1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অবন্তিকা পাল

Posted in



প্রত্যাখ্যানের নিরিখে যে যাপিত জীবনের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা যায়, প্রায়-দীর্ঘ ৭১ বছর ব্যাপী তা কখনোই সরলরৈখিক স্রোতে বহমান হয়নি। শ্রুত আছে ঈশ্বরচন্দ্র বাল্যবেলায় সংখ্যা শিখেছিলেন বাবার হাত ধরে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে। চলতি ব্যবস্থার সুখপ্রদ অবস্থাগুলিকে এই ব্যক্তিই প্রাপ্তবয়সে যেভাবে প্রত্যাখ্যান করতে করতে এগিয়েছেন, সেগুলিকে তাঁর ব্যক্তিজীবনের মাইলস্টোন বলে ভাবা যেতে পারে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ১৮৪১-এ, ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভের সমসময়ে মাত্র ২৪ বছর বয়সে প্রথমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান হলেন। সেই কলেজ ছেড়ে দিলেন ১৮৪৬-এ। ওই বছরেই যোগ দিলেন সংস্কৃত কলেজে, সহ-আধিকারিক হিসাবে। ঠিক তিন বছর পর রসময় গুপ্তের সঙ্গে বিরোধবশত সংস্কৃত কলেজ পরিত্যাগ করলেন ১৮৪৯ সালে। এরপরে আবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রধান-করণিক হিসাবে কাজে যোগ দিলেন। ততদিনে কিন্তু লেখক হিসাবে ঈশ্বরচন্দ্রের অস্তিত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এতদসত্ত্বেও সংসার প্রতিপালন, এবং মূলত সামাজিক ক্রিয়াগুলি অব্যহত রাখার জন্য তাঁকে চাকরি করে যেতে হচ্ছে। দেড় বছর পর, অর্থাত্‍ ১৮৫০-এর ডিসেম্বরে ফের ফোর্ট উইলিয়াম ছেড়ে তিনি ফিরে এলেন সংস্কৃত কলেজে। নিলেন সাহিত্যের অধ্যাপক ও সেক্রেটারি পদের গুরুদায়িত্ব। এর ঠিক এক মাস পর তিনি ওই কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন হলেন। চলতে থাকল বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয় রচনার কাজ। একইসঙ্গে শ্রেণি নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষার প্রচার, নারীশিক্ষার উন্মেষ ও সর্বোপরি বাল্যবিবাহ রদ এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের ঐকান্তিক প্রয়াস। আট বছর যাবত্‍ সাফল্যের সঙ্গে অধ্যক্ষ পদ বহন করার পর, ১৮৫৮ সালের নভেম্বরে, ৩৯ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করলেন। এমনকি সরকারের সঙ্গেও তাঁর যাবতীয় সংযোগ ছিন্ন করলেন।

এরপর জন্মভিটে বীরসিংহ ত্যাগের পালা। ১৮৬৯-এ স্কুলের হেডপণ্ডিত মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় জনৈকা বিধবাকে বিবাহের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। এই মুচিরামের ভিক্ষা-সম্পর্কে হালদার পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। হালদার পরিবার চাননি এ বিবাহ সম্পন্ন হোক। তাঁর বিবাহ রোধে ঈশ্বরচন্দ্রের শরণাপন্ন হন। ঈশ্বরচন্দ্র কথা দেন এই বিবাহ থেকে মুচিরামকে তিনি নিরস্ত করবেন। অথচ ঈশ্বরের অজ্ঞাতসারে তাঁর ভাই দীনবন্ধু ও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে মুচিরামের সঙ্গে ওই রমণীর বিবাহ সম্পাদন করেন। নিজের অজান্তে বিদ্যাসাগর প্রতিজ্ঞাচ্যুত হন। এই ঘটনার বশবর্তী হয়ে তিনি ঘোষিতভাবে বীরসিংহ পরিত্যাগ করলেন এবং প্রকৃতই আর কখনও সেখানে পা রাখলেন না। এরপর একে একে পুত্রের সঙ্গে মতবিরোধ, পুত্রের প্রতি আশানুরূপ কর্তব্য পালন করতে না পারায় অথবা না চাওয়ায় স্ত্রীর সঙ্গেও দূরত্ব রচিত হওয়া – এসব বিদ্যাসাগরের একক সত্তাকেই প্রতিবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে লাগল।

বীরসিংহ ত্যাগের প্রাক্কালে বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন পশ্চিমে স্থানান্তরিত হতে। মেট্রোপলিটান স্কুল ও কলেজকে কেন্দ্র করে ১৮৭০-৭২ নাগাদ যখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতানৈক্য চরমে ওঠে, ঈশ্বরচন্দ্র চেষ্টা করেন বন্ধুর সহায়তায় দেওঘরে স্থানান্তরিত হওয়ার। সে সময় দেওঘরে বাংলোর দাম অত্যন্ত বেশি ছিল। তাছাড়াও একে একে বালিকা বিদ্যালয়গুলির কাজে অর্থব্যয় করে তাঁর সঞ্চিত সম্পত্তি বেশ কিছুটা কমে এসেছিল। অবশেষে সন্ধান করে ছোটোনাগপুর মালভূমি সন্নিকটে অধুনা-ঝাড়খণ্ডের কার্মাটাড় অঞ্চলে তিনি দুশো কাঠা জমি ও বসবাসের জন্য একটি বাড়ি কেনেন। ১৮৭৩-৭৪ সাল থেকে পাকাপাকিভাবে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে জীবনের শেষ আঠেরোটি বছর সমর্পণ আদতে কলকাতার শহুরে সভ্যতাকেই প্রত্যাখ্যান, যে আপাত-পরিপাটি বঙ্গসমাজ তাঁর প্রায় প্রতিটি নীতিকে প্রতিহত করতে চেয়েছে বারবার, সামাজিক ও আর্থিকভাবে। ১৮৭৪-এ মেট্রোপলিটান-এর ছেলেরা যখন প্রথমবারের এফএ (ফার্স্ট আর্টস) পরীক্ষায় আশাতীত সুফল পেল, ঈশ্বরচন্দ্র ছুটে এলেন কলকাতায়। দ্বিতীয় স্থানে থাকা পরম স্নেহের ছাত্র যোগেশচন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে তাকে উপহার দিয়ে এলেন স্কট-এর ওয়েভারলি নভেলস-এর একটি খণ্ড। তারপর কর্মক্ষেত্রের অনিবার্য টান উপেক্ষা করে ফিরে গেলেন কার্মাটাড়ের বাড়ি নন্দনকাননে। কেন গেলেন?

আত্মকথনে ঈশ্বরচন্দ্র লিখছেন, “সাংসারিক বিষয়ে আমার মতো হতভাগ্য আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সকলকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন করিয়াছি, কিন্তু অবশেষে বুঝিতে পারিয়াছি, সে বিষয়ে কোন অংশে কৃতকার্য হইতে পারি নাই। ...সংসারী লোকে যে সকল ব্যক্তির কাছে দয়া ও স্নেহের আকাঙ্ক্ষা করে, তাহাদের একজনেরও অন্তঃকরণে যে আমার ওপর দয়া ও স্নেহের লেশমাত্র নাই সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই। এরূপ অবস্থায় সাংসারিক বিষয়ে লিপ্ত থাকিয়া ক্লেশ ভোগ করা নিরবচ্ছিন্ন মূর্খতার কর্ম...।” কার্মাটাড় যাওয়ার কয়েক বছর আগে চিঠিতে ভগবতী দেবী ও ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও প্রায় একই মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। কিন্তু কার্মাটাড়-ই তো প্রত্যাখ্যানের শেষ সত্য নয়। ১৮৬৬-তে পানিহাটির বালিকা বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে পথ দুর্ঘটনা ও লিভারে মারাত্মক আঘাত – পরিপাক যন্ত্র দুর্বল হয়ে আসছিল তখন থেকেই। কার্মাটাড়-জীবনের শেষদিকে, ১৮৯০-এ বীরসিংহে এসে যখন মায়ের স্মৃতিতে বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করে যাচ্ছেন, তখন তিনি একবেলার খাবার হজম করতে পারেন কোনোক্রমে। সামাজিক কাজ বিরামহীন, অথচ হোমিওপ্যাথি থেকে হাকিমি, কবিরাজি থেকে পাশ্চাত্যের চিকিত্‍সা, সমস্তকিছুকেই গ্রহণ করতে অপারগ হচ্ছেন। এই শরীরী প্রত্যাখ্যান আত্মিক প্রত্যাখ্যানও বটে।

যে ঋজু মেরুদণ্ডের ব্যক্তিটি কখনও কারও প্রতিনিধিত্ব করেননি (উনিশ শতকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে লালিত হয়ে রামমোহন বা ডিরোজিও যেমনটা করেছিলেন), এককভাবে বিধবাবিবাহের প্রচলন করতে চেয়েছিলেন নারীসুরক্ষা ও পরিবার পরিকাঠামোকে অব্যহত রাখার জন্য, সেই মানুষটি অন্তিমলগ্নেও সহবাস-সম্মতি আইন বিষয়ে তাঁর অসম্মতি ব্যক্ত করে যাচ্ছেন। প্রাচ্যের যে আদি-অকৃত্রিম সংস্কৃতি পরিবার থেকে বিকেন্দ্রীভূত হয়ে সামাজিকতায় বিস্তার লাভ করে, সংসারত্যাগী ঈশ্বরচন্দ্র তাতেই আস্থাশীল থেকেছেন আজীবন। যতবার পরিপার্শ্ব তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারও অধিকবার তিনি সসম্মানে ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যকে সসম্মানে উপেক্ষা করে গেছেন। তাঁর যাবতীয় লড়াই তাই একের লড়াই, সমস্ত ইতিহাস তাই ব্যক্তির ইতিহাস।

1 comment:

  1. খুব সময়োপযোগী ভাল লেখা। কিন্তু 'সহবাস - সম্মতি' আইনটি কী? কনজুগাল রাইট ইত্যাদি কিছু? একটু বললে ভালো হয়।

    ReplyDelete