0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in


অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ৭
অংকুর সাহা 


হৃদয়ের গভীর আবহে নিবিড় অনুভূতির প্রকাশ হল প্রেম -- কাগজে কলমে তাকে রূপ দেয় কবিতা। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে তার প্রবাহ। নিবিড় আকর্ষণের গাঢ় বন্য মধু, গ্রামের দোকানে তার খোঁজ করে লাভ নেই, তাকে তুলে নিয়ে আসতে হবে চাক ভেঙে, পথে থাকবে বাধা-বিপত্তি, কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হবে পা, তীব্র চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে পশুরাজ সিংহ, তাকে ভয় পেলে চলবে না। প্রেমের জ্বলন্ত অঙ্গারে পুড়ে যেতে পারে দুহাত, কিন্তু সেই যন্ত্রনাটায় রয়েছে মুক্তির স্বাদ, মস্তিষ্কের ইলেক্ট্রিক সার্কিটে তা পৌঁছে দেবে অনির্বচনীয় তাপ ও আলোক। দহনের অন্তহীন পুলক অথবা একাকিত্বের নৈর্ব্যক্তিক শান্তি -- এই দুই এর মাঝে-ই কেটে যায় মানব জীবন।

এই কিস্তিতে আপনাদের সামনে উপস্থিত আরও আটজন কবি -- চারজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের; বাকিরা এসেছেন চেকোস্লোভাকিয়া, জাপান, কানাডা এবং আয়ারল্যান্ড থেকে। একজন নোবেলজয়ী, অন্য একজন ২০১৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পেলেন না বলে অনেকেই হতাশ -- এমন তাঁর গদ্যের অভিঘাত স্বাধীন ও চিন্তাশীল মানুষের মনে। বিষম এবং সমলিঙ্গের দয়িত-দয়িতার পানে ধেয়ে যায় তাদের সকল ভালোবাসা। 

চেকোস্লোভাকিয়া নামক দেশটির বিবেক ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট। তাঁর চোখের সামনে গড়ে উঠেছিল দেশটি -- অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের বোহেমিয়া প্রদেশে তাঁর জন্ম। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে যখন দেশটির জন্ম হয়ে, তাকে উদ্দেশ করে লেখা তাঁর প্রথম কবিতাটি। চোখের সামনে দেখেছেন অত্যাচার -- প্রথমে নাৎসি জার্মানির, পরে স্তালিনের সোভিয়েত রাশিয়ার। তার নয় দশকের জীবনে রাজনৈতিক ঝড়-ঝঞ্ঝার অন্ত ছিল না। তবু তিনি হাল ছাড়েননি -- প্রেম ছিল তাঁর অবলম্বন, ঘৃণা নয়। “A poem is not a phantasm, but a difficult and inconsiderable achievement like a workman’s labor.” -- তিনি লিখেছিলেন তাঁর কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায়।

মে সোয়েনসন প্রেমের কবিতা লিখেছেন সারাজীবন। প্রেম তাঁর কাছে, “Thick, concentrated, transparent amber that you bring home, the sweet that burns.” সাহিত্য-সমালোচক এবং “অজর-অমর-অধ্যাপক” হ্যারল্ড ব্লুমের (১৯৩০-২০১৯) মতে তিনি বিংশ শতাব্দীর এক প্রধান ও মৌলিক কবি। ১৯৬৮ সালে আততায়ীর হাতে অকালমৃত রবার্ট কেনেডির শেষকৃত্য উপলক্ষ্যে তিনি লিখেছিলেন এক মর্মস্পর্শী কবিতা। ধরার প্রতিটি অবয়বের ভেতর তিনি প্রেম ও কবিতার সন্ধান পান, যা “spotted, original, spare and strange.” ফুলের ওপরে বসে থাকা প্রজাপতিও তাঁর কবিতায় রতিক্রয়ার শিহরণ আনে।

মুৎসুও তাকাহাশির সংকলিত কবিতাটি তাঁর একুশ বছর বয়েসে লেখা। তিনি পুরুষাঙ্গের একনিষ্ঠ পূজারী, তাঁর সেই একটাই ঈশ্বর -- তিনি বিশ্বাস করেন না যে প্রতিটি পুরুষ শিশু বালক থেকে কিশোর থেকে বলিষ্ঠ যুবকে পরিণত হবে, তার জীবন দর্শন হয়ে উঠবে নারীর দেহ, সমুদ্রের অতল থেকে তাকে সেঁচে তুলে আনতে হবে সুখ, নারীর যোনির অতলস্পর্শী গভীরতায় নিহিত থাকবে তার অন্তর্দৃষ্টির নিগূঢ়তা। গতানুগতিকের চেয়ে ভিন্ন তার কবিতা। ৪২ দিনের জন্যে তিনি নিউ ইয়র্ক ভ্রমণে এসেছিলেন ১৯৭০ এর দশকে, জাপানে ফিরে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতার তাপে লেখেন একটি নোবেল: নভেলা “পুণ্য তীর্থের কাহিনী”। 

পূর্ব ইওরোপের অপরূপ সাহিত্যসম্ভার ইংরেজি ভাষার পাঠক-পাঠিকার কাছে তুলে আনছেন চার্লস সিমিক গত পাঁচ দশক জুড়ে, তাঁর প্রকৃত নাম দুসান সিমিক। তিনি অনুবাদ করেছে ইভান লালিচ, ভাস্কো পোপা, টমাস সালামুন, নোভিকা তাদিচ, গুন্টার গ্রাস ও আরও অনেকের কবিতা। তাঁর স্বরচিত কবিতার বইয়ের সংখ্যাও তিরিশ পেরিয়েছে। “স্তন” কবিতাটির জন্যে তিনি বিখ্যাত। 

মার্গারেট অ্যাটউড জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। নারীবাদী ও প্রতিবাদী লেখক তিনি। নারী-স্বাধীনতা বিহীন এক ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যৎ সমাজের দু:স্বপ্ন দ্যাখেন তিনি। বেশ কিছু ভালো কবিতাও লিখেছেন তিনি, কিন্তু সেই তুলনায় পাঠকের মনোযোগ পান নি।

ইমন গ্রেনান তাঁর রচিত প্রতিটি বাক্যকে কবিতা ও গদ্য হিসেবে শক্তিশালী করে তুলতে আগ্রহী। কবিতার লাইন হবে দাঁতের যন্ত্রণার মতো, তা থামবে না কোনোদিন, আর থামলেও তার রেশ থেকে যাবে, অথবা বার বার ফিরে আসার ভয়।

টয় ডেরাকোট কবিতা ও গদ্য লেখেন কঠিন অথচ সর্বজনীন বিষয় নিয়ে: রাজনীতি, হিংসা, জাতিবিদ্বেষ, মাতৃত্ব, অথবা লিঙ্গ-সমতা।

রবার্ট হাস ক্যালিফোর্নিয়ার কবি, প্রাবন্ধিক। আমেরিকার পশ্চিম উপকূল তার সমুদ্র, পর্বত, অরণ্য আর ভূমিকম্প সমেত তাঁর কবিতায় জীবন্ত; “A lyrical virtuoso who is able to turn even cooking recipes into poetry".

এই কবিদের সবার ভেতর একটি একটি বিষয়ে মিল: তাঁরা প্রেমের কবিতা লেখেন। আসুন এবার সেই কবিতাগুলি পড়ি:

ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট (চেকোস্লোভাকিয়া, ১৯০১-১৯৮৬)


নারী বিষয়ক সংগীত

নগরপ্রান্ত ছুঁয়ে নদীটি বয়ে যায়,
সাতটি সেতু তার গায়ে শোয়;
হাজার সুন্দরী হাঁটে নদীর তীরে 
কেউই কারো নয় সদৃশ।

হৃদয় থেকে তুমি হৃদয়ে যাও ছুটে 
প্রেমের আগুনে হাত সেঁকে নাও; 
হাজার সুন্দরী হাঁটে নদীর তীরে 
সকলেই সকলের সদৃশ।


দর্শন 

বিজ্ঞ দার্শনিকেরা বলেন 
জীবন এক মুহূর্তমাত্র।
কিন্তু বান্ধবীর জন্যে অপেক্ষা করতে গিয়ে 
মনে হয় অনন্তকাল।

[এখন আর দেশটির অস্তিত্ব নেই, কিন্তু কাউকে যদি চেকোস্লোভাকিয়ার জাতীয় কবির অভিধা দিতে হয়, তিনি হবেন ইয়ারোস্লাভ সাইফার্ট। ১৯৮৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার -- “For his poetry which endowed with freshness, sensuality and rich inventiveness, provides a liberating image of the indomitable spirit and versatility of man.” চেক ভাষা থেকে কবিতাদুটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ইওয়াল্ড ওসার্স এবং ডেনা লোয়েইর।]

মে সোয়েনসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯১৩-১৯৮৯)


প্রেম হ’ল 

হীরকখণ্ডের বর্ষণ 
হৃদয় নন্দনবনে 

আত্মার ফলটিকে 
কেটে দু টুকরো করা 

আলোকের ওষ্ঠ থেকে 
গাঢ় বসন্তের আগমন 

মাটির নিচের জল 
সূর্যের কিরণে নির্মিত ফাটল বেয়ে 

বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে
আনন্দে ঝিলমিল 

পাথর নয়, মেঘ দিয়ে 
বানানো মন্দির 

হৃদয়ের যত গর্জন ও 
সব হিংসার থেকে দূরে 

উন্মাদনাহীন শূন্যতার 
নেহাইতে পেটানো এলাকার বাইরে 

পরিবর্তনশীল শস্যদের ফাঁকে ফাঁকে 
নীল স্থায়িত্ব 

উত্তম জমিতে 
এক সংক্ষিপ্ত পদক্ষেপ 

রুটিতে দ্বিতীয়বার কামড় 

[মার্কিন সমকামী কবি, সাংবাদিক, সম্পাদক ও নাট্যকার। এগারোটি কাব্যগ্রন্থ। সতীর্থ কবি রিচার্ড উইলবার (১৯২১-২০১৭) এর মতে, “Her poems find the erotic in all form of natural energy, and whether they speak of nebulae or horses or human love, are full of a wonderfully straightforward and ebullient sexuality.” সুইডেনের কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমার এর কবিতার প্রথম ইংরেজি অনুবাদক। কবিতা লিখেছেন আটশো’র বেশি, প্রকাশিত হয়েছে তার অর্ধেক। তাঁর সব কবিতাই পৃথিবীকে লেখা প্রেমপত্র। জীবনকে ভালোবাসেন তিনি, তার কবিতা তাঁর কবিতা জীবনযাপনের তীব্র উৎসব। কবিতাটি ১৯৯১ সালে প্রকাশিত “মে সোয়েনসনের প্রেমের কবিতা” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।]

মুৎসুও তাকাহাশি: (জাপান, ১৯৩৭- )

মিনো

মিনো
বৃষ আমার
তোমার হাঁটু ছোঁয়ার আগেই
সই পাতিয়েছি তোমার সঙ্গে
তোমার শক্তপোক্ত পা পেয়ে উঠেছি 
আর তোমার বাঁকা চাঁদের মতো শিঙের 
ফাঁক দিয়ে দেখেছি দূরের সমুদ্র 
মাঠের পর মাঠ দাউদাউ হাওয়ায় 
একসঙ্গে দৌড়েছি আমরা 
শূন্যে গুঁতোয় তোমার শিঙ 
বাতাসে ওড়ে আমার দীর্ঘ কেশ 
রাতে ঘুমোই আমরা আলিঙ্গনে 
উদরে উদর, উরুতে উরু 
ভয়ঙ্কর সূর্যোদয় না হওয়া অব্দি 

[জাপানের এই প্রধান কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মেজাজে সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক। সমকামী যৌনকামনা তাঁর সাহিত্যের এক মুখ্য উপাদান। কথাসাহিত্যিক ইউকিও মিশিমা’র (১৯২৫-১৯৭০) ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সতীর্থ। পৃথিবীর নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর রচনা। চল্লিশটির বেশি কাব্যগ্রন্থ। কবিতাটি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত “মিনো, আমার বৃষ” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ হিরোয়াকো সাতো।]


চার্লস সিমিক: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৩৮- )

স্তন 

আমি স্তন ভালোবাসি,
টসটসে নিটোল স্তন,
একটি নির্জন বোতামের পাহারায়।

রাতের বেলা তারা আসে।
পৌরাণিক পশুকথামালা
তাদের দলে একশৃঙ্গ অশ্ব
বাইরেই থেকে যায় তারা।

সূর্যোদয়ের এক ঘন্টা আগের 
পুব আকাশের মতো মুক্তোখচিত,
পরশপাথর ছুঁইয়ে জ্বালানো 
গনগনে দুই উনুন 
তাদের দিকে মন দেওয়া উচিত।

তাদের বৃন্ত থেকে ঝরে 
অশ্রুত দীর্ঘশ্বাসের বিন্দু,
আমাদের লাল স্কুলবাড়ির মতন আননে 
সুস্বাদু স্বরবর্ণের স্বচ্ছতা আনে তারা।

অন্য কোনোখানে একাকিত্ব 
তার জাবদা খাতায় লেখে 
আর এক বিষণ্ণ নাম, দু:খ এসে 
দু মুঠো চাল ধার চায়।

কাছে এসে পড়ে: পশুর 
উপস্থিতি। খামার বাড়ির বালতিতে 
গরুর দুধ কাঁপে।

আমি নিচের থেকে উঠে এসে 
ছুঁতে চাই সেই কোমলতা, দুষ্টু ছেলে 
যেরকম চেয়ারে ভর দিয়ে 
তাকে থেকে চুরি করে খায় নিষিদ্ধ জ্যাম।
আলতো আমার ঠোঁটের ছোঁয়ায় 
আলগা হয় বোতাম।
আমার হাতে পিছলে আসে তারা 
সদ্য ঢালা দু মগ বিয়ার।

যে সব মূর্খের তত্ত্বজ্ঞানে স্তনের কথা নেই,
তাদের মুখে থুথু দিই আমি;
রাত জেগে তারা দেখে যায় লোকে 
অথচ ঘরে রয়েছে অপরূপ চাঁদ দুটি..…..

তাদের স্পর্শে আঙ্গুল পায় 
নিজ স্বরূপ, ভূমানন্দ:
তারা কুমারী সাবান, নিষ্পাপ ফেনায় 
হাত ধুয়ে নিই আমরা।

ডিমের কুসুমে ভেজানো পালকের মতন 
কুর্নিশ করে আমার জিভ,
নরম রুটির মতন তাদের চেটে 
সম্মান জানিয়ে।

আমি জোর গলায় বলি:
কাঁকাল অব্দি নগ্ন নারী 
পৃথিবীর প্রথম ও শেষ অলৌকিক ঘটনা।

যে বুড়ো দারোয়ানটা তার মৃত্যুশয্যায় 
দাবি করেছিল পত্নীর নগ্ন স্তন 
শেষবারের মতন 
পৃথিবীর সেরা কবিদের একজন সে।

হে মধুর হ্যাঁ, হে মধুর না 
দ্যাখো, সারা পৃথিবী নিদ্রামগন।

এখন, সময়ের অন্তহীন স্থিরতায় 
হে আমার প্রিয়, কোমর জড়িয়ে 
কাছে টেনে নিই তোমায়, আর 

প্রতিটি স্তনের বৃন্ত 
গাঢ়, ভারী আঙ্গুল হয়ে 
ঝরে যাক আমার 
নিদ্রালু ঠোঁটের মৌচাকে।

[সার্বিয়ান-মার্কিন কবি এবং সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপক। প্যারিস রিভিউ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯০ সালে কবিতায় পুলিৎসার পুরস্কার পেয়েছেন। তিরিশটি কবিতার বই, দশটি প্রবন্ধগ্রন্থ, পূর্ব ইউরোপের কবিতার অনুবাদের অনেকগুলি গ্রন্থ। “ঘন করে বানানো চিনে ধাঁধার বাক্স” তাঁর কবিতা।]

মার্গারেট অ্যাটউড: (কানাডা, ১৯৩৯- )

সহবাস 

বিবাহ মানে একটা 
গৃহ নয় এমনকী তাঁবুও নয়

আরও আদিমতর, এবং শীতলতর: 

বনের প্রান্তে কিংবা মরুভূমির 
প্রান্তে 
প্লাস্টার খশা সিঁড়িতে 
পিছনের উঠোনে, উবু হয়ে 
বসি আমরা, পপকর্ন চিবোই 

সরে সরে যাওয়া হিমবাহের প্রান্তে 

যেখানে বেদনা ও বিস্ময় নিয়ে 
বুঝতে পারি অবিশ্বাস্য হলেও 
বেঁচে রয়েছি আমরা 

তারপর চকমকি ঠুকে আগুন জ্বলতে শিখি 

[অনেকগুলি জনপ্রিয় উপন্যাসের পাশাপাশি দু-ডজন কবিতার বই রয়েছে এই কবির। যে কোনো বছর পেয়ে যেতে পারেন সাহিত্যের নোবেল পুরষ্কার। তাঁর ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত “সেবিকার কাহিনী” (“The handmaid’s Tale”) উপন্যাসে বর্ণিত গা-শিরশিরানো ভবিষ্যতের বিভীষিকা আংশিকভাবে হলেও সত্যি হতে চলেছে আমেরিকায়। উপন্যাসের সিকুয়েল “সুসমাচার” (“The Testament”) প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে। কবিতাটি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত “নির্বাচিত কবিতা ১৯৬৫-১৯৭৫” থেকে নেওয়া হয়েছে।]


ইমন গ্রেনান: (আয়ারল্যান্ড, ১৯৪১- )

বার্নার্ডের চিন্তাভাবনা 

তার শয়নকক্ষে থিকথিক করে একাকিত্ব ও যৌনতা: 
কার পা জড়িয়ে ধরে একজনের কাঁধ, কার
উত্তপ্ত হাত পেয়ে যায় একজনের উরু, বাহু
জড়িয়ে ধরে কার পিঠের মসৃন অরাল? সে বলে
আমরা ভুল বুঝি আর দমবন্ধ হয়ে আসে। ভালোবাসতে
পারি না, মিথ্যের ঝুলি খুলে বসি। চেরিগাছের
গোছা গোছা ফল লেগে আছে জানলার কাচে 
ভালো করে আকাশ দেখা যায় না। কামনা আমাদের
ক্ষইয়ে দেয়। এখানেই যাতনারসঙ্গে কামনার সুন্দর মিল
খেয়ে যায়: কার কফিনে আরেকটা পেরেক মারলো?
দাঁড়িয়ে দ্যাখো। নকশি কাঁথার গায়ের ফুলগুলো সমানে
হিসহাস-ফিসফাস করে যাচ্ছে আর যা জানে
সব বলে দিচ্ছে পর্দার গায়ের ফুলগুলোকে।

[কবির জন্ম আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে। সত্তর এর দশক থেকে বাস করছেন আমেরিকায়। নিউ ইয়র্ক রাজ্যের ভাসার কলেজে অধ্যাপনা করেছেন তিন দশক। অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থ; নিজেকে আয়ারল্যান্ডের কবি বলেন, মার্কিন কবি নয়। কবিতাটি “দি নিউ ইয়র্কার“ পত্রিকায় প্রকাশিত। ]


টয় ডেরাকোট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪১- )

ভগাঙ্কুর 

এবার আমার ভগাঙ্কুর তোমার মুখের মধ্যে নিলে,
আমি ভাববো না যে স্বাদটা তোমার পছন্দ হচ্ছে না।
পাণ্ডুর শাদা বেরির ওপর থেকে আমি পাটলরঙা গুন্ঠন
সরিয়ে নিই। একা চেয়ে থাকে সে হাজার হাজার শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে।
নারীর স্কার্টের ট্যাফেটার মতন আমি তার ত্বকের স্তরগুলোকে
আঙুল দিয়ে সরাই। খুব লাজুক আমার ভগাঙ্কুর, নবীন কিশোরীর মতন 
তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে সামিল করতে হয় কামোন্মাদনায়।


প্রৌঢ় বয়েসের রতিক্রিয়া 

আমরা কি এখন অ-
যৌন দম্পতি, একে 
অন্যকে ছুঁই আলতো মৃদু 
মা যেমন শিশুকে ছোঁয় 
তার চেয়েও মৃদু,
আমাদের একজোড়া শরীর 
প্রিয়, প্রিয়, প্রিয় আমাদের হাতে?
তুমি আমায় স্পর্শ করো যেন তুমি জানো 
কোথায় বাস করে আমার প্রতিটি দেহকোষ।
আমি থাকি এখানে ওখানে যেখানে তোমার হাতের 
নিবিড় ছোঁয়া যেমন শিশুর চুলের ভেতর 
মায়ের নি:শ্বাস। তোমার হাত সরে সরে যায় 
আমার কাঁধ থেকে পিঠ হয়ে আমার নিতম্বে,
আমি ভুলে যাই তার মাঝে কী ঘটে গেছে 
হারায় আমার শরীর তোমার দুহাতে,
আমার মন বলে, এইভাবে মৃত কোষগুলো 
পথ হারাচ্ছে কেন, অবহেলায় সরিয়ে দেয় 
ছোটো ছোটো গ্রহগুলিকে? আপাদমাথা নাঙ্গা তুমি 
স্থপতির ডেভিডের মতন, বোঝার ক্ষমতা নেই 
তোমার, হে 

আলোর স্তনবৃন্ত 
আমার জিভের প্রান্তে।

[পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপনা করেন এই আফ্রিকান-আমেরিকান কবি। সাতটি কবিতার বই। আমাদের নির্যাতিত ও বিভাজিত করে যে বিষয়গুলি: জাতি, গাত্রবর্ণ, লিঙ্গ, যৌন নির্বাচন অথবা সামাজিক স্তর -- এ সবের বিরুদ্ধে এক একলা নারীর প্রতিবাদ তাঁর কবিতায়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত “নতুন ও নির্বাচিত কবিতা” কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে তাঁর দুটি কবিতা;]


রবার্ট হাস: (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪১- )

চল্লিশ পেরিয়ে 

নারীটি আনমনে পুরুষটিকে বলে, “তুমি যদি কখনো
ছেড়ে যাও আমাকে, বিয়ে করো এক তরুণীকে আর বাচ্চা জন্মায় তোমাদের,
আমি ছুরি বসাবো তোমার হৃৎপিণ্ডে।” তারা তখন শয্যায়,
সে স্বামীর বুকে চড়ে বসে, সোজা তাকায় তার চোখে।
বলে, “বুঝতে পেরেছো কী? তোমার হৃৎপিণ্ডে।”


ফ্রিডা কাহলো: থুথুতে 

থুথুতে 
কাগজে 
ছায়ায় 
সব রেখায় 
সব রঙে 
সব মাটির ভাঁড়ে 
আমার স্তনে 
বাইরে ভেতরে 
দোয়াতে -- সৃষ্টির পরিশ্রমে 
আমার দুচোখে বিস্ময় -- সূর্যের 
সীমারেখায় (কোনো সীমানা নেই সূর্যের) আর 
সবকিছুতে। আর কথা বলা বাহুল্যমাত্র, রাজকীয় 
দিয়েগো আমার প্রস্রাবে -- দিয়েগো আমার মুখে -- আমার 
হৃদয়ে। আমার পাগলামিতে। আমার স্বপ্নে -- আমার 
ব্লটিং কাগজে -- আমার কলমের ডগায় --
আমার পেনসিলে -- প্রকৃতির শোভায় -- মুখের 
গ্রাসে -- কঠিন ধাতুতে -- কল্পনায় 
অসুস্থতায় -- কাচের আলমারিতে --
তার জামার কলারে -- তার চোখে -- দিয়েগো --
তার মুখে -- দিয়েগো -- তার সব মিথ্যাচারে।

টীকা: দিয়েগো রিভেরা (১৮৮৬-১৯৫৭) এবং ফ্রিডা কাহলো (১৯০৭-১৯৫৪) মেহিকোর ডাকসাইটে শিল্পীদম্পতি। দিয়েগোর ষ্টুডিও মেহিকো সিটির আসিয়েন্দা স্যান্ আনহেল এর নিকটে -- সেখানে ফ্রিডার হাতে লেখা একটি চিরকুটে এই কবিতাটি দেখে কবি সেটি কপি করেন এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

[ক্যালিফোর্নিয়ার কবি, তাঁর সারা জীবন কেটেছে সেখানে এবং ক্যালিফোর্নিয়া তাঁর কবিতায় জীবন্ত; বার্কলে শহরে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘকালীন অধ্যাপক। মহাকবি চেসোয়াভ মিউশের বন্ধু ও অনুবাদক। প্রতিবাদী ও পরিবেশবাদী সাহিত্যিক। দুটি কবিতাই ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত “অরণ্যের তলে সূর্য” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

মার্চ ২০২০ [ক্রমশ:]

0 comments: