9

প্রবন্ধ - পল্লববরন পাল

Posted in




আরে! মুখুজ্যে মশাই যে! নমস্কারকী খবর?
আর এই লেখা-টেখা সংসার-টংসার এই নিয়েই ব্যস্ত।
তা বেশ। কিন্তু দেখো মুখুজ্যে...

একটা একদম আটপৌরে আলাপচারিতা – আড্ডার ঢঙে – জনৈক মুখুজ্যের সঙ্গেযিনি লেখেন-টেখেন আর সংসার-টংসার করেন – আচ্ছাবাঙলা কবিতায় এর আগে এই ‘টেখা’ ‘টংসার’ জাতীয় শব্দের ব্যবহার হয়েছে কিএই মুখার্জী নয়নৈমিত্তিক কথ্য ‘মুখুজ্যে’ শব্দটিও এর আগে বা পরে বাঙলা কবিতা সাহিত্যের কোথাও উল্লেখ হয়েছে কিএ সব প্রশ্নের উত্তর গবেষকরা দিতে পারবেন। আমি সামান্য কবিতাপ্রেমী। আমার সীমানা এই প্রশ্ন উত্থাপন অবধি! প্রসঙ্গত বলিএ কবিতা আমি প্রথম পড়েছি আমার স্কুলজীবনে – গত শতাব্দীর সাতের দশকের গোড়ার দিকে – তখনও আমি রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ পড়িনি, ‘গান্ধারীর আবেদন’ বা ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ও নয় – ইংরেজি সাহিত্যে অনেক আগেই ‘কন্‌ভার্সেশন পোয়েম’ লিখেছেন কোলরিজকিন্তু আমি সে সব জেনেছি অনেক পরে – কাজেই, ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’এর এই আড্ডাভাবনা আমার কাছে তখন অভিনব। নতুন। আবিষ্কার।

অনেক বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘যত দূরেই যাই’। ১৯৬২তে প্রকাশিত। ত্রিবেণী প্রকাশন। প্রচ্ছদ পূর্ণেন্দু পত্রী। দাম তিন টাকা। ১৯৬৪ সালে এই বইয়ের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার দেওয়া হয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। এই বইয়ের ২৮ নম্বর অর্থাৎ শেষ কবিতা ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’। এ বইয়ের দীর্ঘতম কবিতা।

আচ্ছাআলাপের একদিকে তো ওই জনৈক মুখুজ্যেযিনি ব্যস্ত তাঁর ‘লেখা-টেখা সংসার-টংসার’ নিয়ে – কবিতার শুরুতেই মনে হচ্ছে ইনি কবি সুভাষ মুখুজ্যেই হবেন – বেশবোঝা গেলো – কিন্তুঅন্যজন কেকথার মেজাজে বুঝতে পারিইনি সমবয়সী একজন অতিপরিচিত প্রতিবেশী – একেবারে তুইতোকারি জিগরি দোস্ত নয়হলে নাম ধরে বা শুধু মুখুজ্যে বলে সম্বোধন করতেন, ‘মুখুজ্যে মশাই’ বলতেন না। আবার আপনি-আজ্ঞের দূরত্বেরও সম্পর্ক নয় – কথার ঢঙেও বেশ শুভানুধ্যায়ী পারস্পরিক সমীহপূর্ণ আত্মীয়তা -
আমার এই ডানদিকটাকে বাঁদিক
আর বাঁদিকটাকে ডানদিক ক’রে
আয়নায় এভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া –
আমি ঠিক পছন্দ করি না।
তার চেয়ে এসোচেয়ারটা টেনে নিয়ে
জানলায় পা তুলে বসি।
এককাপ চায়ে আর কতটা সময়ই বা যাবে?

দু’জনে আড্ডা মারতে বসছেন পাড়ার চায়ের দোকানে নয়একেবারে যে ঘরে আয়না থাকে অর্থাৎ শোবার ঘরেই – তার মানে এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি মুখুজ্যে মশাইয়ের নিকটতম প্রতিবেশীতাঁর ডানদিকের বাঁ আর বাঁয়ের ডানদিক – তৃতীয় পংক্তির ‘এভাবে’ শব্দটিতেই পরিস্কার – আয়নার অন্যপারের মুখুজ্যে। অর্থাৎএটা ‘মুখুজ্যের সঙ্গে মুখুজ্যেরই আলাপ’।

পুরো আড্ডায় প্রথম মুখুজ্যের সংলাপ ঐ একটা পংক্তিতেই সীমাবদ্ধ। কবিতার দ্বিতীয় পংক্তিটুকু – ‘আর এই লেখা-টেখা সংসার-টংসার এই নিয়েই ব্যস্ত’ – ব্যাস! ঐটুকুতেই তাঁর নড়বড়ে এলোমেলো কিংকর্তব্যবিমূঢ় যাপনচরিত্রের বিভ্রান্তি বিধৃত – ওই ‘লেখা-টেখা’ আর সংসার-টংসার’এ। লেখা নাকি টেখাসংসার নাকি টংসারআমরা সাধারণত একটা অর্থযুক্ত শব্দের সঙ্গে প্রায় সমোচ্চারিত অর্থহীন অন্য একটি শব্দ জুড়ে দিই – খুব অগভীর হাল্কাচ্ছলে – অর্থযুক্ত শব্দটির গুরুত্ব কমাতে – শব্দটাকে গুলিয়ে দিতে – উচ্চারণে তুচ্ছতাবোধের তাগিদে। এই দুর্বোধ্য প্রহেলিকাতেই তো চিরকালীন ‘আমি’-র বসবাস। আমাদের সকলের ‘আমি’। এবং সেই সূত্রেই প্রত্যেক ঘরের দেয়ালে নয়তো সাজটেবিলে ঐ ‘ডানদিকটাকে বাঁদিক আর বাঁদিকটাকে ডানদিক’ করা আয়নার অস্তিত্ব ঘোষণার তাগিদ।

দেশলাইআছে।
ফুঃএখনও সেই চারমিনারেই রয়ে গেলে।
তোমার কপালে আর ক’রে খাওয়া হল না দেখছি।
বুঝলে মুখুজ্যেজীবনে কিছুই কিছু নয়
যদি কৃতকার্য না হলে।

আলাপের প্রথম অংশের শেষে আরো কিছু তথ্য জানা গেলো – যা বিস্তার লাভ করবে পরবর্তী অধ্যায়ে। যেমনপাঁচের দশকের বামপন্থী বুদ্ধিজীবিদের কয়েকটি সাধার বাহ্যিক ধর্ম ছিলোযা থেকে খুব সহজে তাদের চেনা যেতো – পাঞ্জাবি-পায়জামাকাঁধে ব্যাগআর ঠোঁটে চারমিনার। পাঞ্জাবি-পায়জামা বা ব্যাগের ক্ষেত্রে তবু উচ্চ মধ্য নিম্ন বিত্তের তারতম্য তর্কাতীত নয়কিন্তু চারমিনার একমেবাদ্বিতীয়ম সর্বহারা সংস্কৃতির সঙ্গে খাপে খাপে মানানসই ও সম্পৃক্ত।

অর্থাৎ জানলায় পা তুলে চায়ের কাপ হাতে পাশাপাশি চেয়ারে আধশোয়া আলগা বসে পড়লেন দুই মুখুজ্যে – সুভাষ মুখুজ্যে ও আয়না মুখুজ্যে। আড্ডার আবহাওয়া ও মেজাজ তৈরি।

এবং ফস্‌ করে দেশলাই ঠুকলেন আয়নার মুখুজ্যে।



আকাশে গুড়গুড় করছে মেঘ –
ঢালবে।

অনায়াস ঔদ্ধত্যে ওভার বাউন্ডারি দিয়ে ইনিংস শুরু করলেন আয়না মুখুজ্যে। এমন দুটি পংক্তি উচ্চারণ করে একমাস নির্জলা উপোসেও তৃপ্তির ঢেকুর ওঠে। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় আমার জীবনে পড়া বোধহয় সবচেয়ে প্রিয় দুটি পংক্তি। বিশেষত দ্বিতীয় পংক্তিটি। একটি মাত্র শব্দের। মিতভাষণ কবি সুভাষের স্বভাবধর্ম। এই ‘এক শব্দের পংক্তি’ র মধ্যে যেন মাইল মাইল ধু ধু মাঠযেন তিন খণ্ডের ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’র বিশাল বিস্তৃতি। এমন উদাহরণ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই ‘যত দূরেই যাই’ গ্রন্থেরই পাতায় পাতায় – প্রথম কবিতা ‘যেতে যেতে’র মধ্যে ‘ ...আমার কাঁধের ওপর হাত রাখল/ সময়।/ তারপর কানের কাছে...’; ‘পাথরের ফুল’ কবিতায় ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও,/ আমার লাগছে।/ মালা/ জমে জমে পাহাড় হয়/ ফুল জমতে জমতে পাথর। ...’এছাড়া ‘যেন না দেখি’, ‘ফিরে ফিরে’, ‘আরও গভীরে’, ‘ঘোড়ার চাল’, ‘গণনা’ – অজস্র কবিতায় অসংখ্যবার বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই এক শব্দের পংক্তি ব্যবহার করেছেন কবি সুভাষ। পরবর্তী সময়েও এর অনেক সার্থক প্রয়োগ দেখেছি সুভাষের কবিতায় – যেমন ‘কাল মধুমাস’ বইয়ের ‘খোলা দরজার ফ্রেমে’ কবিতায় ‘...মাথার ওপর লম্বা একটা লাঠি উঁচিয়ে/ কোলে-পো কাঁখে-পো হয়ে/ একটা ট্রাম/ তার পেছন পেছন/ তেড়ে গেলে/ তারের গায়ে অনেকক্ষণ ধ’রে ঝুলে থাকল/ একটা একটানা/ ছি/ ছি/ শব্দ...’। কিন্তু এই সব অসাধারণ শব্দ-পংক্তির মধ্যেও একটিমাত্র ক্রিয়াপদে ‘ঢালবে’ অদ্বিতীয়। এতো সংক্ষিপ্ত অথচ দীর্ঘতম উপন্যাসোপম বিস্তৃতি – ভাবা যায় না। মেঘ গুড়গুড় করলে আকাশ কী কী ঢালতে পারেসেটার জন্য কবি কি পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর ভরসা করেই মৌন রইলেন?

‘...কিন্তু খুব ভয়ের কিছু নেই;
যুদ্ধ না হওয়ার দিকে।
আমাদের মুঠোয় আকাশ;
চাঁদ হাতে এসে যাবে।...’

‘ঢালবে’ পংক্তিটা আরো গমগম করে উঠলো – শব্দ ও বাক্যটির অভিঘাতে পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তি প্রত্যেক পংক্তির শেষে আরো কয়েক গুণ বেড়ে বেড়ে গেলো। কী সহজ কথায় অনায়াসে ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধের কথা রূপকথার নরম ঐশ্বর্যে মুড়ে পেশ করলেন সুভাষ। এই রূপকথা প্রসঙ্গে বলি, ‘যত দূরেই যাই’ বইয়ের প্রথম কবিতা সহ বেশ কয়েকটির মধ্যে এই রূপকথার মেজাজ লক্ষ্যণীয়। এর সঙ্গে ‘সন্দেশ’ শিশু পত্রিকার সম্পাদনার কোনো যোগসূত্র আছে কিনাসুভাষ গবেষকরা বলতে পারবেন।

এতক্ষণে ইনিংস গুছিয়ে নিয়েছেন আয়নার মুখুজ্যে। উইকেটের চারদিকেই স্বচ্ছন্দে বাউণ্ডারি মারছেন। খুচরো রান নিচ্ছেন। মাঠ বড়ো করছেন এবং আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছেন।

‘...ঘৃণার হাত মুচড়ে দিচ্ছে ভালবাসা।
 পৃথিবীর ঘর আলো ক’রে –
দেখোআফ্রিকার কোলে
সাত রাজার ধন এক মানিক
স্বাধীনতা।
...শুধু ভাঙা শেকলগুলো এক জায়গায় জুটে
এই দিনকে রাত করবার কড়ারে
ডলারে ফলার পাকাবার
ষড়যন্ত্র আঁটছে। ...’

ভালোবাসার পাঞ্জায় কী অসম্ভব জোর – ঘৃণার পেশিবহুল হিংস্র হাত মুচড়ে দেওয়ার সাহস ও শক্তি! মানুষের যে কোনো সৎ সুস্থ প্রবৃত্তির মধ্যেই যে এই জোর থাকেন্যায়ের এই প্রস্তরবৎ শিরদাঁড়ার কথা প্রচার করা একজন কবির অত্যন্ত জরুরি একটা সামাজিক দায়িত্ব। এখানে আর একটা জিনিস লক্ষ্য করুন পাঠকপরের লাইনে ‘পৃথিবীর ঘর আলো ক’রে’-র শেষে ‘ড্যাশ’ চিহ্নটির প্রয়োগ। মোটেই বাহুল্য নয়। আরও একাধিক শব্দের অযথা ব্যবহারকে নস্যাৎ করে মিতভাষী এই কবি একটা ছোট্ট চিহ্নের ব্যাপ্তিনির্দেশে অন্ধকারের দেশের মুক্তির আলো সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিলেন। তারপর আবার এক শব্দের পংক্তি - ‘স্বাধীনতা’। সদ্যোজাত শিশুর মতো পবিত্র ও মহার্ঘ্য। পরক্ষণেই তিনটি মোক্ষম শব্দের অনুপ্রাসে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের গোপন উপস্থিতির সতর্কবার্তা। আলো অন্ধকারের কী নাটকীয় উত্থান-পতন!

এই অবধি ছিলো পটভূমি নির্মাণ। সামগ্রিক পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা। কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে বা সেমিনারে এটাই দস্তুর। শুরুতে পটভূমিকায় আঞ্চলিক থেকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণতার পর ‘কী করিতে হইবে’। আয়না মুখুজ্যেও তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক কথাবার্তার আয়োজনের প্রস্তুতি সেরে নিলেন।

এবার নিজস্ব মতামত ও নির্দেশ দিতে শুরু করলেন – সেই আড্ডার নৈমিত্তিক ঢঙেই – যেন পার্টি ক্লাশ নিচ্ছেন – এই সুভাষিত ভাষা ও ভঙ্গিতে যদি সত্যিই তখন বা পরবর্তী সময়ে পার্টি-ক্লাশ হতোতাহলে হয়তো বামপন্থার আরো সঠিক বিস্তার হতো – মার্ক্স এঙ্গেলস লেনিনকে মুখস্থ করে মাথায় না রেখে বুকের ওমে টাটকা রাখা যেতো – আরো সঠিক প্রয়োগ হলে পরবর্তীতে বামদূর্গের হুড়মুড় ভেঙে পড়া বোধহয় রোধ করা যেতো – এই রাজনৈতিক অতিমারীতে হয়তো এই বামপন্থাই ফের মানুষের আশ্বাস ভরসা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হতো।

‘...ধনতন্ত্রের বাঁচবার একটাই পথ
আত্মহত্যা।
দড়ি আর কলসি মজুত
এখন শুধু জলে ঝাঁপ দিলেই হয়।
পৃথিবীকে নতুন ক’রে সাজাতে সাজাতে
ভবিষ্যৎ কথা বলছেশোনো,
ক্রুশ্চভের গলায়।

নির্বিবাদে নয়বিনা গৃহযুদ্ধে
এ মাটিতে
সমাজতন্ত্র দখল নেবে।
হয়তো একটু বাড়াবাড়ি শোনাচ্ছে
কিন্তু যখন হবে
তখন খাতা খুলে দেখে নিও
অক্ষরে অক্ষরে সব মিলে যাচ্ছে।...’

ব্রিগেডের লাল জনসভার ভাষণকেউ দুঃস্বপ্নেও এর আগে ভেবেছিলো যেএই ভাষায় কবিতা লেখা যায়আমার আলোচনা সুভাষের রাজনীতি নিয়ে নয়কবিতা নিয়ে। তাই ক্রুশ্চভ ঠিক না ভুলসমাজতন্ত্র সত্যিই উন্নততর পদ্ধতি কিনা – সে সব নিয়ে রাজনৈতিক তাত্ত্বিকেরা অন্যত্র আলোচনা করবেন।

আমি শুধু এটুকু বলতে পারিএই কবিতা পড়েই কমিউনিজমে দীক্ষা নিয়েছিলো আমার প্রজন্ম সেই যুগে – গত শতাব্দীর সেই ষাট-সত্তর দশকে। বাঙলায় বামযুগের সূত্রপাতে এই কবির একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিলোযতোই তাঁকে পরবর্তী সময়ে অস্বীকার করুক বাম দলেরা।



তৃতীয় অধ্যায়ে খুচরো রানে ব্যস্ত হলেন আয়না মুখুজ্যে। আন্তর্জাতিক স্তর থেকে বৃত্ত ছোটো করে এলেন আঞ্চলিক চেনা চৌহদ্দিতে। বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়ে ফের বিন্দুতে ফিরে এলেন। একদম পার্টি-ক্লাশের শিক্ষকের মতো। কথা বললেন মস্তিষ্ক থেকে নয়বুক থেকে উঠে এলো তাঁর আন্তরিক অনুশাসন – সামগ্রিকভাবে এটাই তো হওয়ার কথা ছিলো।

‘...দেখো মুখুজ্যেমাঝে মাঝে আমার ভয় করে
যখন অমন সুন্দর বাইরেটা
আমার এই আগোছালো ঘরে হারিয়ে যায়।...’

কী সহজ বিবরণ! ঘর আর বাহির – বাস্তব আর স্বপ্ন – মাঝখানে কি বার্লিনের কংক্রিট পাঁচিলকী অদ্ভুত ব্যবহার ‘আগোছালো’ শব্দটার! নাহ্‌অভিধানে ‘অগোছালো’ আছে, ‘আ’ তো নেই! তাতে কী? ‘অ’ সরিয়ে ‘আ’ আরো একটু বেশি এলোমেলো অবিন্যস্ত করলো না কি আমার ঘরটাকেএ স্বাধীনতা তো কবিরই প্রাপ্য। তাএই ‘আগোছালো’ ঘরটা কী রকম?

‘... পাঞ্চেতের এক সাঁওতাল কুলি দেখতে দেখতে
ওস্তাদ ঝালাইমিস্ত্রি হয়েছিল –
এখন আবার তাকে গাঁয়ে ফিরে গিয়ে পেটভাতায়
পরের জমিতে আদ্যিকালের লাঙল ঠেলতে হচ্ছে।
এক জায়গায় রুগী ডাক্তার অভাবে মরছে,
অন্য জায়গায় ডাক্তার রুগী অভাবে মরছে। ...

আমি দেখে এসেছি নদীর ঘাড় ধরে
আদায় করা হচ্ছে বিদ্যুৎ -
ভালো কথা।
কলে তৈরি হচ্ছে বড় বড় রেলের ইঞ্জিন –
খুব ভালো।
মশা মাছি সাপ বাঘ তাড়িয়ে
ইস্পাতের শহর বসেছে –
আমরা সত্যিই খুশি হচ্ছি।...’

এ সবই ধনতন্ত্রের অমোঘ ফলাফল। পুঁজির বিকাশচিত্র। আমাদের সামনে উন্নয়ণের নীল-সাদা রঙ বা তিনহাজার কোটির প্যাটেলমুর্তির চোখ ধাঁধানো তালিকা। কিন্তু কবি তো দূরদ্রষ্টা। সত্যবাদিতা কবি হয়ে ওঠার প্রাথমিক স্বার্থ। অনেকটা এগিয়ে থাকে তাঁর দৃষ্টিসীমানা। তাই –

‘... কিন্তু মোটেই খুশি হচ্ছি না যখন দেখছি –
যার হাত আছে তার কাজ নেই,
যার কাজ আছে তার ভাত নেই,
আর যার ভাত আছে তার হাত নেই।...’

পরপর তিনটি ছক্কা! পুঁজিবাদের এর চেয়ে মোক্ষম সংজ্ঞা হয়আমি দ্বিধাহীন সোচ্চারে বলিএতো সহজে কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বগুরুও আমাকে পুঁজিবাদ বোঝাতে পারেননি। ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। এই ‘আছে’ আর ‘নেই’এর ধাঁধায় সংশয়ে দ্বিধায় আমরা ‘কলে পড়া জন্তুর মতো মূর্ছায় অসাড়’। ‘আছে’ আর ‘নেই’এর সংঘাতেই তো সমাজের আসল দ্বন্দ্বএই দ্বন্দ্ব থেকেই তো বস্তুবাদযা কবি সুভাষের জীবনে বহুদিনের বিশ্বাস। পরবর্তীকালে আশির দশকের দ্বিতীয় ভাগে সোভিয়েতের পতনে তার চিন্তার গতিপথ পরিবর্তন হয়েছিলো। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ, এবং আরো বছর পঁচিশেক পরের ঘটনা। কারণআমরা এখন আছি ‘যত দূরেই যাই’ প্রকাশকাল, অর্থাৎ উনিশশো বাষট্টি পরবর্তী কালে। শুনেছি ‘ভবিষ্যৎ কথা বলছে শোনো ক্রুশ্চভের গলায়’ প্রসঙ্গে নব্বই দশকে সুভাষ অকপটে বলেছেন – এখন হয়তো নয়কিন্তু ব্যাপারটা ঐ সময়ে আমার কাছে সত্যই ছিলোআমি আমার বিশ্বাস থেকেই লিখেছিসেটাই সত্য সেই সময়ের জন্য। ভণ্ডামিহীন এই প্রজাতির সৎ কবি এ যুগে কেউ আছেন কি?

এই তৃতীয় অধ্যায়ের শেষে আয়না মুখুজ্যের হাতের ব্যাট ফের গর্জন করে উঠলোগলার আওয়াজ আরো স্পষ্ট ও ধারালো হলো –

‘... গদিতে ওঠবস করাচ্ছে
টাকার থলি।
বন্ধ মুখগুলো খুলে দিতে হবে
হাতে হাতে ঝনঝন ক’রে ফিরুক।
বুঝলে মুখুজ্যেসোজা আঙুলে ঘি ঊঠবে না
আড় হয়ে লাগতে হবে।...’  

সরাসরি নির্দেশ। একদম রাজনৈতিক নেতার মতোন। কবি সুভাষ তখন আগাপাশতলা রাজনৈতিক মানুষ। পার্টিসদস্য।



‘... যারা হটাবে
তারা এখনও তৈরি নয়।
মাথায় একরাশ বইয়ের পোকা
কিলবিল করছে –
চোখ খুলে তাকাবার
মন খুলে বলবার
হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবার –
মুখুজ্যেতোমার সাহস নেই।...’

কমিউনিস্ট পার্টির অনুশাসনের মধ্যে থেকেও এই সপাট আত্মসমালোচনা বা স্বগতোক্তির সাহস একমাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো গুটিকয় মানুষই দেখাবার হিম্মত রাখতেন। এই মেরুদণ্ড এখন বিরল প্রজাতি। উপরের এই আট পংক্তির সত্যতা আজও সমানভাবে প্রযোজ্য। তাই শেষ পংক্তির থাপ্পড়ের পরেও উচ্চস্বরে বলেন –

‘... আগুনের আঁচ নিভে আসছে
তাকে খুঁচিয়ে গনগনে ক’রে তোলো।
উঁচু থেকে যদি না হয়
নীচে থেকে করো।...’

এখনও নিশ্চয়ই আর সেই জানলায় পা তুলে চেয়ারে হেলান দেওয়া অলস ভঙ্গি নয়! এক কাপ চা অনেকক্ষণ শেষ। কাপের গায়ে শুকনো স্মৃতি হয়ে লেগে আছে উনিশশো বাষট্টি। আয়না মুখুজ্যে হাহাকার করে উঠলেন –

‘... সহযোদ্ধার প্রতি যে ভালোবাসা একদিন ছিল
আবার তাকে ফিরিয়ে আনো;
যে চক্রান্ত
ভেতর থেকে আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে
তাকে নখের ডগায় রেখে
পট্‌ ক’রে একটা শব্দ তোলো।।...’

আপাদমস্তক রাজনৈতিক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ভালো লাগার জন্য তাঁর রাজনীতির প্রতি সমর্থন কোনো শর্তই নয়। আমি বহু বিরুদ্ধ মতবাদে বিশ্বাসী মানুষকেও সুভাষের কবিতা অনর্গল মুখস্থ বলতে শুনেছি। আসলে কবি সুভাষ আমাদের মতো কয়েকটা প্রজন্মকে বামপন্থী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর নির্দেশেই আমরা বিশ্বাস করেছি যুক্তি বিজ্ঞানকেআমরা অনুশীলন করেছি ভাবনাগুলোকে চামচে ক’রে নাড়ার মতো মুক্তচিন্তার। তাঁর কবিতা পাঠেই ভরসা পাই – ‘হেরেছিতাতে কী?/ কখনও যায় না শীত/ এক মাঘে।/ আছে/ লড়াইতে হারজিত।’

‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’ এই বইয়ের এমনই একটা দীর্ঘ কবিতাযার সাথে আমাদের প্রজন্মের আত্মীয়তা। এই একটি কবিতা নিয়ে আলোচনায়আমার অনুভূতিগুলোকে লিপিবদ্ধ করার প্রয়াসে বা কবিতাটির পাঠ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমি টানা দশ বছর বকবক করতে পারি। ইতিমধ্যেই অন্তত তিন লক্ষ বার আমার নিজস্ব আয়নার সামনে এ কবিতা পাঠ করেছি। এখনও করি। আজীবন করবো। আমার সত্তায় স্বভাবে শরীরের প্রতিটি রোমকূপে মৌলবাদের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার দৈনিক সংগ্রামে এই কবিতা আমাকে আজও আশাবাদী করে রাখেযে মুক্ত চিন্তারযে আশাবাদের প্রচার আজ এই সামাজিক রাজনৈতিক অতিমারী সময়েও ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক।      

‘... দরজা খুলে দাও,
লোকে ভেতরে আসুক।

মুখুজ্যেতুমি লেখো।।’   

9 comments:

  1. পদাতিক কবির প্রতি অনন‍্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপন😃

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  4. ভীষণ মনোগ্রাহী ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা।

    ReplyDelete
  5. অসাধারণ বিশ্লেষণ। ঋদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  6. প্রবন্ধও যে এভাবে পাঠ করা যায়, তার সুখানুভূতি হলো।

    ReplyDelete
  7. "ঢালবে"... "ঘৃণার হাত মুচড়ে দিচ্ছে ভালবাসা"; "ফুঃ এখনও সেই চারমিনারেই রয়ে গেলে!"; দরজা খুলে দাও,
    লোকে ভেতরে আসুক।

    মুখুজ্যে, তুমি লেখো।।’;
    অনেক ধন্যবাদ পলাশবাবু। ঝেড়েঝুড়ে তাক থেকে নামাবো "যতদূরেই যাই" আর "ছেলে গেছে বনে"।।

    ReplyDelete
  8. পল্লব দা, খুব উন্নত মানের লেখা এটি। তুমি নিজে একজন কবি। তাই তোমার লেখায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো কবির কবিতার আলোচনা একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে।

    ReplyDelete