0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in


রোদ্দুর


বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত নাম। বলতে দ্বিধা নেই, আমি এঁর সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। জানাজানি হওয়ার পরে আরো জানার কৌতূহলে ইউটিউবের শরণাপন্ন হলাম। তাঁর গাওয়া দু-একটা গান শুনেই চলে গেলাম তাঁর জীবনী এবং সাক্ষাৎকার বক্তব্য শুনতে। খানিক শোনার পরেই মনে হলো ‘আপনাকে তো কাল্‌টিভেট করতে হচ্ছে মশাই’ – এবং গত কয়েকদিন ধরে অবিরাম ‘কাল্‌টিভেট’ করে গেলাম। বিবিধ খোঁড়াখুড়ির পরে ইতিমধ্যে প্রকাশিত কিছু প্রথাগত মন্তব্য এবং আলোচনাকে অদ্ভূত বালখিল্য বলে মনে হতে লাগলো। সচেতন নাগরিক হিসেবে তাই কলম তুলে নিতেই হলো।

আলোচনায় প্রবেশ করার আগে একটি কথা সবিনয়ে বলে নিতে চাই – রোদ্দুর রায়ের গান ভালো না খারাপ, সেটা আদৌ গান কিনা – এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা মাথাব্যথা নেই – সে সবের জন্য সঙ্গীত বিশেষজ্ঞরা আছেন, তাঁরা বিচার করবেন। আমি শুধুমাত্র একজন দর্শনের ছাত্রী হিসেবে, প্রতিষ্ঠিত সন্তানের মা হিসেবে এবং সর্বোপরি একজন সচেতন সামাজিক নাগরিক হিসেবে এই দুর্ভাগ্যবান সমাজের ওপর রোদ্দুর রায়ের প্রভাব বিষয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই।

এ কথা বলতে আমার একটুও দ্বিধা নেই, বাঙালি প্রথা ভাঙাকে কোনোদিনই ভালো চোখে দ্যাখেনি। ‘ঘরে বাইরে’ সিনেমায় বিমলা এবং সন্দীপের চুম্বনদৃশ্য বাঙালিসমাজে কম ঝড় তোলেনি। এতদিন, মানে সিনেমাটা হওয়ার আগে অবধি ওদের প্রেম বাঙালি ‘প্লেটোনিক লাভ্‌’ বলে ধরে এসেছে – শুধু মনের আদানপ্রদান – শরীর থাকতেই পারে না। কিন্তু বই আর সিনেমা – দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন মাধ্যম। বই পড়ে যেটা জানছি, সেটাকেই যখন সিনেমায় ফুটিয়ে তুলতে হচ্ছে, তখন কিছু আলাদা দৃশ্যকল্পের দরকার আছে বৈকি। কিন্তু যুক্তির কথা কে শোনে? কাজেই ‘গোলি মারো শালেকো’। রবীন্দ্র অবমাননার দায় থেকে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ও রেহাই পাননি। সিনেমাটিতে জমিদারের দেশপ্রেম এবং দেশনেতার ভণ্ডামি যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তার জন্য সত্যজিৎ রায়কে খুব কমই প্রশংসা করা হয়েছে। কারণ, সে কৃতিত্ব তো রবীন্দ্রনাথের। এই আমাদের জাতীয় চরিত্র। যিনি ভালো তিনি আমাদের চোখে ভগবান। একটা মাত্র চুম্বন দৃশ্য দিয়ে আমরা গোটা সিনেমাটাকে বিচার করে ফেলি। কাজেই রোদ্দুর রায়ের গান গাওয়ার ভঙ্গি এবং আপত্তিকর কিছু শব্দ প্রয়োগের জন্য আমরা তাঁকে জেলে পাঠানোর আর্জি জানিয়ে ফেলি। অসুবিধাটা এইখানেই। আমাদের মতে, গবেষণা বা পরীক্ষানিরীক্ষা থাকবে কাগজের পাতায়, কিম্বা বন্ধ অডিটোরিয়মের সেমিনারে। তাকে বাস্তব প্রয়োগ করলেই – ঐ – ‘গেলো গেলো’ আর ‘গোলি মারো...’।

রোদ্দুর রায় সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তুলেছেন রবীন্দ্র রচনায় ‘আমি’ ‘তুমি’ ‘ব্রহ্ম’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, বাঙালি তা আজ অবধি কিস্যু বুঝতে পারে নি। ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুণী উঠল রাঙা হয়ে, আমি চোখ মেললুম আকাশে...’ – এখানে ‘আমি’ কি শুধু রবীন্দ্রনাথ? মোটেই নয়। এখানে ‘আমি’ আমি আপনি রোদ্দুর রায় সকলেই – যারা প্রত্যেকেই এই বিশ্বাত্মার অংশবিশেষ। তা যদি হয়, তাহলে ভাবপ্রকাশের ভিন্নতাকে মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়?

রবীন্দ্র দর্শনে ‘তুমি’ হলেন ব্রহ্ম। ভারতীয় দর্শনের ব্রহ্ম। যাকে ‘নিরাকার ব্রহ্ম’ বলা যাবে না, কারণ তাহলে অর্থ দাঁড়াবে যা ‘সাকার’ তা ব্রহ্ম নয়। ‘ব্রহ্ম অসীম’ এভাবেও ব্যাখ্যা করা যাবে না, কারণ তাহলে অর্থ দাঁড়াবে যা ‘সসীম’ তা ব্রহ্ম নয়। ভালো মন্দ, সৎ অসৎ কোনো শব্দ দিয়েই ‘ব্রহ্ম’কে বাঁধা চলবে না। ‘ব্রহ্ম’ শূন্য। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন – শব্দই ব্রহ্ম। তা যদি হয়, তাহলে শব্দ সম্পর্কে শ্লীল অশ্লীল ভেদাভেদ করা যায় কি? শব্দ চলমান। তাই নতুন নতুন শব্দ যে কোনো জীবন্ত ভাষায় প্রবেশ করবেই। আবার কালের প্রভাবে দুর্বলেরা বিদায়ও নেবে। এখন ভেদবুদ্ধি থাকলে এ দর্শন বোঝা খুব শক্ত। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস রাখতে হবে। যে ভেদবুদ্ধির জন্য উচ্চবিত্ত মানুষ একজন দলিতের গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে একজন মানুষকে তার ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করার জন্য অত্যাচার করে হত্যা করে – সমাজে সত্যিকার গণআলোড়ন তুলতে হবে এই সব ক্ষেত্রে। রোদ্দুর রায় কিভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবেন, সেটা তাঁর একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। আপনার ভালো লাগলে শুনবেন, না লাগলে শুনবেন না। কারও ভালো লাগলে তাকে শুনতে দিন। সমাজ উন্নতও হবে না, অবক্ষয়ও হবে না। বড়োজোর সমাজে একটা নতুন ধারা যোগ হবে মাত্র। বাঁচবে কিনা, কতদিন বাঁচবে – সে উত্তর দেবে সময়। শিল্পী হিসেবে আদৌ কোনো তুলনা না টেনেই বলছি - দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কম হৈচৈ হয়েছে? জীবনমুখি গানের ধারাও যখন এলো, চারদিকে গেলো গেলো রব ওঠেনি?

এবার একটু অন্য আঙ্গিকে বিষয়টাকে দেখা যাক। শব্দদূষণের দায়ে যাঁরা রোদ্দুরকে দায়ী করছেন, তাঁদের অভিযোগ কি একেবারেই ভিত্তিহীণ? মোটেই না, একেবারেই না। কিন্তু মুশকিল হলো একটাই – এই সার্বিক দূষণে তাঁদেরও যে ভূমিকা রয়েছে, সেটা তাঁরা স্বীকার করছেন না। রোদ্দুর রায় তো কোনো ভিন্‌ গ্রহের প্রাণী নয় – আমার আপনার সন্তান। সেই সন্তানদের কি আমরা দূষণমুক্ত ‘রোদ্দুর’ ঝলমল পৃথিবী দিতে পেরেছি? আমি আপনি তাদের সামনে কোন্‌ সমাজ, কোন্‌ রাজনীতি, কোন্‌ আদর্শ, কোন্‌ যাপননীতি উপহার দিয়েছি? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আদিখ্যেতা করেছি, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় রবীন্দ্রধারা প্রয়োগ করার কথা ভেবেছি কি? শিক্ষাকে অন্তরের মুক্তি হিসেবে না প্রয়োগ করে পিঠের বোঝা হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছি। আমাদের মেনে নিতে হবে, যে সময়কে আমরাই অস্থির করেছি, সেই অস্থির সমাজে সৃষ্ট শিল্পও তো অস্থিরই হবে। ভালো না লাগলে উদাসীন থাকুন, যেমন গোমূত্রে আছেন। আর সমালোচনা করলে আত্মসমালোচনাটা আগে করুন। খুব কৌশলে ছড়ানো অসহিষ্ণুতার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সামগ্রিক বিপর্যয় বাড়াবেন না।

কাউকে অপমান করতে গেলেও তাকে জানতে হয়। আজকের রোদ্দুররা রবীন্দ্রনাথকে জানছে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়েই। আমাদের সংস্কৃতির এখানেই জয়। আমাদের প্রজন্ম প্রেম নিবেদন করতে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় খুঁজেছে। আজকের প্রজন্ম, যাদের মধ্যে আমরা প্রেমই শেখাতে পারিনি, তারা ঘৃণা ঝরাতে রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হচ্ছে। হ্যাঁ, সেই রবীন্দ্রনাথেরই। হোক না। প্রেম আর ঘৃণায় তফাৎ কতটুকু? ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো, অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারে নি’। আজকের অমলকান্তিরা যদি রোদ্দুর হতে চায়, দিন না। আমরা তো ওদের অমলকান্তি করেও তুলতে পারিনি। ওদেরকে ওদের মতো বাঁচতে দিন।

পরিশেষে বলতে পারি, রোদ্দুর রায়ের মুখভঙ্গি হাসি লাফঝাঁপ আপত্তিকর শব্দ প্রয়োগ যে ভাবে স্বপ্নহীন পচা গলা এই সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কিম্বা বিক্ষোভ হয়ে ঝরে পড়ছে, তা এক দিক থেকে অত্যন্ত সদর্থক। রোদ্দুর রায়ের কোনো অনুগামী অন্তত কোনোদিন নির্ভয়াকাণ্ডের নায়ক বা রাজনৈতিক গুণ্ডা হবেন না – দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। শিল্পের মাধ্যমে যাঁরা নিজেদের ক্ষোভ অভিমান উদ্গীরন করতে পারেন – উচ্চ নিম্ন যে কোনো মানেরই হোক না কেন, তাঁরা আর যাই হোক সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারেন না। ব্যর্থতা ক্ষোভ উগরে দিতে যারা হাতে তুলে নেয় আগ্নেয়াস্ত্র অথবা বেছে নেয় নারী শরীর, তারাই বরং সমাজের পক্ষে ভয়ঙ্কর।

0 comments: