someপ্রতীক - সৌমিত্র বসু
Posted in someপ্রতীক
বহুরূপীতে অনেক সময় দুপুর থেকে মহলা হয়ে সন্ধ্যের মধ্যে শেষ হয়ে যেতো। আমরা ছেলে ছোকরারা সেই সুযোগে উত্তর কলকাতায় পেশাদার থিয়েটারের নাটক দেখতে যেতাম। আমাদের দলের পাণ্ডা ছিলো রমাপ্রসাদ বণিক। দু-চারটে ছবি করার সূত্রে সেই সময়েই তার সঙ্গে এই সব পেশাদার অভিনেতাদের যোগাযোগ হয়ে গিয়েছিলো, ফলে পয়সা-কড়ি কিছু খরচ করতে হতো না। এই রকমই একদিন, দল থেকে বেরিয়ে দেখা গেল সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে। থিয়েটার পাড়ায় পৌঁছোতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তার চেয়ে যাই, কলামন্দিরে ঢুকে পড়ি। বহুরূপীর মহলাঘর লোয়ার রেঞ্জে, কলামন্দির সেখান থেকে হাঁটা পথে মিনিট পাঁচেক। মাটির ওপরের কলামন্দিরে তখন মৃচ্ছকটিক নাটকের অভিনয় হচ্ছে। কেউ একটা কানে কানে বললো, বসন্তসেনা যে করছে, মেয়েটা বাঙালী। জানিস তো, নাম ঊষা গাঙ্গুলি। অজ্ঞতার থেকেও তো মানুষ অনেক সময় সত্যি কথা বলে ফেলে। ঊষাদি যে বাঙালী নয়, সেটা তো আইনের সত্য, সরকারি সত্য। কিন্তু সেসব কাগুজে সত্যের বাইরেও তো কিছু সত্য থাকে, কী নাম দেবো তার, হৃদয়ের সত্য? সেখানে ঊষাদি বাঙালী। একশো ভাগ বাঙালীই। কিংবা, তুলনাটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো হয়তো, রবীন্দ্রনাথের গোরা যেমন একই সঙ্গে আইরিশম্যান, হিন্দু এবং ভারতীয় মানুষ। ঊষাদি তার তুলনায় অনেক ছোট পরিসরে একই সঙ্গে অবাঙালী, বাঙালী, ভারতীয় মানুষ এবং থিয়েটারের মানুষ। সেই মানুষ, যে নিজের কথা বলবার জন্যে অনবরত স্পন্দিত হয়। থিয়েটারের মধ্যে দিয়ে, থিয়েটারের বাইরের যে কোনো রন্ধ্রপথ দিয়ে সে বেরিয়ে আসে, ফুটন্ত জলের মতো ফুলে ফেঁপে।
কিন্তু বাঙালী কথাটা বললাম কেন? নিজে বাঙালী বলেই বুঝি। ঊষাদির বাংলা উচ্চারণে একটা মিষ্টি আড়ষ্টতা ছিলো, কিন্তু যতদূর জানি, এ ভাষা পড়ায় কোনো অসুবিধে ছিলো না। রবীন্দ্রনাথটা তো বেশ ভালো করে পড়েছিলো। দখলটা কতটা পর্যন্ত তা বোঝাবার জন্যে একটা কথা বলি, খুব বেশি মানুষ সে কথা হয়তো জানেন না। কর্ণেল বসু নামে এক ভদ্রলোকের একটি রেকর্ডিং স্টুডিও ছিলো, সেখানে কাজ করতেন শ্রাবন্তী মজুমদার। সেই সুবাদে এটাকে সবাই শ্রাবন্তীর স্টুডিও নামেই চিনত। সেখানে ঊষাদি আসতো, বিজ্ঞাপনের গান, যেগুলো বাংলায় লেখা হয়েছে এবং তার হিন্দি করতে হবে, গাইতে হবে সেইসব গান, তার অনুবাদের কাজ করবার জন্যে। তার বাইরেও, বালক বনে মহান বলে একটা হিন্দি নাটকের সিরিজ আসতো সেই স্টুডিওতে, মহাপুরুষদের ছোটোবেলার কোনো না কোনো কাহিনী নিয়ে নাটক, তার বাংলাও করতো ঊষাদি, যতদূর মনে পড়ছে। একটু প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলি, সেই বালক হলো মহানের নাটকগুলোতে ছোট্ট মহাপুরুষের চরিত্রের একচেটিয়া অভিনেতা, শ্যামল সেন আর চিত্রা সেনের তখনো গোঁফ-দাড়ি না ওঠা সন্তান, কৌশিক সেন। যাই হোক, অনুবাদের কাজ, কেঠো অনুবাদ নয়, বিজ্ঞাপনের জন্যে মনোমোহিনী অনুবাদের কাজ যাদের করতে হয়, তাদের দুটো ভাষাই বেশ ভালো না জানলে চলে না, এ তো যে কেউ বুঝতে পারবেন। মৃচ্ছকটিকের সেই মেয়েটির সঙ্গে ওই স্টুডিওতেই ভালো করে ঊষাদি হিন্দিতে নাটক করেন, এই পর্যন্ত জানি, তখনো পর্যন্ত সে সব নাটক দেখাবার ব্যাপারে খুব টান অনুভব করিনি। সে টান টের পেলাম আর একটু বড় হয়ে ওঠার পরে, আর সেই তাঁর নিজের ক্ষেত্রে ঊষাদি আমাকে একেবারে ফ্ল্যাট করে দিলেন। তাই নিয়ে কথা বলবার আগে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা একটু বলে নিই। একবার বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে কী একটা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি বলছিলাম, মেয়েদের যে কোনো কাজে তাদের স্বভাবের ধরন, খারাপ অর্থে নয়, সদর্থে যাকে মেয়েলিপনা বলে, তা চলে আসতে বাধ্য। তখন যাদবপুরে সাহিত্য নিয়ে পড়ছি, উইমেন্স ডায়লেক্ট ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা শুনছি, সেইসব জায়গা থেকেই কথাটা মাথায় এসেছিলো কিনা আজ আর বলতে পারবো না। বিভাসদা কিছুতেই মানবেন না। শেষে বললেন, বেশ, এই যে ঊষার কোর্ট মার্শাল, বলো, কোথায় মেয়েলিপনা আছে? আমি চুপ।
আমি এখনো বিশ্বাস করি, মেয়েদের কাজে সাধারণভাবে তাদের লিঙ্গগত যে অভিজ্ঞান, তা থেকে যাওয়ার কথা, যেমন পুরুষের। কিন্তু এইসব তর্ককে সরিয়ে রেখে যদি বলি, ঊষাদির কাজের মধ্যে এমন একটা প্রাবল্য, একটা তীব্র আগ্রাসী ধাক্কা আমি পেয়েছি, তার সঙ্গে মেয়েলি ধরন বলতে আমরা যা বুঝি, তার খুব স্পষ্ট বিরোধ আছে। অথচ সেই প্রাবল্য প্রায় এই মানুষটির নিজস্ব অভিজ্ঞান হয়ে আছে, অন্তত আমার কাছে। বহু মানুষকে নিয়ে কাজ করতে পারতেন, তাদের একসঙ্গে জুটিয়ে পাটিয়ে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনাটা খুব সহজ কাজ নয়, বিশেষত আমাদের মত হাফ পেশাদারদের দেশে। ঊষাদি সেটা কী করে করতেন বলার অভিজ্ঞতা আমার নেই, কিন্তু পারতেন যে, তা তো প্রযোজনা দেখেই বোঝা যেতো। আমার মনে হয়, এর পেছনে তাঁর তীব্র আবেগের একটা বড় ভূমিকা আছে। ঊষাদি কোথাও বক্তৃতা করতে গেলে বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠবেন এবং বোঝাই যায়, সেটা উত্তেজনার অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি উত্তেজনা। নাটকের শেষে এসে জড়িয়ে ধরছেন, কোনো ভান নেই, ভালোবাসার তাপটা স্পষ্ট অনুভব করা যায়। আমরা দুজন পাশাপাশি বসে কোনো নাটক দেখছি, ঊষাদির নাটকটা অপছন্দ হয়েছে। অশ্লীল, ধান্দাবাজি বলে মনে হয়েছে। ঊষাদি আমার কাছে এমন করে অভিযোগ করছেন যেন আমি একবার নির্দেশককে বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একবার টেলিভিশনে ধারাবাহিকভাবে নাটক নিয়ে কী একটা করার কথা হলো, আমাকেও ডেকে নিলেন। তাঁর ঘরে বসে দুজনে নানারকম পরিকল্পনা হচ্ছে, সে পরিকল্পনার মধ্যে প্রভূত আবেগ, হয়তো অত আবেগের ধাক্কাতেই কাজটা আর হয়ে উঠলো না শেষ পর্যন্ত। আমাকে ওঁর দলের একটি মেয়ে বলেছিলো, উঃ! মহিলা কী ভালোবাসতে পারে, আর নিজের থিয়েটারের ব্যাপারে কী নিষ্ঠুর হতে পারে। এই নিষ্ঠুরতাটা তো ভালোবাসা থেকেই আসে।
সাধারণভবে থিয়েটারের আজকের যে চেহারা, সেটা একেবারেই পছন্দ হচ্ছিলো না। বহুবার আমাকে বলেছেন, সৌমিত্র, আমার এই বিনোদিনী কেয়া মঞ্চে আমরা থিয়েটারের লোকেরা মাঝে মাঝে একটু আড্ডা মারবো। নিজেদের মধ্যে মন খুলে কথা বলবো। খুব ঘন ঘন যে হতে পারেনি সেই আড্ডা, তার একটা দায় হয়তো আমারও। আমিও সময় দিইনি, দিতে পারিনি। ওই ছোটো পরিসরে নাটক করাতেন, আমাদের অন্তর্মুখকে দিয়েও নাটক করিয়েছেন। প্রথম অভিনয়টা দেখতে পারেননি, পাকিস্তান চলে যেতে হয়েছিলো, তাই নিয়ে কী আফশোষ। পরের নাটকটা দেখে সেই বুক জড়িয়ে ধরা।
একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। ওইরকম একটা আড্ডায় বসেছি আমরা, রবিবারের সকাল। যে বাবা-মায়েদের সন্তানেরাও থিয়েটারে এসেছে, তাদের নিয়ে আড্ডা, বাবা-মা আর ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গ। আমি সস্ত্রীক সঞ্চালক। যা হয়, শেষ হতে হতে বেলা হয়ে গেলো। তাতে কিছু না, দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমার আবার সেদিন আলিপুর জেলের ভেতরে কয়েদীদের সামনে একটা অনুষ্ঠান আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঢুকতেই হবে, জেলের ব্যাপার, ইচ্ছেমতো যাওয়া যাবে না। আমি পালাবার তাল করছি। অসম্ভব। ঘটনাটা বললাম, আমি বাইরে খেয়ে নেবো। অসম্ভব। কাঁধ ধরে বসিয়ে দিলেন। সে হাতের যা জোর, আমার হাঁটু পর্যন্ত অবশ হয়ে গেলো। আলাদা করে ভাত দিয়ে খাওয়ালেন, কোনোমতে না পেট পুরে। হাঁক-ডাক করে পরিবেশন করিয়ে করিয়ে।
কত যে বয়েস হয়ে গেলো। অমন করে কাঁধ চেপে বসিয়ে দেবার মতো মায়াবী শক্ত হাত আর কোথাও আছে বলে তো বিশ্বাস হয় না।
0 comments: