someপ্রতীক - সুশান্ত চন্দ্র
Posted in someপ্রতীক
আত্ম অনুভূতিকে আত্ম স্বতন্ত্র রূপে প্রত্যক্ষ করাই হল ART। জীবনের প্রাঙ্গণে সুন্দরের আবির্ভাব ঘটেছে বারবারই। তবু মানুষ আজো বুঝি তার পূর্ণ অর্থ খুঁজে পায়নি। তাই চলেছে নিরন্তর অনুসন্ধিৎসার অভিযান।
প্রত্যুষে সূর্য তার আলোর আবেদনে যে বিস্ময় আনে, ফুল ফোটানো জ্যোৎস্না, আন্দোলিত বসন্ত বাতাস, বন বেতসের নৃত্য ভঙ্গিমা, মর্মর মুখরিত সায়াহ্নের নিঃসঙ্গ বনপথ, রূপ পূজারী মানুষের মনে ভিন্ন রসের সঞ্চার করে।
তাই মানুষ চায় তার ছন্দে সুরে লেখায় রেখায় বর্ণবিন্যাসে এই পলাতক সৌন্দর্যকে চিরস্থায়ী করে রাখতে। তাই কবির কল্পনা উজ্জীবিত অতীতের উজ্জিয়নী মহাকালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আজো বেঁচে আছে। হাজার মানুষের মনের গহনে যে মন অনুভব করে, সেই মনই করে শিল্পের রচনা। সত্যিকারের শিল্পবোধ সহজাত। অনন্তকালের অবগুণ্ঠনের ফাঁকে ফাঁকে যে সৌন্দর্য লক্ষ্মীর আবির্ভাব ঘটে বারে বারে, তাকে অকুণ্ঠ চিত্তে অভিবাদন জানায় মানুষের বিমুগ্ধ শিল্প মন। সেই বিমুগ্ধতার উপলব্ধি ঘটে গ্যেটে বা রবীন্দ্রনাথের চিত্তলোকে। আবার সাধারণ মানুষের মনেও। শিল্পানন্দের অনুভব চলে সবার অন্তর লোকে।
কিছু চিত্তের বাহির অঙ্গনে এনে সবার সামনে মেলে ধরবার শক্তিটুকুই হল শিল্পীর নিজস্ব সম্পদ। বাইরের জগতে রূপাশ্রয়ী করবার তাগিদ এলে সাধনার কথা ওঠে। শিল্পীর এই সাধনাগুলো প্রকাশের অনন্ত প্রয়াস যে পরম গীতি ধ্বনিত হল আমার মনে, তাকে মনোলোকের বাইরে এনে বিশ্ব মানসের গোচর যদি করতে না পারি, তবে তা আমার একান্ত নিজস্ব বস্তু হয়ে রইল।
যে সৌন্দর্যসুধায় সিক্তও হল আমার মন সেই সুধার ধারার বিস্তৃতি ঘটল না সবার মনের ঘাটে ঘাটে। প্রকাশের অভাবে সমাজে স্বীকৃতি পেলো না আমার শিল্প অনুভূতি। উপলব্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমি যে অসীম আনন্দ লাভ করলাম সুন্দরের অনুধ্যানে, তাকেই চরম বলে স্বীকার করব। নাই বা হল আমার অন্তরের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। নাই বা রূপ পেল আমার আনন্দ বিশ্বজনের চোখের সামনে। যে শিল্পী কায়া দিল না, তার অন্তর লক্ষ্মীকে তার অনুভূতিকে কি অস্বীকার করা যায়? কাগজে কলমে বা ক্যানভাসের বুকে রুপ দেওয়া তো আঙ্গিকের ব্যাপার। দার্শনিক ক্রোচে যাকে বলেছেন টেকনিক। এই টেকনিক-এর সাহায্যে আত্মানুভূতিকে বাইরের রসিক জনের দরবারে হাজির করা হয়। একথা অবশ্যই স্বীকার্য। তবে একথাও সত্য যে প্রকাশ শক্তিহীন শিল্পীর দল শিল্পানন্দের যে আস্বাদন করে তাও কোনও অংশে কম নয়। সুন্দরের জন্য যে গোপন অর্ঘ্য এরা রচনা করে চলেছে, তার মুল্য অপরিসীম।
তবে প্রকাশের সাধনা করতে পারলে ব্যাক্তিগত আনন্দকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সর্বজনের মাঝে।
একের আনন্দ বহুর আনন্দ হয়ে সৃষ্টি করে শাশ্বত সুন্দরের। এই প্রকাশের সাধনা যে করে তাকেই আমরা শিল্পী বলি। প্রতিভাবান বলি। খোলা চোখে আমরা কোনও বস্তু বা দৃশ্য নিজেরা দেখি। আরও দশজনকে সে দৃশ্য দেখাতে গেলে ক্যামেরার প্রয়োজন হয়। শিল্পীর মন এই ক্যামেরা আর শিল্পীর প্রতিভা এই ক্যামেরার ভিতরকার কলকব্জা। ক্যামেরার ভিতরের উল্টোপাল্টা রীতি পদ্ধতির মাধ্যমে যেমন সুন্দর ছবিখানি আমরা পাই, তেমনি প্রতিভার জারক রসে জারিত হয়ে আমাদের অতি পরিচয়ের মরচে ধরা বস্তু জীবন স্বপ্নের স্বর্ণাভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
এবার আসা যাক universality-র কথায়। এর প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহণ করা যাক সর্বজন অধিগম্যতাকে। শিল্প হবে বিশ্ব মানুষের অধিগম্য। শিল্প হবে দেশ ও কাল নিরপেক্ষ। অর্থাৎ দেশ ও কালের সীমা ছাড়িয়ে শিল্পের আবেদন পৌছবে সর্বত্র। এ দেশের কবি বিরহ মিলনের যে গাহক রচনা করবে, ওদেশের মানুষ তাকে অভিনন্দিত করবে শ্রদ্ধার সঙ্গে। এই universality-র ধারণা শিল্প ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে।নআমরা মনে করি শিল্প হবে ইউনিভার্সাল, অর্থাৎ যে শিল্প রসোতীর্ণ হয়েছে তার আবেদন পৌছবে সকল মানুষের মনে। কিন্তু এর তত্ত্ব যদি এতই সহজ, তবে ইউনিভার্সালিটির প্রশ্নে এত জটিলতা কেন? কেন রবীন্দ্রনাথের মত মহাকবির মনেও আক্ষেপ ছিল যে তাঁর কবিতা সর্বত্রগামী হয়নি? তাই তিনি আক্ষেপ করেন সেই কবির জন্য, “যে আছে মাটির কাছাকছি সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।”
বস্তুত, অভিধানগত ভাবে কোনও শিল্পই ইউনিভার্সাল নয়। মানুষের রুচি ভিন্নধর্মী। শিক্ষা, দীক্ষা, পরিবেশ মানুষের রুচিকে গড়ে তোলে। আর মন ধর্মকেও পূর্ণাঙ্গ রুপ দেয়। শিল্প আবার এই মনের কাছেই দরবার করে। তাই কোনও শিল্পই সর্বজন অধিগম্য হতে পারে না। যে অর্থে আহার, নিদ্রা, ভয় ইউনিভার্সাল, শিল্প সেই অর্থে ইউনিভার্সাল নয়। একজন খাঁটি বৈষ্ণব যে ভাবে তার সমস্ত সত্তা দিয়ে উপভোগ করে কৃষ্ণলীলার মাধুর্য, ঠিক তেমন করে বৈষ্ণব কাব্য কাহিনীর রস গ্রহণ করতে পারেনা সাধারণ পাঠক। শিল্প-সুরের ধ্বনি বিভিন্ন মনে বিভিন্ন ধরণের প্রতিধ্বনি তোলে। রসবেত্তার আবেগ, মনন, ধর্ম, রুচির ওপর শিল্পের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে। শিল্পের আবেদন যে মানুষের অনুভূতিলোকে!
অধ্যাপক কলিংউডের কথায় বলা যায়, শিল্পের মূল্য সবসময় নির্ণীত হয় ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা। ব্যক্তি না থাকলে শিল্প থাকে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আর্ট-এর ক্ষেত্রে ইউনিভার্সালিটি কথাটির অর্থ বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ।
যিনি সাধনা করেছন শিল্প সৃষ্টির জন্য আর যিনি রস উপলব্ধির সাধনা করেছেন, তাঁরা দুজনেই একই কোটির মান। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেন, “The light that never was on sea or land” - জল, স্থল, অন্তরীক্ষে কোথাও এই শিল্পসৃষ্টির তুল্য মর্যাদাসম্পন্ন বস্তুর দেখা পাওয়া যায়না।
তাই তো শিল্প হল অনন্য পরতন্ত্রা।
দার্শনিক Basanque-এর ভাষায় uniquely individual। শিল্পের এই ঐকান্তিক বৈশিষ্ট্য জাত হয় শিল্পীর কল্পনা থেকে। কল্পনা বা imagination আদর্শ বা ideal-এর সঙ্গে মিশে গিয়ে কবি তথা শিল্পীকে সৃষ্টিধর্মে প্রবুদ্ধ করে। স্নায়বিক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে কল্পনা প্রবৃত্তির একটি বাস্তববাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন Aristotle-
কল্পনা হল অনুভূতিরই প্রতিচ্ছবি, যা মানুষের মনের মধ্যে থাকে সবসময়। আসলে কল্পনা বিষয়টিকে প্রায় গভীর একটি দার্শনিক প্রতীকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। সর্বপ্রথম তিনি নিছক কল্পনা “Fancy” থেকে প্রকৃত কল্পনার “Imagination”–এর পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। বড় শিল্পীর কাছে কল্পনা বিষয়টি শুধু জৈবিক না, দার্শনিকও। ভারতীয় শাস্ত্রজ্ঞরা বলে থাকেন প্রতিভা হল “অপূর্ব বস্তু নির্মাণ ক্ষমা প্রজ্ঞা।” রবীন্দ্রনাথের সেই “আমি” তত্ত্ব, যে আমির চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে আলো ফুটে ওঠে, গোলাপ সুন্দর হয়, সেও এই কল্পনা তত্ত্বের অনুসারী। “Me”-“My life” – “Lotus” – “Blooming”... বৌদ্ধ দর্শনের এই ধ্যান মন্ত্র রাবীন্দ্রিক মননে মিশে যায় অনায়াসে।
0 comments: