0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















২১ 

ফ্রান্সেস্কোর কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেলো। সমাজে একঘরে করে দেওয়া হয়েছে এই পরিবারটিকে। ফলে সেই পরিবারের কোনো সদস্যকে দেখা গেলে গ্রামের লোকেরা ঠিক সেই কাজটাই করে থাকে, যেটা একটা পাগলা কুকুর কিম্বা নেকড়েকে দেখে করা হয়। পাথর এবং ঢিল ছুঁড়ে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়ে থাকে লোকালয় থেকে দূরে। আজ এমনকি গ্রামের নারী এবং শিশুরা পর্যন্ত একজোট হয়ে ঢিল ছুঁড়ছিল আগাথার দিকে। যেন সে কোনো সুন্দর কিশোরী কন্যা নয়, যেন সে এক ভয়ঙ্কর জন্তু, যেন সে এক দানব, যে অশুভ সময় কিম্বা প্লেগের মত কোনো এক মহামারী বয়ে নিয়ে এসেছে। আগাথা নিশ্চিত ছিল যে গির্জায় এলে সে আশ্রয় পাবে; তাই নির্যাতিতা কন্যা দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে দৌড় লাগিয়েছে গির্জার দিকে। কোনোমতে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে এখানে আছড়ে পড়েছে। কিছু শিশু-কিশোর, এরা এখনো ঢিল ছুঁড়ে যাচ্ছে তার দিকে। 

তরুণ যাজককে বিশেষ কিছু বোঝাতে হল না জনগণকে। সে বেরিয়ে আসা মাত্র আপনা থেকে লোকজন রণে ভঙ্গ দিলো। ধীরে ধীরে সবাই সেই স্থান ত্যাগ করলো। 

ফ্রান্সেস্কো হাতছানি দিয়ে গির্জার ভেতরের অংশে ডেকে নিলো আগাথাকে। আগাথা ঘটনার অভিঘাতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফ্রান্সেস্কো ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত ছিল খুবই। গির্জার বিশাল ঘরে তাদের দুজনেরই শ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো। বরঞ্চ তরুণ যাজকের সহকারিনী বৃদ্ধা পেট্রোনিলা কিছুটা বিস্মিত হলেও তুলনামূলকভাবে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিল গির্জার ঈশ্বরের আসনের সামনে। সে বিধ্বস্ত, আহত আগাথাকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এলো। পেট্রোনিলাকে দেখেই যেন আগাথা ধীরে ধীরে আপন সত্তায় ফিরে এলো। সে যেন তখনই বুঝতে সক্ষম হল যে সে কতখানি অপমানিত হয়েছে, আহত হয়েছে। শিশুসুলভ সারল্যে সে কখনো হেসে উঠলো, কখনো ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে যারা লাঞ্ছনা করেছে, তাদের শাপশাপান্ত করতে লাগলো। তার কণ্ঠস্বর ভরাট, গমগমে, বীররসে ভরপুর। আজ দেখা হওয়ার পরে এই প্রথম আগাথার কণ্ঠস্বর শুনে ফ্রান্সেস্কো একইসঙ্গে মুগ্ধ এবং অবাক হয়ে গেলো। কন্যাটি জানেই না যে সে কেন আক্রান্ত হয়েছে! 

সোয়ানা গ্রামটা আগাথার কাছে মৌচাকের খোপ কিম্বা পিঁপড়ের বাসার মত, কারণ সে অনেক উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে এতদিন সোয়ানাকে দেখেছে। সে ভীষণ হতাশ, ক্রুদ্ধ এবং হতবাক, কারণ তার সারল্য দিয়ে গ্রামবাসিদের এই আক্রমণ এবং ঘৃণাকে সে বুঝতে পারছে না। সে শিশুকাল থেকে এই গ্রামকে দেখছে, যেভাবে মানুষ প্রকৃতিকে দেখে। মৌমাছি কিম্বা পিঁপড়ের কামড়কে সে যেরকম মনে করে, তার কাছে এই আক্রমণ কতকটা সেরকমই মনে হয়েছে।কিম্বা বুনো জন্তুর আক্রমণের ভয়ে মানুষ যেমন আচরণ করে, আগাথাও কিছুটা সেরকমই আচরণ করছিল। জন্তুকে মানুষ যেভাবে গালি দেয় ক্রুদ্ধ হয়ে, ঠিক সেভাবেই আগাথা রেগে উঠছিল। বৃদ্ধা সহকারিনী যখন ধীরে ধীরে তার ছিঁড়ে যাওয়া পোশাক ঠিক করবার চেষ্টা করছিল, সেই চেষ্টার মধ্যেই খুলে ছড়িয়ে পড়ল তার লালচে সোনালি রঙের দীঘল কেশরাশি। সে তাড়াতাড়ি সেই এলোকেশ গুছিয়ে একটা হাতখোপা বেঁধে নিলো। 

ঠিক সেই মুহূর্তে ফ্রান্সেস্কো প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো আপন প্রবৃত্তির সঙ্গে। ছিন্ন পোশাকের মধ্য দিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ছিল সেই কন্যার যৌবনের সম্পদ। উজ্জ্বল ত্বকের উপর দিয়ে আলো পিছলে যাচ্ছিল। এত নিকটে এত সুন্দর কোনো নারীকে ফ্রান্সেস্কো আগে দেখেনি। তার স্নায়ুর অদ্ভুত আচরণে সে যেন অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। বজ্রমুষ্টিতে চেপে রেখেছিল নিজের দুই বাহু। দাঁতে দাঁত চেপে বন্ধ রেখেছিল নিজের মুখ। তার মস্তিষ্কের তাৎক্ষণিক অন্ধত্ব কেটে গিয়ে এক তীব্র আলোর ঝলকানিতে অজস্র ছবি, ভাবনা এবং অনুভূতির প্রবল ঝড় উঠছিল তার মনোজগতে। প্রাকৃতিক দৃশ্য, মানুষজন, পুরানো স্মৃতি, পরিবারের সঙ্গে কাটানো নানা উজ্জ্বল মুহূর্ত, অতীতে তার পড়াশুনো এবং কাজের জায়গা এসব কিছুর ছবি বর্তমান সময়ের সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে ভেসে উঠছিল তার মনে। এই সব কিছুকে ছাপিয়ে এক সুন্দর মিষ্টি ভবিষ্যতের ছবি ভেসে উঠছিল, যে ছবির জন্য তার মনে অদ্ভুত বাসনার সৃষ্টি হল। 

এই অসংখ্য, অস্থির চিত্রগুলি যেমন ঝটিতে বিদ্যুৎঝলকের মত তার মনে দেখা দিলো, ঠিক তেমনি শীঘ্র মিলিয়ে গেলো। প্রবল ভয়ের সঙ্গে ফ্রান্সেস্কো লক্ষ্য করলো যে তার প্রবৃত্তির ইচ্ছেগুলো কীভাবে যেন তার আত্মার অন্তর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে এবং তার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ঈশ্বরের করুণার উপরে নির্ভর করছে এখন যে তার আচরণ কেমন হবে। সে যেন এক অদ্ভুত আবেশের ঘোরে ডুবে যাচ্ছিলো। সেই পাপের অপরাধে ডুবে যাওয়ার ঘোরের ভয় সত্ত্বেও তার অদ্ভুত আনন্দে চিৎকার করতে ইচ্ছে হল। তার নিজের ক্ষুধার্ত প্রবৃত্তির মূর্তিকে সে নিজেই অদ্ভুত তৃপ্তির সঙ্গে দেখছিল। তার মনে হল ক্ষুধাতেই তার তৃপ্তি, তৃপ্তিতেই তার ক্ষুধা। এই অপরাধী ভাবনা তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে ঘা দিয়েছিল যে প্রবৃত্তির নিবৃত্তিতেই অনির্বচনীয়, ঐশ্বরিক নির্বাণ সম্ভব। রূপের উপাসনা, মূর্তির উপাসনা তো এক ধর্মবিশ্বাসী খ্রিস্টানের আত্মার জন্য নিষিদ্ধ কাজ নয়। 

সেই মুহূর্তে লিগর্নেত্তোর সেই বিখ্যাত ভাস্কর, নিজের কাকাকে তার অতি সাধারণ মানের শিল্পী বলে মনে হোলো। সে নিজেও তো একসময় ছবি আঁকতে পারতো। কেন সে শিল্পী হওয়ার চেষ্টা করলো না! বার্নার্দিনো লুইনির বিখ্যাত সব বিশাল পেইন্টিংগুলির কথা মনে এলো তার, যেগুলো সে লুগানোর উপাসনালয়ে দেখেছিলো অতীতে। সুন্দরী স্বর্ণকেশী পবিত্র সেই নারীর ছবি মনে এলো তার। কিন্তু তার সামনে উপস্থিত এই জ্বলন্ত বাস্তব মূর্তির সামনে সেইসব সৃষ্টিকে তার সম্পূর্ণ বিবর্ণ বলে মনে হলো। 

ফ্রান্সেস্কো ভেবে পাচ্ছিলো না ঐ মুহূর্তে যে তার ঠিক কী করা উচিৎ; মস্তিষ্কের বিপদসঙ্কেত তাকে ঐ কন্যার থেকে দূরে যেতে নির্দেশ দিলো। তার সমস্ত যুক্তিবোধ তাকে নির্দেশ দিলো ঘটনাটা সঙ্গে সঙ্গে নগরপালকে জানানোর জন্য। অন্য কারো মুখ থেকে ঘটনাটা নগরপাল শুনবার আগেই তার পৌঁছাতে হবে, এই ভাবনাটা চাড়া দিয়ে উঠতেই ফ্রান্সেস্কো রওনা দিলো। নগরপাল শান্তভাবে সম্পূর্ণ ঘটনাটি শুনলো; সৌভাগ্যবশত ওইসময় বাড়িতেই ছিল সে। একজন যাজকের কর্তব্য হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ফ্রান্সেস্কো সম্পূর্ণ ঘটনাটি বিবৃত করেছিলো। একজন প্রকৃত ক্যাথলিকের কর্তব্য অনুযায়ী আল্পসের উপত্যকায় এরকম অরাজক অবস্থা চলতে দেওয়ার বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ করা জরুরি। সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। পাপাচার বাড়তে দেওয়া যায়না। আবার একইসঙ্গে সোয়ানার গ্রামবাসীদের এরকম আক্রমণও সমর্থনযোগ্য নয়। নগরপাল কথা দিলো যে সে সত্বর কঠিন প্রতিকারের ব্যবস্থা করবে। 

তরুণ যাজক চলে যাওয়ার পরে, নগরপালের সুন্দরী তরুণী স্ত্রী ধীরে ধীরে মিষ্ট স্বরে বলে উঠল, ‘এই যাজক খুব কর্মনিষ্ঠ।’ নগরপালের স্ত্রী সবসময় শান্তভাবে কথা বলতো। সে আরও বলতে লাগলো... ‘আমি মনে করি, এই মানুষটি একসময় সর্বোচ্চ পদে যেতে পারেন; পোপ হতে পারেন। শুধুই দায়সারা পৌরোহিত্য, বা ধর্মগ্রন্থ পাঠ, উপাসনা করে ইনি কর্তব্য করেন না। নিজেকে উপবাস, প্রার্থনা, ধ্যান, জাগরণ ইত্যাদি নানা আচরণের মধ্য দিয়ে সর্বদা আধ্যাত্মিক পথে আছেন। তবে এরকম ঈশ্বরসেবক মানুষের দিকেই আবার শয়তানের দৃষ্টি পড়ে। তারা নানা ছলাকলা করে এদের বিচ্যুত করতে চায়। আহা, ঈশ্বর যেন সর্বদা এঁকে রক্ষা করেন।’ 

গির্জায় ফিরে আসবার পথে অনেকেরই চোখে পড়েছিল যে ফ্রান্সেস্কো অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে হেঁটে আসছে। গ্রামের বিক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ মহিলাদের চোখ যেন তাকে বিদ্ধ করছিল; তারা বুঝতে পেরেছিল যে সে নগরপালের কাছে নালিশ জানাতে গিয়েছিল। কিন্তু তারাও ঐ কন্যাকে বিষাক্ত ছোঁয়াচে অসুখের মত পরিহার করতে চায়। কাঠুরে মেয়েরা গ্রামের চৌমাথার কাছে, কিম্বা কাপড় কাচতে আসা মেয়েরা সোয়ানার মার্বেলের সারকোফাগাসের ঝর্ণার কাছে তাকে দেখতে পেয়ে চাপা হাসিতে সৌজন্যমূলক সম্ভাষণ জানালো ঠিকই, কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো অসন্তোষে। ফ্রান্সেস্কো হেঁটে যাচ্ছিল এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্য দিয়ে। পাখিদের কলকাকলি, সোয়ানার জলপ্রপাতের শব্দ সবকিছুই তার কানে পৌঁছাচ্ছিল, যদিও তার মনে হচ্ছিল যে তার পা দুটো মাটির উপরে নেই। বিভিন্ন শব্দ এবং নানারকমের চিত্র ভেসে আসছিল, সেগুলো তাকে ঘিরে ফেলছিল ঘূর্ণিঝড়ের মত। এসবের মধ্য দিয়েই সে নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। একসময় সে নিজেকে আবিষ্কার করলো গির্জায় মেরিমাতার প্রধান বিশাল আসনের সামনে। হাঁটু গেড়ে বসে সে অন্তরের এই প্রবল ঝড়কে শান্ত করে দেবার জন্য মেরিমাতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো। 

------------------------------------------ 

(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা

0 comments: