undefined
undefined
undefined
প্রবন্ধ - শুক্লা পঞ্চমী
Posted in প্রবন্ধ
"অচিন পাখি"- আধ্যাত্মবাদে এক সুপরিচিত নাম। যাকে শিল্পে সাহিত্যে গানে কবিতায় নানাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। আধ্যাত্মবাদ নিয়ে আমার সারা জীবনের আগ্রহ। বিশেষ করে জন্ম এবং মৃত্যু। একটা প্রক্রিয়ায় মানুষের জন্ম হয়। ধীরে ধীরে কাঠামো গড়ে উঠে। অজস্র সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অণু পরমাণু নিয়ে কাঠামোটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। এই যে দেহ পরিচালনাকারী শক্তি – কেউ কেউ তাকে অচিন পাখি বলে আখ্যায়িত করেছেন। জন্মমৃত্যুর রহস্যের কোনও কূলকিনারা নেই। যুগ যুগ ধরে বহু দার্শনিক আধ্যাত্মবাদকে নানাভাবে নানারকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিজ্ঞানীরাও বাদ যাননি। খুঁজেছেন, এখনো খুঁজে চলেছেন এর স্বরূপ। আপাতদৃষ্টিতে জন্মের রহস্যে বিজ্ঞানীরা বেশ খানিকটা এগিয়েছেন। কিন্তু মৃত্যুর ব্যাপারে একেবারেই ধোঁয়াশায়। মৃত্যুকে ভয় নেই এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। মানুষ জীবনকে বড্ড ভালবাসে, তাই হয়তো মরণকে ভয় পায়। মরণভীতি শুধু মানুষের বেলায় নয়। অন্যান্য প্রাণীরাও এর থেকে আলাদা নয়। একটা বাঘকে যখন আটকে ফেলা হয়, প্রথমেই যে ভীতিটা কাজ করে তা হচ্ছে মৃত্যুভয়। সাপের ক্ষেত্রেও তাই। একটা সাপ তখনই আঘাত করে যখন বোঝে সে বিপদগ্রস্ত। হয়তো ভাবে, সে মৃত্যুর সম্মুখীন। জন্ম এবং মৃত্যুকে ঘিরে কিছু অদ্ভুত জিনিসও ঘটে। যেটাকে বলে মিরাক্ল। যেখানে বিজ্ঞান বা ধর্ম দুটোই যুক্তিহীন হয়ে পড়ে। লালনের গানটিই তখন যথার্থ বলে মনে হয়...
চিরদিন পোষলাম এক অচিন পাখি
ভেদ পরিচয় দেয় না আমায়
সেই ভেবে ঝরে আঁখি—
কী অদ্ভুত দর্শন! নিজের দেহের ভিতর বাস করে যে পাখিটা, তাকে আমরা চিনতে পারি না। কী বলে বিজ্ঞান? বৈজ্ঞানিক যুক্তি আদৌ কি ফলপ্রসূ?
এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরাও দ্বিমত পোষণ করছেন। বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকগণ মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রশ্নে সংশয়বাদের আশ্রয় নেন। বিজ্ঞানীরা কেউ কেউ বিশ্বাস করেন ব্রেনের বাইরেও আত্মা বলে একটা জিনিস আছে। যেটা চলে গিয়েও কখনো কখনো মৃত ব্যক্তির শরীরে ফিরে এসেছে। আমরা জানি আত্মার দুটো কাল আছে – ইহকাল এবং পরকাল। লোকায়ত মতবাদ থেকে এ ধারণা এসেছে। অনেক মানুষ মনে করে মৃত্যুর পর আত্মা বেঁচে থাকে। কোনও কোনও ধর্ম মনে করে আত্মার পুনর্জন্ম হয়। আবার কোনও ধর্ম মনে করে, ইহকালের কর্মফলের কারণে আত্মা শাস্তি পায়। মূলত পরকালের আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার্য। অধিবিদ্যিয় (মেটাফিজিক্স) মডেলগুলো বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর আত্মা বেঁচে থাকে। অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স কী, সেটা স্বল্প পরিসরে জেনে নেওয়া যাক। মেটাফিজিক্স হল দর্শনের একটি শাখা, যা বিশ্বের অস্তিত্ব, আমাদের অস্তিত্ব, সত্যের ধারণা, বস্তুর গুণাবলী, সময়, স্থান, সম্ভাবনার দার্শনিক আলোচনা করে। এই ধারার জনক দার্শনিক অ্যারিস্টটল।
Metaphysics is the branch of philosophy that examines the fundamental nature of reality, including the relationship between mind and matter, between substance and attribute, and between potentiality and actuality.
অধিবিদ্যায় দুটো মূল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়-
১-সর্বশেষ পরিণতি কী?
২- কিসের মত?
এই দুটো ধারাই বস্তু বা সত্তার অন্তর্নিহিত রূপকে জানার চেষ্টা করে। বাস্তবিক অর্থে আত্মা বা স্পিরিট নিয়ে সর্বশেষ কোনও সমাধান কেউ দাঁড় করাতে পারেননি। মানুষ নিজের মত করেই ভেবে নেয়। মৃত্যুভীতি নিয়েই জীবনকে চালিয়ে নেয়।
সবার মত আমারো মৃত্যুভয় ভয়ঙ্কর। ছোটবেলায় কেউ মারা গেছে শুনলে ঘর থেকে বেরোতাম না। মায়ের আঁচল ধরে বসে থাকতাম। বাথরুম পেলে খুব চেপে যেতাম। মায়ের সামনে সহজে আওয়াজ বের করতাম না। এতো ভয় পেতাম দেখে মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, কৃষ্ণনাম জপ করলে ভয় চলে যায়। এই বিশ্বাস নিয়ে মনে মনে এগোলেও বাস্তবে খুব একটা কাজে লাগাতে পারিনি। বিশেষ করে রাতের বেলায় কিছুই কাজে আসতো না। গ্রামের বাড়ি ইলেক্ট্রিসিটি নেই, আমগাছ জামগাছ বাঁশঝাড়ের মটমট শব্দ সবই যেন মৃত্যুভীতির পরিপূরক। এর মধ্যে পুড়িয়ে ফেলা মনে হলে শিরশির করে উঠত গা। আর কবরের ব্যাপারটা আরো ভয়ঙ্কর। সাদা কাপড়টা নিয়ে নাকি লাশ উঠে আসে। এরকম দুই একবার আমাদের বাড়ির গোরক্ষক হরিকাকার মুখে শুনেছি। হরিকাকার স্টকে কত গল্প যে ছিল! তা এই ভীতু অতি আগ্রহী মানুষটিকে না বললেই যেন নয়।
মৃত্যু জিনিসটা শুধু ভয়েরই নয়, বেশ আগ্রহেরও। যত ভয় পেতাম তত আগ্রহ জন্মাত। মৃত্যু নিয়ে ভাবেননি এমন কেউ নেই। তবে কেউ কেউ মৃত্যুকে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছেন। মৃত্যু ভাবনা নিয়ে আমার আজকের লেখা অচিন পাখির টানে। মৃত্যুকে কে কিভাবে দেখেন। এই যে দেহের ভিতর অচিন পাখি, তাকে তো সবাই অনুধাবন করেন। লালন দর্শনে বারেবারে তুলে ধরেছেন খাঁচা আর পাখি। যে কিনা দেহ নামক খাঁচাতে আটকে থাকে। সময় হলেই খাঁচা ফেলে চলে যায়।
মৃত্যুকে ভাবেন না এমন কেউ নেই। রবীন্দ্রনাথও মৃত্যু নিয়ে দোদুল্যমান ছিলেন। চলে যাওয়ার বেদনা যেমন তাঁকে তাড়িত করেছে, তেমনি মৃত্যুকে আহবান জানিয়ে শ্যামের সাথে তুলনা করেছেন। কখনো মৃত্যুকে চিরশান্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন। 'মৃত্যুতে চিরশান্তি'। আদৌ কী তাই? কেন? ভয়ঙ্কর ভীতু মানুষটি স্বয়ং তিন তিনটে মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখেছি। এবং তিনটি মৃত্যুতেই পাখি নামক জিনিসটাকে চলে যেতে অনুভব করেছি। অসম্ভব দ্বিপার্শ্বিক টানাটান গমনরত মানুষটিকে ক্লান্ত করে তোলে। একদিকে বেঁচে থাকার মায়া ,অন্যদিকে চলে যাওয়ার বেদনা প্রতিটা শিরায় শিরায় যেন সঞ্চালিত হয়ে ওঠে। তার মুখ, নিঃশ্বাসপতন ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে।
খুব কাছে থেকে দেখা সম্প্রতি আমার বাবার মৃত্যু। ঠিক দুপুর বারোটা পাঁচ। আমি বাবার হাত ধরে বসে আছি। ঘাম হচ্ছে ত্বকে, অনুভূত হচ্ছে কিন্তু বাইরে বোঝা যাচ্ছে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি মুখের দিকে। মনে হচ্ছে কার সাথে যেন লড়াই করে যাচ্ছে। ছোট্ট পাখিটা গলার কাছে ঘরঘর শব্দে কিচির মিচির করে যাচ্ছে। জিভটা শুকিয়ে আসছে বারবার। একফোঁটা একফোঁটা করে জল দিয়ে যাচ্ছি। এটাও যেন পরপারে যাওয়া এক যোদ্ধার সাথে সামিল হওয়া। হঠাৎ দেখলাম খুব বড় করে হাঁ করছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা যেন বেরোবে। তাকে চলে যাওয়ার জন্য যেন পথ খুলে দিচ্ছে। সেই হাঁ ক্রমশ বড় হতে থাকল। উপুড় হয়ে তাকিয়ে থাকলাম মুখের দিকে। দেখলাম ক্যাচ করে শব্দ করে কী যেন বেরিয়ে গেল। যা ধরার জন্য আমার বাবা দুইবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। কিন্তু না, পাখিটা সত্যি খাঁচা ফেলে চলে গেল। পালস বিট দেখলাম আস্তে আস্তে চলছে। হার্টও সচল। খুব ধীর লয়ে থামাচ্ছে তার গাড়ি। এবারো টের পেলাম মানুষের শরীরে আত্মা বা স্পিরিট নামে একটা অচিন পাখি থাকে। যার শরীরের অন্যান্য অর্গ্যানগুলোর সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। সে থাকলে তারা সচল না থাকলে অচল। আমার মত মৃত্যু নিয়ে অনেকেই ভেবে থাকেন। বিখ্যাত ব্যক্তিরাও এর থেকে আলাদা নন, যেমিনটি আমি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বলেছি।
মৃত্যু নিয়ে কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের উক্তি থেকেও জানা তাদের মৃত্যু ভাবনা।
"জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন নদে?" মাইকেল মধুসূদন দত্ত
"মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়" -- সমরেশ মজুমদার
"আমি মনে করি মৃত্যু হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ উদ্ভাবন। এটি জীবন থেকে পুরনো ও সেকেলে জীবন থেকে মুক্ত করে" -- স্টিভ জবস
"এই যে বেঁচেছিলাম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, যেতে হয় সবাইকে অজানা গন্তব্যে। হঠাৎ ডেকে উঠে নাম না জানা পাখি অজান্তেই চমকে উঠে জীবন, ফুরলো নাকি! এমনি করেই সবাই যাবে যেতে হবে" রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ
জীবনানন্দ তাঁর "মানুষের মৃত্যু হলে" কবিতায় বলেছেন-
মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনায় পরিমাপ নিতে আসে
বলতে গেলে জীবন ও জীবনবোধ এবং মৃত্যু নিয়ে বলে গেছেন সব গুণীজন। ভাবি এই যে, জন্মরহস্য হাজার হাজার শুক্রাণুকে ঠেলে নিজের জায়গা করে নেওয়া পরবর্তীতে শুধু ঠাঁই ঠাঁই নাই করে তরী ভারী করা... এসবই বেঁচে থাকার চরম স্বার্থপরতা কিনা।
আজকাল মানুষের দৌরাত্ম্য ভাবিয়ে তুলছে। কী না করতে পারছে মানুষ। বলতে গেলে জন্মমৃত্যু নিয়েও খেলছে। জন্মমৃত্যু নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। যদিও ধর্ম এবং বিজ্ঞান এ নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে আগেই আলোচনা করেছি। সেদিকে আর আলোকপাত করতে চাচ্ছি না। আমার আলোচ্য বিষয় জন্ম এবং মৃত্যুর অচিন পাখি। মানুষের আগমন থেকে প্রস্থান। এই দুইয়ের মধ্যিখানের সময়টা শুধুই লড়াই। বাস্তব পরাবাস্তবতার অন্তক্ষরণের সমীকরণ। হিন্দু শাস্ত্রে মানুষের জীবন কর্মকে চারটা ভাগে ভাগ করেছেন।
ব্রহ্মচর্য
গার্হস্থ্য
বাণপ্রস্থ
সন্ন্যাস
জীবনের প্রথম ভাগেই রয়েছে শিক্ষা। গুরুসমেত বিদ্যাপিঠে পরবর্তী জীবন যাপনের জন্য সুশৃঙ্খল জ্ঞান অর্জন করা। গুরুকুলকেই শিক্ষার প্রথম পাঠ ধরা হয়। যার পাঠক্রিয়া রামায়ণ ও মহাভারত এবং বেদে পরিস্কার ভাবে পাওয়া যায়। সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ "কোরানুল করিমে" আছে জন্ম থেকে কবর অবধি শিক্ষা। অর্থাৎ সুশৃঙ্খলতা। শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা। তার কৃতকর্মই তার পথ নির্দেশনা দেবে। মৃত্যুর পরে আদৌ কোন কিছু আছে কিনা তা কোনদিনই মানুষ জানতে পারবে না। শরীর থেকে অচিনপাখি বেরিয়ে গেলেও মানুষের চোখেমুখে ভেসে উঠে শান্তির ছাপ। মনে হয় দীর্ঘপথচলার ক্লান্তিময় ঘুম। যা রবীন্দ্রনাথের গানের মতই বলতে হয় "এইখানে শান্তির পারাবার"।
এই লেখাটা যখন শুরু করেছিলাম তখন টিনের চালে টুপটুপ বৃষ্টি পড়ছে। ফিকে হয়ে গিয়েছে দিনের আলো। বলা চলে সন্ধে, তবুও খানিকটা বিকেলের আমেজ একপাটি খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সন্ধিক্ষণের দ্বৈরথ। অর্থাৎ বিকেল বলছে যাবো না, সন্ধে বলছে আমি এসে গেছি। কী অদ্ভুত নিয়ম প্রকৃতির মাঝে! চলে গিয়েও আবার ফিরে আসে নতুন রূপে। প্রাণীদের বেলায় তা হবার নয়। এখন শ্রাবণ মাস। আকাশের মনের কোনও স্থিরতা নেই। যখন ইচ্ছে ঢলে পড়ছে। একটু আগেও বোঝার উপায় ছিল না এমন হুড়মুড় করে বৃষ্টি ঝরবে। দুদিন হল বেড়াতে এসেছি। গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সমতল ভূমি সুসং দুর্গাপুরে। উদ্দেশ্য, শতবর্ষী শাশুড়িমাতাকে দেখা। প্রহর গুনছেন অমোঘ নিয়মের। শ্রাবণ মেঘের ধারাপাত শুনে হঠাৎ বলে উঠলেন "এটা কী শ্রাবণ মাস?" জানিনা শ্রাবণের বৃষ্টিপতন তাঁর মনের উপর কী রেখাপাত করেছে। আমিও ভাবছি, এই যে ঠাণ্ডা অক্সিজেন বুক ভরা নিশ্বাস অচিন পাখির অস্তিত্বকেই ধারণ করে। আমি রোজকার মত দেহের খাঁচা ধুই, পরিষ্কার করি মুছে রাখি সযতনে। পাখি শূন্য হলে সবই বৃথা। সাধ আর সাধ্যের খুনসুটিতে পড়ে মনটা মাঝেমাঝে বিগড়ে যায়। তখন মৃত্যুর মত সরল সত্যকে অনেকটা শ্যামের মতই লাগে। দূরে বাজে অষ্ট আঙুল বাঁশের বাঁশি আর আমি নির্জনে খুঁজি আত্মহারা কবিতা। যে কবিতা ছুঁয়ে যায় শূন্য খাঁচায়। আমার স্মৃতি বিস্মৃতির মধ্য সীমানায়। সক্রেটিসের মৃত্যু ভাবনা দিয়ে আমার সামান্য ভাবনার পরিসমাপ্তি টানছি "I to die, you to live, which is better only God knows."
0 comments: