0

প্রবন্ধ - সোমব্রত সরকার

Posted in



















এক


সরল পুঁটি এনেছি প্রাণ, নতুন গাঙের মাছ নিবি কেউ, 
বউ দিদিরা ভালো করে বাছ, 
আমার পুঁটি দেখলে পরে, সোনা-রুপো ঝক্ মারে
বলতে পারি গুমোর করে, কোথা লাগে ইলিশ মাছ
জেলে আমার ধীরে ধীরে, খেপলা জালে মাছ ধরে
নাগর পটাই পাড়ায় ঘুরে, বেচি পুঁটি মাছ
সুখতারা ফুটলে পরে, জেলে মোর রয়না
ঘরে আঁচল ধরে আসে ঘরে, নাগ বাছের বাছ॥
জেলেনীর গীত

ভৌগোলিক সূত্রে ছোটো মফস্বলের যে অঞ্চলটিতে আমি থাকি তার পেছনেই রয়েছে আদি-অন্ত জেলেপাড়া। তাই ছোটোবেলা থেকেই এই জালিয়া সংস্কৃতির সঙ্গে আমি বিশেষ পরিচিত। শ্রাবণ মাসে এই পাড়ার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মনসা পুজো হয়ে থাকে। তাতে ছোটোবেলা থেকেই আমার নেমন্তন্ন। তবে কেনা হতো না কোনও মনসার মূর্তি। মনসা গাছই প্রতীক হিসেবে পুজো পেত। এখন অবশ্য কিছু বাড়িতে দেখি মূর্তি আসে, আবার ঘটেও পুজো সারে অনেকে। শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের যে কোনও শনি অথবা মঙ্গলবারে মনসা মায়ের পুজো হয় পাড়ার নিকটবর্তী মনসাতলায়। আবার সংক্রান্তির দিন হয় বিশেষ পুজো। পুজোর সেই একান্নবর্তী রীতি ক্রমে ক্রমে ভেঙে গিয়ে এখন ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত হয়। বেশ মনে আছে মনসা পুজো উপলক্ষে আগের দিনের ভাত, সজনে শাক সেদ্ধ, চালতা ও আমড়া দিয়ে মুসুর ডাল সেদ্ধ করে রাখা হয়। পুজোর দিন চিংড়ি মাছ পুড়িয়ে আগের দিনের রান্না করা পান্তাভাত, সজনে শাক সেদ্ধ, মুসুর ডাল সেদ্ধ দিয়ে মায়ের ভোগ হত। সেই ভোগ সকলকে বিতরণ করা হতো। জেলেপাড়ার কয়েকটা ছেলে আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। ওদের বাড়িতে পুজোর দিন আমি যেতাম; প্রসাদ খেতাম। প্রসাদী রান্নায় তেল দেওয়া হতো না। তবে পেঁয়াজের চল ছিল শাক্ত ঘরে। তারা সব পেঁয়াজ দিয়েই ভোগ লাগাত। জেলেদের এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তারাও এখন বংশানুক্রমের এই পেশাতে সবাই নেই। নানা কাজে বিভক্তি হয়েছে। বাইরে অনেকে সোনার কাজ করে। কুয়েতে, দিল্লি, মুম্বইতেও ছড়িয়ে গিয়েছে অনেকে। আমার সমবয়সীরা পরবর্তীতে ইস্কুল ছুট হলেও, এখন কয়েকজন কলেজের মুখ দেখছে। কেউ কেউ পুলিশ সহ প্রতিরক্ষা বিভাগেও ঢুকতে পেরেছে। এসব কারণে, তাদের বাড়ির পুজোতেও এখন বিবর্তন। পোড়া মাছের বদলে এখন মাছ ভাজা এবং নানা তরকারি রান্না করে ভোগ দেওয়া হয়। ফাল্গুন মাসে আবার ঘেঁটু পুজো হয়। ঘণ্টাকর্ণ ছিলেন শিবের উপাসক। শিব ছাড়া অন্য দেবতাদের নামগান যাতে তাঁর কানে প্রবেশ না করে কোনও ভাবেই, সেজন্য তিনি দু’ কানে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন বলে তাঁর নাম ঘণ্টাকর্ণ বা ঘেঁটু। এই ঘেঁটু পুজোর দিনে একটা হাঁড়িকে উপুড় করে তার ওপরে গোবরের আস্তরণ দিয়ে কড়ি দিয়ে চোখ-মুখ-কান আঁকা হয়। তারপর তাকে পুজো করায় হয়। এক টুকরো হলুদ মাখানো কাপড়, ঘেঁটুফুল — অনেকে আবার বলে ভাটফুল, ফল, বাতাসা দিয়ে এই পুজো সারা হয়। পুজো শেষে ঘেঁটু মূর্তি লাঠি দিয়ে মেরে ভেঙে ফেলা হয়। জেলেদের বিশ্বাস ঘেঁটু চর্মরোগ নিরাময় করেন। সেই বিশ্বাসে পুজোর পর হলুদ মাখানো কাপড় বাড়ির ছোটোদের গায়ে বোলানো হয়। কালী পুজোর দিন আবার গো-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। পাটকাঠি জ্বালিয়ে এবং কালী পুজোর জন্য সংগৃহীত বাজি ফাটিয়ে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এরপর মনসা পাতায় কাজল পেতে বাড়ির ছোটো ছেলেমেয়েদের পরানো হয়। গরুর কপালে সিঁদুরের ও চন্দনের টিপ দিয়ে, পা ধুইয়ে দুব্বোঘাস ও কলা খেতে দেওয়া হয়। সকলকে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠান শেষে ধামা বা কুলো বাজিয়ে মশা তাড়ানো হয়। সঙ্গে সুর করে বলা হয়, ‘ধারে মশা অমুকের বাড়ি যা’ ইত্যাদি গোছের নানা কথকতা। চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন হয় গাজনের মেলা। সংক্রান্তির দশ দিন বা পনের দিন, যে যেমন পারে সেই মতো আগে থেকে সন্ন্যাসব্রত নেয়। এই ব্রততে সকলের হয় শিবগোত্র। সংক্রান্তির আগে হয় নীল পুজো। তারপর চড়ক। চড়কে বাঁশের দু’-ডগায় দু’-জনকে ঝুলিয়ে চড়ক গাছে ঘোরানো হয়। জিভে বঁড়শিও গাঁথে কেউ কেউ। কাঁটা ভাঙা হয়। এই সব করে শরীরকে কষ্ট দিয়ে ভগবানের আশীর্বাদ চায় গাজনের সন্ন্যাসীরা। ব্রত চলাকালীন গাজনের সঙ বেরোয়। লৌকিক এই সব প্রথা এখন খানিক কমে এলেও একেবারে কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়নি। জালিয়া সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে এগুলো সব এখানে কেন, সমস্ত জায়গাতে, বিশেষত খোদ কলকাতাতেও একটা সময় প্রভূত সাড়া জাগিয়েছিল। সেই চালচিত্রের ধারাটা দেখবার আগে জালিয়া সংস্কৃতির অস্তিত্বটা বোধহয় বুঝে নেওয়া দরকার। তাহলে সামগ্রিক ছবিটি পেতে আমাদের সুবিধে হবে।

ক্রমশঃ

0 comments: