গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
Posted in গল্প
প্রধানমন্ত্রী আসেনি
সকাল সকাল ঝুনঝুনি বাজিয়ে কোন ভগবান যেন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো! স্ট্রীট-লাইট লাগানোর একটা ক্রেন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, সেটা যাবার ঝকাৎ ঝকাৎ শব্দে তার ঘুম চটে গেলো। রাস্তার উপর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ফুটপাথের বিছানায় সে উঠে বসলো। একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গতে লাগলো। নজর তার সামনে, রোদ্দুরে উছলানো শহরের ডাগর রাস্তা। একজন পূণ্যার্থী পর্যটক ওর দিকে দুটাকার একটা কয়েন ছুঁড়ে দিলো। পয়সাটা পেয়ে ছেলেটার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একটা মাত্র শব্দ- ‘ঘ্যামা!’ আজকের দিনটা তার ভালো যাবে।
মাথার উপর আমগাছটার পাতাগুলোকে কাঁপিয়ে ভেসে যাচ্ছে হাল্কা হাওয়া। যেমন থির থির করে কাঁপতে কাঁপতে ভেসে যায় মানুষের অনির্দিষ্ট জীবন। ও বুঝতে পারছে, আজ এ শহরে একটা বিশেষ কিছু হতে চলেছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে, অথচ কিছুই ভাবছে না। ভাবনা ভাবনা খেলার এই ব্যাপারটা হঠাৎ রুখে গেলো কর্কশ একটা গলার আওয়াজে।
‘এই ছোকরা, তুই তো এখানেই থাকিস। নামটা কি?’
অপরিচিত লোকটার ডাকে ও উঠে দাঁড়ায়। টুকুন নড়াচড়া করে। উত্তর দেয় – ‘আমার নাম? ...ধূলোবরণ দাস।’
লোকটার পরনে ফ্লুরেসেন্ট টেপ লাগানো সুন্দর একটা হলুদ জ্যাকেট।
‘কাজ করবি? টিফিন মিলবে। পয়সাও মিলবে।’
ছেলেটা একটু ভাবে। মাথা নাড়ে।
‘তোর কাজ হচ্ছে এই সামনের রাস্তাটুকুন একটু নজরে নজরে রাখা, সাফ সুতরা রাখা। দেখে মনে হচ্ছে, তুই ভালই পারবি।’
ধূলোবরণ যদিও বাচ্চা, বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা চওড়া গড়ন। অবসন্ন মুখেও ছিরি ছাঁদ আছে। দেখলে পছন্দ হয়ে যায়। ধুলো ওই হোমড়া চোমড়া লোকটাকে চেনে না।
‘জানিস, কালকে প্রধানমন্ত্রী আসছে?’
আসল কথা এই শহরে কালকেই দেশের মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর আগমন, এখান দিয়েই তার গাড়ী যাবে! স্বচ্ছতা মিশন! জনসভাও আছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরে আসছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট।
লোকটা হাঁকে - ‘কি ছোকরা, রাজি তো? এখান থেকে ফুটে যাস না আবার! এই রাস্তায় বালের চুল, এক টুকরো কচড়াও যেন পড়ে না থাকে। মনে রাখিস আজ আর কাল, এ দু’দিন তোকে এ রাস্তায় মজুত থাকতে হবে।’
লোকটা নাম বাবুয়া চৌধুরী – ধান্ধাবাজ, ফোরটুয়েন্টি। এই অঞ্চলের কর্পোরেশন কর্মকর্তাদের অনেক সাগরেদ ও চ্যালাচামুন্ডারা আছে। সে তাদেরই একজন।
লোকটা এক পাউন্ড রুটি, প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভিজে অঙ্কুরিত ছোলা, আরেকটা প্যাকেটে কিছুটা ঢেলা গুড় আর দশ টাকার দুটো নোট ধরিয়ে দেয় ধূলোর হাতে। বলে - ‘এই নে খাবার, তাছাড়াও পয়সা মিলবে। তোদের জন্যে জ্যাকেট আসছে, জ্যাকেট মানে এখানে ডিউটি দেবার জন্যে স্পেশাল জামা।’ নিজের পরনে ফ্লুরেসেন্ট টেপ লাগানো হলুদ জ্যাকেটটা দেখাতে দেখাতে বলে - ‘তোর কাজটা কিন্তু এখন থেকেই শুরু, আজ রাতটা, কালকে সারাটা দিন, যতক্ষন না প্রধানমন্ত্রী ভিআইপিরা চলে যাচ্ছে, ততক্ষণ। পাক্কা দুদিন, মনে রাখিস। আজকে রাতে এ রাস্তাটা আর একবার ঝাড়ু দিবি।’
ধূলো সযত্নে বুকে আঁকড়ে ধরে খাবারের প্যাকেটটা, ছুঁয়ে থাকে পাউরুটির ঘ্রাণ। পেটের খিদে তো সব সময়েই থাকে। এইমাত্র পাওয়া কড়কড়ে দশটাকার দুটো নোট ঢুকিয়ে রাখে ছেঁড়া জামার বুকপকেটে।
এরই মধ্যে অন্য দুটো লোক হাজির হয়। ওদের পরণেও হলদে জ্যাকেট। সঙ্গে ব্যাগে রাখা আছে এরকম আরো অনেকগুলো ইউনিফর্ম। ওদেরই একজন হলদে জ্যাকেটটা ধূলোবরণের গায়ে পরিয়ে দেয়।
ভিআইপি সফর বলে কথা! সাফ সাফাইএর কাজে যারা লেগে আছে, সবাইকে এরকমই ইউনিফর্ম পরে থাকতে হবে। সাফাই কর্মী হোক, কিংবা ঠিকাদারই হোক। প্রধানমন্ত্রী আসছে, তাই ড্রেসকোডের কানুন এই দুদিন সবার জন্যে লাগু।
যারা ওকে ঝকমকে জ্যাকেটটা পরাচ্ছিলো, তাদেরই একজন বললো -‘শোন, কেউ যদি জানতে চায় এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিস, বলবি তুই সাফাই কর্মী, বলবি ঠিকাদার চৌধুরীর কোম্পানীর লোক।’ ওই লোকদুটো আগে চলে যায়, অন্যান্য সাফাইকর্মীদের ড্রেস পরাতে।
বাবুয়া চৌধুরী চলে যেতে যেতেও যায় না। নতুন নিয়োগপত্র দেয়া ফুটপাথের এই ছেলেটাকে দেখে ওর বেশ মজাই লাগে। কপচাতে থাকে – ‘জানিস, এ দেশের প্রধানমন্ত্রীটা কে? তোদের মতো লন্ডা বাচ্চাদের প্রধানমন্ত্রী খুব ভালোবাসে।’
ধূলো তাকিয়ে দেখে, কারা যেন আজকে সকালে চৌকো সবুজ রঙ্গের একটা নতুন ডাস্টবিন রেখে গেছে ফুটপাথের পাশেই। এটা তো কালকেও ছিলো না। ফুটপাথ আর বাসস্ট্যান্ডে তার অনেকদিন বসবাসের অভিজ্ঞতা। সে তার ফুটপাথে বসবাসের একটা স্বাভাবিক ধারণা আর সাধারণ বুদ্ধিতে আঁচ করে নেয়, আজকে একটা অন্য রকম দিন।
বাবুয়া চৌধুরী ঠাট্টা করে একটা ম্যজিশিয়ান মাফিয়ার মতো ধীরে ধীরে বলতে থাকে - ‘জানিস, প্রধানমন্ত্রী এলে সামনের ওই রাস্তাটা সোনার হয়ে যাবে। তোর মাথার উপরে এই আমগাছগুলো থেকে খাট্টা খাট্টা আম নয়, সুন্দর সুন্দর আপেলের মতো অদ্ভুত সব ফল ঝুলতে থাকবে। দেখিস, কত রকমের পরিবর্তন হবে। তখন তোদের আর খাওয়া পরার কোন কষ্টই থাকবে না।’
মিউনিসিপ্যালিটির থেকে দুদিনের এই টেম্পোরারি কাজটার সাব-কনট্রাক্ট হাতিয়েছে বাবুয়া চৌধুরী। তাই এখন অনেক কাজের তাড়া। ব্যবসায়ীর বাস্তব বুদ্ধিটাও তার খুব টনটনে - প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্যে সে কিছু বাচ্চাকেও কাজে লাগিয়ে রেখেছে। ধূলোকে দেখভালের জন্যে দেয়া হয়েছে রাস্তাটা এই মোড়টা থেকে হোটেলের সামনের সাত নম্বর ল্যাম্পপোস্টটা পর্যন্ত, সেখান থেকে চোদ্দ নম্বর ল্যাম্পপোস্ট পর্যন্ত মদনাকে লাগানো হয়ে গেছে। মদনার ঠিকানাও এই ফুটপাথ। সামনে প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তাটা ভিআইপি জোন। এটার স্পেশাল সাফসাফাই আর দু’দিনের দেখভালের পেটি কন্ট্রাক্ট বাবুয়ার হাতে। দূর থেকে মজদুর আনিয়ে, সারাদিন সারারাত লাগিয়ে, একাজ করাতে গেলে মজুর পিছু খরচ কমসে কম পাঁচশো টাকা। রাস্তায় শুয়ে থাকা ছেলে-ছোকরাদের পেছনে পঞ্চাশ-ষাট খরচা করলে সেই কাজই আরো ভালো ভাবে উৎরে যাবে। তাই সে বড়দের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে ফুটপাথের এইসব বাচ্চাদেরও – সামান্য ক’টি টাকা আর খাবারের বিনিময়ে।
ধূলো খুব খুশী। দুদিনের কাজ। বিশটা টাকা মিলছে, টিফিনও মিলেছে।
তখন দুপুর। আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী আসছে। মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন দুপুরে ফুটপাথ সহ গোটা রাস্তাটাই একবার সাফ সাফাই করে দিয়েছে। কয়েকদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি চলছিলো। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার, বড়ো বড়ো নেতাদের ফটো। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানো নীল সবুজ সোনালী রূপালি ঝালর! একটার পর একটা পুলিশের গাড়ি লালপিলা লাইট জ্বালিয়ে প্যাট্রোল দিচ্ছে। শহরের রাস্তায় গাড়ি, বাস, যাত্রী নিয়ে অটোরিক্সা, পথভাঙা মানুষ। স্বাভাবিক ব্যস্ততায় টইটম্বুর এই শহরটার চারদিকে এখন কেমন যেন অন্য রকম পরিবেশ, একটা সাজোসাজো অবস্থা।
দুপুর থেকে বিকেল হয়। এরই মধ্যে পকেটের পয়সা দিয়ে ধূলো বাসস্ট্যান্ডের দোকন থেকে একবার চপ আর ভাজিয়া কিনে খেয়েছে।
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে রাত নামে। আজ সারারাত জেগে রাস্তা সাফাই হবে। পরনের হলুদ জ্যাকেটটার মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর খাবারের ফিরিক লুকোনো আছে। ভবঘুরেদের খাবার জন্যে বাজারের ভেতরে ঝুপড়িতে বসা পাইস-মিলের দোকান। রাত নটা নাগাদ সেখান থেকে পকেটের টাকা ভাঙিয়ে সে আরেকবার থালা ভর্তি ভাত ডাল আর অনেকগুলো সব্জী খেয়ে এসেছে - ধূলোর কি নিশ্চিন্ত সময়। সকাল, দুপুর, রাত – এ দুদিন পেটের চিন্তা নেই।
নাইট ডিউটি। তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। আকাশে বড়ো একটা চাঁদ। যদিও এ রাতে চাঁদটার দরকার ছিল না। কিলোওয়াট গেলা স্পেশাল বড় বড় ইলেক্ট্রিকের ল্যাম্প। রাতের শহরেও স্পেশাল আলোর ব্যবস্থা। ঝকঝকে রাস্তায় মার্কারির তীব্র ঝলকানি। এত আলোর ঝকমকিতে উপরের চাঁদটাকে অনাহুত মনে হচ্ছে। ধূলোবরণ বুঝে নিয়েছে তার সাফ-সাফাই আর নজরদারির এরিয়াটাকে, রাস্তার এই মোড় থেকে সাত নম্বর ল্যাম্পপোস্ট পর্যন্ত। মাঝরাতের রাস্তায় গাড়িটারি খুব কম। ট্রাফিক পুলিশের ফেলে রাখা ‘সাবধান’ বোর্ড।
উজ্জ্বল ফ্লুরোসেন্ট লাগানো হলদে জ্যাকেট শরীরে, ফুটপাথের বাসিন্দা কয়েকটা বুড়ো আর বাচ্চা মাঝরাতে সাফাই করে চলেছে মহানগরীর এই তিন কিলোমিটার ভিআইপি রাস্তা। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! লম্বা ডান্ডিয়ালা ঝাড়ু। এসব ঠিকাদারেরই সাপ্লাই করা। প্রায় জনা দশেক লোক মিলে মাঝ রাত্তিরে চলছে বিশেষ স্বচ্ছতা অভিযান। মার ঝাড়ু, মার ঝাড়ু - মেরে ঝেটিয়ে বিদেয় কর! পরিষ্কার রাজপথে একটু খানি ঝাড়ু বুলিয়ে যাওয়া। সাফাই সাফাই উৎসব। চাঁদের আলোর নীচে বেশ মজার খেলা। আজ রাতটুকু পোহালেই এ রাস্তায় প্রধানমন্ত্রী আসবে, কালকে এ রাস্তা দিয়ে তাদের গাড়ী যাবে।
এই সাফাই উৎসবে রাত অনেকটা গড়িয়ে গেছে। শেষ রাত। ঝাড়ুটাকে পাশে রেখে বাসস্ট্যান্ডের গুমটির মধ্যেই নিজের রোজকার জায়গায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো ছেলেটা।
# # #
পরদিন সকাল বেলায় তার ঘুম ভাঙ্গলো মিলিটারিদের কুচকাওয়াজে। প্যারা মিলিটারিদের একটা দল বিউগল আর নানা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে রিহার্সাল করে চলেছে।
আড়মোড়া ভেঙ্গে রোজকার চটের বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো ধূলো। বাসস্ট্যান্ডের পেছন দিকের দেয়ালে সেরে নিলো চিরিক মিরিক পেচ্ছাপের কাটাকুটি খেলা। প্লাস্টিকের দোমড়ানো বোতল থেকে জল বের করে ছিটিয়ে নিলো চোখে, মুখেও ঢেলে নিলো খানিকটা।
ধূলোর ঘরবাড়ি এখানেই। বাসস্ট্যান্ডের গুমটিটায়। একটা সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চের নীচেই তার দিনযাপনের সামান্য খুঁটিনাটি। মা আর একটা ভাই, তারাও এ শহরের কোনও ফাঁকফোকরেই সিঁধিয়ে থাকে, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মধ্যে এসে তাকে দেখা দিয়ে যায়। ওর মা আর ভাইয়ের আজকের খবর কি? প্রধানমন্ত্রী সফরের জন্যে এরকম দুদিনের রুটিরুজি ওদেরও মিলেছে কি? ও জানে না।
সকাল সকাল ঝকঝকে হলদে জ্যাকেটটা টান টান করে ধূলোবরণ রাস্তায় মোড়টার কাছে টহল দিতে লাগলো। হলদে পোষাকে নিজেকে অনেকটা রাজকীয় মনে হচ্ছিলো। চায়ের দোকানে টিভিতে দেখা রাজপুত্রর কথা তার মনে পড়লো। একটা অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় সে প্রাণিত হোলো। টগবগে ছাগলের বাচ্চার মতো রাস্তার এমাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত টহল দিতে লাগলো। দেখতে লাগলো এদিক ওদিক রাস্তায় কিছু কচড়া পড়ে আছে কিনা। কিছুক্ষণ টহল দেবার পরই সে বুঝতে পারলো, মানুষের বাচ্চা হোক কি রাজপুত্র কোটালপুত্র হোক, সবারই ক্ষিদে পায়। গত রাতটায় ওরা রাস্তায় রাস্তায় ঝাড়ু বুলিয়েছে, সাফসাফাই করেছে। তাই সকাল সকালই ওর এতো খিদে পাচ্ছিলো।
কি করবে কি করবে এমনি ভাবতে ভাবতে সে যখন হলদে উর্দি পরে তার নির্দিষ্ট জায়গাটায় নজরদারির ডিউটিটা দিচ্ছিল, তখনই দেখা দিল সুপারভাইজার- বাবুয়া চৌধুরীর সেই অ্যাসিস্ট্যান্টটা। আগের দিনের মতোই হলদে ইউনিফর্মে। লোকটার মোটর সাইকেলের পেছনে বড়ো একটা বাক্স। সেখান থেকে বড়ো সাইজের একটা খাবারের প্যাকেট তুলে এনে ধরিয়ে দিলো ধূলোর হাতে।
বাবুয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট বললো, ‘প্রধানমন্ত্রী চলে গেলে সন্ধ্যায় আমি আবার আসবো, এখানেই থাকবি। তখন টাকা মিলবে কিন্তু।’
লোকটা চলে যেতেই ধূলোবরণ দেখলো রাস্তায় একটা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি। জল ছিটাতে ছিটাতে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় যাতে একটুও ধূলো না থাকে। কি বিচিত্র! বারো-তেরো বছরের ছন্নছাড়া জীবনে এমন উৎসবময় পরপর দুটো দিন তার কাছে আগে কখনোই আসে নি। হাতে আসা বিশাল প্যাকেটটা খুলে তখুনি সে কিছুটা খাবার গিলে ফেললো, বাকিটা বাঁচিয়ে রাখল দুপুরে খাবার জন্যে।
প্রধানমন্ত্রী আসছে। রাস্তায় অনেক জায়গাতেই সাউন্ড সিস্টেম লাগানো হয়েছে। কোথাও বাজছে দেশাত্মবোধক সংগীত, কোথাও বা বিসমিল্লা সাহেবের সানাই। সব সুরগুলো মিলে মিশে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। সুন্দর সমারোহের পরিবেশ। দল বেঁধে মানুষ যাচ্ছে। তাছাড়া রাস্তায় ঘুরছে কাগজ আর প্রেসের ফটোগ্রাফারেরা। বিদেশী ট্যুরিস্টদেরও আনাগোনা। এই রাস্তাতেও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে যানবাহনের আসা যাওয়া। সব গাড়িকে রাস্তায় ঢুকতে দেয়া হচ্ছেনা।
সবুজ গাড়িতে একদল মিলিটারি। তার একটু পেছনেই, পায়ে হেঁটে মার্চ করে যাচ্ছে একদল পুলিশ। ধূলো দুচোখ ভরে দেখছে আজকের ঘটে যাওয়া একের পর এক দৃশ্য, চারদিকে একটা ব্যস্তসমস্ত ভাব, অথচ সব কিছুই খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ।
একটু বেলা বাড়তেই রাস্তায় মানুষদের আনাগোনা বাড়ছে। জনসভায় প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে যাবার হুমড়েপড়া ভীড়। পথে চলেছে মানুষ, আজীবনের অভ্যাসে কেউ কেউ রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে সিগারেটের প্যাকেট, গুটকা – পানপরাগ বা মশলার পাউচ, চলতি প্রাইভেট কার থেকে কেউ একজন ছুড়ে ফেললো ম্যাঙ্গো জুসের খালি ডাব্বা – চুমুক দেবার স্ট্র। চক্কর দিতে দিতে কর্তব্যপরায়ণ সাফাইকর্মীর মতো ধূলো সেগুলো কুড়িয়ে আনে, জড়ো করে রাখে সবুজ সবুজ নতুন ডাষ্টবিনগুলোয়।
রাস্তায় ব্যানারে ব্যানারে ছয়লাপ। দুপাশের ল্যাম্প পোস্টের বোর্ডে ঝুলে আছে প্রধানমন্ত্রীর চেহারা। কে প্রধানমন্ত্রী, কি তার নাম এসব সে জানে না। জানার প্রয়োজনও পড়েনি কোনোদিন। খবর কাগজয়ালা চেঁচাচ্ছে – ‘বিশেষ খবর, এই শহরে আজ আসছে প্রাইমমিনিস্টার। আসছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। খবর কাগজের বিশেষ খবর, কিনে নিন- দাম মাত্র তিন টাকা!’
ভ্রাম্যমান খবর কাগজয়ালাটি পানপরাগের পাউচ রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতেই ধূলোবরণ শিশুসুলভ রাগে প্রতিবাদ করে – ‘এই পেপারওয়ালা! রাস্তা নোংরা করতেছিস ক্যানে? পোধানমন্তি আসতিছে।’
রাস্তার মোড়, যেটাকে চৌমাথা বলে, সেখানে পিচবোর্ডের বড়ো বড়ো কাট আউটে দুটো বিশাল মূর্তি – একজনের সাদা ধুতি শার্ট, অন্যজন স্যুট-টাই – হাত ধারাধরি করে দাঁড়িয়ে। বারো-তেরো বছরের এই সাফাইকর্মী মাথা উঁচিয়ে সেই বিশাল মূর্তিদুটোকে দেখতে থাকে। ওই দুটো চেহারার মধ্যে একজন নিশ্চয়ই আমাদের প্রধানমন্ত্রী, আর অন্যজন বিদেশের প্রেসিডেন্ট। ছেলেটার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী এলে সত্যি সত্যি এ জায়গাটায় বিরাট কিছু একটা ঘটে যাবে। ওই যে ঠিকাদার বলেছিলো না – অনেক কিছু উন্নতি হবে! সামনের রাস্তাটা পালটে যাবে, ঐ গাছগুলো থেকে কি সমস্ত অদ্ভুত সব ফল ঝুলবে!
এখান থেকে তিন কিলোমিটার গেলে জনসভার মাঠ। সেখানে জনসভা। ধূলো এসব কথা খবর কাগজ বেচে যে লোকটা, তার মুখ থেকেই শুনেছে। তারপর প্রধানমন্ত্রী নাকি ফরাসি প্রেসিডেন্টকে নিয়ে মন্দির দর্শনে যাবে, নদীর ঘাটে পূজা দেবে।
প্রধানমন্ত্রী আসছে। কিন্ত কেমন সেই মানুষটা? স্বাভাবিক কৌতূহলে এসব প্রশ্ন ধূলোর মনে জাগে। ঠিক কটার সময় সে আসবে? এসব কথা কেউ তাকে আগে থেকে বলে দেয় নি। প্রাইমমিনিস্টার আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট যখন এরাস্তা দিয়ে যাবে, তখন তাদেরকে ও কি চিনতে পারবে? এর আগে কয়েকবার ভোটের সময় নেতা মন্ত্রীদের সারিবদ্ধ গাড়ি দেখেছে। কিন্তু আজকে প্রধানমন্ত্রীদের বিশেষ গাড়িগুলো দেখতে কেমন হবে? সে গাড়ী কি অন্য গাড়ীগুলোর থেকে অনেকটাই উঁচু, দোতালা বাসগুলোর মতো? নাকি মেলায় দেখা রথের মতো, বিশাল কাঠের চাক্কায় তৈরী সেসব গাড়ি। যেখানে জগন্নাথেরা বসে থাকে। সে শুনেছে এই ভগবান নাকি ঠুঁটো, তার হাত পা নেই। দেশের লোকেরা তাহলে কি দড়ি দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে যাবে প্রধানমন্ত্রীর ঝান্ডা ওড়ানো বিশাল সেই রঙচঙে রথটাকে?
ওই তো ভিআইপিদের একটা লম্বা কনভয়, লালনীল বাতি জ্বালিয়ে ছুটে যাচ্ছে। সামনে আর পেছনে সাইরেন লাগানো মিলিটারিদের সবুজ ভ্যান। ওটাই কি ওনাদের গাড়ী?
সময় গডিয়ে যায়।
বিভিন্ন জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে হলদে জ্যাকেট পরিহিত বিশেষ সাফাইকর্মী ধূলোবরণ এই জনসমুদ্রে অপেক্ষা করতে থাকে। অধীর আগ্রহে একটা আন্তরিক বাসনা নিয়ে দুচোখ মেলে থাকে - আগমন ও প্রস্থানের দুর্লভ মুহূর্তে সে প্রধানমন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখে নিতে চায়। তার সামনে দিয়ে হাজার হাজার মানুষ চলে যায়, সাদা সাদা গাড়ী যায়, লাল নীল গাড়ী যায়, শব্দ তোলা মাইক, ফ্ল্যাগ ফেস্টুন, বাদ্যযন্ত্রও এসব অনেক কিছুই যায়। ‘প্রধানমন্ত্রী যুগ যুগ জিও’ – ধ্বনি দিতে দিতে লোকেদের মিছিল যায়। ‘দেশ-বিদেশ ভাই ভাই, এই দোস্তিতে খাদ নাই’ – কিছু লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এগিয়ে যায়। অথচ কেউ তাকে বলে দেয় না প্রধানমন্ত্রী কখন আসছেন, কখন ফিরে যাচ্ছেন! ধীরে ধীরে সময় এগোতে থাকে।
ব্যস্ত দুপুরটা ক্রমশঃ গড়াতে থাকে। নানা মিছিল আর বিশাল আয়োজনের মধ্যে ক্রমশঃ বিকেল হয়। পূর্বাহ্নের সেই সব তৎপরতা ক্রমশঃ ঢিলে হয়ে আসে। মিলিটারি পুলিশের গাড়ি, ব্যান্ডপার্টির লোক, কুচকাওয়াজ করে পায়ে হেঁটে যাওয়া এসটিএফ-এর দল উলটো দিকে ফিরে আসে। সন্ধ্যা নামে, রাস্তার ভীড়ও ধীরে ধীরে হাল্কা হয়ে আসতে থাকে।
তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী এসে ফেরৎ চলে গেছে? না না, তা কেমন করে হবে? তাহলে প্রধানমন্ত্রীর হয়তো ট্রেন লেট আছে, কিংবা হয়তো এখনো তিনি এসে পৌঁছোন নি। একটু পরেই আসছেন।
একসময়ে একটা লোক ধূলোর সামনে আসে। তড়িঘড়ি ওর পরণের জ্যাকেটটা ফেরৎ নিয়ে নেয়। ‘তুই এখানেই থাকবি। কোথাও যাবি না। মালিক আসবে। বাকী পয়সা তোকে তখনি মিলে যাবে।’ এই কথা বলে লোকটা মোটর সাইকেলে উধাও হয়ে যায়। ঝকঝকে ফ্লুরেসেন্ট লাইট লাগানো চওড়া রাস্তায় সন্ধ্যা গড়িয়ে ক্রমশঃ রাত্রি নামে। রাত বাড়তে থাকে। ধূলোর ক্ষিদে পায়।
রাত আটটা নাগাদ হঠাৎ লোড শেডিং। কিছু গোলোযোগের কারণে রাস্তায় অনেকক্ষণ লাইটের দেখা নেই। দুদিন ব্যাপী এই রাজকীয় উৎসবের জন্যে রাস্তাটাকে অতিরিক্ত আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছিলো। সিস্টেমের ওভারলোডিং? কিছু কিছু অস্থায়ী বিদ্যুত সংযোগও নেয়া হয়েছিলো, নাকি তার জন্যে কোনো গড়বড়ি, ফল্ট? মজুত কর্মচারীরা ছোটাছুটি করছে – তবুও রাস্তায় লাইটের দেখা নেই। জেনারেটর আর ইনভার্টরের এমার্জেন্সী আলো, ছুটন্ত গাড়ীগুলোর হেডলাইটে কিছুক্ষণ আগের এই ব্যস্ত রাস্তাটাকে বড় অসহায় আর অভিসন্ধিমূলক মনে হয়।
এই মহানাগরিক অন্ধকারে ধূলো তার মালিকের অপেক্ষায় বসে থাকে। সকালের কথামতো বকেয়া প্রাপ্য পয়সা মেটাতেও কারুর মুখ দেখা যায় না। এই ফুটপাথের রাতে গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে তার চোখে পড়ে আবছা সেই পীচের রাস্তাটা। আমগাছের লম্বা লম্বা পাতার ফাঁফ ফোকর দিয়ে মাথার উপর উঁকি মারে ছেঁড়াখোড়া চাঁদ।
বিদ্যুতের সরবরাহ আংশিক ফিরে আসে, রাত তখন প্রায় একটা। কিছু ঘর, কিছু ল্যম্পপোস্টে আলো জ্বলে। বেশী আলো, কম আলোতে অবশ্য ধূলোর কিছু আসে যায় না। গতকালের তুলনায় আজ রাতে তার এই পরিচিত রাস্তাটাকে রোগীর মতো ক্লান্ত আর অসুস্থ মনে হয়।
অন্যদিনের চাইতে কম ঊজ্জ্বল আলোকিত সেই ফুটপাথে বসে ধূলো সামনের নির্জন হয়ে আসা বিশাল রাস্তাটাকে দেখে। তার মনে পড়ে, মালিক লোকটার কথাগুলো। প্রধানমন্ত্রী এলে অনেক অনেক ভালো ভালো ঘটনা ঘটে যাবে। অথচ সামনের রাস্তাটা কালো পীচের যেই কে সেই। কই সেই মালিক লোকটার কথামতো রাস্তাটা তো শেষ পর্যন্ত সোনার হয়ে যায়নি! সামনের গাছটায় টক আমের বদলে আপেলের মতো অদ্ভুত অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর ফলও ঝুলছে না? তার ফুটপাথের জীবন যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। তাহলে যাদের আসার কথা ছিলো, তারা কি আজকে আসে নি?
ধূলোর ক্ষিদে ক্রমশই বাড়তে থাকে। একটা চটের বিছানায় ছেঁড়া জামা পরে নিজের শরীরটাকে ফুটপাথে বিছিয়ে দেয়। এই মধ্যরাত্রে কপর্দকহীন, কিছুটা ক্লান্ত ও তন্দ্রাচ্ছন্ন ছেলেটার সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে থাকে।
ধূলোর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে সংক্ষিপ্ত খিস্তি – চুৎমারাণি! তার পেটে ক্ষিদে। সে নিজের মনে নিজেই বিড় বিড় করে বলতে থাকে – ধ্যুৎ শালা। এখানে পোধানমন্তি কখনো আসেনি! এখানে পোধানমন্তিরা আসে না!
0 comments: