0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



আহিরণ তৃতীয় ভাগ 

৬ 

নিমকি থুড়ি সরলাকে নিয়ে ওর ছোটভাই মনীশ ঠিক পরের রোববারেই হাজির হল। সেই ভিলাই থেকে এই গেওরা কয়লাখনি এলাকা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূর; সকালে রওনা দিলেও পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। রূপেশ একটা জীপ ভাড়া করে ওদের স্টেশন থেকে আনতে গেছল। দেখল নেই নেই করেও ছোট বড় সাতটা স্যুটকেস এসেছে, আবার গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত একটা পোর্টেবল টিভি। 

মনীশ সদ্য কলেজে ঢুকেছে। ক্লান্ত হলেও চারদিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছে। কোয়ার্টারের কাছে আহিরণ নদী! ভারি মজা তো। খালি বলল—জীজাজি, আপনার এখানে এত গরম, কোন কুলার নেই? আর কোয়ার্টারের ছাদ এত নীচু কেন? তাই এরকম লাগছে। একটা ভাল দেখে কোয়ার্টার নিন না! 

রূপেশ বলে যে কয়লাখনি অঞ্চলে লেবার কোয়ার্টার এমনই হয়। মনীশ একটু অবাক হল, জীজাজি তো ব্যাংক ম্যানেজার, লেবার কোয়ার্টারের কথা উঠছে কেন? তাহলে কি বিয়ে দেওয়ার সময় ওর দিদিকে ঠকানো হয়েছে? ব্যাজার মুখে দিদিকে বলে --খাট-টাট না এনে ভাল করেছিস। এত ছোট দরজা দিয়ে ঢুকতো না। 

রূপেশ বোঝায় যে গ্রামীণ ব্যাংক খনিবিভাগের ব্যাংকার নয়, তাই ওদের কোন কোয়ার্টার দেবার প্রশ্নই ওঠে না। গাঁয়ে পাকা বাড়ি নেই বলে আপাততঃ এক লেবার কোয়ার্টারে ঠাঁই হয়েছে। তবু মনীশের মুখের মেঘ কাটে না। বলে – আপনার ব্যাংক সরকারি ব্যাংক তো? কোন প্রাইভেট বা কো-অপারেটিভ ব্যাংক না তো? 

রূপেশ হেসে বলে—আজ রোববার। কাল তোমাকে গেওরা গাঁয়ে আমার ব্যাংকে নিয়ে যাব। তাহলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। 

দিদি এবার ভাইকে মৃদু বকুনি লাগায়। হয়েছে হয়েছে; এবার চান করে ভাত খেয়ে একটু গড়িয়ে নে। সেই সকালে বেরিয়েছিস। 

সন্ধ্যের মুখে শালা জামাইবাবুর যৌথ প্রচেষ্টাতেও চোদ্দ ইঞ্চির সাদা কালো ছোট টিভি সাড়া দিল না। স্ক্রীনে শুধু ঝিলমিল ঝিলমিল বা সাদা সাদা দানা, যেন কাঁচের জানলায় বৃষ্টির ফোঁটা। মনীশ গজগজ করে। 

আপনার কি আসে যায়? আপনি তো ব্যাংকের কাজে ব্যস্ত থাকবেন। আমার দিদি সারাদিন কী করবে? এই অশিক্ষিত লেবার পাড়ায় একটা কথা বলার লোক নেই। 

রূপেশ সরলার দিকে তাকায়। সরলা চোখের ইশারায় মানা করে। তারপর ভাইকে বলে—তোকে এতসব ভাবতে হবে না। কাল সন্ধ্যে নাগাদ তোর জীজু কোরবা থেকে একজন মেকানিককে নিয়ে আসবে। ও ছাদে উঠে এলুমিনিয়ামের পাঁচকাঠিওলা এরিয়েল লাগিয়ে দেবে। তারপর দেখবি। 

মনীশ আস্বস্ত হয়, কিন্তু জিদ ধরে কাল বিকেল নাগাদ লোক্যাল ট্রেন ধরে ও বাড়ি ফিরে যাবে। রূপেশ বলে –কাল আমার ব্যাংক দেখে নাও। তারপর বিকেলের দিকে আমি তোমাকে নিয়ে কোরবা বাজার থেকে এরিয়েল কিনে আনব। পরশু সকালে বাড়ির জন্যে রওনা দিলেই হবে। আমি নিজে গিয়ে বাসে তুলে দেব। 

পরের দিন জামাইবাবুর সঙ্গে ব্যাংক দেখতে গিয়ে মনীশ যারপরনাই হতাশ। এটা ব্যাংক? ক্যাশ কাউন্টার নেই, আলাদা ভল্ট রুম নেই, বন্দুক হাতে গার্ড নেই। হলের কোনে একটা পর্দার পেছনে সিন্দুক আর গোল্ড লোনের ছোট দাঁড়িপাল্লা! ছোঃ এ তো দুর্গের ভোলা শেঠের গদ্দীর মত ব্যাপার। জামাইবাবু হাসে, বলে নতুন ব্র্যাঞ্চ, আগামী তিনমাসের মধ্যে ক্যাশ কাউন্টার ইন্সটল হবে। 

এমনসময় হাজির হল নুর মুহম্মদ আর সোমন সোনকর। স্টেশনের কাছেই ওদের দুজনের পার্টনারসশিপের ভাত-ডাল-চিকেন এবং দেশি মদের ভোজনালয়। সপ্তাহের শেষে মজুরি পাওয়া খাদানের মজদুরেরা সোজা যায় ওর দোকানে। ভরপেট খাবার এবং যত ইচ্ছে মদ গিলে কেউ দোকানের বাইরেই মাটিতে শুয়ে পড়ে, কেউ রাস্তায় বমিটমি করে ধূলোর মধ্যেই গা এলিয়ে দেয়। নুর ওদের গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে বিড়বিড় করে—মর মর! খেয়ে মর শালারা! যত হাড়হাভাতের দল জুটেছে। নুর মদ ছোঁয় না, সুদের ব্যবসা করে না আর স্টেশনের কাছে গজিয়ে ওঠা মেয়েমানুষের ঝোপড়ার দালালি করে না। 

ওরা এসে এ মাসের স্টক স্টেটমেন্ট এবং সুদ শুদ্ধু কিস্তি জমা করে দিল। তারপর রূপেশকে অনুরোধ করল আগামী তিনমাসের মধ্যে ওদের ক্যাশ ক্রেডিট লিমিট বাড়িয়ে দিতে। কয়লা খাদান ছড়াচ্ছে, কয়লা তোলা শুরু হয়েছে। সরকার নতুন দুটো গাঁ নিয়ে নেবে বলে নোটিস দিয়েছে। মজুরের সংখ্যা বাড়ছে, ওর ভোজনালয়ের খদ্দেরও খুব বেড়েছে। সাহেব একটু বিবেচনা করুন। 

সাহেব বলে যে খদ্দেরদের ভিড় সামলে বিকেল নাগাদ ও এদের লোন প্রপোজাল নিয়ে আলোচনা করতে পারে, তার আগে নয়। ঠিক আছে ,আমরা ততক্ষণ শালাবাবুকে কোরবা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। রূপেশ কিছু বলার আগে মনীশ লাফিয়ে ওঠে। হ্যাঁ, হ্যাঁ; সেটাই ভাল। জীজাজি এখন ব্যাংকের কাজে ব্যস্ত থাকবেন। আমি গিয়ে টিভির এরিয়েল কিনে আনি। 

রূপেশ নুর মহম্মদকে সতর্ক করে। ওরা যেন রেলপুলের ওপর দিয়ে না গিয়ে আহিরণ নদী নীচের রফটা দিয়ে পেরোয়। 

সোনকর সঙ্গে সঙ্গে মাথা হেলায়। সে আর বলতে! আপনার একলৌতা শালেসাহাব। হম কোই রিস্ক নহীঁ লেঙ্গে। ‘সারে দুনিয়া এক তরফ, জরু কা ভাই এক তরফ’ । 

( গোটা দুনিয়া একদিকে তো গিন্নির ভাই আরেকদিকে। ) 

ওরা বেরিয়ে পড়ে। নুরের ইয়েজদি মোটরবাইকে ওরা তিনসোয়ারি। মাঝখানে মনীশ। আহিরণ নদীর পাড়ে রেললাইনের সামনে এসে নুর বাইক থামায়। একটি ছেলে এসে মোটরবাইকের হ্যান্ডল ধরে, নুর ওর হাতে একটা টাকা গুঁজে দেয়। মনীশ অবাক হয়ে দেখে ওই ছেলেটি অবলীলায় বাইকের গিয়ার নিউট্রাল করে রেললাইনের উপর গাড়ির চাকা তুলে বাইকটা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। ও পা রাখছে কাঠের স্লিপারের উপরে। কিন্তু দুটো স্লিপারের মধ্যে বিশাল ফাঁক, নীচে আহিরণ এখন ক্ষীণকায়া। পুলটা পেরোতে অন্ততঃ পাঁচ সাত মিনিট লাগবে। এর মধ্যে যদি রেল আসে। ওঃ, ও তো সকালে একবার, বিকেলে একবার। কিন্তু মালগাড়ি? কয়লা বোঝাই? তা হতে পারে। তখন মাঝে মাঝে যে সাইডে একটা টাওয়ারের মত করা আছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াবে। সময় পাওয়া যায়? আরে ট্রেন এখানে স্পীড কম করে সিটি বাজাতে বাজাতে আসে। 

এবার নুর মনীশকে জিজ্ঞেস করে। 

--তোমার জামাইবাবু বলেছেন রেললাইনের উপর দিয়ে না যেতে, নীচের রফটা বা রামের সেতুবন্ধ দিয়ে যেতে। একদম সেফ। কিন্তু তুমি এখন অ্যাডাল্ট, ভোট দেবে। তুমি কি বল? 

-- রিস্ক নেই? 

--আছেও আবার নেইও। মানে আমরা পাশাপাশি চলব দুদিক দিয়ে, তোমার হাত ধরে। তাহলে কোন রিস্ক নেই। 

--তাহলে নীচে পাইপ, বাঁশ ও বালি ফেলে ওই সেতুবন্ধ কেন তৈরি হয়েছে? 

--ওটা সীজনাল। এখন বর্ষা থেমে গেছে,জল অমে গেছে তাই। পাঁচ মাস টিকবে। তারপর রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই, পয়সা লাগে না। রফটায় মানুষ পিছু আট আনা। দেখ কত মেয়েরা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে নদী পার হচ্ছে। তুমি নওজোয়ান, পারবে না? 

ওরা লাইনের উপর পা রাখে। মনীশ বুঝতে পারে এদের কথায় না নেচে নীচের রফটা দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। অন্ততঃ পঁচিশ ফুট নিচে দিয়ে বইছে আহিরণ, জল কমে যাওয়ায় জেগে উঠেছে উটের পিঠের মত পাথরের বড় বড় বোল্ডার। সোনকর সাবধান করেছিল—নীচের দিকে তাকাবে না, নইলে স্লিপারের ফাঁক দিয়ে জল আর পাথরের দিকে চোখ পরলে মাথা ঘুরবে। তুমি সামনে দেখ, খালি আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটার পর একটা স্লিপারে পা ফেলতে থাক। আর কিচ্ছু ভাববে না। হঠাৎ দেখবে ওপারে পৌঁছে গেছ। ওরা ওকে অন্যমনস্ক করতে গল্প করতে থাকে। মনীশ শুধু মনে মনে ভগবানকে ডাকে—যেন কোন মালগাড়ি না আসে। কিন্তু ভগবানকে একমনে ডাকা এত সহজ নয়। উলটো দিক থেকে আসছে পুরুষ ও মেয়ের দল, কেউ সাইকেল ঠেলছে, কারও কাঁধে ব্যাগ, কারও মাথায় বোঝা। একটা মেয়ে ওর মুখোমুখি, সাইড চাইছে—থোড়কন খসকো সাহাবজি! একটু সরে দাঁড়াও গো সাহেব। 

কিন্তু ও কোথায় সরবে? তাহলেই তো নীচে জল আর –। ওর হাঁটু কাঁপে থরথর করে। 

নুর হেসে মেয়েটিকে বলে—নয়া আদমি। মেহমান। তঁয় খসক না ও! 

মনীশ অবাক হয়ে দেখে মেয়েটি নিজের একপায়ের পাতায় আর একপা তুলে ত্রিভঙ্গমুরারী পোজে ব্যালান্স সামলায়। ইতিমধ্যে আরেকটি বাইক ঠেলে এপারে ফিরে আসতে থাকা ছেলেটি চেঁচিয়ে নুরকে জানিয়ে দেয় যে ওর ইয়েজদি ওপারে গয়ারামের হাতে। 

ওপারে পৌঁছে মনীশ একটা পাথরের উপর বসে পড়ে, ওর মুখ ফ্যাকাশে। নুর ওর পিঠ চাপড়ে দেয়। তারপর নুর ওকে পাঞ্জাবি ধাবার দালচিনি দেওয়া গরম চা খাওয়ায়। বলে –চল আগে শহর ঘুরিয়ে আনি। সীতামড়ি, পাওয়ার হাউস, মানিকপুর কলিয়ারি। তারপর ওই জায়গাটা দেখাব যেখানে রাস্তাটা নীচে, আর নদী আমাদের মাথার উপর দিয়ে যাবে। সে আবার কী? চলই না, নিজের চোখে দেখলে তবে বুঝবে। দু’ঘন্টা ধরে ওরা নতুন গড়ে ওঠা কোরবা-বালকো বাইকে করে চষে ফেলে। এরমধ্যে একজায়গায় তড়কা রুটি খাওয়া হয়ে যায়। 

--সিগ্রেট খাও? লজ্জা কর না। জীজাজিকে বলব না। কেনা হয় টিভির জন্যে এলুমিনিয়ামের এরিয়েল, নুরের চেনা থাকায় ১০% কমদামে। ফেরার সময় ওরা রফটা দিয়ে নদী পার হয়। তার আগে এপারে সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দিরে পূজো দিয়ে সোনকর আর মনীশ এক টাকা করে প্রণামী দেয়। পূজারী ওদের দুজনের কপালে গোলা সিঁদুরের টিকা লাগিয়ে দিয়ে নারকোলকুচি আর নকুলদানার প্রসাদ দিলে মনীশ দিদি জামাইবাবুর জন্যে খানিকটা নিজের রুমালে বেঁধে নেয় । 

নুর বাইকের উপর বসেছিল। হেসে বলে –ব্যস, এবার নিশ্চিন্ত। ওই টিকা দেখলে সাহেব আর কিছু জিগ্যেস করবেন না । 

সন্ধ্যেবেলা চালু হল টিভি। কোন মেকানিক নয়, সোনকর নিজে এসে এরিয়াল কোরবার দিকে মুখ করে ফিট করে দিয়েছে। কালো ছবিতে শুরু হয়ে গেল জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘নুক্কড়’। মানে সরু গলি। মুম্বাইয়ের চাল এবং তাতে মাথা গোঁজা নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের কৌতুকের ছোঁয়া লাগা গল্প। মনীশের মুড এক্কেবারে হলিউড জলিগুড। খেতে বসে কথায় কথায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কুড়ি ফুট উঁচু ন্যাড়া রেললাইনের স্লিপারে পা রেখে এগোতে লাইনের ফাঁক দিয়ে আহিরণকে দেখে কেমন বুক ধুকপুক করছিল। 

মনীশের মুখ গম্ভীর। নুর মুহম্মদ কাজটা ঠিক করেনি। মনীশ ওর হয়ে সাফাই দেবার চেষ্টা করল –ইতনী ঘাবড়ানে কী ক্যা হ্যায় জীজাজি? কিতনী লড়কিয়াঁ সর পে বোঝা লেকে লাইন পার কর রহী থী? বারিশ কী মৌসম মে ভী –। মতলব নুর ভাইয়া বোল রহে থে কি -- 

ধমকে উঠল রূপেশ। 

তোমার নুর ভাইয়া এটা বলেছে কি প্রতি বর্ষায় অন্ততঃ তিনজন মেয়ে -পুরুষ পা পিছলে ওখান থেকে নদীতে পড়ে ভেসে যায় আর ওদের বডি তিনচার কিলোমিটার দূরে নদীর পাড়ে ফুলে ঢোল হয়ে ভেসে ওঠে? গত মাসে আমার ক্লায়েন্ট দুরপা গাঁয়ের বীরবল স্কুটার নিয়ে লাইন পার করছিল। ট্রেন আসায় ওই পাশের লোহার মাচানের মত তাতে গিয়ে দাঁড়াল স্কুটারটা ধরে। খেয়াল করেনি যে স্কুটারের পেছনের দিকটা লাইনের অনেকটা কাছে। হল কি, ট্রেনের লোহার ফুটবোর্ডটা ওর স্কুটারকে ছুঁয়ে গেল। সেই ধাক্কায় ও স্কুটার সমেত উড়ে গিয়ে নদীতে পড়ল। দু’দিন পরে লাশ ভেসে উঠল । 

সবাই খানিকক্ষণ চুপ। দূরদর্শনে কবিতা শ্রীবাস্তব নিউজ পড়ছেন। খানিক পরে নিমকি উঠে গিয়ে টিভি বন্ধ করে দেয়। মনীশ অস্বস্তি কাটাতে গিয়ে বলে—জানেন জীজাজি, দূরদর্শনে আর একজন নিউজ পড়ে—নজমা সুলতান। দারুণ দেখতে কিন্তু কি গম্ভীর! আমাদের কলেজের একজন বাজি ধরেছে নজমা নিউজ পড়ার শুরুতে বা শেষে যেদিন একটু হাসবে সেদিন ও আমাদের সবাইকে দোসা খাওয়াবে। 

পরের দিন সকালে উঠে মনীশ ব্যাগ গোচ্ছাচ্ছে, সরমা ব্যস্ত জলখাবার বানাতে। রাত্তিরে এখানে হল্ট করা অশোক বাস সার্ভিসের বাস স্টেশনের কাছ থেকে ঠিক সাড়ে সাতটায় ছেড়ে দেয়। সরমা ভাইয়ের এয়ারব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে। ধরা গলায় বলল – বাড়ি ফিরে নাঙ্গা রেললাইনের উপর দিয়ে সার্কাস করার গল্পটা কাউকে বলার দরকার নেই। 

মনীশ এবার দিদি-জামাইবাবুর পা ছুঁয়ে কাঁধে ব্যাগ তুলে নিল। রূপেশ ওর বাইকটা বের করে ইগনিশনের চাবি লাগিয়ে দিয়ে স্টার্ট দিতে যাবেও, এমনসময় একটা খ্যানখেনে গলার চিৎকারে শান্ত নিস্তরঙ্গ সকাল খানখান হয়ে গেল। গায়ে গায়ে লাগা লেবার কোয়ার্টারের লাইনের ওমুড়ো থেকে এক বুড়ির অশ্রাব্য গালাগাল। সে কোন অদৃশ্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশ্লীল শব্দের তুবড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আশেপাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে উনুন ধরিয়ে রাখা হয়েছে। পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে নীলচে আর সাদা ধোঁয়া। খানিকক্ষণ পরে উনুন ধরে গেলে ধোঁয়া ওঠা বন্ধ হয়ে গনগনে আঁচ দেখা দেবে। তখন সবাই উনুনগুলো ভেতরে নিয়ে যাবে। এ তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু আজকের এই ঘটনায় সবাই হতভম্ব। 

সরলা শুধোয়—ইয়ে কা শুরু হুয়া? সুবহ সুবহ? সাতসক্কালে এসব কী শুরু হল? 

রূপেশ বাইক স্টার্ট করে বলে—এসে দেখছি। এখন সময় নেই, বাস ছেড়ে দেবে। 

যথাসময়ে বাস ছেড়ে দিল। দিদিকে একা ছেড়ে যাচ্ছে, মনীশের গলা ধরে যায়। জামাইবাবু, দিদিকে একটু দেখবেন। দিদি খুব ভালো, কিন্তু বড্ড অভিমানী। 

ফিরে এসে দেখল ধুন্ধুমার লেগে গেছে। চারপাশের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এসেছে গোটা ভারতবর্ষ। সর্দার হিম্মৎ সিং ডোজার ড্রাইভার, পঞ্চপকেশন ইলেক্ট্রিশিয়ান, হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার মাইতি, পাম্প অপারেটর দেবাঙ্গন এবং কার্পেন্টার লাকড়া; কে নেই? হইহট্টগোলের মধ্যে অনেক কষ্টে যা বোঝা গেল তা হল পটেল বুড়ির বাড়ি থেকে কে বা কাহারা একটি মুর্গী চুরি করিয়াছিল দিন দুই হইল। গতকল্য প্রতিবেশি কোয়ার্টারের সাহু ম্যাসন বা রাজমিস্ত্রির নববিবাহিত বৌয়ের পাকশালা হইতে মাংস রন্ধনের সুগন্ধ বুড়িমার নাকে প্রবেশ করে। তাহার সন্দেহ উহা চুরির মাংস। সাহু ম্যাসনের বৌটি একটি পাকা চোর। গত সপ্তাহে বেড়াইতে আসিয়া সে বুড়ির ঘেরা আঙিনায় চরিতে থাকা দশটি মুরগীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিপাত করিতেছিল। বুড়ির চক্ষে তাহা ধরা পড়িয়াছিল। এইরূপ অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে বুড়ি সাহুবৌয়ের নামে সোজাসুজি অভিযোগ করিলে যুবতীটি অস্বীকার করে কিন্তু বুড়ির গালাগালির এবং অভিসম্পাতের তোড়ে পলাইয়া গিয়া নিজগৃহে কপাট বন্ধ করিয়া কাঁদিতে থাকে। কারণ বুড়ি ছত্তিশগড়ি প্রাকৃত বুলিতে যাহা বলিতেছিল তাহার নিগলিতার্থ হইল এই বৌটি স্বভাবতঃ বারভাতারি, বাপভাতারি এবং ভাইভাতারি! 

তামিল ইলেক্ট্রিশিয়ান পঞ্চপকেশন এবং কার্পেন্টার লাকড়া বুড়ির সন্তানকে বুঝাইতে চেষ্টা করে যে উক্ত মাংস কাল সাহু ইহাদের সঙ্গে বাজারে নুর মুহম্মদের হোটেলের পাশের দোকান হইতে কিনিয়াছে। উহারাও একই সময়ে কিনিতেছিল। অতএব তুমি তোমার মাতা ঠাকুরাণীকে ঘরের ভিতরে লইয়া গিয়া এক গেলাস গরম চা খাওয়াও। ইহা কলিয়ারির ভদ্রলোকের পাড়া। সবাই সজ্জন এবং সংস্কৃতিবান। এবংবিধ ভাষা ও সম্বোধন। তোমার মাতাঠাকুরাণী আমাদের সবার প্রণম্য, নহিলে---। এখন সবাইকে ডিউটি যাইতে হইবে। বৃথা কালক্ষয় করিও না। 

গালির স্রোত বন্ধ হয়েছে। সরলা মাটিতে আসন পেতে স্বামীকে ভাত বেড়ে দেয়। রূপেশের রওনা হবার সময় বলে – এ পাড়ায় বেশিদিন থাকা যাবে না মনে হয়। 

রূপেশ আশ্বস্ত করে জানায় যে ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় এবং স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে; সঙ্গেকিছু দু-বেডরুমের ভালো কোয়ার্টার। সেখানে একটা কোয়ার্টার ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। 

সরমার চোখমুখ উজ্বল হয়। আচ্ছা? তা কতদিন লাগবে মনে হয়? 

--বেশিদিন না। ধর মেরেকেটে বছরখানেক। 

--সে কি! তুমি কি আগামী বছরও এখানেই থাকবে নাকি ম্যানেজার? ট্রান্সফার হবে না? 

-- হতেও পারে। কিন্তু তার জন্যে মালা জপতে শুরু না করে চারপাশটা ভাল করে ঘুরে নাও। এখানের কয়লা খাদান,আহিরণ নদী, অজগরবাহারের জঙ্গল আর ডলোমাইট বক্সাইটে ভরা ফুটকা পাহাড়ে পিকনিকের কথা ভাব। প্রত্যেক রোববারে আমরা কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাব। দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে যাবে । 

ব্যাংক বন্ধ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে সাতটা। এসে দেখে আজ পাড়ায় কলিয়ারি থেকে ফ্রিতে সিনেমা দেখানোর কথা। একটা মাঠের মত, তাতে ১৬ মিলিমিটারের পর্দা টাঙানো, সামনে প্রোজেক্টর ফিট করে খুটখাট কাজ চলছে। আজকের ফিল্ম মেহমুদ অভিনীত “সব সে বড়া রূপাইয়া”। শুরু হবে আটটা নাগাদ। সবাই উৎসাহের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে। ঘরে ঘরে গরম রূটি সেঁকার গন্ধ; খেয়েদেয়ে সপরিবারে মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে বা খবরের কাগজ পেতে বসে ফুল মস্তি। 

ঘরে গিয়ে দেখে সারাদিনে সরলা ঘর গুছিয়ে নিয়েছে সুন্দর করে। 

জান, পাশের বাড়ির দেবাংগন গিন্নি এসেছিল। একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাব কিনা জিজ্ঞেস করছিল। বললাম মাত্র এসেছি, ঘর গোছানো বাকি। পরের বার নিশ্চয়ই যাব। টিভি চালাই ? 

--নাঃ ; ছেলেটা এত শখ করে এনেছিল। আজ ও নেই, কাল থেকে চালাব। 

খাওয়ার পাট চুকিয়ে সরলা বাইরের দিকের জানলাটা বন্ধ করে দেয়। রূপেশ দেখেও দেখেনা। ঘরে জ্বলছে জিরো পাওয়ারের নাইট ল্যাম্প; নীল রঙের। সরলা শাড়ি পালটে একটা নাইটি পড়েছে। রূপেশ নিজের পরিবারে কাউকে নাইটি পরতে দেখেনি। ওর চুলও অন্যরকম করে বাঁধা। বিছানার চাদরে বালিশে জেসমিনের সুগন্ধ। সরলা প্রশ্ন করে—তুমি আমাকে কী দেবে? 

মানে? 

না, মানে দ্বিরাগমনে ভিলাই গেলে সহেলিরা জিজ্ঞেস করছিল –তোর বর তোকে সুহাগরাতে কি দিয়েছে? আমি বলতে পারিনি। বলেছি আগে ওর ঘরে যাই তবে তো! 

আচ্ছা, আমাকে কেউ বলেনি যে এসময় কিছু দিতে হয় । 

ইটস ওকে ম্যানেজার। ওসব পরে দেখা যাবে। তুমি জল খাবে? 

রূপেশের কিছু মনে পড়ে। ও উঠে গিয়ে নিজের অফিসের ব্যাগ খুলে একটা প্যাকেট বের করে। নীলিমা তাকিয়ে আছে। বেরিয়ে আসে একটা টেপ রেকর্ডার কাম ক্যাসেট প্লেয়ার। প্যানাসোনিক কোম্পানির। গতমাসেই কোরবার কপুরচন্দ এন্ড সন্স থেকে ইন্সটলমেন্টে কিনে এনে ব্যাংকের আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছিল। গজল ভালো লাগে তোমার? 

একটু পরে প্লেয়ারে জগজিত সিংয়ের দরদী গলায় বেজে ওঠে—সরকতে যায়ে রুক সে নকাব, আহিস্তা, জনাব আহিস্তা। 

(মুখের থেকে খসে পড়ছে মুখোশ, ধীরে বন্ধু, আরও ধীরে। ) 

সরলা ধীরে ধীরে প্রথমে নিমকি হয়, তারপর মায়াবী নীল আলোয় নীলিমা হয়ে যায়। রূপেশ কোন কথা না বলে ক্যাসেট পালটে দেয়। আমজাদ আলীর সরোদে মালকোষ, ওর খুব প্রিয়। প্রথমে আলাপ; দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় তরফের তারে অনুরণনের ঢেউ ওঠে। ধীরে ধীরে রাগের মধ্যে রাত্রির মায়া ও তার মাদক রূপ ফুটে ওঠে। আলাপের পর জোড়ে যেন আপাত এলোমেলো ছড়ানো টুকরোগুলো যুক্ত হচ্ছে। লয় বাড়ছে। এবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। জোড় শেষ করে ঝালার তীব্রগতির সময় রূপেশের পিঠে নখ বসিয়ে ধরা গলায় নারী জিজ্ঞেস করে—তোমার কী চাই ম্যানেজার? বল, বল কী চাই ? 

শিউরে উঠে পুরুষ। নারীর কানের লতিতে দাঁত বসিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে—শুধু তোকে চাই নীলিমা, শুধু তোকে। 

(চলবে)

0 comments: