অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা
Posted in অনুবাদ সাহিত্যঅবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ১২
এবারের প্রেমের কবিতার কিস্তিতে পাঁচজন কবি।
পেরুর কবি সেসার ভায়েহো বেঁচেছিলেন ৪৬ বছর। পরের প্রায় পাঁচ দশক তাঁর স্ত্রী জর্জেত তাঁর কবিতাকে বুকে করে জীবন কাটিয়েছেন, প্রকাশ করেছেন অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত লেখার সংকলন, তত্বাবধান করেছেন নানান ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদের। “ত্রিলসে” নামে ৭৬ টি পরাবাস্তববাদী কবিতার একটি গ্রন্থ, দুরূহতায় যার তুলনা হতে পারে জেমস জয়েসের “ফিনেগান এর শোকযাত্রা” এর সঙ্গে। মনপার্নাসের অভিজাত সমাধিক্ষেত্রে তিনি অন্তিম শয্যায় অন্যান্য কালজয়ী কবি-লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে।
হুলিও কোর্তাসার কোন দেশের? আর্হেন্তিনার, ফ্রান্সের না পৃথিবীর? কথাসাহিত্যের জগতে যিনি বিপ্লব ঘটিয়েছেন, কবিতার জগতেও তাঁর অবদান ভেবে দেখার মত। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত “ক্রোনোপিওদের আর ফামাদের কাহিনী” লাতিন আমেরিকার হাইব্রিড সাহিত্যের এক অমোঘ উদাহরণ। গদ্যকবিতার শৈলী, অথচ তাতে রয়েছে ন্যারেটিভের উষ্ণতা এবং জাদুবাস্তবতার গোলকধাঁধা। মালার্মের তীব্র প্রভাবে তাঁর কবিতা লেখার সূচনা, কিন্তু খুব সহজেই তিনি তাঁর নিজের কাব্যপথটি খুঁজে নিয়েছিলেন। এসপানিওল ভাষায় কবিতাকে বলে “poema”, বহুবচনে “poemas”। ওই শব্দের আখরগুলিকে এলোমেলো করে দিয়ে তিনি তাঁর কবিতার বইয়ের নাম দিলেন “তকিবা ও বতিকা” (“Pameos i Meopas”)। এখানে সঙ্কলিত দুটি কবিতা তাঁর “গোধূলি ব্যতীত” (“সালভো এল ক্রেপুসকুলো”, ১৯৮৪) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
জেন শোর এর কবিতাটি বিষাদকরুণ ব্যর্থ প্রেমের -- জেন এবং তাঁর স্বামী কথাসাহিত্যিক হাওয়ার্ড নরম্যান বাস করতেন মেরিল্যান্ড রাজ্যের চেভি চেজ শহরে। ২০০৩ সালের গ্রীষ্মকালে তাঁদের অনুপস্থিতিতে সেই বাড়িতে হাউসসিটিং করতে আসেন উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতিময় ভারতীয়-মার্কিন কবি ঋতিকা ভাজিরাণী (১৯৬২-২০০৩) এবং তাঁর শিশুপুত্র জিহান। ঋতিকা তখন উইলিয়াম এবং মেরির কলেজে আবাসিক লেখিকার কাজ করছিলেন এবং হেমন্তকালে তিনি যোগ দেবেন এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে। তাঁর প্রেমিক এবং সন্তানের পিতা এক ডাকসাইটে মার্কিন কবি। কিন্তু ২০০৩ সালের জুলাই মাসে তিনি তাঁর শিশুসন্তানের কব্জি কেটে ফেলে তাকে হত্যা করেন এবং নিজেও আত্মহত্যা করেন। জেন এর “মালকিন” কবিতাটি সেই ভয়াবহ ও রক্তাক্ত ঘটনার পরে বাড়িতে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা বিষয়ে।
ভিয়েতনামের যুদ্ধের রক্তাক্ত ছায়ায় লাম থি মাই জা’র কবিতা জীবনের সূচনা। তিনি বাস করেন মধ্য ভিয়েতনামের থুয়া থিয়েন হুয়ে প্রদেশের হুয়ে শহরে -- যুদ্ধের বীভৎসতা ও বিষন্নতার মধ্যেও তিনি খুঁজে পান কবিতার বীজ। শহরের কেন্দ্র দিয়ে বয়ে গেছে সং হুয়াঙ অর্থাৎ অপরূপা সুগন্ধি নদী, তার জলের রং সবুজ, দুধারে ঘন হয়ে দাঁড়ানো গাছের সারি, সেই গাছের ছায়া পড়ে নদীর জলে, দূরে দেখা যায় নু বিন পর্বতমালা। মে থেকে নভেম্বর নিয়মিত বৃষ্টি ঝরে, বছরে গড়ে ৭১ ইঞ্চি। দিগন্ত অব্দি ঘন সবুজ আর আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের মাথায় টোকা। এই পরিবেশের সঙ্গে আন্তরিক সাযুজ্যই মাই জার কবিতার মেরুদণ্ড। যুদ্ধ তাঁকে আঘাত দিয়েছে, কিন্তু ভেঙে ফেলতে পারে নি। “ধানের সোনালী রঙ ক্লাস্টার বোমার রঙে মেশে” আর বোমার গর্তগুলি হয়ে দাঁড়ায় প্রকৃতির, পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রোবের্তো বোলানো চিলের লেখক এবং লাতিন আমেরিকার রাঁবো -- বোহেমিয়ান কবি, আপাদমাথা প্রতিষ্ঠান বিরোধী এবং পেশাদার সাহিত্য প্ররোচক। তাঁর হাতে নিগ্রহ সয়েছেন মেহিকোর রবীন্দ্রনাথ, স্বয়ং ওকতাবিও পাস -- মঞ্চে কবিতা পড়তে ওঠার আগে তিনি প্রেক্ষাগৃহে উঁকি মেরে দেখে নিতেন, বলেন ও তার দলবল কোথাও ওঁৎ পেতে রয়েছে কি না। কবিতার জন্যে যে কোনো শারীরিক ও মানসিক অনাচার ও নৈরাচারই যথেষ্ট নয় এই কবির কাছে। মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে তিনি লিখেছেন হাজার হাজার পাতার থকথকে গদ্য, সেগুলি এখন শোরগোল তুলেছে পৃথিবীতে।
এবার আমরা তাঁদের কবিতাগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো।
সেসার ভায়েহো (পেরু, ১৮৯২-১৯৩৮)
অনন্ত ফুলশয্যা
প্রেম থেমে গেলেই প্রবল হয়।
এবং সমাধি হয়ে ওঠে বিশাল এক আঁখিগোলক,
বাঁচে আর কাঁদে, মধুর অনন্ত
এবং কৃষ্ণ প্রত্যুষের পানপাত্রে যেমন।
যখন ওষ্ঠ অধর কুঞ্চিত চুম্বনের প্রস্তুতিতে,
যখন ভরা পাত্র উপচায় আর মরে
এবং সেই আলোকিত সংযোজনে,
একজোড়া ঠোঁট অন্যজোড়া ঠোঁটের জন্যে
প্রত্যাখ্যান করে অসুখী দিনযাপনের জীবন।
এবং, এইভাবে ভাবলে, মধুর লাগে সমাধিকে
যেখান সকলেই ঢোকে একে অন্যের গর্ভে
সমবেত গর্জনে;
মধুর সেই ছায়া, যার নিচে জড়ো সবাই
প্রেমের সার্বজনীন হস্তাক্ষরে।
[মূল কবিতার নাম: “এল তালানো এতারনো”।]
ক্লান্ত বলয়গুলি
যে কামনাগুলির কাছে ফিরে আসি, ভালোবেসে
অদৃশ্য হয়ে যাই না, এমন কামনা রয়েছে যার জন্যে
মৃত্যুও শ্রেয়, যার জন্যে যুদ্ধে মাতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী
জলরাশি, যাদের জোড়া হয়নি কখনো।
এক মহান চুম্বনের কামনা, যা ঢেকে ফেলতে পারে
জীবনকে, যার সমাপ্তি আফ্রিকায়, অসহ্য
যন্ত্রণার মধ্যে এক আত্মহত্যায়।
এমনও কামনা রয়েছে ..... যার কোনো কামনা নেই,
হে ঈশ্বর! আমার দেবহন্তা আঙ্গুল দেখায়
তোমাকে দিকে: সে কামনা হৃদয়কে বন্ধ করে রাখার।
বসন্ত আসে ফিরে ফিরে, চলে যায় আবার।
আর ঈশ্বর, সময়ের চাপে নতজানু,
বারবার বলে যান: চলেন, চলেন,
ব্রহ্মাণ্ডের মেরুদণ্ডকে পিঠে বোঝা নিয়ে।
আমার মন্দিরে যখন বিষাদের ঢাক বাজে,
যখন ছোরার গায়ে খোদিত স্বপ্ন পীড়িত করে আমাকে,
কামনাগুলো হেলায় ছড়িয়ে রাখি এই কবিতার গায়ে।
[মূল কবিতার নাম: লস আনিওস ফাতিগাদোস”।]
[“আমার মৃত্যু হবে প্যারিসে; সকাল থেকে বৃষ্টি হবে সেই দিনটিতে।” ফরাসি স্ত্রী জর্জেতকে প্রায়ই এই কথা বলতেন পেরুর এই কবি। ১৯৩৮ সালের ১৫ এপ্রিল এক বৃষ্টিমেদুর দিনে তাঁর মৃত্যু প্যারিসে। বামপন্থা থেকে পরাবাস্তববাদ পর্যন্ত দীর্ঘ সাহিত্যিক পদযাত্রা এই কবির। পেরুর জাতীয় কবি, সে দেশের প্রথম আধুনিক কবি, বিংশ শতাব্দীর এক মহীরুহ। এসপানিওল ভাষা থেকে কবিতাদুটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ক্লেটন এশলেম্যান।]
হুলিও কোর্তাসার (আর্হেন্তিনা, ১৯১৪-১৯৮৪)
এক প্রেমের চিঠি
যা কিছু আমি তোমার কাছে চাই
অন্তিমে সব তুচ্ছ
আবার অন্তিমে তাই সর্বস্ব
পাশ কাটিয়ে যাওয়া কুকুর, অথবা এক পাহাড়,
অর্থহীন সব সামগ্রী, যা একঘেয়ে,
গমের শিষ, লম্বা চুল, চিনির দুটো ডেলা,
তোমার শরীরের সুবাস,
যা কিছু তুমি বলে যাও যে কোনো বিষয়ে
আমার পক্ষে বা বিপক্ষে,
এই সব যা তোমার কাছে পাওনা
সব তুচ্ছ, কারণ তোমাকে ভালোবাসি।
আমি চাই তুমি আমাকে পেরিয়ে দূরে তাকাও,
আর আমাকে ভালোবাসো আগামীকালের
জবরদস্ত অবজ্ঞায়,
তোমার রাগমোচনের শীৎকার ফেটে পড়ুক
আপিসের কোনো বড়বাবুর মুখের ওপর
এবং যে ইন্দ্রিয়সুখ আমাদের যৌথ আবিষ্কার
তা হোক স্বাধীনতার আর এক চিহ্ন।
[মূল কবিতার নাম: “উনা কার্তা দে আমোর”]
অনুষ্ঠান
অশ্রু ও কম্পনের ফাঁকে ফাঁকে বসনমুক্ত করি তোমায়
এই শয্যা অসীম পর্যন্ত উন্মুক্ত,
এবং তোমার প্রতিবাদ, মিনতি অথবা লজ্জায় রাঙা মুখ
আমার মনে আনে না কোনো করুণা,
সময়ের আদিকালে আমি ছিলাম কুম্ভকার,
মাটির তালের ভেতর জন্মের অনুভূতি
জ্বলন্ত আগুনে পোড়ার মন্দগতি ও প্রথাগত ঝুঁকি সমেত,
ফুল হয়ে বা সৃষ্টির মুখে ফেরার পৌরাণিক অভিপ্রায়।
আমার বাহুতে তুমি বুনে দাও শৃঙ্খলের মতন
সময়ের মর্মরিত গুচ্ছ গুচ্ছ কেশদাম
বিসর্জন দাও তাকে অন্তহীন পুনরাবৃত্ত আগুনে।
জানি না তোমার বিলাপের মধ্যে কি দেখেছি,
দেখেছি ঈগল আর শৈবাল, আমি হয়েছি
আরশির সেই দিকটা যেখানে সরীসৃপ গান গায়।
[মূল কবিতার নাম: “লা সেরিমোনিয়া”]
[আর্হেন্তিনার কবি, ডাকসাইটে গল্পকার, এস্পানিওল ভাষার কথা সাহিত্যের খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন “রাউএলা” (“এক্কা দোক্কা” অথবা “হপস্কচ”) উপন্যাস লিখে (প্রকাশ ১৯৬৩)। দৈনন্দিন আমরা যেসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে সক্ষম বনাম প্রতি রাতে আমাদের মনের দুর্গম গোলকধাঁধায় যেসব মোহিনী, জাদুকরী ব্যাপার ঘটে -- তিনি তাঁর মধ্যেকার কোমল ভারসাম্যটিকে সবর্দা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে। এস্পানিওল ভাষা থেকে কবিতাদুটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন স্টিফেন কেসলার।]
জেন শোর (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৭- )
মালকিন
আমার নীড়ে তার বিশ্রাম, ডবল বেডে শুতো সে
আমার দিকটায়, থাক করে বই রাখতো --
আমার বই সব -- পড়া শেষ হলে নাইটস্ট্যান্ডে।
আলমারিতে তার ইস্ত্রি করা ড্রেস
আমার স্বামীর ট্রাউজারের গা ঘেঁষে।
শিশুর খেলনার সঙ্গে আমি সেগুলো
বাক্সবন্দি করে পাঠিয়েছি তার বাপের বাড়ি।
তার নীল টুথব্রাশ আর কচ্ছপখোলার চিরুনি
ফেলে দিয়েছি জঞ্জালে। পুলিস নিয়ে গেছে
গালচেটা। আর আমার দুটো ধারালো ছুরি।
কিন্তু হেঁশেলে এখনও তার মশলাপাতি ঘ্রাণ --
তার দারুচিনি, কারি পাউডার, লবঙ্গ।
সারা ঘরে ধূপধুনো অগুরুর
সুগন্ধি গোলকধাঁধা। প্রায় প্রতিদিন
খুঁজে পাওয়া যায় তার নতুন নতুন জিনিস।
যেমন লা ব্রেয়ার আলকাতরার খনি থেকে
মাঝে-মাঝেই উঠে আসে প্রাচীন অস্থি,
পৃথিবীর কালো পেশি তাদের
দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে দেয় ভূ-পৃষ্ঠে।
যোগব্যায়ামের মাদুর একটি।
আমার নিজেরই তো রয়েছে। আর কী দরকার?
জপের মালা। স্ট্র্যাপবিহীন ব্রা একটা।
সোনার আংটিটা। খুব সুন্দর।
খাপে খাপ আমার করে আঙুলে।
তার প্রিয় সাবানে হাত ধুয়ে আমি,
ঠান্ডা, শাদা একতাল মাটির মণ্ড সাবান।
একগাছি কালো চুল এখনো তার গায়ে লেগে।
তার জড়িবুটির চা-পাতা দিয়ে চা বানালে,
তার গন্ধতেল মাখলে, তার হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেলে,
তার হজমিগুলি (খুব ভালো কাজ দেয়,
বলেছিলো সে) খেলে অন্যায় হবে কি?
হলুদ বোতলটি প্রায় ভরা। নষ্ট করি কেন?
চারটে টকটক বড়ি মুখে ফেলি।
টীকা: “লা ব্রেয়া আলকাতরার খনি” (“La Breya Tar Pit”) -- এসপানিওল ভাষায় “লা ব্রেয়া” মানে “আলকাতরা”। তাই সঙ্গে “Tar Pit” জুড়ে দেবার প্রয়োজন নেই স্থান নামে। লস এঞ্জেলিস শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত এবং বর্তমানে একটি জাদুঘরের অংশ। এখন থেকে আবিষ্কৃত জীবাশ্ম দিয়ে প্রমান হয়েছে প্রাচীনকালে নানান জাতের ঘোড়া ও উটের বসবাস ছিল আমেরিকায়।
[জেন শোর এর সাম্প্রতিক গ্রন্থের নাম “সুখী পরিবার”। কবি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। “লাঙল” নাম একটি বিখ্যাত ক্ষুদ্রপত্র সম্পাদনা করতেন। সবমিলিয়ে ছ’টি কাব্যগ্রন্থ।]
লাম থি মাই জা (ভিয়েতনাম, ১৯৪৯- )
সায়গনের বৃষ্টি
একই সঙ্গে
আমাকে ভেজায়
বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি
সায়গনের বৃষ্টি
আর আবেগপ্রবণ প্রেমের বাণী
বন্য উদ্দামতায়
জলপ্রপাত হয়ে ভাসায়
মেঘ জমা আকাশ
পুরুষের বুকের মতন
ভারী, ঈষৎ বক্র
তার দরজা ভাঙে আর
দমকে দমকে বেরোয়
প্রেম প্রেম প্রেম
বিবাহিত নারী ভাসাতে পারে না নিজেকে
দগ্ধে মরি
যখন কন্যা ছিলাম
এমন বৃষ্টির দেখা পাই নি কেন
তুমি কি আমার উপযুক্ত?
ধানের দানা যদি পৃথিবীকে শুধোয়
তুমি কি আমার উপযুক্ত?
গাছ যদি বাতাসকে শুধোয়
তুমি কি আমার উপযুক্ত?
মেঘ যদি আকাশকে শুধোয়
তুমি কি আমার উপযুক্ত?
তুমি অনন্ত বিশাল আকাশ
আমি তাতে মেঘ হয়ে ভাসি
তুমি প্রবল বেগে বও বাতাস
আমি বৃক্ষ জড়াতে চাই তোমায়
তুমি গভীর গহন ধরিত্রী
আমি পাকা ধান সোহাগ করি তোমায়
কিন্তু প্রশ্নের রেশ থেকেই যায়
হৃদয়ের আনাচে কানাচে
তুমি কি আমার উপযুক্ত?
কর্পূর গাছের সারি
অন্তরে যেই বিষাদ জাগে
তোমার কাছে আসি
সারি সারি কর্পূর গাছ
আমার সুখের রাশি
সবুজ গোল পাতার ফাঁকে
জেড পাথরের আকাশ
ফলের মতন বাতাস ঝরে
ফিসফিসানি দূরের পথে বাঁকা
গাছের ছায়ায় হাঁটতে গিয়ে
ভাবি না: আমি শিশু
বৃক্ষ বাড়ে দৈর্ঘ্যে আড়ে
আমার মতোই, কী সুখ
অনুতাপে লাভ ক্ষতি কার
পাতায় হবে জরা
হলুদ পাতা দরজা হয়ে
আকাশটাকে সরায়
কর্পূরের গন্ধ আসে
সত্তায় ও নাকে
রাতের ঘুমে দিনের জাগায়
দেখতে পারি তাকে
সারি সারি কর্পূর গাছ
হুয়ে শহরে আমায়
ধরে রাখে বেঁধেও রাখে
বিষাদটাকে নামায়
[“লাম” তাঁর পদবি অথবা বংশনাম, “থি” অর্থাৎ তিনি এক নারী, “মাই জা” এর অর্থ “সুন্দর নিশীথিনী” (মা তাঁর এই নাম রেখেছিলেন); তিনি “লাম” পরিবারের কন্যা অথবা বধূ, যাঁর নাম “সুন্দর নিশীথিনী”। তিনি ভিয়েতনামের এক প্রধান কবি। প্রেম, প্রকৃতি, ভিয়েতনামের যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী জীবনযাত্রা নিয়ে তাঁর কবিতা। ভিয়েতনামি ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মার্থা কলিন্স এবং থুই দিন।]
রোবের্তো বোলানো (চিলে, ১৯৫৩-২০০৩)
প্রেমে দিওয়ানা কুকুর
অনেক কাল হল, বয়েস যখন আমার বিশ ছুঁই ছুঁই, আমি
আপাদমাথা উন্মাদ।
আমি হারিয়েছি স্বদেশ
কিন্তু জিতে নিয়েছি স্বপ্ন।
এবং সেই স্বপ্ন যতক্ষণ আমার সহায়
পরোয়া করি না অন্য কিছুর।
না করি কাজকর্ম, না করি পুজো,
না করি ভোরের আলোয়
প্রেমে দিওয়ানা কুকুরের পাশে বসে লেখাপড়া।
আমার অস্তিত্বের শূন্যতায় শিকড় গাড়ে স্বপ্ন।
আলো আঁধারের কম্বলে মোড়া
কাঠের শয়নকক্ষে
যা গ্রীষ্মমন্ডলের ফুসফুসের গভীরে বসানো।
মাঝে মাঝে আমি নিজের অন্তরে পিছু হটে
স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছোই: তরল ভাবনায়
চিরন্তন ভাস্কর্য,
কামনায় শিউরে ওঠা
শুভ্র কীট।
পলাতক প্রেম।
স্বপ্নের অভ্যন্তরে আরো এক স্বপ্ন।
দু:স্বপ্ন আমাকে ডেকে বলে: বয়েস বাড়বে তোমার।
যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি ও তার গোলকধাঁধা পিছনে ফেলে
এগোবে তুমি, ভুলেও যাবে তাদের।
কিন্তু অনেক কাল আগে, সেই বয়েস বাড়াটাও ছিল অপরাধ।
যা বলছিলাম, আমি এখন হাজির, প্রেমে দিওয়ানা
কুকুরদের সঙ্গে এবং এলাকা ছেড়ে নড়ছি না আমি।
[মূল কবিতার নাম: “লস পেররোস রোমান্তিকোস”।]
লুপে
মেয়েটি শরীর বেচতো লা গুয়েরেরো শহরে, জুলিয়নের বাড়ি থেকে
খানিকটা দূরে, বয়েস মোটে সতেরো, কোলের ছেলেটা মরেছে আঁতুড়ে।
ত্রেবোল হোটেলে আমার কক্ষটি প্রশস্ত, আলোকবিহীন,
বাথটব আর বিদে সমেত -- ঘরে কাটানো যায় কয়েক বছর -- সেখানে
সন্তানের স্মৃতিতে কেঁদেছিল সে। সেখানে বসে আমি লিখতে চেয়েছিলাম
বিভীষিকার কবিতাগুচ্ছ অথবা সন্দেহজনক
স্মৃতিচারণার গ্রন্থ। লুপে মেয়েটি
খ্যাংরাকাঠি রোগা, লম্বা ঊরুদুটোয়
চিতাবাঘের মতন ছোপ ছোপ।
প্রথমবার আমার যন্তর তো দাঁড়ালোই না:
তবে তাতে একেবারেই ভেঙে পড়ি নি আমি। লুপে তার
জীবনের কথা বলে যায়, কিসে তার সুখ হয়, সেই কথা।
এক হপ্তা পরে আবার দেখা -- রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে
পুরানো ক্যাডিলাকের গায়ে হেলান দিয়ে, অন্য কিশোরী বেশ্যাদের সঙ্গে।
দেখা হয়ে আমরা দুজনেই খুশি। সেদিন থেকে শুরু হল তার
মনের কথা বলা আমাকে: কখনো কাঁদতে কাঁদতে,
কখনো ঠাপাতে ঠাপাতে, অথবা হাত ধরাধরি করে
বিছানায় শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে, সর্বদা নগ্ন।
তার ছেলেটা পেট থেকে পরেই রুগ্ণ, লুপে মানত করেছিল
জাগ্রত মা মেরির কাছে -- বাচ্চাটি সেরে উঠলে
সে দেহব্যবসা ছেড়ে দেবে। দু-এক মাস কথা রেখেছিল,
কিন্তু ভাত না জোটায় ফিরে গেল নরকে।
কয়েকদিন পরে মরলো শিশুটি, লুপে বলে দোষটা তারই
মানত করেও সে কথা রাখতে সমর্থ হয় নি।
শপথ ভঙ্গের মূল্য হিসেবে মা মেরি নিজের হাতে
তুলে নিলেন তাঁর দেবশিশুকে ধরাধাম থেকে।
আমি কিছু উত্তর দিতে নারাজ তখন।
আমি শিশুদের পছন্দ করি অবশ্যই, কিন্তু
অনেক বছর পরে যখন সন্তান এলো আমার নিজের জীবনে,
বুঝলাম দুধের শিশুকে হারানো কতোটা ভয়াবহ হতে পারে।
তাই চুপ ছিলাম আমি, চরাচরে বা হোটেলের কোনো ঘরেই
শব্দের রেশ নেই, শিরশিরে আতংকজনক নীরবতা।
হয় দেওয়ালগুলো খুব পুরু অথবা কেউ নেই অন্য ঘরগুলোতে,
অথবা থাকলেও কেউ বলছে না কিছুই, শীৎকার তো নয়ই।
লুপের তরুণী শরীরে আরোহণ করা সোজা, নিজেকে
মনে হয় পুরুষালি আবার একই সঙ্গে হতভাগা।
লুপেও তালে তালে জঘন নেড়ে সাড়া দেয়, আর
তলঠাপের সঙ্গে সঙ্গে গল্প মারে -- বুকারেলি থিয়েটারে
নতুন কী রোমহর্ষক সিনেমা দেখেছে।
চিতাবাঘ ঊরু দিয়ে আশ্লেষে জড়ায় কোমর,
মাথা ডুবিয়ে দেয় আমার বুকে আর জিভ দিয়ে
খোঁজে আমার নিপল অথবা হৃদস্পন্দন।
এক রাত্তিরে বলে সে,
এখানটায় চোষো আমায়, খুব আরাম হবে।
কোথায় লুপে? তোমার হৃদয়ে?
[মূল কবিতার নাম: “লুপে”।]
[যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তিনি পুরোপুরি অপরিচিত পাঠক মহলে, কিন্তু ৫০ বছর বয়েসে অকাল মৃত্যুর দেড় দশক পরে এখন তিনি ভুবন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হিসেবে। কিন্তু তাঁর মতে,
“People are cowardly to their last breath. Poetry is the last thing that is not contaminated ….. Only poetry is not shit!” লেখকের কবিতাগুলিও তাঁর গল্প উপন্যাসের মতন: তাড়াহুড়ো করে লেখা। এসপানিওল ভাষা থেকে কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন লরা হিলি।]
[আগস্ট ২০২০. ক্রমশ:]
0 comments: