0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১৮ 

খাড়াই ঢাল বেয়ে দাড়িওয়ালা খয়েরিরঙের আলখাল্লা পরিহিত পুরুষরা সারিবদ্ধভাবে উঠে আসতে লাগলো। তারা যেন এখনই কোনো সাঙ্ঘাতিক গুহ্য কর্মে লিপ্ত হবে। এই ভয়ঙ্কর দৈত্যাকার মূর্তিগুলি যারা নিষ্ঠুর এবং পাশবিক কাজ করতে চলেছে শীঘ্রই, তাদের পেছন পেছন সারি বেঁধে আসতে লাগলো একদল নারী, যাদের শরীর শুধুমাত্র যার যার নিজের কৃষ্ণবর্ণ, সোনালি অথবা বাদামী রঙের ঢেউখেলানো দীঘল কেশরাশি দ্বারা আবৃত। স্বপ্নের মধ্যেও ফ্রান্সেস্কো কেঁপে উঠছিলো, সে বুঝতে পারছিল যে ঐ নারীরা প্রচণ্ড লজ্জায়, ভয়ে চোখ নামিয়ে রেখেছে। এক ভয়ঙ্কর মূর্তির সামনে ঐ নারীদের নিবেদন করা হবে পূজাসামগ্রী হিসেবে। সন্ন্যাসীদের চোখে নিহিত ছিল এক নিঃশব্দ, অন্ধ রাগ, যেন কোনও অদ্ভুত প্রাণীর দংশনবিষে তারা আহত, এক অদ্ভুত প্রতিশোধস্পৃহায় তারা উন্মত্ত।  

অবশেষে তারা সবাই স্থির দাঁড়ালো সবাই জেনারাসোর সেই অগভীর গুহায় জীবন্ত মূর্তির মত। তারপর শুরু হল সেই কুৎসিত বীভৎস আচার! পাগানদের লিঙ্গপূজার ঐ অদ্ভুত রীতি ফ্রান্সেস্কোর কাছে অসহ্য লাগছিলো। ফ্রান্সেস্কোর ধার্মিক পবিত্র আত্মার কাছে ঐ রীতি আঘাতের মত মনে হচ্ছিল। তার আত্মা আতঙ্কিত হয়েছিলো, ভয়ে সঙ্কুচিত হয়েছিল স্বপ্নের ভিতরেও। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফেরা আর্তনাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল পেঁচাদের কর্কশ ঘুৎকাররব। মায়াময় জ্যোৎস্নার আলোতে জলপ্রপাতের শব্দ, রাতচড়া পাখিদের ডাক, সবকিছু ছাপিয়ে যারা আনন্দের যন্ত্রণায় চিৎকার করে মরছিলো, সেই বলিপ্রদত্ত সন্ন্যাসিনীদের হাহাকার ভেসে আসছিলো। 

অবশেষে আবার সেই দরিদ্র, অভিশপ্ত মেষপালকদের উপাসনার দিন উপস্থিত হল। সেইদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রান্সেস্কো ভেলার নিজেকে একদম আলাদা একজন মানুষ বলে বোধ হতে লাগলো। প্রতিটি মানুষের জীবনেই, সে না চাইলেও একদিন না একদিন চরম এবং অপ্রত্যাশিত সত্যটা উদ্ঘাটিত হয়। সেদিন সকালে এই তরুণ পুরোহিতের সাধুসন্ত, দেবদূত কিম্বা ঈশ্বর- কোনকিছু হয়ে উঠবার ইচ্ছেই জাগ্রত হলোনা। বরং তার মধ্যে এক নীরব ভীতি জেগে উঠলো যে যদি কখনো সাধুসন্ত, দেবদূত অথবা স্বয়ং ঈশ্বরের সঙ্গে তার শত্রুতা দেখা দেয়, তাহলে কী হবে! 

পাহাড়ের উপরে সেন্ট আগাথার উপাসনাগৃহে পৌঁছেও সে হতাশবোধ করতে লাগলো। তার উপাস্য মূর্তির নামে নাম যার, সেই কন্যা আজ অনুপস্থিত। সে প্রার্থনা থেকে সরিয়ে রেখেছে নিজেকে। হতাশ, ফ্যাকাসে তরুণ যাজক যখন রুক্ষ, হতদরিদ্র পিতাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলো, উত্তর হিসেবে দুর্বোধ্য কতগুলি শব্দ নিঃসৃত হল। তখন তাড়াতাড়ি বাড়ির কর্ত্রী, অর্থাৎ তার ভগিনী, সে এসে বললো যে আজ কন্যা ঘরের কাজকর্মে বিশেষ ব্যস্ত, তাই আসতে পারেনি। তারপরে ফ্রান্সেস্কো যখন তার পবিত্র উপাসনা আরম্ভ করলো, সে যে কোনটার পরে কী বলতে লাগলো, আর কোনটার পরে কী করতে লাগলো, তার নিজেরই একদম খেই হারিয়ে গেলো। উপাসনার শেষে একদম বিধ্বস্ত অবস্থায় সে ভাবতে বসলো যে সে আদৌ কোথা থেকে শুরু করেছিল! অন্তরে অন্তরে সে যেন নরকযন্ত্রণা সহ্য করছিল; নিজেকেই পতিত হতদরিদ্র অভিশপ্ত মানুষ বলে বোধ হচ্ছিল তার। 

যাজকের সহকারী বালক এবং স্কারাবোটা পরিবারকে পিছনে রেখে ফ্রান্সেস্কো পাহাড় থেকে নামতে শুরু করলো। সে মনের ভুলে অন্য রাস্তা ধরেছিলো। গন্তব্য কিম্বা আসন্ন সম্ভাব্য বিপদ- কোনো দিকেই দৃষ্টি ছিলনা তার। আবার সেই অস্প্রে বাজপাখির জুটিকে দেখতে পেলো সে। সেন্ট আগাথার শিখরের উপরে গোল হয়ে উড়ে চলেছে। মিলনের আনন্দে পাখিদুটি ডেকে উঠলো বার বার-- সেই ডাক তার কাছে বাতাসের ইথারতরঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ব্যঙ্গের মত মনে হল। আধাশুকনো পিছল এক নদীর খাতে হোঁচট খেয়ে পিছলে গেলো ফ্রান্সেস্কো এক দু বার, হাঁপাতে হাঁপাতে হতাশ হয়ে লাফিয়ে উঠলো। ভীষণ এক বিভ্রান্তির মধ্যে একই সঙ্গে প্রার্থনা এবং অভিশাপ আওড়াতে লাগলো; অন্তরে অন্তরে ঈর্ষার অত্যাচারে দীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল সে। যদিও সেদিন আগাথার উপাসনায় অনুপস্থিত থাকা ছাড়া আর কিছুই তেমন ঘটেনি। 

পাপী আগাথা! তার সাংসারিক কাজ কি এমন থাকতে পারে, যে সে আসতে পারলোনা! নাকি সান্টা ক্রোশের আল্পসের উপত্যকায় কোনো তরুণ যুবকের প্রেমে পড়েছে সে, যে কারণে গির্জায় আসবার সময় বের করতে পারলোনা; ফ্রান্সেস্কোর হঠাৎ কেন এমন মনে হতে লাগলো, সে জানেনা। তার মনে হলো যে, হয়তো গির্জায় আসবার সময়টুকু চুরি করে আগাথা প্রেমিকের বাহুবন্ধনে ধরা দিয়েছে। তার সমস্ত চিন্তা এভাবে শুধুই আগাথাকে আশ্রয় করে রয়েছে দেখে সে প্রচণ্ড শঙ্কিত হল, রাগে, হতাশায় ভেঙে পড়লো। আগাথাকে শাস্তি দেবার প্রচণ্ড ইচ্ছা জেগে উঠলো তার মনে; মনে হল তার সমস্ত আধ্যাত্মিক আয়োজন, প্রীতি ও ভালোবাসার প্রয়োজন, পবিত্র ঈশ্বরের শরণ নেবার প্রয়োজন সবকিছু থেকে যেন আগাথা তাকে মুক্তি দেয় একবারে। সে তার যাজকের গর্বে আঘাত হেনেছে। অদম্য হয়ে উঠছিল তার ক্রোধ। তার সত্তায় গভীর আঘাত অনুভব করলো সে। আগাথার অনুপস্থিতি তার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক বলে বোধ হলো।

পাপী নিজে থেকেই যাজককে প্রত্যাখ্যান করেছে; ঈশ্বরের ভৃত্য, সঠিক আলো দেখাবার দিশারী শিক্ষকের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে। তার অন্তরের পুরুষ, যাজক, সন্ত, সব্বার অহংবোধ একত্রিত হয়ে আগাথার কাল্পনিক প্রেমিক – যে একজন চাষা, কিম্বা মেষপালক অথবা কাঠুরে- তার প্রতি রাগে ফুঁসতে লাগলো। কারণ, উপাসনায় না এসে আগাথা তার কাছে গিয়েছে, তার কাছে থাকা শ্রেয় মনে করেছে। 

ধুলোমাখা ছেঁড়া আলখাল্লা পরে, ক্ষতবিক্ষত দুই হাত এবং আঁচড় লাগা মুখ নিয়ে ফ্রান্সেস্কো উদ্ভ্রান্তের মত পাহাড়ে ঘুরতে লাগলো। বিভিন্ন চড়াই- উতরাই পেরিয়ে, ঝোপ-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, ঝর্ণা পেরিয়ে সে যে কোথায় কোথায় ঘুরতে লাগলো, তা সে নিজেও জানেনা। একটা চাতালের মত উপত্যাকার কাছে এসে মেষযূথের গলার ঘণ্টার টুংটাং আওয়াজ ভেসে এলো তার কানে। সে কোথায় পৌঁছেছে, তা সে বুঝতে পারলোনা। অনেক নিচে ফেলে আসা সোয়ানা গ্রাম, তার গির্জাঘর, সব সে দেখতে পেলো। সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় সব পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান। সে দেখতে পেলো অজস্র মানুষ কাতারে কাতারে গির্জাঘরে ঢুকছে। কেউ জানেনা যে সে সেখানে নেই। তার নোটিশ দিয়ে আসা উচিত ছিল। সূর্যটাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিচে নামিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল তার। এত তাড়াতাড়ি আকাশের উপরে চড়ে গেলো কীভাবে? হতাশা চরমে পৌঁছালো তার। কোন অদৃশ্য বন্ধনে রয়ে গেছে সে এখন আল্পসের পথে!! 

তরুণ যাজক মস্তিষ্ক স্থির করে চিন্তাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। এমন সময় একটা ধোঁয়া ধোঁয়া সুগন্ধ তাজা পাহাড়ি বাতাসের সঙ্গে তার নাকে এসে লাগলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটু দূরে তাকালো সে। সে লক্ষ্য করেনি একটু দূরেই এক পুরুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। পুরুষটি আগুন জ্বালিয়ে একটা পাত্রের মধ্যে কিছু একটা রান্না করছে। কী রাঁধছে? মিনেস্ট্রোন স্যুপ? তাই হবে। হ্যাঁ, ধোঁয়ার গন্ধে তাই মনে হচ্ছে। ঐ মানুষটি সম্ভবত ফ্রান্সেস্কোকে দেখেনি, কারণ সে তার দিক থেকে পিছন ফিরে বসে আছে। দূর থেকে তরুণ যাজক বুঝতে পারলো যে গোল, প্রায় সাদাটে সোনালি চুলে ভর্তি মাথা, সুগঠিত স্কন্ধ এবং পৃষ্ঠদেশ পুরনো খয়েরি রঙের বিবর্ণ একটা জ্যাকেটে যাহোক করে ঢাকা। কাঁধের উপরে গলার পেছনে অনাবৃত ত্বকের রং রোদ্দুরে পুড়ে বাদামী। লোকটা চাষি, মেষপালক, কাঠুরে- যাই হোক না কেন, এখন আগুনের উপরে ঝুঁকে পড়ে কী যেন করছে। কী করছে লোকটা? জগতসংসার ভুলে কী যেন করে যাচ্ছে। ফ্রান্সেস্কো একটুও না নড়ে লোকটাকে দূর থেকে লক্ষ্য করছিল। লোকটা সুরেলা শিষ দিতে দিতে কাজ করে যাচ্ছিল; হঠাৎ শিষ থামিয়ে সুরেলা কণ্ঠস্বরে এক দু কলি গান গেয়ে ভাসিয়ে দিলো পাহাড়ের শীতল বাতাসে। 

ফ্রান্সেস্কোর হৃদপিণ্ড ধড়ফড় করে উঠলো। তার চারপাশের পরিস্থিতি, পরিবেশ সবকিছু কতটা অদ্ভুত- সে হঠাৎ বুঝতে পারলো। এমন নয়, যে পথটুকু সে পেরিয়ে এসেছে, তার মধ্যে কোনো অদ্ভুত হিংস্রতার মুখোমুখি হয়েছিল সে। কিন্তু এখন তার অস্বস্তি হতে লাগলো। আগুনের পাশে বসে থাকা মানুষটির সুগঠিত শরীর, উচ্ছল যৌবন, সোনালি কোঁকড়ানো মাথার চুল, পোশাক-পরিচ্ছদ – এসব থেকে পরিষ্কার যে সে এই পাহাড়েই থাকে। যে মুহূর্তে আগাথার সম্ভাব্য প্রেমিক হিসেবে সে এই লোকটিকে কল্পনা করতে শুরু করলো, তখনই তার ঈর্ষার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। 

ফ্রান্সেস্কো আগুনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। তার পক্ষে বেশিক্ষণ এখানে আত্মগোপন করে বসে থাকা সম্ভব নয়; এক অপ্রতিরোধ্য শক্তির দিকে কে যেন তাকে টানছে। পাহাড়ি লোকটি ঘুরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। লোকটির মুখে তারুণ্য এবং যৌবনের শক্তি অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে আছে, এরকম মুখ ফ্রান্সেস্কো আগে কোনোদিন দেখেনি। লোকটি ফ্রান্সেস্কোকে আসতে দেখে বসা অবস্থা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। 

ফ্রান্সেস্কোর কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে লোকটি একজন মেষপালক, কারণ তার হাতে রয়েছে একটা গুলতি। এতক্ষণ আগুনের উপরে ঝুঁকে পড়ে মনোযোগ সহকারে, সে গুলতি বানাচ্ছিলো। বাদামী কালো ছোপওয়ালা গরুর দলটা, যেটা ইতিউতি চড়ে বেড়াচ্ছে এখানে, সেটা সম্ভবত এই লোকটি দেখাশোনা করে। তবে লোকটি নিশ্চয়ই খ্রিস্টান ছিল, কিম্বা এখনো খ্রিস্টান। নাহলে এই পাহাড়ি অঞ্চলে যেখানে প্রতি ঢালে ম্যাডোনার উপাসনাগৃহ আছে, সেখানে এই লোকটি কী করছে! সে নিশ্চয়ই পবিত্র গির্জার উপাসনা আদবকায়দা ইত্যাদি সবকিছু জানে, কারণ ফ্রান্সেস্কোর পোশাক দেখে সে বুঝতে পারলো যে সে একজন যাজক; সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে লোকটি তরুণ যাজকের হস্তচুম্বন করলো।


(চলবে) 
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা                              

0 comments: