1

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in






আজ সকালে আমার এক পড়শী - বয়সে আমার চেয়ে বছর কুড়ি’র বড়ো - যাঁকে আমি দিদি বলে ডাকতাম, মারা গেলেন। না, করোনা মৃত্যু নয়। বয়সকালীন হৃদযন্ত্র বিপর্যয়ে মৃত্যু। সকাল দশটায় শেষ দেখা দেখতে গেলাম। তাঁর তিন ছেলে এক মেয়ে – সকলেই উপস্থিত। স্বামী আগেই গত হয়েছেন। শেষ বয়সের সব দায়িত্বই ছোট ছেলের পরিবার সামলেছে। ছোট ছেলের বৌয়ের এ নিয়ে যে একেবারে ক্ষোভ ছিলো না, তা নয়। আমার কাছে সে মন খুলে মাঝে মাঝে কথা বলতো। আমি আমার সাধ্যমতো তাকে সহ্যশক্তি জোগাতাম। মৃত্যুশয্যায় গিয়ে দাঁড়ালাম মহিলাদের ভিড়ে। আমি পুঁইডাঁটা চিবোতে ভালোবাসা নিতান্তই আটপৌরে গৃহবধু। শেষ প্রণাম সেরে বোকার মতো বলে ফেললাম –‘ওফ্‌, এই ক’টা দিন দীপা আর গৌতমের ওপর দিয়ে যা গেলো...’। অমনি পাশ থেকে শিক্ষিত মার্জিত রুচির এক মহিলা বলে উঠলেন – ‘ছোট ছেলে, ছেলে-বৌয়ের পক্ষ টেনে কিছু বলবেন না তো, সেয়ানা কম? – টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি সব নিজেরা দখল করেছে’। 

আমি কেমন ভেবড়ে গিয়ে পাতলা হতে শুরু করলাম। গুটিগুটি পায়ে পিছু হটে বাড়ি ফিরে ভাবতে বসলাম। আচ্ছা, ছোট বৌ দীপার জায়গায় যদি আমি হতাম, তাহলে কি আমি তিন বৌমার (মেয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম) দায়িত্ব একা নিজের কাঁধে তুলে নিতাম অর্থের লোভে? ইষ্টুম-উষ্টুম ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো, দীপা আমায় একাধিকবার বলেছে টাকাপয়সার হিসাব সে বোঝে না। ও সব তার স্বামীর ব্যাপার। সে সব কষ্ট সহ্য করছে শুধু স্বামীর মন রক্ষার জন্য। স্বামীর যে মা-অন্ত প্রাণ। তর্কের জন্য, নিরপেক্ষতার তাগিদে দীপাকে ডাকসাইটে অভিনেত্রী ভাবতে শুরু করলাম। ভাবতে ভাবতে মনে এলো – আজন্মকাল থেকে শুনে আসছি মেয়েরা যে মা হওয়ার শারীরিক কষ্ট দশ মাস দশ দিন ধরে সহ্য করে, তাও তো নাকি শিশুকন্ঠে ‘মা’ ডাক শোনার লালসায়। তাই বলে কি মায়ের কষ্টের মহিমা বিলীন হয়ে যায়? দীপা-গৌতম যদি তাদের অধিকারের সীমা লঙ্ঘণ করে সব সম্পত্তি কুক্ষিগত করে – নিঃসন্দেহে সেটা খারাপ কাজ। কিন্তু সেইজন্য মায়ের শেষ সময়ের (যেটা ছিলো তাদের কাছে অনির্দিষ্টকাল) দায়িত্ব পালনকে কেন ভালো বলা যাবে না – বুঝতে পারলাম না। 

ভাবনার জন্য কিছুদূর পিছনে তাকাতেই শুনতে পেলাম নয় সন্তানের বিধবা জননীর কাল্পনিক উক্তি – ‘নয়টাকে পেটে ধরেছি বটে তবে আমার স্থাবর-অস্থাবরসবই পাবে হেবো, একটু হাবা বটে, তবে মনটা ওর অসম্ভব ভালো’।আটজন কৃতি সন্তানের মায়ের নবম সন্তান হেবোর জন্য লজ্জাবোধ ছিলো না মোটেই। পেটের কলঙ্ক তো মনে করতেনই না। কৃতি এবং বোকা – সবই তাঁর নিজের। আঁকড়ে ধরতেন তাকেই, যে তার কাছের। সমান অধিকারের চিন্তা তার মাথায় আসতো না।জোর করে বোঝাতে গেলে বলে উঠতেন – ‘ও মা, এ আবার কেমন কথা? হাতের পাঁচ আঙুল আবার সমান হয় নাকি? জীবনের প্রথম দশমাস দশদিন যে স্থান দেয় সেই মাতৃগর্বের অধিকারী, তেমনি দ্বিতীয় শৈশবে সমস্ত প্রয়োজন মেটায় যে, সেই তো সেরা সন্তান। কর্তব্য বুঝলাম না, অধিকার বুঝে গেলাম, সমানাধিকার বুঝে গেলাম, নারীর অধিকার বুঝে গেলাম। 

আমি কোন নারী? নিজের বাবা মাকে পরের বাড়ির জিম্মায় রেখে দিয়ে স্বামীর বাবা মায়ের দায়িত্ব সম্পর্কে নিরন্তর সকল সন্তানের সমান কর্তব্যের বুলি আউড়ে যাওয়া সুবিধাভোগী নারী? পুঁইডাঁটার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার মেলবন্ধনে বিশেষ পারদর্শী নারী-যে বলে ছেলে মেয়ে আমার কাছে সমান - অধিকার সমান - তবে শেষ বয়সটা হয় ছেলের কাছে, নয় বৃদ্ধাশ্রমে - রক্ষে করো বাপু, জামাইয়ের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারবো না। অধিকার সমান, কিন্তু পরের বাড়ির মেয়ে আর পরের বাড়ির ছেলের কর্তব্য যে এক – এটা শেখাতে ব্যর্থ এক নারী। ছেলে মেয়ে উভয়েই যদি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়, তবু আমার কাছে ‘ছেলের বাড়ি’আর ‘জামাইয়ের বাড়ি’। 

আমাদের সংবিধান থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ কথাটি বাদ দেওয়ার ফন্দি আঁটছেন বর্তমান সরকার। তা নিয়ে শিক্ষিত মানবতাবাদীরা বিশেষ চিন্তিত। আমি অবশ্য বুঝেই উঠতে পারিনি সমাজতন্ত্র কী জিনিস – মাথায় মাখে না গায়ে দেয়। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সমাজতন্ত্র ধাঁচের সমাজব্যবস্থা গঠনের জন্য ভারত রাষ্ট্র কতদূর এগিয়েছে, ঠিক কোন্‌খানটাতেই বা বাধা পড়লো, এবং তার ফলে এদেশের ধর্ম, অর্থ, শ্রেণী বৈষম্যের শিকার যারা, তারা আর কতোটা নিম্ন মুখে পতিত হবে? হেবোর মা কি সুবিধাবাদী নাকি সমানাধিকার বুঝতে পারা এক নারী? 

বামজমানার শেষদিকে আমার ঘরের হিন্দু কাজের লোককে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম –‘আজ যে বড় তাড়াতাড়ি কাজে এলে?’ সে বলে উঠলো – ‘এখন যে রোজা চলছে বৌদি। ভোর থেকে জল আসে কলে। তাই তাড়াতাড়ি কাজ সারা হয়ে যায়। মুখপোড়ারা দোলের দিন দুপুরবেলা একঘন্টা জল বেশি দিতে পারে না। কিন্তু রোজার সময়ে গোটা মাস ভোর ৩টে থেকে জল দেয়। বার-এও বেশি দেয় গো’। আমি কল ঘোরালেই জল পাওয়া মানুষ। দোলের দিন আমার ঘরের কাজের মহিলাকে দোল খেলে ফেরা মাতাল স্বামী ছেলেকে কিভাবে জলের যোগান দিতে হয়, খোঁজ নিইনি। যতোই আটপৌরে হই না কেন ধর্মনিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছি। শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আমার স্বধর্মীয় লোকের ক্ষোভ যথার্থ কিনা খোঁজ নেওয়ারও দরকার বোধ করিনি। 

ন্যায্যই হোক আর অন্যায্যই হোক, হিন্দুদের জমা ক্ষোভকেই মূলধন করলো বিশেষ এক শ্রেণীর রাজনীতিক। কানাঘুষায় শুনতে পাচ্ছি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিও অচিরেই নাকি বিদায় নেবে ভারতীয় সংবিধান থেকে। মানবতাবাদীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়। মনে হলো বড়ো ভুল হয়ে গেছে। আমি সাধারণ মানুষ। যৎসামান্য আমার ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা সম্বল করে দরিদ্র হিন্দুর এইক্ষোভ কেন সময়মতো তুলে ধরিনি?আমার মতো হাজার হাজার সাধারণ মানুষের যান্ত্রিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ সেজে ওঠার সুযোগেই তো বিশেষ ধর্মীয় সংগঠন রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি হয়ে ওঠার সুযোগ পেলো! 

ঘড়িতে ৩টে বাজে। তৈরি হয়ে নিলাম। মৃতা পড়শীরবাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। মৃতদেহ বাড়ির বাইরে বের করার তোড়জোড় চলছে। আরেকবার প্রণাম জানালাম। সোজা গেলাম দীপার কাছে। দূরত্ববিধি মেনেই বলে উঠলাম – ‘তুই কাঁদছিস কেন? পরের বাড়ির মেয়ে হয়েও তুই তো কোনো কর্তব্যে অবহেলা করিস নি। ওঠ্‌, চারটে বাজতে চললো, তোর শাশুড়ির চা খাওয়ার সময়। আজকের বিকেলের চা-টাও আমাদের সকলের জন্য তুইই কর্‌।’ 

হ্যাঁ, পড়শীর প্রতি আমারমতো সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব আছে। পরিবার দিয়েই দেশ গঠিত হয়। তাই আমার কাঁধে বিশাল দায়িত্ব। সময়মতো সাদাকে সাদা বলার দায়িত্ব। ‘সাদা’ যে আসলে সাতটি রঙের সমাহার – সে তথ্য পৃথিবীকে জানানোর দায়িত্ব বিশেষজ্ঞের – আমার নয়।

1 comment: