গল্প - অরুণ কর
Posted in গল্প
“All I ever wanted was to sit by a fire with someone who wanted me in measure the same to my wanting. To want to make a fire with someone, with you, was all.”- Kotie Ford
এক সপ্তাহের ট্রেনিংয়ের আজই শেষ দিন। প্রথমার্ধের শেষ ক্লাসটা সবে শেষ হয়েছে। চা-জল পানের ছোট্ট বিরতি চলছে। সতীর্থরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সাজানো গোছানো লনটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
আলোচনা হচ্ছিল একটু আগে যিনি ক্লাস নিচ্ছিলেন, তাঁকে নিয়ে। সুলোচনা সেন কোচবিহারের একটা ব্লকে আছেন। আমার এক বছরের সিনিয়র। আমিও এক সময়ে কুচবিহারে ছিলাম, ফলে আলাপ হওয়ার পর এই ক’দিনে আমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে। ট্রেনার ভদ্রলোক তেড়েফুঁড়ে যে ইংরেজি বলছিলেন, তাতে না ছিল ব্যাকরণের আপদ, না ছিল অ্যাকসেন্টের বালাই। তবে শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে গড়গড়িয়ে দিব্যি বলে যাচ্ছিলেন, সামান্যতম সঙ্কোচ, জড়তা কিংবা দ্বিধা ছিল না, কিছু শব্দোচ্চারণের মধ্য দিয়ে যেন না-জানার অহঙ্কার বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ছিল। পুরো ক্লাসটাই বড় আমোদে কেটেছে আমাদের।
এই প্রশিক্ষণ-কর্মশালায় যারা যোগ দিয়েছেন, তাঁরা সকলেই স্টেট সার্ভিসের অফিসার। সকলেরই মাতৃভাষা বাংলা। ফলে লেকচারটা বাংলায় হলে কিছু ক্ষতি ছিল না।
সুলোচনা বললেন, ব্যাপারটা বুঝলে না? ভদ্রলোকের নামের পেছনে যে তিন অক্ষরের লেজটা দেখছ, সেটা সদ্য গজিয়েছে। সম্প্রতি স্টেট সার্ভিস থেকে সেন্ট্রাল সার্ভিসে নমিনেশনের ফলে ফড়িংয়ের পক্ষীত্ব-লাভ। নিজের লেকচারের মধ্যে তাই উনি একটা সর্বভারতীয় ফ্লেভার আনতে চাইছিলেন। অনভ্যাসের লাঙ্গুল-সম্পদ, সেটা কী ভাবে প্রদর্শন করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না বলেই এই বিপত্তি। হঠাৎ অনির্বাণ এসে আমাকে এক কোণে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, খবরটা শুনেছিস?
আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। অনির্বাণ আমার পুরনো বন্ধু, কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়তাম, এখন ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টে আছে। অসম্ভব নাটুকে স্বভাব বলে ওর কথায় আমি সচরাচর গুরুত্ব দিই না। তাই হেসে বললাম, আজ খবরের কাগজে যে খবরগুলো ছাপা হয়েছে, তার বাইরের কিছু?
অনির্বাণ থমথমে মুখে বলল, না। এ খবরটা আজকের কাগজেই ছাপা হয়েছে, তবে খুব ছোট্ট বলে হয়তো সেভাবে কারও নজরে আসেনি।
সন্দেহ হল, ফের নাটক করছে না তো? আমি আবার ওর মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম, ওর চোখমুখ অসম্ভব সিরিয়াস। তবু খুব নিস্পৃহ ভাবে জিজ্ঞেস করলাম, কী খবর?
অনির্বাণ একটা মুখবন্ধ খাম এবং ভাঁজ করা একটা বাংলা দৈনিক আমার দিকে এগিয়ে ধরল। ছোট্ট খবরটুকু কলমের দাগ টেনে মার্কিং করা। বলল, আমারও চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। একটু আগে সব্যসাচী এসেছিল। আমাদের আগের ব্যাচের সব্যসাচী দত্ত, এক বার কলেজের জি এস হয়েছিল, মনে নেই? সব্যসাচী ওদের যেন কেমন আত্মীয় হয়, তোকে খবরটা দিতে বলল, সঙ্গে এই খামটা।
হঠাৎ আমার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। চোখ দুটো এমন ঝাপসা হয়ে এল যে হেডলাইনের পর আর একটা অক্ষরও পড়তে পারলাম না।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অনির্বাণ বলল, এ কী, তোর মুখটা এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, হ্যাঁ, মাথাটা খুব ধরেছে।
অনির্বাণ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, সে কী, এত ক্ষণ বলিসনি কেন? ওষুধ আনাব?
হড়বড় করে আরও কী সব যেন বলছিল ও। কিন্তু তার এক বর্ণও আমার কানে যাচ্ছিল না। আমি মাতালের মতো টলতে টলতে কোনও রকমে হোস্টেলের দিকে এগোলাম। পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ফিরে দেখি, অনির্বাণও আসছে। মুহূর্তে আমার কী যে হল, মেজাজ হারিয়ে খুব রুক্ষভাবে বললাম, ওহ! হোয়াই ডু ইয়্যু ফলো মি? লিভ মি অ্যালোন।
থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল অনির্বাণ। ও হয়তো আমার এমন রুঢ়তার জন্যে তৈরি ছিল না। ওর মনোযোগ-প্রত্যাশী মুখটা হঠাৎ নিভে আসা প্রদীপের মতো কালো হয়ে গেল। চূড়ান্ত অপমানিতের মতো মাথা নিচু করে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল।
আমি কোনও রকমে ঘরে ঢুকে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব ইচ্ছে করছিল, এক বার অন্তত চিৎকার করে কাঁদি। কিন্তু কিছুতেই আমার কান্না এল না। মনে হল, আমি যেন রোলার কোস্টারে চেপে অবিরাম এলোমেলো পাক খেয়ে চলেছি। অস্থির হয়ে উঠছে আমার সমস্ত চেতনা, কোনও ভাবনাই তাই স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
খবরের কাগজটা আবার চোখের সামনে মেলে ধরলাম, কিন্তু একটা অক্ষরও পড়তে পারলাম না।
দুই
“You open always petal by petal myself as Spring opens (touching skilfully, mysteriously) her first rose” - Edward Estlin Cummings
দক্ষিণবঙ্গের মানুষের কাছে উত্তরবঙ্গে পোস্টিং অনেকটা দ্বীপান্তরের মতো। তবু আমার প্রথম পোস্টিং কোচবিহারে হওয়াতে খুব একটা খারাপ লাগেনি। প্রথমত উত্তরবঙ্গের প্রতি আমার একটা চিরকেলে আকর্ষণ, তার উপর আবার নতুন চাকরি। পোস্টিং নিয়ে বাছাবাছির অবকাশও ছিল না।
কোচবিহারে যাওয়ার দু’এক দিনের মধ্যে বড় অদ্ভুত ভাবে ধৃতিকান্তের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
আগের দিন রাত থেকে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। কোচবিহারে বৃষ্টি শুরু হলে নাকি সহজে থামে না। একটা রিকশাকে কোনও রকমে ম্যানেজ করে কলেজে পোঁছে দেখি, কলেজ প্রায় ফাঁকা। স্টুডেন্টরা সংখ্যায় কম, টিচারদের মধ্যে ফিজিক্সের পিনাকীবাবু এবং পলিটিক্যাল সায়েন্সের দীপাঞ্জন বেরা এক কোণে বসে কোনও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক শুরু করে দিয়েছেন। বাইরে তখনও মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। আমি এক পাশে চুপচাপ বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম।
হঠাৎ সে এসে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, তুমিই মালবিকা?
নিখুঁত ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট, কণ্ঠস্বর ভরাট, গমগমে। মুখ তুলে দেখি, এক জন যুবক হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। বয়েস তিরিশের আশেপাশে, সাহেবদের মতো ধবধবে গায়ের রঙ, নীল চোখ, সুঠাম ঋজু শরীর, তীক্ষ্ণ উন্নত নাক। হঠাৎ দেখে মনে হল, বিদেশি বুঝি।
বললাম, ইয়েস। অ্যান্ড ইউ?
নিঃসঙ্কোচে হ্যান্ডশেক করার জন্যে সটান হাত বাড়িয়ে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমি ধৃতিকান্ত। এই কলেজে বছর দু’য়েক আছি, ইংরেজি পড়াই। মণিময় আমার বন্ধু। ইন ফ্যাক্ট তোমার কথা মণিময়ই আমাকে বলেছে।
মণিময় আমার মাসতুতো দাদার বন্ধু। কী সব পশুপাখির ছবি তুলে বেড়ায়, অসম্ভব ভালো আবৃত্তি করে। আমাদের স্কুলের রি-ইউনিয়নে বিনি-পয়সায় ছবি তুলতে এসে অনেকগুলো কবিতা আবৃত্তি করেছিল। বেশির ভাগই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। সেই থেকে মণিময়ের সঙ্গে যোগাযোগটা রয়ে গেছে। তবে তা ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপে, দেখাশোনা প্রায় হয় না বললেই চলে।
আমি হেসে বললাম, কী আশ্চর্য, মণিময়দা তো আমাকে কিছু বলেনি!
ধৃতিকান্ত হেসে বলেছিল, ও তো ওরকমই। কোনও কথাই পুরোটা বলে না। নিজেকে বরাবরই গুটিয়ে রাখতে ভালবাসে। তুমি কি জানতে, মণিময় খুব ভাল সাঁতারু? চন্দননগরের ঘাট থেকে এক সময়ে আমরা বাজি ধরে গঙ্গা এপার-ওপার করেছি। আমরা তো এক বার সাঁতার ম্যারাথনে মুর্শিদাবাদ থেকে বাগবাজার পর্যন্ত গিয়েছিলাম, কাগজে ছবিও বেরিয়েছিল। তবে ও নিজের থেকে এ সব কথা কাউকে বলে না। আমরা বললেও বিরক্ত হয়।
আর আপনি বুঝি নিজের কথা বলতে খুব ভালবাসেন?
হঠাৎ আমার সম্পর্কে তোমার এমন ধারণা হওয়ার কারণ?
না, মানে মণিময়দার কথা বলতে গিয়ে যে ভাবে নিজের ঢাক পেটাতে শুরু করেছেন!
ও কিন্তু আমার এই খোঁচায় বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ হল না। বরং হাসতে হাসতে বলল, কী করব বলো, আমার ঢাক আর কে-ই বা বাজাবে? তা ছাড়া নিজের ঢাক নিজে পেটানোই তো সেফ, তাতে অন্তত ফেঁসে যাওয়ার ভয় থাকে না।
কার ফেঁসে যাওয়ার ভয়? নিজের না ঢাকের?
তোমার সঙ্গে দেখছি সাবধানে কথা বলতে হবে! না হলে—
ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কা?
আমার কথা শুনে হোহো করে হেসে উঠল ধৃতিকান্ত। বলল, না! তোমার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা আমার কম্ম নয়!
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। এমন ভুবনমোহন হাসি আমি খুব কমই দেখেছি। পাছে এই মুগ্ধতাটুকু ওর নজরে পড়ে যায়, তাই মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, তা হলে সে চেষ্টা না করাই ভাল।
এর পর প্রায় প্রত্যেক দিন ওর সঙ্গে দেখা হতে লাগল। কোনও দিন মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, কী ম্যাডাম, নতুন জায়গা, কেমন লাগছে? আবার কোনও দিন বলে, কী, বাড়ির জন্যে মন খারাপ করছে না তো? জায়গাটা কিন্তু কলকাতা থেকে অনেক দূরে, ইচ্ছে হলেই হুট করে পালানো যায় না!
কয়েকদিন পর বিকেলে কলেজ থেকে বেরোচ্ছি, এমন সময় ফের ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল ধৃতিকান্ত। কাছাকাছি পৌঁছে বুঝলাম, মেয়েগুলো ধৃতিকান্তের কাছে প্রাইভেট টিউশন পড়তে চায়, সে বিষয়েই কথা হচ্ছে। ধৃতিকান্ত কিছুতেই রাজি নয়, অথচ মেয়েগুলো নাছোড়বান্দা। আমাকে আসতে দেখে ও খুব খুশি-খুশি গলায় বলল, ম্যাডাম, একটু দাঁড়াবেন, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
ফের আমার অবাক হওয়ার পালা। প্রথম পরিচয়ে যে ‘তুমি’ দিয়ে শুরু করেছিল, সে কেন হঠাৎ ‘আপনি’ বলছে ভেবে পেলাম না। আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ও হেসে বলল, এই যাদের আপনি দেখছেন, এরা সকলেই ইংলিশের ছাত্রী, তবে দুজন আমাদের কলেজের, বাকিরা কোচবিহার কলেজের। এরা সকলেই আমার কাছে পড়তে চায়। কী করি বলুন তো?
আমার ধন্দ আরও বেড়ে গেল। আমাদের পরিচয় হয়েছে মাত্র কয়েকদিন। এর মধ্যেই এমন একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে পরামর্শ চাওয়ার মানে কী? আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেমন যেন ছেলেমানুষের মতো দুষ্টুমিভরা মুখে ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ধৃতিকান্ত মেয়েদের দিকে ফিরে বলল, এমনিতে পড়াতে আমার ভালই লাগে। এই মাগ্গি-গন্ডার বাজারে বাড়তি কিছু টাকাও পাওয়া যায়। কিন্তু একটা ছোট্ট সমস্যা হয়েছে। আগামী মাসেই আমার বিয়ে, মাসখানেক তো বটেই, একটু বেশিও হতে পারে, আমাকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় যেতে হবে।
তার পর আমার দিকে ফিরে বলল, ওই সময়টুকু কি আপনি এদের একটু দেখিয়ে দিতে পারবেন? বুঝতেই পারছেন, মাস তিনেক বাদে ওদের পরীক্ষা...
মেয়েগুলো যেন একটু মিইয়ে গিয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
ধৃতিকান্ত আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে হঠাৎ মনে পড়েছে, এমন ভাবে বলল, ওহ, স্যরি! ম্যাডামের সঙ্গে তো তোমাদের পরিচয়ই করানো হয়নি। উনি মালবিকা সান্যাল, আমাদে কলেজে ইংলিশের লেকচারার হিসেবে সদ্য জয়েন করেছেন। খুব ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট ম্যাডামের, ইউনিভার্সিটি টপার।
ওদের মধ্যে একটা মেয়ে দেখলাম বেশ সপ্রতিভ। সে বলল, তা হলে তো ভালই হল। আমরা বরং পড়ার ব্যাপারে ম্যাডামের সঙ্গে পরে কথা বলে নেব। থ্যাঙ্ক ইউ স্যর।
মেয়েরা চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ হল বৃষ্টি ধরে গিয়ে সুন্দর লালচে রোদ উঠেছে। কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাটাকে ডাকতে যাব, এমন সময় ধৃতিকান্ত বলল, তুমি তো বেশি দিন এ শহরে আসোনি। যদি খুব তাড়া না থাকে, তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারি। আশা করি তোমার ভালো লাগবে।
খুব অবাক হলাম। ক’দিনের মাত্র পরিচয়, এর মধ্যেই একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব! কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সম্পূর্ণ অপরিচিত কারও সঙ্গে এমন হুট করে কোথাও যাওয়া উচিত হবে কি না ভাবছিলাম। তবে ওর বলার মধ্যে এমন এক সহজ আত্মীয়তা ছিল যে চট করে না-ও বলতে পারলাম না। আমার মৌন সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে ও নিজেই রিকশা ডাকল।
জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছি আমরা? ও হেসে বলল, গেলেই বুঝতে পারবে! তুমি কিটস-এর সেই অমোঘ শব্দবন্ধ পড়োনি? Heard melodies are sweet, but those unheard, are sweeter.
রিকশাওয়ালাকে বলল, কাকা, ফাঁসিঘাট চলো।
কোচবিহারে ‘কাকা’ খুব প্রচলিত সম্বোধন। আমি ছদ্ম ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ফাঁসিঘাট? বাপ রে, কী বিদঘুটে নাম! শুনলেই যেন গলায় ফাঁস লাগার কথা মনে হয়! ধৃতিকান্ত হাসতে হাসতে বলল, ফাঁস লাগার জন্যে কোথাও যাওয়ার দরকার হয় না কি? সে তো আপনা থেকেই লাগে।
একটা ছোট্ট কাঠের সেতু পার করে রিকশাওয়ালা যেখানে নামিয়ে দিল, দেখলাম সেটা একটা খেয়াঘাট। বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি অস্থায়ী গুমটি, এক জন লুঙ্গি-পরা লোক মাচার উপর বসে পারাপারের পয়সা নিচ্ছেন। সামনেই ভয়ঙ্কর স্রোতস্বিনী তোর্সা। ভরা বর্ষায় ফুলেফেঁপে যেন ফুঁসছে। নদীর ওপারে যতটা চোখ যায়, শুধু জল আর জল। এমন প্রবল সে জলের তোড় যে খড়কুটো পড়লে বোধ হয় নিমেষে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার কাছেই ঝুপ করে অনেকটা পাড় ভেঙে জলের তোড়ে ভেসে গেল। আমার বুকের মধ্যেটা কেমন যেন কেঁপে উঠল।
গুমটির লুঙ্গি-পরা লোকটা চেঁচিয়ে বলল, বেশি ধারে যাইয়েন না। দ্যাহেন না, পাড় ভাঙতাছে! ব্যাবাক মাঠখানারে গিলা ফ্যালাইছে। আমার ভীত-বিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে ধৃতিকান্ত বলল, জায়গাটা ভয়ঙ্কর সুন্দর, তাই না? নদীর এমন দুর্নিবার প্রাণোচ্ছল রূপ আগে কখনো দেখেছ? উপরে ভুটান পাহাড়ে যদি বৃষ্টি বাড়ে, তা হলে দু’এক দিনের মধ্যে বাঁধের কানায় কানায় জল উঠে যাবে। আমার কী যে ভাল লাগে, মানুষের মন আর নদী, দু’কূল ছাপাতে শুধু একটা প্লাবনের অপেক্ষা।
ধৃতিকান্তর চোখমুখ যেন কেমন এক অপার্থিব আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বেলাশেষের মেঘভাঙা আলোয় মনে হল, ওর নীল চোখে যেন রাশি রাশি স্বপ্ন ভিড় করে আছে। কেমন স্বপ্নাচ্ছন্ন গলায় ও গেয়ে উঠল, “Ol’ man river/ Dat ol’ man river/ He mus’ know sumpin...”
সেই পড়ন্ত বিকেলে প্লাবন-ব্যাকুল ভাঙন-বিধ্বস্ত তোর্সার পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর গলায় পল রোবসন শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম।
সন্ধেবেলায় ও যখন আমাকে আমার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল, তখন মনে হল, আমি যেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, নিজের কাছেই অচেনা।
তিন
“Love alters not with his brief hours and weeks, but bears it out even to the edge of doom.”-William Shakespeare
আমি বেশ বুঝতে পাছিলাম, ধৃতিকান্ত যেন আমাকে চুম্বকের মতো টানছে। প্রতিদিনই আমি ছুটির ঘণ্টার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকি। কোনও দিন বেরিয়ে আমরা গল্প করতে করতে রাজবাড়ি চলে যাই, আবার কোনও দিন কোনও রেস্তরাঁয় বসে ধৃতিকান্তের মুখে শেক্সপিয়র থেকে শেলি, মার্ক্স থেকে চে গুয়েভারার ব্যাখ্যা শুনি। এত ভাল বলে ধৃতিকান্ত, মনে হয় এত কাল ধরে আমার যা কিছু জ্ঞান, যা কিছু পড়াশুনো, সবই অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো— অসার এবং অপূর্ণ।
মাঝে মাঝে নিজেই অধৈর্য হয়ে পড়ি। নিজেকেই প্রশ্ন করি, ধৃতিকান্তের কাছে আমার কি কোনও গোপন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে? আমি কি ওর কাছ থেকে কলেজ, রাজনীতি, দর্শন, এসবের বাইরে অন্য কিছু শোনার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছি? পরক্ষণে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে বলি, তা কী করে সম্ভব? মাসখানেকের মধ্যেই যার বিয়ে হওয়ার কথা, সে আমাকে নতুন কিছু বলবেই বা কেন, আর আমি শুনবই বা কেন?
প্রতিটি দিন আমি নিজের সঙ্গে নিজের দ্বন্দ্বে দীর্ণ হতে থাকি।
এক দিন ও আমাকে নিয়ে গেল তোর্সার বাঁধের গা-ঘেঁষা কোচবিহারের রাজাদের সমাধি মন্দিরে। জেলা প্রশাসন থেকে সুন্দর পার্ক তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। অজস্র ফুলের কেয়ারি। বিকেলবেলা মা-ঠাকুমার হাত ধরে বাচ্চারা খেলতে এসেছে। প্রতিটি সমাধির গায়ে রাজাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পড়তে পড়তে ও বলল, দেখেছ, এখানকার রাজারা কত স্বল্পায়ু ছিলেন? তবু প্রজারা তাদের মনে রেখেছে। তুমি লক্ষ্য করলে দেখবে, এখনও এখানকার মোটর ড্রাইভিং স্কুল থেকে ছোট দোকান, অনেকগুলোরই নাম রাজাদের নামে! আসলে আয়ুটা কোনও ফ্যাক্টর না। মূল কথা হল, বাঁচার মতো করে বাঁচা। সেই ধন্য নরকুলে, লোকে যারে নাহি ভুলে, মনের মন্দিরে নিত্য—
হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলল, কী হল, তুমি অমন করে চেয়ে আছ কেন? ভাল লাগছে না জায়গাটা?
আমি বললাম, না। জায়গাটাও ভাল লাগছে না, তোমার কথাও ভাল লাগছে না। এসব প্যানপানানি সেন্টিমেন্টের কথা শুনতে আমার ভাল লাগে না।
ধৃতিকান্ত কী বুঝল কে জানে, বলল, তবে চলো, ফেরা যাক।
কয়েকদিন পরে অফ পিরিয়ডে কলেজের লাইব্রেরিতে বসে পাবলো নেরুদা পড়ছিলাম। এমন সময় কেমিস্ট্রির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট শিবতোষ ভট্টাচার্য এলেন। এর আগে আমার সঙ্গে এক দিনই মাত্র ওঁর কথা হয়েছিল। ভদ্রলোক যেমন রোগা, তেমন ঢ্যাঙা। এই ক’দিনেই আমি জেনে গেছি, ছাত্ররা আড়ালে ওঁকে ‘কঙ্কাল স্যর’ বলে ডাকে। খুব খিটখিটে স্বভাব বলে সকলেই ওঁকে এড়িয়ে চলেন। ভদ্রলোক হঠাৎ কোনও ভূমিকা ছাড়াই বললেন, তুমি কি ওদের সমিতির মেম্বারশিপ নিয়েছ?
কলেজ শিক্ষকদের এখন একাধিক সংগঠন, তাই উনি ‘ওদের’ বলাতে বুঝতে না পেরে বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম, কাদের সমিতির কথা বলছেন?
ভদ্রলোক স্পষ্টতই বিরক্ত হলেন। বললেন, কেন ধৃতিকান্ত সংগঠনের বিষয়ে তোমাকে কিছু বলেনি?
উনি গলার স্বর নিচু করে বললেন, তোমার বয়েস কম, সবে চাকরিতে জয়েন করেছ, সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, খবরদার, ওদের খপ্পরে পোড়ো না যেন।
আমি বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি দেখে ওঁর বুঝি একটু করুণা হল। বললেন, আর একটা কথা। শিক্ষকতা যে আর পাঁচটা পেশার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। বিষয়টা যদিও একান্তই তোমার ব্যক্তিগত, তবু বলি, ধৃতিকান্তের সঙ্গে তোমার মেলামেশা নিয়ে কিন্তু এর মধ্যেই নানা কথা উঠতে শুরু করেছে। কোচবিহার ছোট্ট শহর, এখানে অখ্যাতি ছড়াতে সময় লাগে না।
ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। কলেজে শিক্ষকতা করতে আসা এক জন মানুষ কার সঙ্গে মিশবেন, কোন সংগঠন করবেন, সেটা উনি ঠিক করে দেবেন! রাগে আমার চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। উনি তখনও নির্বিকার ভাবে বলে চলেছেন, তা ছাড়া ধৃতিকান্ত লোকটা কিন্তু মোটেই সুবিধের নয়। বিরুদ্ধ-পলিটিক্সের কথা বলে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ খেপানোই ওর কাজ। আর তোমাদের মেয়েদেরও বলিহারি! কী দেখে যে ঝাঁপিয়ে পড়ো, তোমরাই জানো! তবে একটা কথা বলে রাখি। এ পর্যন্ত কতগুলো মেয়ে যে ওর পাল্লায় পড়ে গোল্লায় গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। নাম্বার ওয়ান ওম্যানাইজার! তবে আমরাও তক্কে তক্কে আছি, একটা অভিযোগ পেলেই—
আমি ভেতরে ভেতরে ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছিলাম। ভদ্রলোকের অযাচিত উপদেশ এবং কুৎসিত মন্তব্যগুলোর কী জবাব দেব ভাবছি, এমন সময় ধৃতিকান্ত এসে বলল, ও তুমি এখানে? আমি তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। তার পর শিবতোষবাবুর দিকে ফিরে বলল, কী স্যর, এঁকে সব ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিয়েছেন তো?
শিবতোষবাবুর কালো মুখটা রাগে বেগুনি হয়ে উঠল। ধৃতিকান্ত হাসতে হাসতে বলল, আসলে স্যর আমাকে খুব স্নেহ করেন তো, তাই সুযোগ পেলেই প্রশংসা শুরু করেন।
শিবতোষবাবু রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন, আই সয়্যার, আই উইল সি য়্যু। ধৃতিকান্ত মুখের হাসিটি ধরে রেখে বলল, সে তো জানি স্যর। আপনি মহান মানুষ, পিতিগ্যে করার দরকার নেই, আপনার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে।
শিবতোষবাবু আর দাঁড়ালেন না।
ধৃতিকান্ত বলল, দিন তিনেকের ছুটি নিয়েছি, কলকাতায় যাব। কথাটা তোমাকে অবশ্য টেলিফোনেও বলা যেত—
আমি বললাম, ও, সেই বিয়ের ব্যাপার বুঝি? তা সে তো তোমার মাসখানেকের ছুটি নেওয়ার কথা ছিল। তিন দিনে কি বিয়ে সারা যায়?
ধৃতিকান্ত হো হো করে হেসে উঠল। বলল, না। আপাতত বিয়ের সমস্যা মিটেছে। অল্পবয়সি ছাত্রীরা ইয়ং ব্যাচেলার টিচারের কাছে পড়ার জন্যে এত উৎসাহী, যে বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে আমাকে নানা মিথ্যে বলতে হয়। আমি অবশ্য ওদের দোষ দিই না। পাত্র হিসেবে আমি যে ফেলনা নই, এ কথা নিশ্চয়ই তুমিও মানবে?
আমি মুখ বেঁকিয়ে বললাম, না মেনে আমার উপায় আছে?
আমি হয়তো ওর রসিকতার জবাবে একটু হালকা রসিকতা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নিজের কথা নিজেরই কানে কেমন যেন বেসুরো লাগল। দেখলাম, ধৃতিকান্তও হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেছে। একটু চুপ করে থেকে ও বলল, হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, তোমার সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখে সকলেই ধরে নিয়েছে, আমরা মনে হয় পরস্পরের প্রেমে পড়েছি। কোচবিহার ছোট্ট জায়গা তো, ইতিমধ্যেই কথাটা সারা শহরে চাউর হয়ে গেছে। কেন, শিবতোষবাবু তোমাকে কিছু বলেননি? উনি তো কলেজের স্বঘোষিত মর্যাল গার্ডিয়ান!
ধৃতিকান্ত চলে গেল। আমার সন্দেহ হল, ও কি স্রেফ এ কথাটাই বলতে এসেছিল? আমার দু’চোখ যেন জ্বালা করতে লাগল। ধৃতিকান্তের বলা ‘আমরা মনে হয় পরস্পরের প্রেমে পড়েছি’ কথাটা আমার মনের মধ্যে বার বার পাক খেতে লাগল।
তবে কি এটা সত্যি নয়? ও কি ‘সকলেই ধরে নিয়েছে’ বলে ইচ্ছে করে আমাকে আমাদের দুজনের মাঝখানে একটা অলঙ্ঘ্য কাচের দেয়াল তুলতে চাইছে? নিজের মতো করে মনের পর্দায় ভিড় করা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে দেখলাম, কোনওটাই পছন্দ হচ্ছে না।
হতাশ হয়ে একটা রিকশা ডাকলাম।
চার
“This poem is endless, the odds against us are endless, our chances of being alive together statistically non-existent; still we have made it”-Lisel Mueller
নতুন বছরে ছাত্র ভর্তি নিয়ে কয়েকদিন ধরে কলেজে বেশ গোলমাল শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই স্লোগান শাউটিং, পিকেটিং, পাল্টা পিকেটিং চলছে। এক দল চাইছে, ভর্তি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে। বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির জন্যে যারা পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের মেধা তালিকার সঙ্গে প্রাপ্ত নম্বরও প্রকাশ করতে হবে। ভর্তির নামে তোলাবাজি বন্ধ করতে হবে।
আর এক দলের দাবি, ছাত্র সংসদের সঙ্গে পরামর্শ এবং আলোচনা করে তবে মেধা তালিকা চূড়ান্ত করতে হবে। গত কয়েকদিন ধরে কথায় কথায় তারা ক্লাসে ঢুকে পড়ে ক্লাস ভন্ডুল করে দিচ্ছে। গেটে দাঁড়িয়ে পিকেটিং করার নামে বিরোধী শিবিরের ছাত্র-শিক্ষকদের দেখলেই কটূক্তি করছে। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে ধৃতিকান্ত ওদের পয়লা নম্বর টার্গেট। সব মিলিয়ে খুব বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
কলেজের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ এই ছাত্রদের পক্ষে। তারা সকাল-বিকেল ধৃতিকান্তের মুন্ডুপাত করছে। ওদের অভিযোগ, স্বচ্ছতার ধুয়ো তুলে যারা ভর্তি প্রক্রিয়া বানচাল করার চেষ্টা করছে, ধৃতিকান্তই তাদের মেন্টর।
ধৃতিকান্ত কিন্তু অদ্ভুত রকম শান্ত এবং নির্বিকার।
সে দিন সকাল থেকেই কলেজে উত্তেজনা বাড়ছিল। দু’দল ছাত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে মিছিল করছে, স্লোগান দিচ্ছে, এর মাঝেই আমরা লক্ষ্য করলাম, কিছু বাইরের মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে কলেজের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারা বেছে বেছে একটা বিশেষ সংগঠনের ছাত্রদের মারতে শুরু করল। আমরা, শিক্ষকরা নিরপেক্ষতা এবং শান্তির পরাকাষ্ঠা হয়ে স্টাফ রুমে নিশ্চেষ্ট দার্শনিকের মতো বসে রইলাম। একমাত্র ধৃতিকান্ত সেই রণাঙ্গনে নেমে গিয়ে ছাত্রদের পাশে দাঁড়াল। বুক চিতিয়ে চিৎকার করে বলল, কারা আপনারা? সাহস থাকলে আগে আমাকে মারুন, তার পর ওদের গায়ে হাত দেবেন।
ধৃতিকান্তের দেখাদেখি আরও দু’একজন শিক্ষক বেরিয়ে আসতে আক্রমণকারীরা পালিয়ে গেল। ততক্ষণে সংখ্যায় হীনবল ছাত্রদের কারো মাথা ফেটেছে, কারও হাত ভেঙেছে। শারীরিক হেনস্থা থেকে ছাত্রীরাও বাদ যায়নি। ধৃতিকান্ত কোত্থেকে একটা গাড়ি জোগাড় করে আহত ছাত্রদের নিয়ে হাসপাতালে ছুটল। বিকেলের দিকে শ্মশানের মতো নীরব শান্তিপূর্ণ কলেজ থেকে বেরিয়ে ধৃতিকান্তকে যখন ফোন করলাম, ও তখন আহত ছাত্রদের নিয়ে এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে ছোটাছুটি করছে।
কলেজে গন্ডগোলের খবর পেয়ে পর দিনই এক স্থানীয় নেতা এলেন মধ্যস্থতা করতে।
স্টাফ রুমে তখন নেতার আগমন নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। শিবতোষবাবুর নেতৃত্বে বেশ কিছু শিক্ষকের বক্তব্য, এক জন সংবেদনশীল নেতা হিসেবে কলেজের অচলাবস্থা দূর করার চেষ্টা ওঁর নৈতিক কর্তব্য। এ ক্ষেত্রেও ধৃতিকান্তই একমাত্র প্রতিবাদী। সে গলা ফাটিয়ে বলে যাচ্ছিল, এটা কলেজের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে বাইরের কারো নাক গলানোর কোন এক্তিয়ার নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা! গলার জোরে শিবতোষবাবু একাই একশো। তার উপর বেশির ভাগ টিচার পোঁ ধরার জন্যে এগিয়ে আসায় সে বেচারা কোণঠাসা হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদে নেতামশাই খবর পাঠালেন, সরকারের নির্দেশে তিনি প্রিন্সিপ্যাল এবং শিক্ষকদের সঙ্গে মিটিং করতে চান। সবাই যেন প্রিন্সিপ্যালের ঘরে চলে যান।
মুহূর্তে স্টাফ রুম খালি হয়ে গেল। বেশির ভাগই নেতার আহ্বানে আপ্লুত হয়ে দৌড়লেন। বাকি যে দু’এক জন বসে ছিলেন, তাঁরা কী সব কাজ আছে বলে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেলেন। শুধু আমি আর ধৃতিকান্ত সেই বিশাল স্টাফ রুমে বসে রইলাম। সম্পূর্ণ নির্বাক। সেই অদ্ভুত দ্বিপ্রহরে আমাদের দুজনকেই যেন এক অদ্ভুত শীতল বিষণ্ণতা গ্রাস করল।
এ ভাবে কত ক্ষণ কেটেছিল জানি না, হঠাৎ বেশ কিছু উত্তেজিত কণ্ঠের সম্মিলিত চিৎকার শুনে চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি, কয়েকজন অপরিচিত লোক রে-রে করে তেড়ে আসছে। আমাদের দুজনকে স্টাফ রুমে বসে থাকতে দেখে তারা প্রথমে অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করল। তার পর এক জন এগিয়ে এসে ধৃতিকান্তের কলার ধরে চিৎকার করে উঠল, হালার পো হালা, কলেজের স্টাফ রুমডা কি তোমাগো বেডরুম পাইছ? এইহানে বইয়া বইয়া পিরিত মারাইতাছ? মারমুখী লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হল, বহু দিন আগেই তারা ছাত্রজীবন পেরিয়ে এসেছে। আমি ধৃতিকান্তকে ছাড়াবার জন্যে উঠে কাছে যেতেই ওদের মধ্যে এক জন এসে জোরে আমাকে ধাক্কা দিল। মনে হল, আমার মাথাটা শক্ত কিছুতে যেন ঠুকে গেল। নিমেষে আমার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে এল।
জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম, আমি এম জে এন হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি।
দিন তিনেক পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বেরোতে যাব, এমন সময়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন ছাত্র এসে বলল, ম্যাম, আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। স্যর আপনাকে এটা দিতে বলে গেছেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, স্যর মানে?
সে বলল, ডি এস স্যর।
আমি উত্তেজিত গলায় ফের জিজ্ঞেস করলাম, বলে গেছেন মানে? স্যর কোথায় গেছেন?
ছেলেটা মুখ নিচু করে বলল, আপনি শোনেননি ম্যাম, স্যরকে তো গত পরশু পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।
আমি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলছ তুমি? কেন?
ছেলেটি বলল, সে অনেক কথা ম্যাম। আপনাকে যে দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হল, তার পরের দিন আমরা কলেজ গেটে পিকেটিং করছিলাম। দেড়টা নাগাদ দেখলাম একটা পুলিশ ভ্যান কলেজে ঢুকল। আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো আমাদের পিকেটিং তুলে দেওয়ার জন্যে পুলিশ ডাকা হয়েছে। আমরা আরও জোরে জোরে স্লোগান দিতে শুরু করলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের কিছু না বলে কলেজের মধ্যে ঢুকে গেল। পরে যখন ভ্যানটা বেরোচ্ছে, তখন দেখলাম, স্যর ওই ভ্যানে বসে আছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে এটা আমার হাতে দিয়ে আপনাকে দিতে বলে গেলেন।
কিন্তু কলেজে গোলমালের জন্যে ওকে অ্যারেস্ট করবে কেন? বাইরের লোক ঢুকে কলেজে গুন্ডামি করল, মহিলাদের গায়ে হাত দিল—
ছেলেটা বলল, আমি যত দূর শুনেছি ম্যাম, স্যারের বিরুদ্ধে কেউ নাকি অন্য অভিযোগ করেছে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে—
আমি কাগজ খুলে দেখলাম, ধৃতিকান্ত লিখেছে, জানি না আর ফিরব কি না, কিংবা ফিরলেও তোমার যোগ্য থাকব কি না। একটা অনুরোধ। শিক্ষাঙ্গনে এই দুষ্কৃতীদের দেখে তোমরা, যাদের আমি বন্ধু বলে বিশ্বাস করি, তারা যেন পালিয়ে যেয়ো না। এই চরম প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে লড়াই করার নামই তো জীবন। আমার বিশ্বাস, আমরা সম্মিলিত ভাবে ঘুরে দাঁড়ালে হয়তো সময় বদলাবে।
পাঁচ
“Oh plunge me deep in love — put out my senses, leave me deaf and blind, swept by the tempest of your love, a taper in a rushing wind.”- David C. Dickau
এর পর ধৃতিকান্তের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। কোচবিহারের চাকরি ছেড়ে চলে আসার পর জেলখানায় যত বার ওর সঙ্গে দেখা করতে গেছি, প্রতি বারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। ও দেখা করেনি। শুনেছিলাম, ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। শীঘ্র ছাড়া পাবে জেল থেকে।
হোস্টেলে ঢুকে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে দিলাম। তার পর সব্যসাচীর মাধ্যমে ধৃতিকান্তের পাঠানো মুখবন্ধ খামটা খুলতেই ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজের সঙ্গে খানিকটা লাল আবির ছড়িয়ে পড়ল। মনে পড়ে গেল, সে বার দোলের সময় আমিই দুষ্টুমি করে ওকে খামে ভরে এই আবির পাঠিয়েছিলাম।
কাগজটার ভাঁজ খুলে অবাক হয়ে গেলাম। ধৃতিকান্ত লিখেছে, তুমি যে কথা বার বার বলতে চেয়েও বলোনি কোনও দিন, তা শোনার জন্যে আমি ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিলাম। আমারও অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু আজ হয়তো আমরা কেউই আর সে কথা বলার বা শোনার যোগ্য নেই। পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো।
আমার দু’চোখে বাঁধভাঙা বন্যা নেমে এল। কোলের উপর ওর আত্মহত্যার সংবাদবাহী খবরের কাগজখানা আমার চোখের জলে ক্রমশ ভিজে উঠতে লাগল। আমি চুপ করে বসে রইলাম।
বেশ
ReplyDelete