গল্প - বরুণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in গল্প
স্রোতের পাশে
হাঁ করে তাকিয়েছিলাম মেয়েটির দিকে। চাঁদপালঘাটের দুপুর। গঙ্গায় ভাটার টান। ছুটির দিন, তাই বেশ নির্জন ফেরিঘাট। তার মধ্যে মেয়েটি ঘুরে ঘুরে একটা কালো রঙের ডায়েরীতে কি সব নোট করছিল। তার সুশ্রী সুন্দর গড়ন, হাল ফ্যাশনের পোশাকের বাহার, সাথে জুটের ম্যাচিং ঝোলা স্ট্র্যাপের ব্যাগ --সব কিছুর মধ্যে স্পষ্ট রুচির ছাপ। টপ-নট করে বাঁধা টান টান খোঁপার নীচে উদ্ধত গ্রীবার সঞ্চালনে আভিজাত্যের আভাস। অতএব আমার দৃষ্টি যে পরিচিত নদীর চেনা দৃশ্যপট আর ওপারের শিল্প নগরীর ম্রিয়মাণ ল্যান্ডস্কেপ ফেলে তাকে অনুসরণ করবে, এ আর আশ্চর্য কি?
আপাতত আমি বেকার, তাই মাঠে-ঘাটে আড্ডা মেরেই দিন কাটে। আসলে দাদার একটা জরুরী কাজে এসপ্ল্যানেড যেতে হয়েছিল। বেকার হলে যা হয় আর কি। সংসারের যাবতীয় ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে দিন যায়। আমি অবশ্য ওসব নিয়ে ভাবি না, সমাজসেবা আমার ভালই লাগে। আর এদিকে এলে আমি সাধারণত লঞ্চেই ফিরি। জলযাত্রায় ভেসে যেতে বেশ লাগে আমার। আপাতত তেমন তাড়া নেই, লঞ্চ আসতে এখনো প্রায় আধঘণ্টা।
ফাঁকা, শুনশান লঞ্চঘাটে একটি মেয়ে একা ঘুরে ঘুরে ডায়েরী লিখছে --এ ছবি আগে কখনো দেখিনি, তাই একটু কৌতূহল হচ্ছিল। অন্য দিনের মত ভিড় থাকলে হয়তো এসব দুর্বুদ্ধি মাথায় আসতো না। মেয়েটা একবার একদৃষ্টে নদীর দিকে দেখছে, একবার আকাশে তাকাচ্ছে, তারপর ডায়েরীতে ঝুঁকে পড়ে কী সব লিখে নিচ্ছে আপন মনে। আমিও একটু আধটু লিখি, তবে এভাবে পথে ঘাটে লিখতে সংকোচ হয়। ও আমার চার-দেওয়ালের ঘেরাটোপ-ই ভাল।
হঠাৎ একটা তুঁতে রঙের মাছরাঙা জেটির চাল থেকে উড়ে এসে ছোঁ মারল জলে এবং অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ। অতঃপর ডায়েরী থামিয়ে সে অবাক চাহনি স্রোতের ওপর ভেসে রইলো কিছুক্ষণ। আমিও বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলাম ঘটনাক্রম এবং তাকিয়ে ছিলাম প্রায় অপলক।
কিন্তু এ কী? ও যে এবার হাত নেড়ে আমাকে ডাকছে। হ্যাঁ, আমাকেই তো। কি করি? পালাবার প্রশ্ন ওঠে না। অগত্যা মুখের ওপর একটা উদাসীনতার মেক আপ ঝুলিয়ে নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম মেয়েটির দিকে। বুকটা একবার একটু ধুকপুক করে উঠলো, পাত্তা দিলাম না।
-ব্যাপারটা কি জানতে পারি। হাঁ করে ক্যাবলার মত তাকিয়ে আছেন কেন? মেয়ে দেখেননি কোনওদিন?
আমি দুদিকে মাথা নাড়ালাম। কী যে বোঝাতে চাইলাম, আমিও বুঝিনি ভাল করে। আসলে একটু নার্ভাস লাগছিল। তবু কিছুই না বোঝার ভান করে পরবর্তী প্রশ্নের আশায় তাকিয়ে রইলাম।
আমার অমন নির্ভীক ভাব দেখে থমকে গেল সে। তারপর গলায় একটু জোর টেনে বললো, উত্তর দিচ্ছেন না যে? এসবের মানে কি?
চাইনি, কিন্তু আমার মুখ থেকে হুস করে বেরিয়ে গেল কথাগুলো -- 'সংগত কারণ একটা দেখাতে পারি, তবে সেটা হবে গৌণ। মুখ্য কারণটা খুলে বললে হয়তো আবার সংগত হবে না!’ --বলার পরেই মনে হল কি জানি, বাড়াবাড়ি হয়ে গেল বোধহয়। তাই সামলে নিতে হেসে বললাম, এটা কিন্তু আমার যুক্তি নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের।
ও বাবা, তলে তলে এত ? বেশ গুছিয়ে মাঠে নেমেছেন দেখছি। সত্যি, তারিফ না করে পারছি না! তা, এত জানেন আর এটুকু জানেন না যে, ওভাবে মেয়েদের দিকে তাকাতে নেই। ওটা ব্যাড ম্যানারস।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, না মানে, গাংচিলের মত...!
ও গড! রবীন্দ্রনাথকে তো এনেছেন, এবার এই ভর দুপুরের গঙ্গা পাড়ে আবার জীবনানন্দকে টেনে আনবেন না কি? আপনার মতলবটা কী --বলুন দেখি ?
আরে না না, তেমন কোন বদ মতলব আমার নেই। আর ওঁদের মত মানুষকে টানার মত ক্ষমতা আমার কোথায় বলুন। বলতে চাইছিলাম আনকোরা নতুন এক কবির কবিতা। ওই তাকানো- টাকানো নিয়েই আর কি, জাস্ট মাথায় এলো তাই।
কী মাথায় এলো? কবিতা? ইন্টারেস্টিং! তা বলুন তো একটু, শুনি।
'ওভাবে তাকিও না তিলোত্তমা--
বড় ভয় হয় কুমারী সম্মোহনে,
যদি দিনলিপি ফেলে ভেসে যাই
হিসেবের ঘর শূন্য ফেলে রেখে...'
বেশ বড়সড় একটা বেগুনি ছায়া পড়লো মেয়েটির চোখে। সেই ছায়া ক্রমশ আরও ঘন হয়ে চেপে বসলো ওর গাংচিলের মত ঘন দীর্ঘ ভ্রু-জোড়ার ওপর এবং এই প্রথম সে দৃষ্টিতে সম্ভ্রমের রঙ ধরলো।
একটুক্ষণ থেমে রইলো সে, কি যেন ভেবে নিল আপনমনে, তারপর বললো - আপনি তো আচ্ছা মানুষ দেখছি। তা এতদিন কোথায় ছিলেন? না, না জোকস অ্যাপার্ট, আপনার সত্যি এলেম আছে। আপনি এত অকপট কথা বলেন! কবিতা লেখেন না কী..?
এ পরিচয়ে আমার চিরদিনের অহংকার। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে গদগদ কণ্ঠে বললাম — লিখি তো।
শুনশান জেটি, ঘোলা জলস্রোত, পুরনো শহর, প্রাকবিকেলের হলুদ রোদ্দুর এবং একটি মাছরাঙা -- সবকিছু এক পলকে যেন ঘোর অর্থবহ হয়ে উঠলো। নদী-পাড়ের আপাত নির্জনতা কোথাও একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পেল অবশেষে।
0 comments: