0

ধারাবাহিক - সায়ন্তন ঠাকুর

Posted in
বনবাংলোর লেখা - ৭

সামনে অনুচ্চ মালভূমি কণ্ঠহারের মতো জড়িয়ে ধরেছে আকাশকে। মালভূমির মাথায় আজ মেঘ জমেছে, যেন উনানের ধোঁয়া, ভেসে ভেসে তারা নীচের দিকে নেমে আসছে,কখনও আবার পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছে মহাশূন্যে। বড় রাস্তা ছেড়ে ডানহাতে একখান মেঠো পথে চলে এসেছে অমিতাভ। সামনে পথশরীরে চার পাঁচটি নয়নহরা বাঁক, লালরঙা ধুলো, দুধারে হলদে নীল অজস্র পুটুস ঝোপের রেলিঙ, তারপর যতদূর চোখ যায় মাঠ মাঠ আর মাঠ। চাষারা আশ্বিনের ধান বুনেছে সেখানে, মাঝে মাঝে সার সার তাল খেজুর গাছ। কার্ত্তিকের গোড়ায় খেজুর গাছ কামিয়ে রেখেছে শিউলিরা, আকাশে মেঘ সরে গেলেই নতুন হাঁড়ি বাঁধবে তারা, টুপটুপ করে গাছ থেকে খসে পড়বে মিষ্টি দেহরস। 

আজই সকালে এখানে এসেছে অমিতাভ, তেমন কিছুই নাই চারপাশে, শাল খয়ের মহুয়া গাছের জঙ্গল আর ওই মালভূমি, ছোট ছোট গ্রাম। বড় রাস্তাটি সোজা চলে গেছে অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে, তার আগে পড়ে মাঠাবুরু ফরেস্ট রেঞ্জ, একখানি ছিমছাম বাংলোও আছে। ওখানেই উঠেছে অমিতাভ, বাংলোটি আসলে গাছবাড়ি, শাল গাছের খুঁটির ওপর গোল বারান্দা ঘেরা দুটি ঘর,মাথায় টিনের চাল, বারান্দা থেকে নিচের দিকে নেমে গেছে প্যাঁচানো কাঠের সিঁড়ি। বাংলোর হাতা পার হলেই বড় রাস্তা, রাস্তার ওদিকে ঘন জঙ্গল। মাঝেই মাঝেই সন্ধের দিকে হাতির পাল চলে আসে। অন্যদিন এমন কার্ত্তিক মাসে নরম আলোয় সবুজ পান্নার মতো ঝলমল করে অরণ্যচরাচর, আজ দুদিন হল খুব মেঘ, ঝিরিঝিরি জল পড়েই চলেছে, সঙ্গে ক্ষ্যাপা বাতাস। রাঢ়দেশ কোন অদৃশ্য যাদুবলে যেন পাহাড়ি গ্রাম হয়ে গেছে! এখানকার এমন রূপ আগে কখনও দ্যাখেনি অমিতাভ। 

প্রায় কুড়ি একুশ বছর আগে এদিকে এসেছিল, তখন কলেজের শেষ বছর, দুশো টাকা ছিল পকেটে, তাই নিয়েই ধর্মতলা থেকে রাতের বাস ধরে পুরুলিয়া! এত লোকজন দোকানপাট তখন কিছুই ছিল না, নির্জন বাসগুমটি একখান, একটা ভিড় ঠাসা বাস বাঘমুণ্ডির দিকে যাচ্ছিল, ওতেই চড়ে বসে! কোথায় যাবে,থাকবে সেসব ভাবনা মাথায় ছিল না, ওবয়স তো পরিকল্পনা করার বয়স না, চোখে লেগে থাকে মায়াকাজল, বৈরাগীর মতো স্রোতে ভেসে চললেই আনন্দগৃহের উঠান দ্বার খুলে যায়। ওসব দিন মনে পড়লে হাসিই পায় এখন অমিতাভর, ছেলেমানুষের মতো আশা ছিল, একদিন অল্ডুভাই গর্জ পার হয়ে মাসাইদের গ্রামে যাবে! দুপাশে সেই অতিশ্রুত সাভানা তৃণভূমি, অন্ধকার আদিম রাত্রির দেশ আফ্রিকা! 

যুবতি শরীরের বাঁকের মতো পথ ধরে এগিয়ে চলেছে অমিতাভ। গুঁড়ো গুঁড়ো জল ভাসছে বাতাসে, এমন রাস্তায় অনেককাল ধরে শুধু হাঁটতেই ভালো লাগে তার, দূর থেকে দ্রিম দ্রিম মাদলের শব্দ শোনা যাচ্ছে, কারোর ঘরে বিয়া আছে মনে হয়। গোরুর পাল নিয়ে বিবর্ণ পুরাতন ছাতা মাথায় একটা লোক আসছে সামনে, কালো শরীর, খেটো ময়লা ধুতি, পালের সামনের গোরুর গলায় ঘণ্টি বাঁধা, টুংটুং বাজছে। ফড়িঙের পাল উড়ছে দলবেঁধে, দুটো তিনটে ল্যাজঝোলা ফিঙে একবার পুটুস ঝোপের মাথায় একবার বড় অশ্বত্থ গাছের ডালে যাতায়াত করছে! ভারী চঞ্চল ওরা! পথ ছেড়ে দাঁড়াল অমিতাভ। লোকটি তাকাচ্ছে তার দিকে, একটু হেসে অমিতাভ বলল 

--কাকা, এদিকে বেড়াতে এসেছি! 

--অ। তা উঠা হয়েছিক কোনঠি ? 

--ওই যে মাঠা বাংলো,ওইখানে! 

লোকটি বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলে 

--মাঠা, মাঠা জোংগলে! অ, ফরেসেট বাবুদের ঘর! 

গোরুগুলো এগিয়ে গেছে একটু, লোকটি তাকিয়ে আছে সেদিকে। আকাশে আষাঢ়ের মতো মেঘ, ঘন ছায়া এলিয়ে পড়েছে মাটির বুকে, পাহাড়ের মাথায় কে যেন সাদা রঙ লেপে দিয়েছে। দামাল শিশুর মতো বাতাস হামা টেনে বেড়াচ্ছে ভুবনডাঙায়। অমিতাভ জিগ্যেস করে 

--কাকা, এদিকে জাহের থান আছে কোথাও ? 

প্রশ্ন শুনে ঘোলা চোখ তুলে তাকাল লোকটি। সারা মুখে অজস্র বলিরেখা, কালো কুচকুচে কোঁকড়া চুল মাথায়,একটু থেমে বলে ওঠে 

--আছেক! তবে ইদিকপানে লাই ! 

--তাহলে ? 

অনির্দিষ্ট পশ্চিম দিকে আঙুল তুলে বলে 

--উদিকে! 

--ওদিকে কোন গাঁ ? 

কিছুই বলে না লোকটা, মাথা নাড়তে নাড়তে গোরুর পালের দিকে হেঁটে যায়। হাঁটার ভঙ্গিমাটিও ভারী অদ্ভুত, যেন অনন্তকাল ধরে গবাদি পশুর দল নিয়ে হেঁটেই চলেছে সে, দুপাশে কত নগর জনপদ তুষারাবৃত পর্বতমালা, চিরহরিৎ বৃক্ষরাজি,ওই তো মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখছে চকমকি পাথর ঠুকে ঠুকে, তারপর চাকা বানাবে, চাষবাস শিখবে...এমন সজল মেঘছায়ার নিচে লোকটির অপূর্ব ভ্রমণ শেষ হয় নাই এখনও! জীবন পার করে মৃত্যু পার করে সে এগিয়ে চলেছে, আরও সামনে, সম্ভবত পূর্ব দিগন্তরেখার দিকে। 

মাদলের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এখান থেকে, কত পুরাতন কথা মনে পড়ে অমিতাভর। বস্তার জেলার কুরাণ্ডি, বলি ভাতরা, অবুঝমারের মাথায় ওঁরচা গ্রাম, ভেষজ রঙ তৈরি ওখানেই শিখেছিল। বলি ভাতরার সমাধির ওপর স্মৃতিফলক, উরাসগুট্টা বলে ওরা, চোখ বন্ধ করলেই মনে ভেসে ওঠে। সেদিনও এমন ঘন মেঘের ডাক শোনা গিয়েছিল, অবুঝমার যাচ্ছিল অমিতাভ। মৃত আগ্নেয়গিরির মতো ওই আনন্দক্ষত আজও শুকিয়ে যায় নাই। ফিরে এসেই ছবির জোয়ার এসেছিল হাতে, বিচিত্র রঙ আর রেখায় ভরে উঠেছিল বড় বড় ক্যানভাস। বিক্রি তেমন হয়নি যদিও, একটা একসিবিশন করেছিল তারপর আর বিক্রির হাটে বসেনি অমিতাভ। কী হবে ওসব করে! কেউ কিনবে বা দেখবে বলে তো সে আঁকে না! বিক্রি হলে হবে নাহলে না হবে! 

ঘোড়ার ক্ষুরের মতো একটা বাঁক সামনে, সেখান থেকেই পথখানি আবার বিপরীত দিকে রওনা দিয়েছে। সামনেই বেশ বড় মতো মহুয়া গাছ, এখন ফুলের সময় নয়, সবুজ পাতায় ঢাকা গাছের সারা শরীর। মহুয়ার মদ ভারী প্রিয় অমিতাভর। প্রথম মহুয়া এখানেই খেয়েছিল, সেবার ফুচু মাচুয়া নিজের ঘরে তৈরি ওই তাজা কুসুম-আরক এনে খাইয়েছিল, কুড়ি একুশ বছর বয়স তখন! মহুয়ার নেশায় সদ্য কিশোরকাল পেরোনো যুবকের চোখ লাল হয়েছিল, রিণরিণি ঝিম সারা দেহে! ফুচুর খোঁজ করলে হয় একবার, বেঁচে আছে কিনা কে জানে! তখনই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ছিল বয়স। বামনি জলপ্রপাতের একেবারে নিচের ধাপে নিয়ে গেছিল সঙ্গে করে, ওদিকে বড় কেউ একটা যায় না, স্নান করার কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। তারপর পাহাড়ের ধাপে আগুন জ্বালিয়ে দিশি মুরগির মাংস রেঁধেছিল ফুচু। কালো কুচকুচে দেহ, পরনে পরিচ্ছন্ন একখান ধুতি, মাথায় গামছা বেড় দিয়ে বাঁধা। অযোধ্যা সরকারি লজ থেকে পায়ে হেঁটে এসেছিল ওরা বামনি অবধি, পথ বড় কম নয়, খিদেও পেয়েছিল খুব, স্নান শেষে বেলা পড়ে আসছে, দূর শৈলরাজির মাথায় ভেসে বেড়াচ্ছে আলো, কী একটা নীল মতো ফুলের ঝোপে ওড়াওড়ি করছে বুনো পোকার দল, আকাশে একটুও মেঘ নাই, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ চারপাশে। রান্নাটি ভারী অদ্ভুত ছিল, আসার সময় মুরগি কেটেকুটে হলুদ শুকনো গোটা গোটা লঙ্কা লবণ একমুঠি আদা ঘষা আর সর্ষের তেল দিয়ে মেখে কাঁচা শালপাতায় বেঁধে কাঁধের গামছায় মুড়ে নিয়েছিল ফুচু। এখন দুটো চ্যাটালো পাথরের মাঝে শুকনো কাঠকুটো একটু জ্বলে উঠতেই শালপাতা সমেত মাংসের পুঁটলি ফেলে দিল আগুনে। কাঁচা শালপাতা আর ধোঁয়ার গন্ধে কত পুরাতন খিদে জেগে ওঠে। চৈত্র মাসের অপরাহ্ন অলৌকিক নক্ষত্রলোক মনে হয় ওই বনপাহাড়ে, একটু দূরে দূরে মহুয়া গাছের সারি, কুসুমহারে পাতা দেখা যায় না, সেসব কোন অতীত যৌবনবেলার কথা! অস্পষ্ট কুয়াশার মতোই মিলিয়ে গেছে মহাকালশূন্যে। 

রাস্তার বাঁক ঘুরে এগিয়ে চলেছে অমিতাভ, দূরে কতগুলো মেটে ঘর চোখে পড়ছে, গ্রাম মনে হয় কোনও। একটু সামনেই যেতেই স্পষ্ট হয়ে উঠল দৃশ্য, মুরগি চড়ে বেড়াচ্ছে রাস্তায়, গোবর লেপা দেওয়াল, বিচিত্র একটা সুবাস ভেসে বেড়ায় এইসব আদিবাসীদের গ্রামে। গোবর মুরগির গু ছাগলের নাদি গবাদি পশুর দেহগন্ধ আর জংলা গাছপাতা একসঙ্গে মিশে অদৃশ্য বলয় রচনা করে। 

গাঁয়ে ঢোকার মুখেই খুব বুড়া একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, দেহে শতচ্ছিন্ন জামা আর নোংরা ধুতি, পায়ে গোদ হয়েছে মনে হয়, ছেঁড়া চট দিয়ে বাঁধা পায়ের পাতা আর হাঁটু, অমিতাভকে দেখেই একগাল হেসে বলে উঠল, কুন আইছিস বাপ ? লগেন ? লগেন আলি ঠি বাপ ? 

চোখের মণি জুড়ে যেন কামলা রোগ হয়েছে, সারা মুখে বৈশাখের মাটির মতো ফাটা ফাটা দাগ, কাছে এগিয়ে গেল অমিতাভ। ময়লা শিরা বের করা হাত দিয়ে খানিক গায়ে মাথায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল বুড়া,তারপর বিড়বিড় করে কীসব যেন বলতে বলতে ঝাঁকামুকো পাকুড় গাছটার দিকে এগিয়ে গেল। কতগুলান ছাগলের বাচ্চা চরে বেড়াচ্ছে ওখানে, বৃষ্টির জলে গাছের তলায় থিকথিকে লাল কাদা,তার ওপরেই থেবড়ে বসল বুড়া। মাথায় গায়ে ঝরে পড়ছে কার্ত্তিকমাসের অকাল বর্ষা। আর ক’দিন পরেই পরব, বাঁদনা পরব, ঘন অমানিশায় শুরু হয়, গোরু আর মোষদের কত যত্ন করে সাজায় সবাই, সুর করে গান গায়, ওহিরে,সবু পরব খালা, ঘুরি ফিরি আওয়ে,মানুয়া মরলে নাহি আওয়ে! অমিতাভ ভাবতে থাকে, ওই বৃদ্ধ মানুষটিকে কেউ পরবে ডাকবে ? গান গাইতে ? একদিন তার সব ছিল, ঘর সংসার অর্থ যৌবন তেজ, আজ কেমন সংসার দুয়ারে সজল আকাশের নিচে একাকী বসে আছে, সবাই হয়তো তাকে ভুলে গেছে! এলোমেলো বাতাসে লগেন, লগেন বলে কাকে যেন ডেকে যায়! লগেন কি তার ছেলে ? পীরিতের জন ছিল ? কে জানে! 

সামনেই একটি ছোট মাটির ঘর, দাওয়ায় একজন লোক বসে বসে মাদল বাঁধছে। মাঝে মাঝে চাটি মেরে দেখছে বোল উঠল কিনা। অমিতাভকে দেখে খানিকক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকল, তারপর মুখ নিচু করে ফের মাদল বাঁধায় মন দিল। রাস্তা দিয়ে একজন অল্পবয়সী ছেলে সাইকেল চালিয়ে এদিকেই আসছে, অমিতাভ হাত দেখাতেই দাঁড়াল। 

--হ্যাঁ রে বাবু, এখান দিয়ে বড় রাস্তায় যাওয়া যাবে ? 

ছেলেটি ঘাড় নাড়াল। 

--তাহলে কোথায় গেছে এই রাস্তা ? 

--হুই, পাখি পাহাড়! 

--এই গাঁয়ের কী নাম রে ? 

--ভুচুংডি! 

--ভুচুংডি ? 

ছেলেটি আবার ঘাড় নাড়ে। 

আকাশে মেঘ এসে জড়ো হচ্ছে কোথা থেকে, হাওয়ায় ভেসে ভেসে চৈতি পূর্ণিমার রাতের পরীর দলের মতো তারা আসছে। তাদের গায়ে কী এক করুণ আলো লেগে আছে, মিহি কাপাস তুলোর মতো বৃষ্টি হয়েই চলেছে। ভুবনডাঙায় সবুজ রঙ যেন গলে গলে খসে পড়ছে, কিছু লেগে গেল মাটির গায়ে, কিছু রঙ হামা দিয়ে উঠে গেল ওই অশ্বত্থ গাছের উঁচু ডালপালায়, ফিঙে আর মৌটুসীর পালকে আটকে গেল দু এক টুকরো রঙের দানা। অমিতাভ কতবার যে দেখেছে ওই বিচিত্র রঙের লীলা, তবুও মন ভরে না। ভারী মহুয়া খেতে ইচ্ছে করছে, একবার ভাবল এগিয়ে যাবে পাখি পাহাড় অবধি, তারপরই মনে পড়ল, পুরাতন কষ্টের কথা। ওই অসমাপ্ত শিল্পকীর্তি দেখলে মনের অতল থেকে জন্মজন্মান্তরের বিষাদ গুঁড়ি দিয়ে উঠে আসে। একদল মানুষ শুরু করেছিল বিশাল এক পাহাড় কেটে কেটে শিল্পবস্তু তৈরির কাজ, শেষ হয়নি তা আর। পরিত্যক্ত সমাধিভূমির মতো পড়ে আছে ওই পাহাড়, কত অনামী অচেনা শিল্পীর বাসনারেণু লেগে আছে, কত গোপণ অশ্রু, আজ মেঘ ছায়াতলে তারা সব অমিতাভর কাছে এগিয়ে আসবে। জিগ্যেস করবে, আমাদের ভুলে গেলে তুমি ? দ্যাখো, কেমন পাথর কেটে হরিণ এঁকেছিলাম আমরা, আধখানা, দুটো পা নাই, তুমি আঁকবে ? বাক পা দুটো ? আঁকবে ? তাহলেই ও কেমন ছুটে মিলিয়ে যাবে গহীন শালবৃক্ষরাজির অন্তঃপুরে! 

থাক বরং, ও প্রশ্নের সামনে দাঁড়ানোর আর বয়স নাই নিজের। বাইক চালিয়ে কুৎসিত কলকাতায় ওষুধ বিক্রি বিক্রি করে করে, দুটো অন্নের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা চাওয়ার পর, ওই অশরীরী কণ্ঠের সামনে আর যাওয়া যায় না। কুরাণ্ডির বলি ভাতরার কথা মনে পড়ে। আর তার সঙ্গে কখনও দেখা হবে না, থাক, থাক ওই জীবন, মাঠা বাংলোয় ফেরার পথ ধরে অমিতাভ। 

সেই বুড়া লোকটি গোরুর দল নিয়ে এদিকেই আসছে আবার। তেমনই সামনের গোরুটির গলায় ঘণ্টি বাজছে, টুং টুং। পেছনে আকাশ আর অনুচ্চ মিলেমিশে একাকার। অবাধ্য বালকের মতো মেঘ উড়ছে তাদের শরীরে। অমিতাভকে দেখে বুড়া দাঁড়াল একটু, অল্প হেসে অমিতাভ জিগ্যেস করে 

--কী গো, গোরু চরানো হয়ে গেল ? 

মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল 

--ঘুরাইতে যাইছিলাম! 

একটু অবাক হয়ে অমিতাভ শুধোয় 

--গোরুদের বেড়াতে নিয়ে গেছিলে ? 

--হঃ 

--তা কী দেখালে ওদের ? 

একটু হাসে লোকটি এবার। হলুদ হলুদ দাঁতের সারি। মুখ তুলে বলে 

--কতক কী আছে, বুলা যায়কো না! 

গোরুর দল এগিয়ে গেছে একটু। অমিতাভ একটা পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলে 

--নাও, খাও! 

হাত বাড়িয়ে নেয়, দুই চামড়া ওঠা ঠোঁটের ফাঁকে কাঠি লজেন্সের মতো চেপে ধরে সিগারেট, অমিতাভ দেশলাই জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় ডগায়। ফস ফস করে ধোঁয়া ছাড়ে বুড়া। অমিতাভ নিজেও একটা সিগারেট ধরিয়ে জিগ্যেস করে 

--কাকা, এখানে ফুচু মাচুয়া বলে কাউকে চেনো ? 

--ফুচু...ফুচু 

নিজের মনেই খানিক বিড়বিড় করে বুড়া। তারপর বলে 

--হঃ, ফুচু! কী হবেক উকে ? 

--আমি আগে, বহুবছর আগে এদিকে এসেছিলাম জানো! তখন ফুচু আমাকে দেখিয়েছিল সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে! 

কিছু বলে না বুড়া। হাসে শুধু একটু। 

--কোথায় থাকে এখন ফুচু ? তুমি জানো ? তাহলে একবার দেখা করতাম! 

এবারও কোনও উত্তর দেয় না। জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে থাকে অমিতাভর দিকে। দু এক মুহূর্ত যায়, দমকা বাতাস উঠে আসে মাঠের দিক থেকে। হঠাৎ একমুঠো পুটুস পাতা ছিঁড়ে দু হাতের চেটোয় ডলে অমিতাভর নাকের সামনে নিয়ে যায় হাতখানি! সহজাত প্রতিক্রিয়াবশেই মাথা পিছনদিকে সরিয়ে আনে অমিতাভ তারপর এগিয়ে দেয় মুখ। তীব্র বুনো কষাটে সুবাসে ঝিমঝিম করে ওঠে শরীর। ঘড়ঘড়ে গলায় বুড়া বলে ওঠে 

--ই বাসটো লেগে ঘুরাই বেড়াই! ঘুরাই বেড়াই! ঘুরাই বেড়াই! 

দূর দিকচক্রবালরেখার দিক থেকে সহস্র অশ্বারোহীর মতো তখন ছুটে আসছে বৃষ্টির অস্পষ্ট মায়া পর্দা। তাদের পায়ের ধুলায় মিশে কালো হয়ে গেছে আকাশ, আলো শান্ত বালকের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে মাঠা পাহাড়ের কোলে। অবাক হয়ে অমিতাভ জিগ্যেস করে 

--বুড়া, ও বুড়া, তোমার নাম কী গো ? 

মহাকালের মতো নির্বিকার গলায় বুড়া উত্তর দেয় 

--নরেন, নরেন ওঁরাং!

0 comments: