গল্প - অনিন্দ্য গাঙ্গুলী
Posted in গল্প'কি ভাই, বাঙালি নাকি?'
কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে বাঁদিকে ঘুরে দেখি পাশের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। চোখে গোল কাঁচের চশমা। নাকের নিচে সিন্ধুঘোটকের মতো ঝোলা গোঁফ। মাথায় একটা হনুমান টুপি। আর গরম জামা যা চাপিয়েছেন তাতে এই বদ্রীনাথ তো কোন ছার্, দক্ষিণ মেরুও ঘুরে আসা যাবে!
ওপর নিচে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের শোভা দেখতে দেখতে দাঁত মাজছিলাম, মুখ ভর্তি টুথপেষ্ট। তাই কথা বলা মুশকিল।
'অঃ আমি দেখেই বুঝেছি। তা এখানে এলেন কবে?'
বাধ্য হয়ে টুথপেস্টটা গিলে ফেলতেই হলো। 'এই দাদা কাল রাতে।'
'বাড়ি কোথায়? কলকাতা?’বাঙালি শুনলেই কেন জানিনা লোকজন ধরে নেয় কলকাতায় বাড়ি।
জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, 'না না, চন্দননগর। ওই যেখানে খুব বড় করে জগদ্ধাত্রী পুজো হয়।'
গোঁফের নিচ দিয়ে এবার কয়েকটা দাঁত উঁকি মারলো। একটা দেঁতো হাসি হেসে ভদ্রলোক বললেন, 'আরে চন্দননগর চিনবো না কেন? তুমি তো দেখছি পাড়ার ছেলে ভাই। আমার বাড়ি ব্যান্ডেল।'
চন্দননগরের খান তিনেক স্টেশন পরে ব্যান্ডেল। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসলে ব্যান্ডেল চার্চ দেখাতে নিয়ে যেতে হয় বলে অনেক বার গেছি। সেটা ওনাকে বলতেই উনি বেশ প্রফুল্লতার সাথে বললেন, 'আমিও বেশ অনেকবারই চন্দননগর গেছি।'
'জগদ্ধাত্রী পুজোতে?'
'হ্যাঁ তাতো আছেই। আর তোমাদের ওই সিনেমা হলগুলো ছিলনা- জ্যোতি, জোনাকি- ওগুলোতে আগে প্রায়ই যেতাম।'
'জোনাকিতেও যেতেন?!’ ভ্রূ কপালে তুলে বললাম আমি।
সাথে সাথে ভদ্রলোক কেমন যেন শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন। 'এই দেখেছো- দেরি হয়ে যাচ্ছে। চান করে বেরোতে হবে। আসি ভাই, পরে কথা হবে' - বলেই কার্ল লুইসের মতো একটা লংজাম্প দিয়ে হোটেলের ঘরের ভিতর অন্তর্হিত হলেন। এদিকে আমি তখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হেসে কুটোপাটি! জোনাকি সিনেমা হলের সুনাম যে চন্দননগরের গণ্ডী ছাড়িয়ে হুগলি জেলার কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছে সেটা আমার কল্পনাতেও ছিল না!
এতক্ষণ অব্দি পড়ে জোনাকি সিনেমা হল সম্পর্কে আপনার যদি ঔৎসুক্য তৈরী হয়ে থাকে তাহলে দোষ দিতে পারিনা। তবে এই সিনেমা হলের যা প্রতিপত্তি তাতে আপনি হয়তো এই হলটির সম্পর্কে অবগত থাকতেও পারেন। আর তাই যদি হয় তাহলে হয়তো আপনি এখন মুচকি মুচকি হাসছেন।
জোনাকি ছিল চন্দননগরের একমাত্র সিনেমা হল যাতে সব কটা শোই হাউসফুল থাকতো। সে অনেকদিন আগের কথা। বাংলার বুকে তখনো পরিবর্তন আসেনি। উচমাধ্যমিকে তখন এক দিনে দুটো পরীক্ষা দিতে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের নাকের জল চোখের জল এক হতো। সে ছিল সিঙ্গল স্ক্রীনের জমানা। মাল্টিপ্লেক্স হয়তো একটা দুটো সবে হয়েছে কোলকাতাতে। সেগুলো খায় না মাথায় দেয় সেটাই জানতাম না। আর শহরের গুটিকতক সাইবার কাফেতে ইন্টারনেটের যা গতি ছিল তাতে একটা সিনেমা ডাউনলোড করতে গেলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিতে হতো। সেই সময়ে চন্দননগরের যত ফচকে ছোঁড়া আর মিচকে কাকুর বিনোদনের অন্যতম স্থল ছিল এই জোনাকি সিনেমা হল।
'মেরে লাইফ মে তেরি ওয়াইফ’, 'লেহেঙ্গে মে দমাদম’ জাতীয় সিনেমা আসতো ওখানে। মাঝেসাঝে অদ্ভুত সব নামের ইংরেজি সিনেমাও আনা হতো যার পোস্টারের দিকে বাবা-মার সামনে তাকালে বাড়িতে উত্তম-মধ্যম অনিবার্য ছিল। মাঝেসাঝে আবার পুরোনো হিন্দি সিনেমাও আনতো, তবে স্ক্রীনে যখন ফুলরা নিজেদের গায়ে ঢলে পড়ছে তখন অন্য কোনো সিনেমার ক্লিপিংস চালিয়ে দেয়া হতো দর্শনার্থীদের জ্ঞানবৃদ্ধির নিমিত্ত।
সিনেমা হলটি কে তৈরী করেছিলেন আমার জানা নেই তবে তাঁর দূরদর্শিতার তারিফ করতে হয়। সব থেকে বড় যেই ছেলেদের স্কুল ঠিক তার পাশে। স্বাভাবিক ভাবেই দুপুরের শোতে স্কুলের জামা-কাপড় পড়া ছেলে-পিলে হলে হামেশাই দেখা যেত। অনেক আরবান মিথও ছিল হলটিকে ঘিরে। কোন ছাত্র দুপুরে স্কুল পালিয়ে হলে গিয়ে লাইনে কোন শিক্ষককে দেখেছে- কে আবার হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সময়ে দেখেছে পাশে বাবা বসে আছে, তার পর দুজনেই দুজনকে 'মাকে বলে দেব’ বলে ব্ল্যাকমেল করেছে। তবে এসব কতটা সত্যি আর কতটা গল্প সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। তবে একটা কথা স্মীকার করতেই হবে- হলটি সাম্যবাদের এক আশ্চর্য নিদর্শন ছিল। স্কুলের পোশাক পরা ছাত্র, মুখ ঢাকা চাকুরীজীবি, লুঙ্গি পরা রিকশাওয়ালা সবাই একই সাথে বসে উপভোগ করতো আদিরস।
স্কুলে পড়ার সময়ে এই হলে যাওয়া ছিল শঙ্করের চাঁদের পাহাড় অভিযানের মতোই উত্তেজক এক অ্যাডভেঞ্চার- যার পদে পদে বিপদ। কে কখন দেখে বাড়িতে বলে দেবে কে বলতে পারে! মনে আছে আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় একবার এই হল-এ গেছিলো গরমকালে জ্যাকেট আর টুপি পরে-লোকের নজর এড়ানোর জন্য। খুব অদ্ভুত পরিবেশ ছিল সেই হলের। অদ্ভুত একটা নীলচে আলো জ্বলতো এমনকি সিনেমা চলাকালীনও। সিলিং ফ্যানগুলো প্রায় কোনোটাই কাজ করতো না বলে এদিকসেদিক অনেকগুলো স্ট্যান্ড ফ্যান রাখা থাকতো। একবার সিনেমা শুরু হলে সিটির চোটে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার জোগাড় হতো।
নীলচে আলোতে সিনেমার ফাটা সাউন্ড বক্সের শব্দ, সিটির আওয়াজ আর তার সাথে স্ট্যান্ড ফ্যানের ঘড়ঘড়ানি সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশের জন্ম দিতো।
বেশ মনে আছে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর চাকরি পেয়ে যখন বেঙ্গালুরু যাবো তখন বেশ কিছু বন্ধু দাবি তুলেছিল যে যাওয়ার আগে শেষ একবার জোনাকি গিয়ে বন্ধুত্ব উদযাপন করা হোক। যাওয়া হয়েছিল কিনা সেটা পরের প্রশ্ন কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে হলটির একটা কাল্ট স্টেটাস ছিল।
বাবা-মার সাথে কেদার বদ্রি ঘুরতে যাবার জন্যে যেবার বাড়ি এলাম সেবার একদিন সন্ধেবেলায় সাইকেল চালিয়ে পুরোনো স্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, তখন চোখে পড়লো যে হলটির সামনেটা কেমন শুনশান। আলোয় ঝলমল রাস্তার পাশে অন্ধকারের কম্বল চাপিয়ে হলটা কেমন যেন প্রেতাত্মার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে শুধালাম 'ব্যাপার কি? জোনাকিতে লোকজন নেই দেখলাম।'
'আর বলিস না। বন্ধ হয়ে গেছে।'
বন্ধ হয়ে গেছে কিরকম! পরক্ষণে মনে হলো আজকাল সস্তার ইন্টারনেটের যুগে হলটা হয়তো নিজের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। এটাই হলো আধুনিক সভ্যতার অভিশাপ। বেশ দার্শনিকের মতো বললাম, ’কি আর বলবো ভাই! বিশ্বায়নের গুঁতোয় আমাদের সংস্কৃতি আর পরম্পরা একের পর এক হারিয়ে যাচ্ছে।'
'সে সব কিছু না।’ বললো এক জন, ’পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে।'
'পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে? আর তাই নিয়ে কোনো বিক্ষোভ, ধর্ণা, প্রতিবাদ সভা কিছুই হলো না?'
