ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক
নিঠুর দরদী
(২)
রেঙ্গুনের জাহাজঘাটাটা দেখতে বেশ অন্যরকম। কলকাতার চেয়ে যেন আরো বেশী পাঁচমেশালী মানুষের ভীড়। বর্মী, মালয়ী আর চীনে তো আছেই, তার সাথে বিহারী, পাঞ্জাবী, এমনকি বাঙালিও বেশ গিজগিজ করছে। মূল বন্দরটা বঙ্গোপসাগরের মুখে বলে জলরাশিও বেশ ঊর্মিমূখর। নতুন ভূখন্ডটিকে প্রথম দর্শনে শরৎের খুব একটা মনে ধরলো না। দিনটা মেঘলা, থেকে থেকেই জোলো হাওয়ায় শীত লাগছে যেন। দিনসাতেক প্লেগের ভয়ে জাহাজের যাত্রীদের কোয়ারান্টাইনের জন্য গাদাগাদি করে একটা বড় ডর্মিটরীতে থাকতে হয়েছিল। আপার ক্লাসের যাত্রীনিবাসটি মন্দের ভালো হলেও সেকেন্ড আর থার্ডেরটি একদম অপরিচ্ছন্ন। মহামায়া আর অসুস্থ রোহিণীকে নিজের জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে কোনওমতে এক কোণেই কাটিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। মাসীর বাড়ি পৌঁছে ভাল করে স্নান করাটা ভীষণ জরুরি। বের হতেই কয়েকফোঁটা বৃষ্টিও যেন গায়ে এসে পড়ল। বাংলাদেশের শ্যামলিমার কিছুটা এদেশে থাকলেও, বর্মা মুলুকটি মূলত পর্বতপ্রধান। লোকজনের মুখে একটা মোঙ্গলীয় ছাপ স্পষ্ট। এদেশের মেয়েগুলি যেন পুতুলের মতো। তারা দুলে দুলে হাঁটে আর জংলাছাপের উজ্জ্বল রঙের একটি অদ্ভূত পোশাক পড়ে। পুরুষেরাও 'লুঙী' বলে সেই পোশাকেই অভ্যস্ত।
মেসোমশাই নিজেই এসেছিলেন। শরৎ এগিয়ে এসে প্রণাম করলেন। অঘোরনাথ প্রতিষ্ঠিত সরকারি উকিল। একইসঙ্গে বিত্তবান ও উদারমনস্ক মানুষ। কিছুটা ব্রাহ্মভাবাপন্ন হওয়ায় বাড়িতে পর্দাপ্রথা নেই। শরৎ সে বাড়িতে সাদরেই গৃহীত হল। অনেকদিন পর একটু সামাজিক উষ্ণতা জুটল শরৎের। মাসীর দুই মেয়েই শরৎদাদার ভক্ত হয়ে উঠল। তাদের গান শেখার আগ্রহে তাল মেলাতে সুকন্ঠ শরৎদাদাকেও চাই সবসময়। শরৎও মেতে উঠলেন বেশ কিছুদিনের জন্য। ওখানে দেখা পেলেন ইরাবতী নামের একটি কিশোরীর, তাঁর বোনেদেরই বয়সী সে, বড় বড় মায়াবী চোখদুটো মেলে শরৎের মুখের দিকে অপার বিস্ময় নিয়ে শুধু চেয়ে থাকে। এলোমেলো চুলের আত্মভোলা যুবকটি তার প্রাণচঞ্চল মনের মধ্যে কি এক গভীর বেদনাকে লুকিয়ে রেখেছে গোপন সিন্দুকে, তা সে এই বয়সেই সে বেশ বুঝতে পেরেছে। শরৎ নিজেও এই বালিকার মুগ্ধদৃষ্টিপাতটি সপ্রশ্রয়ে উপভোগ করেন।
এরই মধ্যে এল স্বস্তির বাতাস। রেলের অডিট অফিসে ক্লার্কের একটি চাকরী জুটল মেসোমশায়ের বদান্যতায়। সঙ্গে বর্মীভাষা শিক্ষা আর আইনজীবী হওয়ার প্রস্তুতি সমান্তরাল ভাবে চলতে লাগল।
ছাদের ঘরটিতে শরৎ থাকেন। তারাভরা রাতের আকাশের নীচে শরৎ উন্মনা হয়ে চেয়ে থাকেন প্রতিদিন। পল্লীবাংলাকে অন্তরে বয়ে বেড়ান সর্বদাই। সেখানে ফেলে আসা ছিন্ন জীবনের অনেকগুলো নারীর মুখ পরপর তাঁর মানসপটে ভেসে ওঠে। শরৎ অস্বীকার করতে পারেন না এই সব মানুষগুলোকে, যারা নিরন্তর জীবনের কষ্ঠিপাথরে প্রতিটি ঘাত প্রতিঘাতের ফলেই নিকষিত হেমের মতোই উজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর হৃদিপটে। সমাজ হয়তো তাদের কারুকে ব্রাত্য করেছে ঠিকই, কিন্তু সেইসব অভাগীদের বুক ভরা ভালোবাসা ও অন্তরস্পর্শী উষ্ণতা শরৎকে যে অন্য এক মহান জীবনের স্বাদের ভাগ দিয়েছে অকৃপণ হাতেই, সেটা তো ভোলার নয়। সেইসব জীবনগুলো তাঁর চারপাশে এসে দাঁড়ায় একটু নিভৃতে। তাদের থেমে যাওয়া কন্ঠস্বর তিনি শুনতে পান যেন। বুকের ভিতরে জমিয়ে রাখা নুড়িপাথরগুলো শব্দ করে ওঠে তখন।
আজ খুব মনে পড়ছে গ্রাম সম্পর্কিত এক অভাগী দিদির কথা। একজন কুলীন বিধবা, নিরুদিদি বলেই তাকে শরৎ ডাকতেন। সবার কাছেই একদা সে ছিল আপনার জন। ঠাকুরঘরের শালগ্রাম শিলাকেই সে দিয়েছিল তার বাকি জীবনের ভার বইতে। শরৎ আর তার নিরুদিদি কত দুপুর সন্ধে এক করে দাওয়ায় বসে গল্প করেছে। কুমড়োফুলের বড়াভাজা ভালবাসেন শরৎ, তাই জন্য নিরুদিদি মাচা বেঁধে কুমড়োলতা লাগিয়েছিল। ভালই কাটছিল সেই সব দিনগুলো। কিন্তু বিধাতাপুরুষ বিরূপ তাঁর প্রতি। আজন্মকাল শরৎ যখন যেটাকে আঁকড়ে ধরে একটু বাঁচতে গেছেন, তখনই তীব্র বিয়োগব্যথায় পেতে হয়েছে গরলের জ্বলন।
গ্রামের পোস্টমাস্টার বাবুটির সাথে কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে নিরুদিদি নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছিল। অজান্তে সেই মিলন আনে অবৈধ সন্তানের সম্ভাবনা। জানাজানি হওয়ার পরে সমাজ তাকেই একঘরে করে দেয় অতি সহজে। শরৎ কিন্তু পারেননি সেদিন সেই নিদানকে মানতে। লোকচক্ষু এড়িয়ে তিনি প্রতিদিন তাঁর দিদিটির কাছে দিনান্তে একমুঠো চাল আর ফলমূল, যখন যা যোগাড় করতে পারতেন হাতে করে নিয়ে এসে দাঁড়াতেন তার সামনে। কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসার অশ্রুতে দুই অসমবয়সী নারী পুরুষ ভেসে যেত এক অজানিত হৃদয়ের টানেই। রাত বাড়লে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে তারপর শরৎ ঘরে ফিরতেন। একদিকে তীব্রতম ভালোবাসার বোধ আর অন্যদিকে সমাজপতিদের রক্তচক্ষু আর লোকনিন্দার মধ্যে তিনি ছুটে যেতেন প্রথমটির টানেই। যে কটা দিন সে অভাগী বেঁচেছিল, শরৎ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও মানুষের মুখ তার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সাতদিনের অজানা জ্বরে বিধাতা তাকে ভবযন্ত্রণা থেকে একদিন মুক্তি দেন। তার শেষকৃত্য করার জন্যও কেউ এগিয়ে আসেনি সেদিন। ঝোপেঝাড়ের মধ্যে ডোম এসে ফেলে গিয়েছিল সেই নারীর ঐহিক অবশেষ। শেয়াল, শকুন আর কুকুরের ভোজ্যে পরিণত হয়েছিল শরৎের মানসপ্রতিমা। শরৎ নিজে একেবারে ভেঙে পড়েন সে সময়। সদ্য যৌবনে এইসব আঘাত তাঁকে যত না বিদীর্ণ করত, তার চেয়ে অনেক বেশী অক্ষমের ক্রোধে জ্বলতেন জগদ্দল পাথরের মতো সমাজটাতে বাস করতে গিয়ে। একটি কুকুরছানাও পুষেছিল নিরুপমা। তার অকাল মৃত্যুতে সে বেচারাও অনাথ হয়ে পড়েছিল। এই ঘটনার অনেক অনেক বছর পরে জীবনের উপান্তে এসে শরৎ একদিন সেই তুচ্ছতম ঘটনাটিও লিখতে পারবেন তাঁর সেই দরদী কলমে -
‘‘ফুলকাটা রাঙাপাড়ের সেলাই করা বগলশ এখনো তার গলায়। নিঃসন্তান রমণীর একান্ত স্নেহের ধন কুকুরটা একাকী এই পরিত্যক্ত কুটিরের মধ্যে কী খাইয়া সে আজও বাঁচিয়া আছে ভাবিয়া পাইলাম না। পাড়ায় ঢুকিয়া কুড়িয়া খাওয়ার ইহার জোরও নাই, অভ্যাসও নাই – অনশনে অর্ধাশনে এ বেচারা বোধহয় তাহারই পথ চাহিয়া আছে যে তাহাকে একদিন ভালবাসিত। হয়ত ভাবে, কোথাও না কোথাও গিয়াছে, একদিন ফিরিয়া আসিবেই। মনে মনে বলিলাম, এ-ই কি এমনি? এ-প্রত্যাশা নিঃশেষে মুছিয়া ফেলা সংসারে এতই কি সহজ?’’
আজ বর্মায় নক্ষত্রখচিত কালো আকাশের নীচে সেইসব স্মৃতি ক্রমশ উন্মোচিত হলে শরৎ হু হু করে ধেয়ে আসা কান্নাকে অবরুদ্ধ করেন। সঙ্গে নতুন করে জীবনকে আলিঙ্গন করতে জন্মায় তীব্র অনিচ্ছা। ইদানীং টের পান ইরাবতীর চোখের ছায়ায় সেই স্বাদু আকাঙ্খিত জীবন হাতছানি দিয়ে তাঁকে প্রলুব্ধ করছে নিয়ত। তবুও তিনি ভয় পান, প্রতিবারের আঘাত তাঁকে ক্রমশ বীতস্পৃহ করে তুলছে জীবনের প্রতি।
কিছু অল্পদিনের মধ্যেই শরৎের সুখের জীবনে আবার যবনিকা নেমে এল। মেসোমশায় হঠাৎ চলে গেলেন। সাথে সাথেই জুটলো কিছু শুভাকাঙ্খী আত্মীয়স্বজন, যারা শরৎের এ বাড়িতে থাকা নিয়ে মাসীকে নানা রকম বিরূপ কুৎসা শোনাতে থাকে। অপ্রীতিকর বাতাস আরো ভারী হয়ে উঠতে উঠতেই শরৎ একদিন মাসীর আশ্রয় ছেড়ে চলে এলেন। বিশ্বপথের পথিক তিনি, আজীবনই ভবঘুরে। চারদেওয়ালের সংসারী প্রকোষ্ঠে তাঁকে আটকানো যায় কি?
বেশ কিছু নতুন বন্ধু জুটেছে তাসের আড্ডায়। সামান্য মদ্যপানের অভ্যাসটিও ধীরেধীরে রপ্ত হয়ে আসছে। সময় পেলেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ান। ইতঃস্ততঃ ছড়ানো বৌদ্ধমঠগুলো, মৌলমিন, ইয়াগন, পিউন উন লিন্ এসব পার্বত্য প্রান্তরের উন্মুক্ত প্রকৃতি তাঁকে মুক্তির রসদ জোগায় আর সহজ সরল বর্মীদের সঙ্গ দেয় ভাবনার রসদ। নেপ্পীর (একপ্রকার শুঁটকি মাছ যাকে 'ঙাপি' বলে) সাথে দেশীয় আরক 'টডি' পানেও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। এখন সারাদিনে দুবাক্স বর্মীচুরুট তাঁর বরাদ্দ। রেলের অডিট অফিসের চাকরিটিও এর মধ্যে শরৎকে তার দায়মুক্ত করে। ফলতঃ কিছুদিন চলল আর্থিক টানাপোড়েন।
আড্ডার আসরে একজন নতুন বন্ধু হয়েছে তাঁর। নাম মণীন্দ্রনাথ মিত্র। প্রায় সমবয়সী বন্ধুটি পি ডাব্লু ডির ইঞ্জিনিয়ার। সঙ্গে একটু আধটু সাহিত্যচর্চারও বাতিক আছে তার। শরতের সাথে বন্ধুত্ব জমে উঠতে বিলম্ব হয়না। দেশে থাকতে মাতুল সুরেন্দ্রনাথের কাছে নিজের কিছু টুকরো লেখা রেখে এসেছেন। বন্ধুর উৎসাহে আবার অবসরে পুরনো লেখাগুলো নিয়ে ভাবতে বসেন।
মণীন্দ্রর যোগাযোগে ওই অফিসেই একটা নতুন চাকরি পেলেন অবশেষে। দৈনিক অফিসের পর বাসায় ফিরে লেখালিখির সাথে ইংরেজি আর ফরাসী সাহিত্যের অনূদিত বইগুলোতেই আজকাল ডুবে থাকেন। বুঝতে পারেন, ভিতরে জমে থাকা অবরুদ্ধ অনুভূতিগুলো এবার প্রকাশের পথ খুঁজে নিচ্ছে খুব দ্রুতই। সামনে বয়ে চলা ইরাবতী নদীটিকে দেখলে ওই ইরাবতী নামের বালিকাটিকে আজকাল খুব মনে পড়ে। যেদিন মাসীর আশ্রয় ছেড়ে চলে আসছিলেন, বারান্দায় দুচোখে মুক্তোদানার মত অশ্রু নিয়ে সে তাঁর যাত্রাপথটিকে অপরিশোধযোগ্য ঋণভারে সৌভাগ্যমন্ডিত করেছিল। সব কথা বলে দেওয়ার নয়, আর বোধহয় বলাও হয়ে ওঠেনা জীবনভর। চাঁদনী রাতে মণীন্দ্রের সাথে সাম্পানে চড়ে বেড়াতে বেড়াতে জ্যোৎস্নার মলমলে আলোয় বেশ নেশা জমে ওঠে। গায়ের কাপড় খুলে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে নেমে যান ইরাবতীর জলে। নদীবক্ষে কিছুক্ষণ সাঁতার শরৎকে বাংলাদেশ ছেড়ে থাকার দুঃখটিকে ভুলিয়ে দেয় অচিরেই।
0 comments: