ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
সোয়ানার রহস্যময় মানুষ
১৬
ফ্রান্সেস্কো বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলো যে ঐ কন্যার মস্তক যেন এক শিশুর মস্তক, অর্থাৎ আত্মার যেমন বিচ্ছুরণ সেই মস্তকে প্রকট, তা শিশু ছাড়া কিছুই নয়। হাল্কা মেটে বাদামী রঙের চুল বিনুনি করে মাথার চারপাশে মুকুটের মত জড়ানো। ঈষৎ আনত, ভারি দীঘল আঁখিপল্লবের কারণে তার চোখের চাহনি কেমন ভেজা ভেজা মায়াময় হয়ে উঠছে।
কিন্তু মস্তকের এই সুর নিচের দিকে নেমে বদলে যাচ্ছে। গজদন্তবর্ণ গ্রীবার পরে যে স্কন্ধ, সেই স্কন্ধের থেকে শুরু হয়েছে নারীশরীরের পূর্ণতা পাবার আর্তির প্রকাশ। যৌবনের উচ্ছলতাপ্রাপ্ত এমন শরীরের সঙ্গে এই শিশুসুলভ মস্তক যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নগ্ন পদযুগল, রোদ্দুরে পুড়ে তামাটে হয়ে যাওয়া শক্তিশালী পায়ের গোছ- সবকিছুই এক পরিণত যুবতীর। দেবী আইসিসের মত অদ্ভুত লাবণ্যময় এবং রমণীয় শরীরের রহস্য হয়তো বা অবচেতনে এই কন্যার মস্তকে এক নিষিদ্ধ গোপনীয় অভিশাপের মতনিহিত আছে; এবং হয়তো বা সেই কারণেই ফ্রান্সেস্কোর মাথা থেকে কিছুতেই নিষ্ক্রান্ত হতে চাইছিলো না এই কন্যার মুখচ্ছবি।
কিন্তু ঈশ্বরের এই অদ্ভুত সৃষ্টি যা পাপের ফলে উদ্ভূত, তাকে দেখে, ফ্রান্সেস্কোর মনের মধ্যে কী ভাবনা চলছে, সে বাইরে কিছু প্রকাশ করলো না; কেবল তার ঠোঁটদুটো একটু বেঁকে উঠলো, ‘তোমার নাম আসলে কী?’ একটা আপাতনির্দোষ প্রশ্ন করলো সে। মেষপালিকা জানালো তার নাম আগাথা। তার মধুর কণ্ঠস্বরে ফ্রান্সেস্কোর মনে হল যেন স্বর্গের পারাবত মৃদু হেসে উঠলো। ‘তুমি কি লিখতে পড়তে পারো?’ প্রশ্ন করলো সে। নেতিবাচক উত্তর এলো। আবার প্রশ্ন করলো ফ্রান্সেস্কো ‘তুমি কি পবিত্র ত্যাগের অর্থ সম্পর্কে কিছু জানো?’ কন্যা নীরবে চেয়ে রইলো তার দিকে।
ফ্রান্সেস্কো তাকে ঐ অপরিসর উপাসনাগৃহের মধ্যে প্রবেশ করতে বললো। সে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। গায়ক ছেলেটি তাকে পৌরোহিত্যের জন্য নির্দিষ্ট যাজকের আলখাল্লা পরতে সাহায্য করলো। মাথায় যাজকের উষ্ণীষ পরে নিলো সে; প্রস্তুত হতে লাগলো নির্দিষ্ট অধ্যাদেশের জন্য। পৌরোহিত্য যে কতখানি কঠিন কর্তব্য, সে অনুধাবন করতে পারছিল। অতীতে কখনো এমন অদ্ভুত ভাসিয়ে নেওয়া অনুভবের দ্বারা সে আলোড়িত হয়নি।
তার মনে হল যে পরম করুণাময় ঈশ্বর যেন তারই একান্ত ভৃত্য হিসেবে তার নাম ধরে ডাকলেন। এতদিন সে যেভাবে বিভিন্ন অধ্যাদেশের পৌরোহিত্য করে এসেছে, তা ছিল কেজো, সারবত্তাহীন, আচারসর্বস্ব- যার সঙ্গে ঐশ্বরিক অনুভবের কোনো সম্পর্ক ছিলনা। কিন্তু বর্তমানে যেন এক প্রকৃত আধ্যাত্মিক এবং পবিত্র সময় শুরু হয়েছে তার জীবনে। ঈশ্বরের প্রেম যেন স্বর্গীয় এক আগুনের বর্ষণ, যে বর্ষণধারার মাঝে সে এখন দাঁড়িয়ে আছে, এবং এর মধ্য দিয়ে তার অন্তরের প্রীতিও যেন সহসা মুক্তি পেয়েছে এবং প্রদীপের শিখার মত জ্বলে উঠেছে। অসীম প্রেমে তার হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে; সমগ্র সৃষ্টির সঙ্গে, সমস্ত প্রাণীর হৃদস্পন্দনের সঙ্গে একই ছন্দে যেন স্পন্দিত হচ্ছে তার হৃদয়। জগতের সমগ্র প্রাণীর প্রতি তার সংবেদনশীলতা তাকে বশীকরণের বিষাক্ত প্রভাব থেকে মুক্ত করেছে। সেই অদ্ভুত সময়ে, যখন সে নিজেকে পরাজিত অনুভব করেছিল শয়তানের প্রভাবে, তখন সে যেন একেবারে প্রস্তরীভূত হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের করুণায় সে দ্বিগুণ উদ্যমে বেরিয়ে এসেছে সেই অবস্থা থেকে এবং এখনই যেন সে পবিত্র চার্চ এবং মেরিমাতার মহিমার প্রকৃত সারসত্য বুঝতে পারছে। এখন সে সম্পূর্ণ নিবেদিত প্রাণে নতুন আশায় ঈশ্বরের একান্ত ভৃত্য হিসেবে জীবন কাটাতে চায়।
ঐশ্বরিক চেতনার অর্থ সে এই পথে, এই পর্বতশিখরের পথে এসে জেনেছে বলেই পবিত্র ত্যাগের প্রশ্ন সে আগাথাকে করেছিল। মেষপালিকার নৈঃশব্দের পরে সে নিজেও নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। নৈঃশব্দের মধ্য দিয়ে নিজের অজ্ঞাতেই আধ্যাত্মিক সত্য সে অনুভব করছে এবং সেই সত্যকে প্রকাশ করেছে মেষপালিকার সামনে।প্রকৃতি মা সবরকম পরিবর্তনের শাশ্বত মূর্ত প্রতীক; যদি সে এই পতিত এবং দুঃস্থ মানুষগুলির প্রতি আকৃষ্ট না হত, তার নিজেরও এই অদ্ভুত পরিবর্তন সাধিত হতনা। তরুণ যাজক উঠে দাঁড়ালো, তুলে ধরলো ঈশ্বরের পানপাত্র; তার চোখ উপচে গেলো আনন্দাশ্রুতে। তার মনে হতে লাগলো স্বয়ং ঈশ্বর আপন শরীরের মধ্যে প্রকট হয়েছেন। পৌরোহিত্য করবার এই পবিত্র কাজের মধ্যে, এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে, এক অদৃশ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সে যেন স্বর্গসুখ অনুভব করতে লাগলো, প্রচণ্ড শক্তি, অদ্ভুত আনন্দ, সবকিছুর মধ্য দিয়ে সে যেন এই চার্চ, সেগুলোর আচার বিচার সমস্তকিছুর অকিঞ্চিৎকর সীমানা ছাড়িয়ে এক তূরীয় অবস্থায় পৌঁছালো। পাঠক, আপনি যদি তাকে একবার দেখতে পেতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন যে সে বাহ্যজ্ঞানরহিত অবস্থায় ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন রয়েছে। সেন্ট পিটার দিবসের উপাসনাতে প্রধান পোপ স্বয়ং এমন সমাধিস্থ অবস্থায় উন্নীত হতে পারেন কিনা সন্দেহ! সে ঈশ্বরের নবজীবনপ্রাপ্ত শাশ্বত শরীরের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরলো পবিত্র মিলনোৎসবের পানপাত্র, যা উজ্জ্বল দ্বিতীয় সূর্যের মত ঝকমক করে উঠলো। দু’তিন মুহূর্তের জন্য হলেও পবিত্র বাতিদান তুলে ধরে সে যখন দাঁড়িয়েছিল, তার মনে হচ্ছিল সে যেন অনন্তকাল ধরে রয়েছে এক ঘোরের মধ্যে; তার মনে হচ্ছিল যেন সুগারলোফ পর্বতের পাদদেশ থেকে শুরু করে সেন্ট আগাথার শিখর অবধি যেন দেবদূতেরা ঘিরে রয়েছেন, সন্ত এবং ভক্তেরা সবাই আছেন সেখানে। তার খুবই ভালো লাগছিল, যখন সে দেখতে পেলো সেই ঘোরের মধ্যে যে এক অদ্ভুত গুনগুন গানের সুরের সঙ্গে সুবেশা কত সুন্দরী, ফুলের মালা দিয়ে তারা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গোল হয়ে নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই উপাসনাগৃহের মধ্যে। তাদের পিছন পিছনে যেন আসছে সেই সারকোফাগাসের অদ্ভুত শোভাযাত্রা, নেচে নেচে লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে ছাগলের মত ক্ষুরওয়ালা পা নিয়ে রোমান দেবতা, স্যাটিয়ার, কেউ আবার কাঠের টুকরোয় উর্বরতার প্রতীক হিসেবে আঁকা প্রায়াপ্স*চিহ্ন নিয়ে আসছে সেই শোভাযাত্রায়; ঠিক ওইরকম কাঠের টুকরো লুসিনো স্কারাবোটার কাছে ছিল।
সোয়ানাতে ফিরে ফ্রান্সেস্কো সেই ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো, কিন্তু গুম হয়ে গিয়েছিল নিজের মধ্যে। মনে হচ্ছিল যেন বিষাক্ত পানপাত্র থেকে শেষ নেশার বিন্দুটুকু সে পান করে নিয়েছে। সেদিনের উপাসনার পরে স্কারাবোটা পরিবারের সবাই তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং তার হস্তচুম্বন করে বিদায় নিয়েছিলো।
ধীরে ধীরে ফ্রান্সেস্কো যত বেরিয়ে এসেছিলো ঘোর থেকে, ততই সন্দেহ দৃঢ় হয়ে উঠছিল তার। সেন্ট আগাথার শিখরে যেরকম ঘোরের মধ্যে সে ঈশ্বরের উপাসনা করেছিল, তা কিছুতেই স্বাভাবিক নয়, সেটা সে বুঝতে পারছিলো। বহুকাল আগে ঐ জায়গাটা পাগানদের উপাসনাস্থল ছিলো। তাদের সরিয়ে খ্রিস্টান চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্ভবত সেই কারণেই সেই জায়গায় একটা অদ্ভুত শক্তি কাজ করছে, যা আবার যীশুকে সরিয়ে দিতে চাইছে। প্রকৃতির সেই অমিতশক্তির সঙ্গে হয়তো বা শয়তানের বিষাক্ত প্রভাবও হাত মিলিয়েছে। তারাই হয়তো নানাভাবে বশীভূত করতে চাইছে তাকে; নাহলে এরকম অদ্ভুত বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় উপাসনা সে কেনই বা করছিল?
সোয়ানায় চার্চে নিজের ঘরে বসে বারবার সেই কথাই ভেবে যাচ্ছিল তরুণ যাজক; অনুতাপের দহনে দগ্ধ হচ্ছিল সে প্রতিনিয়ত। তার ভীতি এমন মাত্রায় পৌঁছালো যে মধ্যাহ্নভোজনের আগে উপাসনাগৃহে ঢুকে এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল অবধি সাষ্টাঙ্গপ্রণিপাত করে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। প্রার্থনা এবং উপাসনার মধ্য দিয়ে নিজের শুদ্ধিকরণ করতে চাইছিল সে ।
ভীষণ অসহায় অনুভব করছিল সে, ঈশ্বরের কাছে ক্রমাগত প্রার্থনা করছিল যাতে শয়তানের প্রভাব থেকে তাকে রক্ষা করেন ভগবান। সে ঈশ্বরের কাছে স্বীকারোক্তি করছিল, ভয়ানক অনুতাপের মধ্য দিয়ে বুঝতে পারছিল সে যে কীভাবে নানা দিক থেকে শয়তান তাকে আক্রমণ করছে। অতীতে যত তাড়াতাড়ি সে বেরিয়ে এসেছিলো তার কুপ্রভাব থেকে, এখন সেভাবে পারছেনা। তাহলে কি সেরে উঠবার সীমা ভয়ঙ্করভাবে পেরিয়ে গেছে সে?
‘আমি যত্নে গড়া এক উদ্যান ছিলাম কেবল আপনারই সেবায় নিবেদিত!’ ...ঈশ্বরকে বলতে লাগলো ফ্রান্সেস্কো... ‘এখন এক মহাপ্রলয়ে যেন সবকিছু ছারখার হয়ে গেছে। হয়তো আবার গ্রহতারার প্রভাবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু আমি যে অন্তহীন বন্যায় এক ক্ষুদ্র ডিঙ্গি নৌকার মত দিশাহীন ভেসে চলেছি। অতীতে আমি আমার নির্দিষ্ট পথের ঠিকানা জানতাম। পবিত্র চার্চের দেখানো পথে আপনার ভৃত্য হিসেবে সেবা করেছি এতদিন। কিন্তু এখন? হায়, এ পথের শেষ লক্ষ্য কী, আমি তা জানিনা!’
-‘প্রভু, ফিরিয়ে দিন আমায়!’... কাকুতিমিনতি করতে থাকে ফ্রান্সেস্কো... ‘ফিরিয়ে দিন আমার অতীতের অধ্যবসায়, আমার আধ্যাত্মিক দৃঢ়তা, যাতে শয়তানের দূতগুলো কিছুতেই আমার অসহায় করে দিয়ে আক্রমণ করতে না পারে। আলো দেখান প্রভু! না, কোনো প্রলোভন নয়। আমি সেই পাপীতাপীদের কাছে আপনার কৃপাকণা বয়ে নিয়ে যাবার জন্যই পাহাড় ডিঙ্গিয়ে গিয়েছি; আবার পবিত্র কর্মের এবং কর্তব্যের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আমি পূর্বের আমাকে ফিরে পেতে চাই।’
(চলবে)
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা
*প্রায়াপ্স –লিঙ্গচিহ্নিত প্রতীক; ‘প্রায়াপ্স’কে উর্বরতার দেবতাজ্ঞানে পূজা করতো পাগান উপাসকরা। খ্রিস্টধর্মের উত্থানের আগে ইউরোপেও লিঙ্গপূজার চল ছিল।
0 comments: