গল্প - অভীক চৌধুরী
Posted in গল্প
নাম রেখেছি বনলতা
‘কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে / মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে, আমি যে মাতাল হাওয়ারই মত হয়ে / যেতে যেতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে’... পাড়ার ফাংশনে প্রথম শুনি গানটা তপনদার গলায়, তপনদার তখন খুব নামডাক। বাড়িতে তখন রেডিও আসেনি, আমি এগারো কি বারো, তবুও আশেপাশের, পথচলতি অনেক বাড়ি থেকে ভেসে আসা এই গান আমাকে বিহ্বল করে তুলতো। গানের মানে ভালোভাবে না বুঝলেও ভীষণ ভালো লাগতো আধুনিক বাংলা গান শুনতে। তারপর সেজকাকা একদিন প্যানাসনিক রেডিও নিয়ে এলো বাড়িতে, কি যে আনন্দ আমার মনে প্রাণে আকাশে বাতাসে। গান শুনতে শুনতেই ক্লাস পেরিয়ে যাই। একদিন কোচিং ক্লাসে সত্যি দীঘল দুটি চোখ আমাকে মন্দ করে দিলো, তার নাম জানিনা। কি যে বলবো। কেন, গান আছে তো, আমার শৈশবে সৃষ্ট আজও শুনি যে গান --- ‘নাম রেখেছি বনলতা যখন দেখেছি / হয়তো বা সেইক্ষণে তোমায় ভালোবেসেছি’ ...না, আমার আর বনলতা নামে ডাকার কোনো সুযোগ ঘটেনি। কারণ তখন, ‘আপন নীড়ে ফিরে গেছে পাখি / নীড় হারায়ে আমি পথে থাকি’
তারপরে কলেজ জীবনের শুরু, সত্তর-একাত্তরের সেই উদ্দাম রক্তঝরা মুক্তির দশকের আঁচ বাঁচিয়ে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে গান শোনাও চলছে পুরোদমে। পুজোর নতুন গান শুনলাম, মনে হলো এতো আমার জন্যই গাওয়া। সপ্তমী পুজোর সন্ধ্যেতে ভিড় কাটিযে, গুরুজনদের চোখ এড়িয়ে, বন্ধুদের আঁচ বাঁচিয়ে অনেক কষ্টে ভালোলাগা একজনকে পেলাম, চোখে চোখে চাওয়া হলো, তার হাসিমুখের ইশারায় অনতিদূরের প্যান্ডেলে গান বাজছে -- ‘কাল তাহলে এই সময়ে আসবো এখানে / এমনি করে হয় যদি প্রেম মন যদি টানে’ ...আমার যে কি অবস্থা, সকালে বন্ধুরা এসে ফিরে গেলো, কাউকে কিছু বলতে পারলাম না। আর মাত্র ক’ঘন্টা পরেই সেই মহামিলন, ভয়ে বুক দুরু দুরু --- ‘দেখা হবে কি হবেনা তা জানিনা / মনে রবে কি রবেনা তা জানিনা’
আমায় অবাক করে দিয়ে বনলতা সত্যি অষ্টমীর সন্ধ্যেতে ঠিক সময়ে এসেছিলো, সঙ্গে ছিল দুই বন্ধু সাগরেদ। হঠাৎ করে একজন আমায় প্রশ্ন করলো, কি পড়ো তুমি আর কোন কলেজে ?
আরে বাবা, প্রেমের সঙ্গে এর কি যোগ? তবুও হেঁচকি সামলে উত্তর দিলাম, অঙ্কে অনার্স। আর একজন সাগরেদ বনলতার হয়ে বললো, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ইংরেজিতে অনার্স।
পাছে ইংরেজিতে প্রেমপর্ব শুরু হয় এই ভয়ে আমি পিছুটান দিলাম। যেতে যেতে শুনতে পেলাম ওদের হাসি, কেমন গুল দিয়ে বোকা বানালাম। আমার মনে হলো --- ‘চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কি হবে / রূপ যদি না থাকে সখী গরব কেন তবে’। গানের মধ্যেই একদিন বুঝতে পারলাম ‘প্রেম করা যে কি সমস্যা / আজ পূর্ণিমা কাল অমাবস্যা’ ...না, আজ আমার প্রেম করা হয়ে উঠলো না।
তারপর ‘চলে যে যায় দিন দিন দিন / নুপুর বাজে রিন্ রিন্ রিন্’ ...শুনতে শুনতে কলেজ অধ্যায় শেষ, বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের জীবন শুরু। চাপ বাড়ে পড়াশোনার, আর বনলতার দেখা মেলে না। তখন কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্র প্রথম সাদা কালো টিভি চালু করেছে। তবুও রেডিও আঁকড়ে থাকি, টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেটে গান বাজে ----- ‘তোমারি পথপানে চাহি / আমারো পাখি গান গায়’ ...বনলতাকে খুঁজে বার করতে খুবই ইচ্ছে করে, তবুও কে যেন তার জাদুকরী কণ্ঠ দিয়ে আমায় মানা করে --- ‘ভ্রমরা, ফুলের বনে মধু নিতে অনেক কাঁটার জ্বালা / তুই যাসনে সেখানে, রূপের জালে জড়ালে তোর আসবে দুঃখের পালা / তারে যে জানে সে জানে’। তবুও অস্তিত্বহীন এক কাজলনয়না, যার চুলের মত মেঘ সব বর্ষার আকাশ ঘিরে থাকে, তারই আবর্তে থাকতে থাকতে নতুন জীবন শুরু হয় সরকারি অফিসে। বনলতার খোঁজে আর হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশে বিজ্ঞাপন দিই না। বাবা-মা’র পছন্দে শুরু হয় নতুন পথচলা। মনে মনে গুনগুন করি ---- ‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর / হাসি আর গানে ভরে তুলব’। সংসার নামক বেতাল জাঁকিয়ে বসে বিক্রমাদিত্যরূপী আমার কাঁধে। ভাড়া বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা, অবিবাহিতা পিসী, দুই সহোদর, স্ত্রী আর নতুন প্রজন্মকে নিয়ে শুরু হয় নতুন পথচলা। অনেক গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত পেরিয়ে বসন্ত আসে, ভার্যার অফুরন্ত তাগিদ, উৎসাহ আর পরিশ্রমের মিশেলে অফিসের ঋণে তৈরি হয় বাড়ি আর ফ্ল্যাট। এফ এম চ্যানেলে কোনোদিন গান বাজে --- ‘এই পথে যায় চলে / ঝরাপাতা যায় দলে / কোন সুরে উতলা মন আমার’ ...কালের অমোঘ নিয়মে বাবা-মা ফটো হয়ে যায় একদিন। আমার ভাইও গান খুব ভালোবাসতো, বিশেষ করে শ্যামল মিত্রের গান। ওকে গাইতে শুনেছি – ‘ধরো কোনো এক শ্বেতপাথরের প্রাসাদে / আমার এই গানের পাখি সোনার খাঁচায় / বন্দি যদি হয়’I না, কোনো গানের পাখিকে সে বন্দি করতে পারেনি। উল্টে তার প্রাণপাখি অবেলায় জীবনের কুঁড়েঘর ছেড়ে চলে গেছে। বনলতাকে আমি আজও খুঁজে পাইনি, তবু নিজের লেখা কবিতায়, গল্পে, সাহিত্য চর্চায় সে থাকে, সে আসে যখন ...‘নীল আকাশের ঐ কূলে / কান্না হাসির ঢেউ তুলে, সূর্য তারা চাঁদের ধারা / মেঘের মাদলে’ ...কিম্বা কোনো রিয়ালিটি শো-তে কোনো কিশোর প্রতিযোগী যখন অবিকল মরমী গলায় গেয়ে ওঠে ---- ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’... আবেগে আমার গলার স্বর বুজে আসে, কালো মেঘের বাস্প জমে দু চোখের আকাশে। কানে বাজে সেই গান --- ‘ছেড়ে যেতে হবে সব / জীবনের কলরব’ ...তবুও সুর আসে, সুখ আসে, গান আসে প্রতিদিন প্ৰতিখন, -- ‘এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে মন যেতে নাহি চায় নাহি চায়’...
বুকের মধ্যে বাজনা বাজে, ‘ধিন তাক কুর ধিন তাক / যায় যাক দিন যাক ...ও মন ভুলে যা ভুলে যা তারে / কি পেয়েছো বা পাওনি তারে, শুধু ছন্দে আনন্দে / মন ভরে দে রে...’
(আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ ও ঠিক পরবর্তী যুগের রত্নভাণ্ডার থেকে চিরকালীন জনপ্রিয় গায়ক ও সুরকার শ্রীশ্যামল মিত্রের গাওয়া অজস্র গানের মাত্র কয়েকটিকে আমার লেখায় উল্লেখ করতে পেরে আমি গর্বিত। হীরা পান্না মুক্তো খচিত এইসব গানের কথা শ্রদ্ধেয় শ্রীগৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্রীসুধীন দাশগুপ্ত, শ্রীসলিল চৌধুরী, শ্রীশৈলেন রায়, শ্রীপবিত্র মিত্র, শ্রীঅভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুরস্রষ্টা শ্রদ্ধেয় শ্রীহিমাংশু দত্ত, শ্রীসুধীন দাশগুপ্ত, শ্রীসলিল চৌধুরী, শ্রীঅভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অবশ্যই শ্রীশ্যামল মিত্র। এঁদের সকলকে আমার বিনম্র প্রণাম, গানে গানে আমাদের ভুবন ভরিয়ে দেবার জন্য। যদি কারুর ভালো লাগে তবে আবার লিখতে চেষ্টা করব অন্য কোনো বিষয়ে, নাহলে এখানেই ইতি।)
বাঃ, পুরাণো গানে লেখাটা ভালোই জমেছে !
ReplyDelete