মানুষ। আর ‘অকুত ফলস মানি’ বলতে বোঝাচ্ছে দেদার ঘুষের টাকা। 



আহিরণ নদীর পাড়ে গাছ-গাছালি ও পাখিদের সভার আর আগের সেই জৌলুষ নেই । কাটা পড়েছে অনেক গাছ; বাদ পড়েনি কোসম গাছও। আর শাল-সেগুনের বন ? সে কবেই হাওয়া হয়ে গেছে। ওদের বলা হয় ‘ইমারতী পেড়’ মানে বাড়ি তৈরির কাঠের জোগানদার গাছ। সেই গাছগুলো সবার আগে উন্নয়নের বলি চড়েছে। এই রাজসূয় যজ্ঞির মাঝে কাজের ফিল্ডে ঘুরে বেড়ানো সাহেবরা অনেকেই ‘ বহতা নদী’তে হাত ধুয়েছেন। কিছু কাঠ, যেমন সেগুন-শিশু-বী্জা, কাজে লেগেছে জলের দরে তাঁদের ফার্ণিচার তৈরিতে। 

রূপেশের ছুরি গাঁয়ে তিনবছর হতে চলল। সম্ভবত; আগামী কয়েকমাসের মধ্যেই ওর ট্রান্সফার হয়ে যাবে। বদলির সীজন প্রায় এসে গেল। হেড অফিসে কাগজপত্তর তৈরি হচ্ছে। কাগজ হাওয়ায় উড়ছে । তার খড়খড় ফরফর শব্দ আসপাশের ব্র্যাঞ্চের স্টাফ ও তাদের নানান গুজব এবং গালগল্পের মাধ্যমে ওর কানেও পৌঁছচ্ছে। বিশেষ করে কাঠঘোরা ব্র্যাঞ্চের রামকুমার। প্রতি সপ্তাহের শনিবারে নানান অফিসিয়াল কাজকম্মের ছুতোয় হাজির হয়ে যায় হেড অফিসে। সেখানে ঘন্টাদুই কাটিয়ে পার্সোনাল ম্যানেজারের অ্যাসিস্ট্যান্টকে তেল মেরে ক্যান্টিনে চায়- সামোসা খাইয়ে বিকেল নাগাদ যায় শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে শনি-রবি দু’রাত কাটিয়ে সোমবারে ভোরের বাস ধরে যথাসময়ে হাজির হয় নিজের ব্র্যাঞ্চে। 

তারপর মঙ্গলবার ফিল্ড ভিজিটের বাহানায় তিনটে নাগাদ রাজদূত মোটর সাইকেলে সওয়ার হয়ে সাড়ে চারটে নাগাদ হাসিহাসি মুখে ছুরি ব্র্যাঞ্চের বারান্দায় এসে হাঁক পাড়ে—বহোত কাম কর লিয়ে শ্রীমানজী। অব তো উঠো, কুর্সি ছোড়ো; চলো বড়া তালাও কে পার চলে উঁহা এক নয়া দুকান খুলে হ্যায়, বড়িয়া বটের কী রোস্ট (জলের ধারে ঘুরে বেড়ানো একধরণের ছোট পাখির সুস্বাদু মাংস) পকাতে হ্যায়। 

কোনদিন নিয়ে আসে টিফিন ক্যারিয়ার, বলে বৌয়ের হাতের রান্না। খেয়ে দ্যাখ দিকি। 

তারপর ফিসফিসিয়ে বলে -সলিড জুগাড় লগায়া হুঁ বস্ ; কাম হো জায়েগা। মেরী বিলাসপুর ট্রান্সফার পাক্কি। অব হমারা সগা ( নিজের জাতের লোক) হেড অফিস মেঁ আ গয়ে। আপ কা ভী কাম করা দুঁ? একবার হাঁ তো বোলো। সীধা আপকে গৃহনগর ভিলাই পোস্টিং! অরে অ্যায়সা মৌকা ফির কহাঁ আয়েগা? শনিবার খামোকা হেড অফিসের চারপাশে ঘুর ঘুর করে? সবাই বোঝে যে এগুলো আসলে শ্বশুরবাড়িতে রাত কাটানোর বাহানা। এ নিয়ে অফিসের ক্লার্ক, চাপরাশি সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে, এসব কি শ্রীমানজী বোঝেন না ! 

রামকুমার কেমন চুপসে যায় । খানিকক্ষণ চুপ করে নাক চুলকোয়। তারপর ধীরে ধীরে বলে – সব জানি, কিন্তু অউর কোই চারা নহীঁ হ্যায়। আমি নিরূপায়। 

--এইসি ক্যা মজবুরি? 

--তুম শাদীশুদা নহীঁ হো মেরে ভাই , তুম নহী সমঝোগে। বিয়ে তো করনি? করলে বুঝতে। 

--- ভাবীজি কো এহীঁ লে আও না ! 

--উয়ো নহীঁ হো সকতী। তুমহারী ভাবীজি ঠহরে বড়ী ঘর কী বেটি। ইহাঁ কচ্চা পাখানা ঘর, উয়ো নহী রহেগী। এখানে কাঁচা পায়খানা, তোমার বৌদি হলেন বড় ঘরের মেয়ে । ও এখানে মানিয়ে নিতে পারেনি। 

রামকুমার ব্যাংকে রূপেশের একবছর সিনিয়র। ওকে সতর্ক করে—ভায়া, ট্রান্সফার হবার কথা চলছে। এ সময় সাবধানে কাজ কোরো, বেশি লোন-টোন দিও না । পরে ভোগান্তি হতে পারে । 

--মানে? 

-- বুঝলে না ? শোন, তুমি তো মুড়িমুড়কির মত লোন দিয়ে চলে গেলে। অনেক গরীব মানুষের আশীর্বাদ কুড়োলে। কিন্তু ট্রান্সফারের টেনশনে লোনের সার্ভে, ইন্টারভিউ, পোস্ট -লোন ভেরিফিকেশন ইত্যাদিতে যদি কোন স্টেপ মিস হয়ে যায় আর অডিটের নজরে পড়ে তো তুমি গেলে! 

রূপেশের চেহারায় কোন ভাবান্তর হয় না। কিন্তু রামকুমার চলে যাবার পর মাথার মধ্যে একটা ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনতে পায় । সত্যি, একই ব্রাঞ্চে তিনটে বছর অনেক। এতলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে যে লোন চাইলে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। আবার লোকগুলো বড্ড অবুঝ। স্থানীয় ডাক্তার মনে করেন যে সংসার খরচে টান পড়লে ব্যাংক থেকে কিছু হাত-হাওলাত নেওয়া তাঁর অধিকার। ম্যানেজার যে কেন কিপটেমি করে ? এমন ভাব করে যেন নিজের পকেট থেকে দিচ্ছে। আসলে ব্যাংকের পয়সা তো পাবলিকের পয়সা। তাহলে এত ফুটুনি কিসের? উনি তো পরের মাসেই দিয়ে দেবেন। 

এদিকে আই আর ডি পি বলে একটা সরকারি যোজনার নামে যত হাঘরে-হাভাতে লোন নিয়ে যাচ্ছে ,তার বেলা? ওরা কি একটি পয়সাও ফেরত দেবে? কত বোঝাই যে ওসব ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ না করে আমাদের মত মান্যিগণ্যিদের দিন , ব্যাংক দ্রুত তরক্কি করবে। চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। চোরা না বকধার্মিক? গাঁয়ের হাভাতে গুলো ধন্যি ধন্যি করে বটে, কিন্তু ব্যাটা নিঘঘাৎ ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। বোকাগুলোর সাবসিডির পয়সা মেরে দিচ্ছে। আমাদের বেলা ওসব চলবে না তাই শুনিয়ে দেয় –এটা গরীবদের জন্যে ঋণদেওয়ার ব্যাংক, আপনারা শুধু টাকা জমা রেখে সুদ পাবেন, লোন পাবেন না , এটাই সরকারের নিয়ম। 

জমনাপারী বকরা ও তার হারেম বৃত্তান্তঃ 

রূপেশ আজ খুব ব্যস্ত।বকরি -পালন যোজনা অনুযায়ী ওকে এই মাসে অন্ততঃ কুড়িটি ইউনিট ফাইনান্স করতে হবে। একটা ইউনিটে আটটি বকরি, আর একটি করে তাদের স্বামী। হারেমের বেগমরা সব দেশি, কিন্তু স্বামীর দায়িত্ব পাওয়া নবাবপুত্তুরটি হবেন হয় জমনাপারি বা ব্ল্যাক বেংগাল। অর্থাৎ যে ব্রিডটির ঠিকুজি হল যমুনানদীর ওপারে বা বাঙলায়। ভিলাই শহরে বড় হওয়া রূপেশ বর্মা কী করে চিনবে কোনটা যমুনাপারি আর কোনটা ব্ল্যাকবেঙ্গাল? 

কাজেই প্র্যাক্টিক্যাল নিয়ম হল ব্লক অফিসের ভেটারিনারি সার্জন খারে সাহেবের মাধ্যমে সাপ্তাহিক পশুবাজারে গিয়ে ক্রেতার সামনে কেনাবেচা করা। ডাক্তারের একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব একটা পেতলের ছোট ট্যাগ একটি স্টেপলারের মাধ্যমে ছাগলগুলোর কানে গেঁথে দেওয়া। কোন পশু মারা গেলে ওই ট্যাগলাগানো কান কেটে মৃত পশুর পঞ্চনামা করে ভেটারিনারি ডাক্তারের সার্টিফিকেট শুদ্ধু ব্যাংকে জমা করতে হবে। ম্যানেজার সেই কাটাকান এবং অন্য কাগজপত্তর পরীক্ষা করে ক্লেইম ফর্মে সাইন করে ইন্স্যুরেন্স অফিসে জমা দিলে তবে ঋণীর নামে ক্লেইম মানি এসে ব্যাংকের লোন একাউন্টে জমা হবে। 

নইলে ধরে নিতে হবে পশুটি হয় চুরি হয়ে গেছে বা ঋণীটি কেটে ফেলে ভোজ লাগিয়েছে অথবা চুপচাপ চড়া দামে বেচে দিয়েছে। মাদী পশুগুলির সংখ্যা দ্রুত কমে আসে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর জন্যে শেষ দুটো কারণ দায়ী। 

কিন্তু আজ সকালে গোপালপুরের দুকালু সতনামী একটি মৃত ছাগলের কান কেটে নিয়ে এসেছে , তার কানে কোন রিং নেই । তাহলে? সামনের চেয়ারে বসে থাকা ভেটারিনারি ডাক্তার খারে বলেন ব্যাটা নিশ্চয়ই অন্য কানটা কেটে নিয়ে এসেছে। গোমুখ্যু কোথাকার! যা বাকি কানটা নিয়ে আয় । 

কিন্তু দুকালু নড়ে না । রূপেশ জেরা করায় বলল যে ওর জমনাপারি ছাগলের কানে সরকারি রিং লাগানো নেই, বাকি আটটি পশুর একটাতেও না । শুধু ওর একার নয় , গোপালপুরের যে কয়জন ‘বকরি-পালন’ ঋণ নিয়েছে সবারই এক অবস্থা। 

কারণ, ঢোরডাক্তার (ভেটারনারি) ভদ্রলোক মাদী ছাগলগুলোর কান বেঁধাতে একশ’ টাকা চাইছেন, আর পুরুষ ছাগলের জন্য দুশো। ইয়ে ত অন্ধের হ্যায়, ঘোর অন্যায়। 

রূপেশ কড়া চোখে ডাক্তার খারের দিকে তাকায়। উনি মিন মিন করে বলেন—বাজে কথা । আমি শুধু ওদের গাঁয়ে যাওয়ার রাহা খরচা, ধরুন মোটরবাইকের পেট্রোলের খরচ দিতে বলেছি। 

--গাঁয়ে যেতে হবে কেন ? আপনারতো ঢোর বাজারে পশু কেনার সময়ই ট্যাগ লাগানোর কথা । এখন এই মৃত ছাগলের বীমা ক্লেইম কী করে হবে? এর দায়িত্ব কে নেবে? দুকালুর ক্লেইম যদি রিজেক্ট হয় তাহলে আপনি এবং আমি এসসি/এসটি অত্যাচার অধিনিয়মের ধারায় কেস খেতে পারি সেটা ভেবেছেন? 

দুকালু রূপেশের দিকে বড় বড় চোখে তাকায়। তারপর চোখ নামিয়ে নেয়। এবার ডাক্তার খারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা জমে। তুতলে তুতলে বলেন—গলতি হো গয়া মেরে কারণ, অব মুঝে হী সুধারনা হ্যায়। নো ফিকর! আমি এই মৃত পশুর কানে একটি ট্যাগ লাগিয়ে কাগজ ব্যাক ডেটে বানিয়ে দিচ্ছি , ক্লেইম ফর্ম আপনি ভরে দিন । ইসীমে হী সবকা ভলাই। 

রূপেশ বিরক্ত হয়ে বলল—যা করার আপনি করুন গিয়ে। আমি এসব লফড়ার মধ্যে নেই । আমার ক্লেইম ফর্ম যেন রিজেক্ট না হয় । 

ডাক্তার কথা না বাড়িয়ে নিজের কালো ব্যাগ খুলে ট্যাগ এবং স্টেপলার বের করে কাজে লেগে গেলেন । 

রূপেশ দুকালুকে আশ্বস্ত করে যে নিয়মানুযায়ী ওকে আগের মত আরও একটি জমনাপারী বকরা দেওয়া হবে, কোন অতিরিক্ত লোন নিতে হবে না । 

দুকালু এবার বলে যে আগের মত নয় , ওর অন্য জাতের বা অন্য বয়সের বকরা চাই । ইয়ে টুরা কস বকরা কোনো কাম কে নহী; ঠিকসে ‘সার্ভিস’ নহীঁ করথে। 

মানে? 

হেসে ওঠে চাপরাশি ঠুল্লু। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ডাক্তার ওকে একটা অল্পবয়েসি বকরা গছিয়েছিলেন। জমনাপারিগুলো বয়েস অনুপাতে দেখতে বড়সড়। দুকালু বুঝতে পারেনি। কিন্তু ওর যা কাজ, অর্থাৎ আট-আটটি মাদীকে সন্তুষ্ট করা, সেটা ওই বয়সে সম্ভব নয় । ফলে দুকালুর ইউনিট অফলা হয়ে রইল। 

ইতিমধ্যে বারান্দায় হাজির আরও একজন। তার হাতে আরও দুটি কাটা কান। 

রূপেশ চেঁচিয়ে ওঠে। 

--হল ত ডাক্তারসায়েব? দেখুন আরও দুটি বকরা মরে গেছে। সব আপনার কীর্তি। 

আগন্তুক লোকটি হাত জোড় করে। 

--নহীঁ সাহাব, বকরা নহীঁ; দু’ঠন বকরী মর গিস। উ জমনাপারী বকরা বহোত তেজী রহিস। বকরীমন সমহাল ন সকী। ই দেখ ওকর কান, সরকারী রিং দুনো মা লগে হ্যায়। অব মুঝে বীমা কে পইসা দিলা দেয়ো সাহাবমন। 

জমনাপারী পাঁঠাটির তেজ খুব বেশি, দেশি বকরীগুলো সামলাতে পারবে কেন ? তাই ওর হারেমের দুটি মরে গেছে। দেখে নাও দুটো কান, সরকারি রিং লেগে আছে । এবার কৃপা করে বীমার টাকাগুলো পাইয়ে দাও। 

রাত্তিরে রূপেশের ঘুম আসে না । হাওয়া এখন দিনে গরম, রাতে শীতল। ব্যাংকের দোতলার জানলা দিয়ে পাশের একটা আমগাছ থেকে বোউলের গন্ধ ভেসে আসে। ভাবে, ট্রান্সফার হলে কোথায়, কতদূরে? আবার বাড়িতে মা ও বড়বৌদি তাড়া দিচ্ছেন বিয়ে করার জন্যে। বৌদির কথায় ইঙ্গিত যে ছোটদেওরটিকে আদিবাসী গাঁয়ের কোন টোনহি (ডাইনি) মেয়ে কালাজাদু করে বশ করে ফেলেছে কিনা। নইলে ও অন্য শহুরে ছেলেদের মত উইক এন্ডে বাড়ি আসে না কেন? 

তাই আজকাল রুপেশ দু’সপ্তাহে একবার ভিলাই ঘুরে আসে। 

উঠে কুঁজো থেকে দু’গেলাস জল খেয়ে ও ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। শুক্লাপঞ্চমীর রাত। আকাশে রাঙাভাঙা চাঁদ। ছুরিগ্রাম ঘুমে অচেতন। রাত কত হল? দূরে কোথায় একটা পাখি কুব কুব শব্দ করে ডাকছে। এই গ্রাম, এই জনপদ ছেড়ে যেতে হবে। আর কোনদিন কি এখানে ফিরে আসবে রূপেশ? এই রহসবেড়া পাড়ার যাত্রা বা নাচা, উঁচু পাড়ওলা বামনদীঘি, তার পাশে ছোট্ট এক দেবদেউল। স্কুলের মাঠে টিচারদের সঙ্গে ভলিবল খেলা, শীতকালে ছুটির দিনে ক্রিকেট ম্যাচ, আহিরণ নদীর পাড়ে সেই পিকনিক। সব কেমন আপন হয়ে গেছে, ও জানতেও পারেনি। আর এখানকার মানুষজন? নরম মনের ডাক্তার চন্দ্রকান্ত কাশ্যপ, ভুরা কম্পাউন্ডার, অর্জুন তাঁতি, ঠুল্লু ও ঠুল্লুর বাবা, রাজবাড়ির কুমারসাহেব। দুই নটখট ভাঁড় ঠিবু ও রসেলু প্যাটেল—যেন মাণিকজোড়। 

কিন্তু আর একজন? আহিরণ নদী। আহিরণ নদীতো বটেই, কিন্তু তার কপালে কাটা দাগ; এক বন্যজন্তুর সঙ্গে মরণপণ লড়াইয়ের নিশানি। নাঃ , তার কথা ও ভুলে যেতে চায়। দোলের সেই সন্ধ্যে, সেও ছিল এমনই এক চৈত্রমাস। 

হঠাৎ ওর খেয়াল হল নীচে গাঢ় অন্ধকারে কিছু একটা নড়ছে। চোখ কুঁচকে ভাল করে তাকায়। জন্তু নয় , মানুষের অবয়ব। এক নয় দুটো মানুষ। একে অন্যের কোমর জড়িয়ে হাঁটছে, ধীর পায়ে। ওরা নিশ্চিত এই রাতে কোন মনিষ্যির কৌতুহল ভরা চোখ ওদের দেখছে না । 

পঞ্চমীর ফিকে আলো এবার ওদের উপর। চমকে ওঠে রূপেশ,একজন রামনিবাস, কিন্তু অপরজন ? না, ও যাকে ভাবছিল সে নয়, এ তো কালিন্দী। এ গাঁয়ের নগরবধু কালিন্দীকে কে না চেনে! 

রূপেশের মনে পড়ে যায় প্রথম আলাপে যোশীমহারাজের সতর্কবাণী—‘ওর বাবা আর ওর বিয়ে সব আমিই করিয়েছি। ভাল ঘরের সুন্দরী গোরী চিট্টি পদ্মিনী মেয়ে, কিন্তু রামনিবাসকে জাদুটোনা করেছে এই গ্রামের কালিন্দী’। 

রূপেশ জানে হিন্দিবলয়ের বহুপরিচিত বহুব্যবহৃত লোকোক্তিটিঃ “দিল লগি জব গাধী সে , তো পরী ক্যা চিজ হ্যায়”? 

গাধার প্রেমে পড়েছি তো পরী কোন ছার!

0 comments: