1

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in


পূর্বকথা 

জন্মের পর কৈশোরের একটা বড় অংশ কেটেছিল কলকাতা থেকে অনতিদূরে এক মফঃস্বল শহরে। একান্নবর্তী পরিবারের আবহাওয়ায় যেখানে রক্ষণশীলতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো মননশীলতা আর নানান বিপরীতধর্মী সংস্কৃতির রং-রূপ- যেমন আমার পিতামহী অল্প বয়সে কলকাতার একটি বিখ্যাত পরিবার থেকে এসে হাল ধরেছিলেন সেই সংসারের। আবার যাঁকে আমরা বড়দিদু বলতাম, মানে বাবার বড় জেঠিমা, তিনি এসেছিলেন আরেক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে, বয়সে আমার পিতামহীর চেয়ে যদিও কিছু ছোটই ছিলেন। বয়সের এই গড়মিলের কারণ যুগসাপেক্ষে সহজবোধ্য। আমার মা এসেছিলেন বর্ধমান থেকে আর আমাদের একমাত্র পিসির বিবাহ হয়েছিল হুগলির এক প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। আসলে এই যে আনাগোনা, পারিবারিক আদানপ্রদান, অনেক কিছুর সঙ্গে এটি অজান্তেই সৃষ্টি করে এক বিশেষ পারিবারিক রন্ধন-সংস্কৃতি। রান্নাবান্নার বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা করতে গেলে বা কোনো নির্দিষ্ট রন্ধনশৈলীর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে এই প্রেক্ষাপটটি ভালো করে বুঝতেই হবে। কারণ যে কোনো রান্নাই, তা যে পরিসরেই হোক না কেন, শেষ অবধি পারিবারিক আর সেইসব হেঁশেল-সংস্কৃতিই ভুবনবিখ্যাত, যেগুলি ভীষণভাবে এই ঐতিহ্যের ওপর নির্ভরশীল। 

চোখ বন্ধ করি যখন, প্রথম রান্নার স্মৃতি, যা মানষপর্দায় ফুটে ওঠে, তা হলো আমাদের সেই হুগলির বাড়ির রান্নাঘরের চেহারাটি। প্রশস্ত সেই পরিসরটি ছিল বাড়ির এক কোণে। তখন গ্যাসের চল হয়নি। উনুনে আঁচ দেওয়া ছিল বিশেষ একটি প্রাত্যহিক গৃহকর্ম। কয়লার উনুনে যেখানে পর্যায়ক্রমে রান্না করতেন মা-জেঠিমারা। আমাদের পিতামহী, যাঁকে আমরা বড়মা বলে ডাকতাম, তিনিও ঢুকতেন কখনো কখনো। সবজি কাটা, যাকে বলা হতো কুটনো কোটা, সে কাজটি বড়মা প্রতিদিনই নিপুণভাবে করতেন। সত্যি কথা বলতে কি রান্নার আগেকার আয়োজন যে কত বিপুল আর বিচিত্র হতে পারে, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রান্নায় হাতেখড়ি হওয়ার আগে সেই তখনই। 



পূর্বকথার পর 

আপাতভাবে এটি উল্লেখযোগ্য কোনও ঘটনা নয়, আমাদের প্রজান্মে আমরা যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছি, তাতে এই দৃশ্য বিরল ছিল না একেবারেই। কিন্তু এখন রান্নার অন্দরমহলে বেশ কিছু সময় কাটানোর পর বুঝতে পারি, কত জরুরি বিষয় এটি। কোন সবজি কীভাবে কাটা হবে, অন্য কোন সব্জির সাঙ্গে তার ভাব-ভালোবাসা হবে এবং শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠবে অনবদ্য একটি পদ, তার অভ্রান্ত ঠিকুজির হদিশ লুকিয়ে আছে এখানেই। সেদিন অবশ্যই এই বোধ ছিল না, হল অনেক, অনেকদিন পর। 

বাবার ছিল মাছ ধরার নেশা, সেইসঙ্গে রান্নার। যে সময়টার কথা লিখছি, তখন হেঁশেল পরিচালনা করতেন বাড়ির মহিলারাই। আমার কোনও বন্ধুকে বলতে শুনেছি বলে মনে পড়ে না যে তার বাবা নিয়মিত রান্না করেন। কিন্তু আমাদের বাবা করতেন। শুধু রান্নাই করতেন না, মাছ ধরে বা কিনে এনে তাঁকে রন্ধন উপযোগী করে তুলতেন নিজের হাতেই- আমাদের চোখে যা খুব অদ্ভুত লাগত। কিন্তু এখন বুঝি প্রকৃত ভালো রান্নার চাবিকাঠিটি সযত্নে এখানেই লুক্কায়িত। মূল রান্না শুরু করার অনেক আগে রান্নার উপকরণ- সবজি, মাছ, মাংস চিনতে এবং কিনতে শেখা, মশলার অমোঘ ব্যবহার, এরকম অনেক বিষয়, যা একইসঙ্গে বিপুল, বিচিত্র, জটিল, চ্যালেঞ্জ-সঞ্চারি এবং আরও অনেক কিছু, যা একটি ছোট্ট শব্দে মিলিত হয়েছে, যার সঙ্গে আমার অনুরাগের সুত্রপাত অবশ্য অনেক পরে, আকস্মিকভাবেই। তার আগে এবিষয়ে কোনও সঠিক ধারণা ছিল না- তখন উৎফুল্ল হতাম প্রিয় কোনও বস্তুকে সামনে দেখতে পেলে। যেমন সিন্নি। এটি এমন এক খাদ্যবস্তু যার সঙ্গে রান্নার সরাসরি কোনও যোগই নেই, এটি পুজোর নৈবেদ্য, পরে প্রসাদ এবং খাদ্যে পরিণত হয়। পাশ্চাত্যে যেমন স্যালাড। সেই সময়টায় প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধেবেলা আমাদের পিসিমণির বাড়িতে লক্ষ্মী পুজোর পর এই খাদ্যবস্তুটির অপেক্ষায় থাকতাম আমরা। দুধ, চিনি, ময়দা আর কলার সংমিশ্রণে পিসিমণি যে ম্যাজিক তৈরি করতেন, তার স্বাদ আজও ভুলিনি। এই পিসিমণির হাতের একটি বিশেষ অথচ সাধারণ রান্নার স্মৃতি যেমন আজও টাটকা। তা হল রবিবার বা অন্য ছুটির দিনের সকালে লুচির সঙ্গে হিং দেওয়া আলুর তরকারি। স্টিলের বাসনের চল আমাদের বাড়িতে তখনও ছিল না। এই বিশেষ তরকারিটির লোভেই ওইরকম কোনও কোনও দিনে আমরা, মানে আমি আর আমার বোন ইনু হাজির হতাম পিসিমণির বাড়ি। রান্নাঘারের সামনের বারান্দায় আসন পেতে কাঁসার রেকাবি নিয়ে বসতাম আমরা পিসতুতো দাদা, দিদিদের সঙ্গে। তরকারিটি তার একটু আগেই উনুন থেকে নেমেছে। সেখানে চেপেছে লুচি ভাজার জন্য ছোট করাই। তেল গরম হচ্ছে, লুচি বেলা চলছে। আমাদের নাকে তখন প্রবেশ করছে হিং, পাঁচফোড়ন মেশানো এক অদ্ভুত গন্ধ। অতঃপর আত্মপ্রকাশ করল সেই বস্তুটি। সাদা, ছোট ছোট আলুর টুকরো সেখানে জড়াজড়ি করে শুয়ে। আলুর গড়ন এক নির্দিষ্ট জ্যামিতিক, তারা গলে যেতে গিয়েও যেন কারও অঙ্গুলিহেলনে থেমে গেছে, পুরো গলেনি। দুয়েকটি কাঁচালঙ্কা ভিতর থেকে উঁকি মারছে। কোনও রান্না কতখানি সহজ, সরল হয়েও তা একটি বিশেষ রন্ধন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বমূলক হয়ে উঠতে পারে, বাঙালি রান্নার ক্ষেত্রে এক বড় উদাহরণ হতে পারে এই পদটি। অনেক পরে রান্নায় হাত পাকাতে গিয়ে হাত পড়ল আমাদের রান্নার বাইবেল, প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর লেখা “আমিষ ও নিরামিষ আহার”, পড়তে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম এই ভাবনার প্রতিফলন আবিষ্কার করে। তিনি লিখছেন, “খাবার সামগ্রীটি অনেক টাকা খরচ করিলেই যে ভাল হইবে তাহার কোনও অর্থ নাই। কোনও জিনিষটা দু-আনায় যেমনটা হইবে হয়ত সেখানে দুটাকা খরচ করিলেও তেমনটা হইবে না; কারণ খাদ্যপাকের কৌশলটুকু জানা না থাকিলে কেবল অর্থ ব্যয়ে কোনও ফলই হয় না”।

1 comment: