4

someপ্রতীক - সুমিতা ব্যানার্জী

Posted in




আমি সুমিতা ব্যানার্জী। মাসীমা আমার নৃত্য গুরু। আজ তাঁর স্মৃতিচারণ করতে বসে অতীতের অনেক স্মৃতি ভীড় করে আসছে।

ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল। যখন আমি খুব ছোট তখন পাড়ার একজন – নাম ছবি ক্ষেত্রী – তাঁর কাছেই নাচের প্রাথমিক শিক্ষা। সেভাবে দেখতে গেলে ওই ছবি মাসিই ছিলেন আমার প্রথম নৃত্য শিক্ষাগুরু। একটু বড় হওয়ার পরে বাবা নিয়ে গেলেন গুরু বন্দনা সেনের কাছে। সেখানে বেশ কয়েক বছর কত্থকের তালিম নিয়েছিলাম। এরপরে নানা জায়গায় অনেক অনুষ্ঠান করেছি, একটু পরিচিতিও ঘটেছে। এইভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন ডাক এল “সৌরভ” নামে একটি সংস্থা থেকে। ওদের ওখানে তখন “মেঘদূত” নামে একটি প্রযোজনার প্রস্তুতি চলছে। আমাকে দেওয়া হলো “যক্ষিণী” চরিত্রটা করার জন্য। রবীন্দ্রসদনের হলে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এখানে অনেক Musician ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন রবীন পাল। তিনি সরোদ বাজিয়েছিলেন। এই রবীনদাকেই পরবর্তীকালে উদয়শংকর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টারে দেখেছি Musicianদের মধ্যে অন‍্যতম মুখ্য শিল্পী হিসেবে। আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সাথে আমিও বড় হতে লাগলাম। যখন আমার বয়স ষোল বছর কয়েক মাস, তখন আমার বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন উদয়শংকর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টারে। আসলে আমার বাবা একসময় রয়টারে এবং পরবর্তীকালে অমৃতবাজার পত্রিকাতে সাংবাদিকতা করতেন। সেই সুবাদে অনেক নামী দামী মানুষের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। ঠিক সেইভাবেই উদয়শংকরের সাথেও তাঁর বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল। আমার কথা বাবা তাঁকে বলেছিলেন। ফলস্বরূপ আমার তাঁর সেন্টারে যাওয়া। সালটা ইংরাজী ১৯৭১-এর February মাস, সন্ধ্যা ৬টা। সেইসময় মাসীমাই ছিলেন সেন্টারের সর্বময়ী কর্ত্রী। সেইদিন সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে দেখি কোনও একটা অনুষ্ঠানের মহড়া চলছে। হাসিমুখে মাসীমা এগিয়ে এলেন। দেখলাম, সুন্দর পেটানো চেহারা এবং অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা, যাঁকে দেখলে সমীহ করতে ইচ্ছা করে। আর একজনকে এখানে দেখে অবাক হলাম, তিনি হলেন রবীনদা। উনিও আমাকে দেখে বলে উঠলেন, “আরে একে তো চিনি – এতো সুমিতা। খুব ভাল নাচে।” মাসীমা সেই শুনে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন আর উপস্থিত যারা ছিল তাদের দেখিয়ে বললেন, ওদের দেখে দেখে আমিও যেন অনুসরণ করে নাচ করি। বলা বাহুল্য যে “মম” অর্থাৎ মমতাশংকরও সেইখানে উপস্থিত ছিল। একদম নতুন আমি। কিছুই জানি না। কি নাচ! কিসের অনুষ্ঠান! তবুও আমার সাধ্যমত আমি করতে লাগলাম। নাচের শেষে মাসীমা খুব খুশি হয়ে বললেন, “কি? আমাদের সাথে tour-এ যাবে নাকি show করতে”? এ এক অভাবনীয় প্রস্তাব। আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। এরপর শুরু হলো প্রস্তুতি। একটি নতুন মেয়েকে কি যত্নের সাথে মাসীমা তৈরি করলেন সেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। পাটনা গেলাম। এর আগে এতো বড় group-এর সাথে আমি এত দূরে কোথাও যাইনি। খুব আনন্দ করেছিলাম আমরা। মাসীমার গাম্ভীর্যের নীচে একটা সরল মানুষও লুকিয়ে থাকত। একদিন সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ উনি আমাদের group-এর এক পুরুষ কর্মীকে ভয় দেখাবেন ঠিক করলেন। অন্ধকার সিঁড়ির এক কোণে দাঁড়িয়ে দুটো হাত সোজা উপরে তুলে দিলেন আর আমাদের বললেন একটা সাদা চাদর দিয়ে ওঁকে ঢেকে দিতে। আমরা তাই করলাম আর সবাই লুকিয়ে পড়লাম। শুধু একটি মেয়ে গিয়ে সেই মানুষটিকে জানাল যে মাসীমা তাকে ডাকছেন। মাসীমা করলেন কী, ঐ চাদরে ঢাকা এত উঁচুতে হাতের পাতা এমনভাবে নাড়তে লাগলেন যেন মনে হলো অসম্ভব লম্বা একজন মানুষ মাথা নাড়ছে। যার উদ্যেশ্যে এত কিছু, সে বেশ হেলতে দুলতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ঐ অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বাপরে মারে বলে চিৎকার জুড়ে দিল। আমাদের মধ্যেও উঠল হাসির রোল। এমনই ছিলেন মাসীমা। আমরা তাঁকে যেমন ভয় পেতাম, ততটাই সমীহ করতাম। অনেক কিছু শিখেছি ওঁর কাছে। একজন নৃত্য শিল্পীর হাঁটা চলা, বসা, দাঁড়ানো – সবই শিখেছি ওঁর কাছে। মেরুদণ্ড টানটান যেন থাকে সবসময়। তাই বোধহয় এখনও সোজা না হয়ে বসতে পারি না। আলস্য বলে কিছু ছিল না ওঁর মধ্যে। আমার আগেকার জীবন অনেকটাই বদলে গেল ওঁর সংস্পর্শে এসে। একজন নৃত্য শিল্পী হতে গেলে শুধু সুর, তাল, ছন্দ মিলিয়ে পা ফেলা বা দেহ ভঙ্গিমা নয়, একজন সত্যিকারের নৃত্য শিল্পীকে জানতে হবে মঞ্চের উপযুক্ত ব্যবহার। পোশাকের সমস্ত খুঁটিনাটি। মঞ্চে আলোর ব্যবহার আর উপযুক্ত মেকআপ। অতিরিক্ত মেকআপ উনি একদম পছন্দ করতেন না। আর মেয়েদের খোলা লম্বা চুলের ব্যবহার দেখেছি এই সেন্টারে এসে।

পোশাক তৈরি হত আমাদের সেন্টারে। আমাদের রাঘবন গুরুজিকেও দেখেছি সেলাই মেশিনে পোশাক সেলাই করতে। একটা নেশার ঘোরের মত কেটেছে ওই সব দিনগুলো। আমাদের মঞ্চে আলোর কাজ করতেন তখন স্বনামধন্য তাপস সেন। “সীতা স্বয়ম্বরা” নামে একটি প্রযোজনা হয়েছিল সেই সময়। খুব নামডাক হয়েছিল ঐ সীতা স্বয়ম্বরার। সেখানে রামের ভূমিকায় মমতাশংকর, তাড়কা রাক্ষসীর ভূমিকায় তনুশ্রীশংকর, আর মীনাক্ষী বলে একটি মিষ্টি দেখতে মেয়ে ছিল সীতার ভূমিকায়। আমি ছিলাম অহল‍্যা। এখানে রাম ও তাড়কার যুদ্ধের একটি scene ছিল। পর্দার ওপরে shadow তে দেখানো হয়েছিল সেই দৃশ্য। দর্শক দেখছে বিশাল দৈত্যাকার তাড়কার সাথে সাধারণ মানবের রূপে রামের লড়াই। আলোর কি চমকপ্রদ ব্যবহার আর তেমনই তনুশ্রী আর মমর অপূর্ব নৃত্য শৈলী। ঐ দৃশ্যের পরে hall কারতালিতে ফেটে পড়ত। মাসিমাকে দেখেছি ঐ দৃশ্যটিকে বাস্তবায়িত করতে স্টেজ রিহার্সাল-এর সময় কি পরিশ্রমটাই না করতে। অনেক কথা মনে পড়ছে। ছোট ছোট ঘটনা। আমরা ট্রেনে করে যাচ্ছি টাটা-জামশেদপুর। কোনও একটি স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। একটি ছোট ছেলে আইস ক্রীমের একটা বাক্স নিয়ে হেঁকে চলেছে, “ঠাণ্ডা আইস ক্রীম, ঠাণ্ডা আইস ক্রীম।” হঠাৎ দেখি মাসীমা ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করছেন, “এই এদিকে আয় তো। কি? তোর কাছে শুধুই ঠাণ্ডা আইস ক্রীম? গরম আইস ক্রীম নেই?” ছেলেটি একটু থতমত খেয়ে “না” বলে একছুটে ওখান থেকে পালিয়ে গেল, আর আমরাও মাসীমার ঐ রসিকতায় খুব মজা করে হাসতে লাগলাম।

তিন বছর ছিলাম ওঁর কাছে। অনেক শিখেছি, অনেক পেয়েছি। আজ মাসীমা নেই, কিন্তু ওঁর দেওয়া শিক্ষাগুলো আমাকে আজও অনুপ্রাণিত করে। উদয়শংকর সৃজনশীল নৃত্যের যে জাদু শিখিয়েছিলেন, তাঁর সুযোগ্যা শিষ্যা ও সহধর্মিণী শ্রীমতী অমলাশংকর কিভাবে তা এতদিন ধরে নিষ্ঠার সাথে, কি অসম্ভব শ্রদ্ধায় বহন করে নিয়ে এসেছেন, ভাবলে শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে মাথা নত হয়ে যায়।

কিছু মানুষের কথা ভাবলে মনে হয়, কেন চিরকাল তাঁরা থাকেন না। মাসীমার চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি, বিশ্বের নৃত্য সমাজে। মাসীমা যেখানেই থাকুন ভালো থাকবেন, আপনার নাচ নিয়ে। আশীর্বাদ করুন, আপনার শেখানো সবকিছু যেন সারাজীবন অন্তরের গভীরে প্রতিপালন করতে পারি।


১ - উদয় শঙ্কর, ২- অমলা শঙ্কর, ৩- আনন্দ শঙ্কর, ৪- মমতা শঙ্কর, ৫- তনুশ্রী শঙ্কর, ৬- সুমিতা ব্যানার্জী (লেখিকা)






















ছবি ঋণ - লেখিকা



4 comments:

  1. খুব সুন্দর লেখা, অনেক কিছুই জানতে পারলাম ওনার ব্যাপারে, চোখ দিয়ে একটু জল ও বেরিয়ে এলো, অপূর্ব বর্ণনা 👍👍👍

    ReplyDelete
  2. Somriddho holam. Khub sundor pranjol bhasae bornito. Ro onek lekha porar ichhe roilo. Dhonnobad lekhika ke

    ReplyDelete