'হলে আগুন লেগেছিলো শো চলার সময়ে। ভাগ্য ভালো কেউ মারা যায়নি তবে কয়েকজন পুড়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। তারপরেই পুলিশ বন্ধ করে দিলো। ওদেরতো ঐসব সিনেমা চালানোর পারমিশনও ছিল না। আগুন লাগার পর কাগজে এই নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল- তুই কিরে! কিছুই শুনিসনি এসব?'
নাঃ। স্মীকার করতেই হলো যে আমার কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ইদানিং বেশ দুর্বল। চাকরির গুঁতোয় নিজের শহরের খবরাখবরও ঠিকঠাক নেয়া হয়না। ফেরার আগের দিন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হলটার পাশ দিয়ে একবার সাইকেল চালিয়ে গেলাম।
এর পর বছর খানেক কেটে গেছে। পুজোর সময়ে ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছি। ব্যাঙ্কে কিছু কাজ ছিল বলে সকাল সকাল বেরিয়েছিলাম। তখন চোখে পড়লো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য যাতে আমার হৃদয় শুধু ময়ূর কেন- জলহস্তী, ওরাংওটাং বাঁ এমনকি মত্ত হস্তীর ন্যায় নেচে উঠলো। জোনাকি হলটা বেশ ঝলমলে দেখাচ্ছে যেন সদ্য চুনকাম করা হয়েছে। সামনেটা বেশ সুন্দর সাজানো, ফুল, ঝালর ইত্যাদি দিয়ে। সামনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কিছু লোককেও ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। বাঃ এই তো চাই। আমরা বাঙালি। আমরা ঐতিহ্যসচেতন। আমরা কিছুতেই আমাদের মহান ঐতিহ্যগুলোকে হারিয়ে যেতে দিতে পারিনা। তবে জোনাকি তো দুপুর বেলায় খুলতো। তাহলে এখন সকালে লোকজন কি করছে ওখানে? মনে হলো যে কয় বছর বন্ধ ছিল সেই কয় বছরের না দেখাতে পারা শোগুলোর লোকসান পুষিয়ে দেওয়ার জন্য এখন হয়তো সকাল সকালই শুরু করে দেয় সিনেমা দেখানো। লোকজন হয়তো এতে এতটাই উৎফুল্ল যে নিজেরাই সাজিয়ে নিয়েছে হলের সামনেটা। তবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবিটা নতুন ড্রেস কোড কিনা ঠিক বুঝলাম না।
ব্যাঙ্কের কাজটাও খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। খুশি মনে শিষ দিতে দিতে বাড়ি ঢুকছি এমন সময়ে একটা শক খেলাম। যেটা শুনলাম ঠিক বিশ্বাস হলোনা। ঠিক শুনেছি কিনা যাচাই করে নেয়ার জন্য বললাম, ’কি বললে মা? আরেকবার বলো।'
'বলছি সন্ধেবেলায় জোনাকিতে যাবো। তুইও যাবো আমার সঙ্গে?'
জোনাকি আবার খোলায় লোকজন আনন্দিত বুঝলাম। কিন্তু এতটাও ঠিক স্বাভাবিক নয় যে মা আমাকে নিয়ে ওখানে সিনেমা দেখতে যাবে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, ’জোনাকি... মানে কেন? কি সিনেমা চলছে এখন?'
'সিনেমা কেন চলবে?’ একটা ধাতানি দিলো মা, ’তোর যত সব উল্টো-পাল্টা কথা। এই আজেবাজে বন্ধু গলোর সাথে মিশেই…'
কথা বেলাইনে চলে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বললাম, ’কি করতে যাবে ওখানে?'
'ওখানে আজ সৎ সঙ্গ আছে।'
'সৎ সঙ্গ করার জন্য অত দূরে যাবে কেন? আমি তো অসৎ নই। বরং রীতিমতো সৎই বলা চলে। আমার সাথে বসে গল্প করলেই তো তোমার সৎ সঙ্গ হয়ে যাবে।'
'তোর যত ফালতু ইয়ার্কি। ওখানে আজ প্রবচন দেবেন গুরুজী।'
কথাবার্তা বলে যা বুঝলাম কোনো এক প্রখ্যাত গুরুজী নাকি জোনাকি হলটা সম্প্রতি কিনে নিয়েছেন। ওখানে নাকি তার একটা আশ্রম হবে। প্রেক্ষাগৃহটাকে অডিটোরিয়ামের মতো ব্যবহার করাটাই প্রধান উদ্দেশ্য। আজকে নাকি তার উদ্বোধন করতেই চন্দননগরের বুকে তিনি আবির্ভূত হবেন। এবং সন্ধে সাত ঘটিকায় তাঁর শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত অমৃতধারা শুনে আমাদের কর্ণদ্বয় ধন্য করার একটা সুযোগ থাকবে। মায়ের মর্নিং ওয়াকের এক সঙ্গিনী নাকি এই গুরুজীর ভীষণ ভক্ত। সকাল সকাল ওনার বাণী চালানোর পর থেকে ওনার বাড়িতে হনুমানের উপদ্রব নাকি একদম বন্ধ হয়ে গেছে। তিনিই মাকে খুব করে ভজিয়ে সৎসঙ্গের টিকেট গছিয়ে দিয়েছেন দুইখানা। বাবা যেতে নারাজ। তাই এখন একমাত্র ভরসা ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো এই আমি!
মনে মনে বললাম বিধির একি অদ্ভুত বিধান। এককালে যে জায়গাটার নাম নেয়াও পাপ ছিল আজ সেইখানেই লোকজন পুন্য অর্জনের জন্য ঢুকবে। সেজন্যই তো কবি বলেছেন চক্রবৎ পরিবর্তন্তে ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাই হোক সন্ধে বেলায় মাকে নিয়ে যথা সময়ে পৌঁছে গেলাম জোনাকিতে। বেশ ভালোই লোক হয়েছে। হলের মধ্যে গিয়ে একটা ভালো দেখে সীট নিয়ে নিলাম। ভিতরটা এরা একেবারে পাল্টে ফেলেছে। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান। নীল আলোগুলোও আর দেখছিনা। চেয়ার গুলোও আগের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থায়। সন্ধে পৌনে সাতটা নাগাদ গুরুজীর এক চেলা মঞ্চে উঠে ঘোষণা করলো যে ১৫মিনিটের মধ্যে গুরুজী মঞ্চে আসবেন। তারপর সাতটা, সাড়ে সাতটা হয়ে যখন আটটা বাজলো তখনো গুরুজী এলেন না। মৃদু ফিসফিসগুলো যখন ধীরে ধীরে ক্রূদ্ধ গর্জনে রূপান্তরিত হচ্ছে তখন মঞ্চে উঠলেন গুরুজীর আরেক চেলা। গুরুজী নাকি সুস্থই ছিলেন। কিন্তু মঞ্চে ওঠার ঠিক আগে থেকে ওনার প্রবল হাঁচি শুরু হয়। সাথে সাথে গলায় প্রবল ব্যাথা আর হালকা জ্বর। গলা নাকি তাঁর এতটাই বসে গিয়েছে যে তা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। অগত্যা তিনি আজ আমাদের সামনে বক্তব্য রাখতে পারবেন না। কিন্তু এই মুশকিলের একটি আসানও পাওয়া গিয়েছে। গুরুজী নাকি কোথাও বক্তব্য রাখার আগে বার কয়েক সেটা ক্যামেরার সামনে অনুশীলন করে নেন। উদ্দেশ্য- ভুল ভ্রান্তি কিছু থাকলে শুরুতেই সেটা সামলে নেয়া। তাঁর সেই ক্যাসেটটাই চালিয়ে দেখানো হবে আজকে। গুরুজী ভিতরের এক ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। বক্তৃতা শোনার পর সবাই সুযোগ পাবে ওনাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করার।
ফিসফাস গলো শান্ত হয়ে গেল আবার। ওপর থেকে নেমে এলো সাদা স্ক্রিন। হলের আলোগুলো সব নিভে গেল। বড় পর্দায় ভেসে উঠলো গুরুজীর আবক্ষ মূর্তি। প্রশান্ত ব্যারিটোন গলায় শুরু হলো তাঁর বক্তৃতা। নাঃ, সাউন্ড বক্সটার উন্নতি হয়েছে দেখছি। আওয়াজ ফেটে যাচ্ছে না। বক্তৃতার ৫ মিনিটও হয়নি হঠাৎ কেমন যেন একটা ঘ্যাসর ঘ্যাসর আওয়াজ শুনতে পেলাম। পাশে তাকিয়ে আবছা আলোয় দেখলাম একটা স্ট্যান্ড ফ্যান। সিলিং ফ্যান গুলো তো ছিলই। আবার স্ট্যান্ড ফ্যান দেওয়ার কি প্রয়োজন?
'এগুলো কখন দিয়ে গেল দেখেছিলি?’ মা বললো। সত্যিই তো! আমার খুব কাছেই তো পাখাটা। কেউ দিয়ে গেলে তো চোখে পড়ার কথা। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি আরো বেশ কিছু স্ট্যান্ড ফ্যান। যাব্বাবাঃ! এটা আবার কি করে হলো? পাশ ফিরতে গিয়ে মনে হলো চেয়ারটাতে ক্যাঁচ করে আওয়াজ হলো। বেঙ্গালুরুতে দেদার ভাল্লুক সেবন করে আমার ওজন বেড়েছে ঠিকই কিন্তু এতটাও বাড়েনি যে চেয়ার নড়বড়ে হয়ে যাবে তাতে। একটু অদ্ভুত লাগলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম বেশির ভাগ লোকজনেরই এই সব দিকে হুঁশ নেই। সবাই মন দিয়ে গুরুজীর বাণী শুনছে। লোকজনের কিন্তু ধৈর্যচ্যুতি হতে আরম্ভ করলো যখন একটু পরে আচমকা গুরুজীর গলার স্বরটা ফেটে যেতে শুরু করলো। তারপরেই বড় পর্দায় গুরুজীর মূর্তিটা কেমন যেন দপদপ করতে লাগলো। একবার জ্বলছে একবার নিভছে। কি যে হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এবার একটা নতুন জিনিস হলো। গুরুজীর ছবি যখন নিভছিলো তখন স্ক্রীন-এ অন্য কোনো একটা সিনেমার মতো কিছু একটার ছবি আবছা আবছা আসছিলো। অন্য কারুর কথা জানিনা। আমি কিন্তু চিনতে পেরেছি সেটা। 'তুমি বসো, আমি এক মিনিট একটু আসছি’ বলেই দৌড় লাগলাম প্রোজেক্টরের ঘরের দিকে। নিশ্চয় কিছু একটা গড়বড় করেছে ওরা। পুরোনো কোনো ক্যাসেট চালিয়ে দিয়েছে কিনা কে জানে! প্রজেক্টরের দায়িত্বে যে লোকটি ছিল তাঁর চোখ মুখ দেখে বুঝলাম সেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কি হচ্ছে। জিজ্ঞেস করতে বললো যে ক্যাসেটটা সে বেশ কয়েকবার চেক করে নিয়েছিল চালানোর আগে, তখন সব ঠিকঠাকই ছিল। আমি বললাম তাড়াতাড়ি বন্ধ করো তাহলে। চোখের সামনেই দেখতে পেলাম সম্প্রচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। কোনো সুইচ কাজ করছে না। প্লাগ খুলে নেয়ার পরেও যখন কিছু হলো না তখন দুজনেই কেমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। নিচে যেতে গিয়ে দেখি প্রোজেক্টর রুমের দরজা খুলছে না। কৌতূহলবশত নিচে তাকিয়ে মনে হলো হল থেকে ঢোকবার বেরোবার সব কটা দরজাই যেন বন্ধ। হলের মধ্যে কেমন একটা মিটমিটে নীল আলো। কোথা থেকে ভেসে আসছে যেন অসংখ্য সিটির আওয়াজ। ফাটা সাউন্ড বক্সের শব্দ, স্ট্যান্ড ফ্যানের ঘড়ঘড় আর সিটির আওয়াজ সব মিলে এক অদ্ভুত পরিবেশ রচনা করেছে। অতৃপ্ত প্রেতাত্মার কথা শুনেছি। কিন্তু এ কি? অতৃপ্ত হল নাকি অতৃপ্ত হলাত্মা? এত দিনের না পাওয়ার প্রতিশোধ কি সে নিতে চায় তার পছন্দ মতো কোনো এক সন্ধ্যার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে? বড় পর্দায় তখন ফুটে উঠছে সিনেমার নাম... লেহেঙ্গা মে দমাদম!
গ্রেট!!
ReplyDelete