ধারাবাহিক - গার্গী বসু
Posted in ধারাবাহিক
(পর্ব ৩)
১৬৭৪ সাল। দক্ষিণ আমেরিকার ক্যরিবিয়ান সমুদ্রের উপকূলে আর্যাবাক উপজাতি বাস করে। তাদেরই এক পরিবারে জন্ম নিল এক মেয়ে। মেঘের মত ঘন কালো চুল আর জোড়া ভ্রূ তার। প্রশস্ত কপালে ছোট্ট একটা সাদাটে দাগ। যেন বিধাতা ভালবেসে আদরের টিপ পরিয়ে দিয়েছেন নিজের হাতে।
তার জন্মের ঠিক পরেই আকাশ কালো হয়ে এল। আশেপাশের মানুষ অবাক হয়ে দেখল মেঘ নয়, হাজারে হাজারে কালো কাক আকাশ বাতাস ঢেকে ফেলেছে, কালো ডানায় ভর করে তারা উড়ে আসছে চারদিক থেকে। এ কি প্রকৃতি দেবতার কোন লীলা? নাকি কোন অশনি সঙ্কেত? সদ্যজাত কন্যাকে বুকে করে কুটির থেকে বেরিয়ে এলেন মা। তাঁর দৃষ্টি যেন স্বাভাবিক নয়। কুটিরের সামনে সব কাকগুলি এসে বসল একে একে। উপস্থিত সকলে সাক্ষী হয়ে থাকলেন এক অলৌকিক দৃশ্যের। সারা পৃথিবীর কাকেরা যেন মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে সদ্যজাত সেই কন্যাকে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরেই আবার তারা দল বেঁধে উড়ে গেল। পড়ে থাকল সার দিয়ে হাজার হাজার কালো পালক।
মেয়েটির নাম রাখা হল তিতুবা। এই নাম ইতিহাসে একদিন লেখা হয়ে থাকবে কেউ জানত কি তখন?
তিতুবা বড় হতে লাগল। দেখা গেল বন জঙ্গলে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করতে সে পারদর্শী। মা তাকে উদ্ভিদবিদ্যা আর ভেষজ উপচারের বিভিন্ন ব্যবহার শেখাল। পোকামাকড়, পাখি আর অন্যান্য পশুদের সাথে নিজের মত করে কথা বলে তিতুবা। পাখিরা ঠোঁটে করে ফল নিয়ে আসে তার জন্য। গভীর বনের মধ্যে যেখানে গাছের ছায়া অন্ধকার করে থাকে, তিতুবা অনায়াসে সেখানে পৌছয়। গাছেরা ডাল ঝুঁকিয়ে সম্মান করে তাকে। মেঘের মত অবাধ্য চুল সামলাতে লতার ফাঁস তৈরি করে তিতুবা। মাথার চারপাশে কালো কাকের পালক শোভা পায় তার। গাছের পাতা আর লাল নীল পাখির পালক বেড় দিয়ে থাকে তার কোমরে। গলায় সামুদ্রিক প্রবাল আর ঝিনুকের মালা, চোখের কোণে, চিবুকে বিচিত্র আঁকিবুঁকি, সব মিলিয়ে জলজ্যান্ত প্রকৃতির দেবী যেন। পূর্ণিমার রাতের মত শান্ত স্নিগ্ধ রূপ তিতুবার। সবাই ভালবাসে তাকে। সারাদিনের শেষে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে গোল করে বসে সবাই। নিজেদের হাতে তৈরি বাজনা বাজায়। নাচ করে সব নারী পুরুষ মিলে। হাত তুলে ধন্যবাদ দেয় এই জীবনের জন্য। গোষ্ঠীর বয়স্ক মানুষেরা সেই আগুনের পাশে বসে তাদের গল্প শোনায়। পশুপাখির গল্প, জীবন ধারণের গল্প, আর মানুষের গল্প। মানুষের লোভ, কাম, আর বিশ্বাসঘাতকতার গল্প।
পৃথিবীর এক আশ্চর্য নিয়ম। যুগে যুগে দুর্বলেরা মরে সবলের হাতে। মানুষ মানুষের ওপর অত্যাচার করে। যুদ্ধে এবং বিনা যুদ্ধে, বল প্রয়োগ করে বা বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বন্দী বানায়। মানুষে দাম ঠিক করে মানুষের। মানুষ মানুষকেই বেচে দেয়, আবার কেনে। একে অপরকে কষ্ট দেয়, মেরে ফেলে। প্রাণ দিতে পারেনা কিন্তু প্রাণ কেড়ে নিতে পারে অনায়াসে। জাতি-ধর্ম- বর্ণের বিভেদ সৃষ্টি করে শত শত ঘৃণার পাঁচিল তোলে মাঝখানে। কিন্তু তারা ভুলে যায় তাদের জানার বাইরেও অনেক কিছু আছে। মহাকাশে, গভীর জলের তলায়, এই বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডে এমন কিছু আছে মানব বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না।
এইভাবেই জীবন কাটছিল তিতুবার। একদিন সমুদ্রের কাছে গিয়ে জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়াতেই একটা ছোট সোনালি মাছ ডিগবাজি খেয়ে এসে তিতুবার পায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ল। পায়ে সুড়সুড়ি লেগে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি খেলে গেল তিতুবার। নিচু হয়ে হাতে তুলে নিল মাছটাকে। কিন্তু তারপরেই চোখমুখ বদলে গেল, গম্ভীর হয়ে গেল ও। তখনই একটু দূরে জলের ভেতরে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হল। অনেক ছোট ছোট মাছ যেন প্রাণভয়ে পালাতে লাগল। তিতুবা সভয়ে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। তারপর পেছন ফিরে তার গ্রামের দিকে দৌড়তে লাগল।
দেখতে দেখতে একদল সাদা চামড়ার মানুষ একটা দানবের মত বিশাল জাহাজকে নোঙর করল। আধুনিক সব অস্ত্র তাদের হাতে। ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা আর্যাবাকদের গ্রামে। বন্দী করে ফেলল আর্যাবাকদের। হাতে পায়ে দড়ি পড়িয়ে টানতে টানতে নিয়ে চলল। আলো-হাওয়া বিহীন জাহাজের খুপরিতে পোকামাকড়ের মত ঠেসে ঠেসে ভরে ফেলল তাদের। শিশুরা মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। তাদের কান্না পৌঁছল না সাদা চামড়ার লোকগুলোর কানে। তারা তখন হিসেব কষতে ব্যস্ত কেমন দামে বিকোবে এই কালো চামড়ার ক্রীতদাসেরা। বন্দী অসহায় নারী পুরুষ দুহাত তুলে বিলাপ করতে লাগল। স্বজন বিচ্ছদের কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অদৃষ্টকে সাথে নিয়ে ভেসে চলল তারা। আর ভিড়ের মাঝে দেখা গেল হতবাক এক কিশোরীকে। তার জোড়া ভ্রূ, কালো চুলে বেড় দিয়ে আছে কাকের পালক, তার কপালে জ্বলজ্বল করছে একটা অর্ধচন্দ্রাকার সাদাটে দাগ। যেন নিমীলিত এক চোখ।
এইটুকু পড়ে বইটা ভাঁজ করলেন ভায়োলেট। শহর আর গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় সালেমের এক মধ্যম মানের স্কুলে পেশায় লাইব্রেরীয়ান, নেশায় বইপোকা কৃষ্ণাঙ্গী তরুণী ভায়োলেট। উচ্চশিক্ষিত মেয়েটি আসলে বর্ণবিদ্বেষের শিকার। সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষিকা হওয়ার বদলে লাইব্রেরীর একটা কোণেই জীবন কেটে যাচ্ছে তার। তবুও সালেমের জীবন নির্ঝঞ্ঝাট।বড় শহরের তুলনায় একটু সহজ। নিউইয়র্কে থাকাকালীন প্রায়শই শুনতে হত “গো ব্যাক টু আফ্রিকা নিগার” অর্থাৎ “নিজের দেশ আফ্রিকায় ফিরে যাও, অসভ্য” ধ্বনি। অথচ জন্মসুত্রে ভায়োলেট আমেরিকান। একটা সময়ে মনে হত, ওরা বুঝি চামড়ার রঙ আর মানবিকতা গুলিয়ে ফেলেছে। পথ চলতে “ব্ল্যাক বিউটি” ডাক তো হামেশাই শুনতে হয়েছে, এমনকি তাকে শুনিয়ে তার শরীরের দরদামও আলোচনা করেছে সাদা চামড়ার কোন সুশ্রী যুবক। ইতিহাস সাক্ষী এরকম একটা সময় ছিল যখন এই এদেরই কোন পুর্বপুরুষের বাড়িতে ভায়োলেট এর মত কোন যুবতী ক্রীতদাসী-বৃত্তি করেছে। সেই কথা ভেবেই পুলকিত হয়ে সভ্যতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে তারা।
প্রথম প্রথম অবাক হয় যেত ভায়োলেট। মানুষের সাথে মানুষের এ কেমন ব্যবহার! কষ্ট হত খুব। ভায়োলেটকে যারা চেনেন সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন ভায়োলেট ভীষণ বই পাগল একজন মানুষ। সব ধরণের বই পড়ার সাথে সাথে দেশ বিদেশের খবর রাখেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে চাঁদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে খবর তার অজানা নয়। ভাবতে ভাল লাগে মানবজাতি মাটিতে বাস করেও আকাশ ছোঁওয়ার ভাবনায় পিছপা হয়না। বিজ্ঞান এত উন্নতি করেছে যে দিনেকালে হয়ত সময় – যাত্রা করাও সম্ভব হবে। চাইলেই চলে যাওয়া যাবে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কিম্বা ফেলে আসা দিনে অর্থাৎ ইতিহাসে। ভাবতে যেমন রোমাঞ্চ বোধ হয় তেমনই আবার মনটা ভারি হয়ে আসে মানুষের প্রতি মানুষের হিংসা, বিদ্বেষ আর ঘৃণা দেখে। আজও কৃষ্ণকায় মানুষেরা সুরক্ষিত নয়। শুধুমাত্র চামড়ার রঙটাই ঘৃণার কারণ হয়ে যায় এক এক সময়ে।
এই জায়গাটা অপেক্ষাকৃত অন্যরকম। বর্ণবৈষম্যের আঁচ এসে পৌঁছয় না। তার স্কুলেও দুই ভিন্ন বর্ণের পড়ুয়ারা আসে। যদিও সাদা চামড়ার পড়ুয়ারা সংখ্যায় বেশি। তাদের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত বিবাদ এতই সূক্ষ যে স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে তা প্রকাশ পায়না। ভায়োলেটের মনে পড়ে যায় একবার স্কুলের একটা ক্লাসের বাচ্চারা ছুটোছুটি করে খেলা করছিল। তাদেরই মধ্যে একটি ছোট ছেলে তার সঙ্গীর হাত ধরতে চাইছিল না কিছুতেই। তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলে বসল কোন কৃষ্ণাঙ্গ খেলার সাথি তার চাই না। কালো ছেলে মেয়েদের হাত ধরবে না সে। অবাক হয়ে গেছিল ভায়োলেট। কত ছোট বয়সে বর্ণবিদ্বেষ ঢুকে যায় এদের মনে?
সারাদিন লাইব্রেরীতে কাটানোর পরেও ভীষণ একা হয়ে যাওয়া ভায়োলেটের একমাত্র সঙ্গী বই। আজ সে যে বইটা হাতে পেয়েছে সেটার পাতায় পাতায় ইতিহাসের অজানা গল্প ছবির মত সাজানো। নিছক কেঠো ইতিহাস নয়, এ যেন সমসাময়িক অন্য এক জগতের গল্প পড়ছে সে। পুরনো সালেম শহরের কথাও লেখা আছে এতে। এক মুহূর্ত কাছ-ছাড়া করতে ইচ্ছা করছে না বইটা। কিন্তু একটানা অনেকক্ষণ ধরে পড়ছে। এবার একটু বিরতি নিতে হবে। জানলার বাইরে সন্ধ্যা নামছে। ঘরের ভেতরের আলো কমে আসছে। আলো জ্বালার জন্য ওঠে ভায়োলেট। বইটা আঙ্গুল দিয়ে মুড়ে নামিয়ে রাখতে যাবে ঠিক এই সময়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চমকে ওঠে সে। ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলের মরা আলোয় হাজার হাজার কালো কাক ডানার ঝাপটে আকাশ-বাতাস রুদ্ধ করে পশ্চিম দিকে উড়ে চলেছে। ঠিক একটু আগে পড়া বইয়ের দৃশ্য যেন সামনে ফুটে উঠেছে। ভয় পেয়ে হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায় বইটা। যে পাতাটা খুলে যায় তাতে তিতুবার কিশোরী বয়সের একটা ছবি আঁকা। এই মুখটা যে ভীষণ চেনা। এই মুখ সে কোথায় দেখেছে? বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ে যায়, স্কুলে তার প্রিয় ছাত্রীর কথা। বিলি। বিলিন্ডা গ্রিন। সেই মুখ, জোড়া ভ্রূ, ঝাঁকড়া কালো চুল আর কপালের মাঝখানে ঈষৎ অর্ধচন্দ্রের মত দাগ।
(ক্রমশ)
0 comments: