প্রবন্ধ - সুশীল সাহা
Posted in প্রবন্ধ
এ জীবনে পেয়েছি অনেক বড় মাপের মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। শুধু মেলামেশার আগ্রহাতিশয্যে নয়, নানা কাজের সূত্রেও বহু গুণী মানুষের স্নেহধন্য আমার জীবন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ফাদার দ্যতিয়েন, গেজা বেথলেনফ্যাল্ভি, শান্তিদেব ঘোষ, বাদল সরকার, মণীন্দ্র গুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, অমিয় দেব, পূর্ণেন্দু পত্রী, সত্যজিৎ চৌধুরী, তরুণ সান্যাল, মনোজ মিত্র, হাসান আজিজুল হক, সুধীর চক্রবর্তী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, দেবেশ রায়— আরও কত মানুষ! এই তালিকার শীর্ষে রাখব আমার শিক্ষাগুরু, খুলনার মুহম্মদ কায়কোবাদ স্যারকে। তিনি অবশ্য ‘সেলিব্রিটি’ মানুষ নন। সব সময়েই থেকে গিয়েছেন আলোকবৃত্তের বাইরে। এছাড়া আছেন গৌরীশংকর দে, রাইচরণ পাল, প্রদ্যোৎ চন্দ্র গুপ্ত, দিলীপ দাশগুপ্ত, আরও কত মানুষ! এঁরাও তেমন নামী মানুষ নন। কিন্তু আমার বড় হয়ে ওঠার পিছনে এঁদের অবদান অনেক, কোনও দিনও ভুলে যাবার নয়। এঁরা আমার গানের দীপে আলো জ্বালিয়েছেন। এঁরা আমার পরম প্রিয়জন ও পথপ্রদর্শক। এঁদের ছত্রছায়ায় ছিলাম ও আছি বলে জীবন এখনও আলোয় আলোকময়। নানা ঘটনাবৃত্তের মধ্যে এঁদের কাছাকাছি এসেছি, জীবন হয়েছে মধুময়। বাবাকে হারিয়েছি তো সেই কবেই! সহোদর দাদাকেও— অকালে। তাই হয়তো ঘরের বাইরের এই মানুষগুলোর মধ্যে খুঁজে ফিরেছি আশ্রয়ের শান্তিনীড়। সৌভাগ্য, পেয়েছি অনেক, দু’হাত ভরে তাঁরা দিয়েই গিয়েছেন। অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। কার কখন যাবার সময় ঘনিয়ে আসে, কে জানে! বুক মোচড়ানো অশেষ দুঃখময় এই হারানো। এই তালিকায় অতি সম্প্রতি যাঁর নাম যুক্ত হল, তিনি আমার পরম প্রিয় দাদা, অভিভাবক। দেবেশ রায়।
এই ক’দিন আগেও যিনি ছিলেন তাঁর সপ্রাণ উপস্থিতি নিয়ে, আজ তাঁর ছবিতে ফুলের মালা। আমারও সমস্ত সত্তা জুড়ে স্বজন হারানোর শোকের ছায়াচ্ছন্ন মেঘ। এই মেঘের আস্তরণ ভেঙে কী করে রচনা করব এই প্রয়াণলেখ! ঠিক এমনই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, নীরেনদা, ইলিয়াসভাই, পূর্ণেন্দুদা, মণীদা, তরুণদা, ফাদার দ্যতিয়েন, শান্তিদা, বাসুদেবদা, রাইচরণদা, প্রদ্যোৎদা আর দিলীপদার প্রয়াণবেলায়।
১৯৮১ সালে কোনও এক সময় বন্ধু বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে ‘পরিচয়’ অফিসে গিয়েছিলাম দেবেশ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সেই প্রথম দেখা। দেবেশবাবুর স্ত্রী কাকলি রায়ের সংগ্রহ করা কয়েকটা গণসংগীতের ক্যাসেট আনতে যাই সেদিন। আমরা দু’জন তখন হাবরায় এক গানের দলের সদস্য। গান বলতে মূলত গণসংগীত, তার সঙ্গে নাচের দৃশ্যায়ন। সেদিন সৌম্যকান্তি ওই মানুষটার সঙ্গে বিশেষ কিছু কথা হয়নি। দপ্তরের কাজে ব্যস্তও ছিলেন। আগের বছর ‘বারোমাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসের প্রথম পর্ব পড়ে মাথাটা ঘুরে গেছে। এ কী লেখা! উত্তরবঙ্গের একটি অবহেলিত জনপদের কী বর্ণনা ! বিস্ময়কর। প্রান্তিক মনুষ্যজীবনের এমন অসহ বর্ণনা পড়লে কার না মাথা ঘোরে! তার আগে সত্তরের গোড়ার দিকে ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’ পড়েই বুঝেছিলাম বাংলা গদ্যের সব্যসাচী মানুষটির আয়ুধের কত ধার! গল্প উপন্যাস কেবল নয়, প্রবন্ধ, রিপোটার্জেও সমান দক্ষ তিনি। তবু তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন হল ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ (১৯৮৮) প্রকাশিত হওয়ার পরে। অনতিকাল পরেই ওই বইটির জন্যে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্তি তাঁকে এক যোগ্য আসনে বসবার অধিকার দেয়। অবশ্য তিনি এসবের তোয়াক্কা করেন নি কোনও দিন। সুদূর মফস্সল শহর জলপাইগুড়ির আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপনা করা ছাড়া, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হয়ে চুটিয়ে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু নিজের লেখকসত্তাকে সব সময় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। লেখালিখি ছাড়া চুটিয়ে দেশবিদেশের বইপত্র পড়েছেন। এ সবই জেনেছি অনেক পরে।
প্রথম দেখার প্রায় এক দশকেরও কিছু পরে ফের তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়। সেই সময় কলকাতার সাহিত্য অকাদেমির বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শতবর্ষ উদ্যাপনের আয়োজনে রাজশাহী থেকে আসার কথা হাসান আজিজুল হকের। তাঁরই নির্দেশে অকাদেমির অফিস থেকে দেবেশবাবু আমাকে ফোন করেন। হাসানভাইয়ের কলকাতায় যথাসময়ে আসার ব্যাপারে তাঁকে নিশ্চিন্ত করি। বনগাঁ সীমান্ত থেকে তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে এসে কলকাতার চৌধুরী গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিই। তিন দিনের ওই সেমিনারের প্রত্যেক দিনই সেখানে গেছি। অনুষ্ঠান পরিচালনায় দেবেশবাবুর সক্রিয় তৎপরতা ছিল রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। সেই সময় বা তার কিছু দিন পরে হাসানভাইয়ের সঙ্গে দেবেশদার বল্মীক আবাসনের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকে হতবাক। বইয়ের পাহাড় চতুর্দিকে। মাতৃসমা কাকলি বৌদিকে প্রথম দেখি সেদিনই। বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপালের কথোপকথনের সাক্ষী হয়ে ছিলাম সেদিন। আমার অসহায় অবস্থা দেখে বৌদি আমাকে অন্য ঘরে নিয়ে যান। তখনই জানতে পারি তাঁর গানের স্কুল ‘গান্ধার’-এর কথা। লেক টাউনের ওই স্কুলে তখন তিনি নিত্য তৈরি করে চলেছেন রবীন্দ্রগানের অনুরাগী ছাত্রছাত্রী। সেদিনই জানতে পারি সুদূর মফস্সল শহর জলপাইগুড়ি থেকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে তাঁর গান শেখার কথা, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, নীলিমা সেন, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যলাভের কথা। দেবব্রত বিশ্বাসের মতো মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতার কথাও জেনেছিলাম। সেদিন দেবেশদার সঙ্গে বেশি কথা হয়নি ঠিকই, কিন্তু পরে তাঁকে ফোন করতেই অনর্গল অনেক কথা বলেছিলেন তিনি। সেদিনের কথা শেষ করেছিলেন একটি আপ্তবাক্য দিয়ে, ‘আপনার বৌদিকে কোন মন্ত্রবলে আপনি জয় করেছেন ভাই?’ অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে কিছুতেও ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ বলাতে রাজি করাতে পারিনি। বয়সে অনেক ছোট কাউকেও দেখেছি ‘আপনি’ সম্বোধন করতে। বুঝেছি এটাই তাঁর রীতি।
নব্বইয়ের দশকে ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকা ও প্রকাশনা কলকাতার সাহিত্যজগতে বেশ সাড়া জাগায়। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে ওঁদের অফিস। নানা কারণে ওখানে যেতাম মাঝে মাঝে। মূলত অরুণ সেন এবং পূর্ণেন্দু পত্রীর কাছেই যেতাম। আর যেতাম পত্রিকার সম্পাদক স্বপ্না দেবের কাছে। সেই সময় দেবেশদার সঙ্গে দেখা হয়েছে কয়েকবার, কথাও। দেখা হলেই বাড়িতে যাওয়ার কথা বলতেন। বিনা কারণে বড় মাপের মানুষদের বাড়িতে যেতে সব সময়েই দ্বিধাবোধ করতাম। তত দিনে তাঁর অনেক লেখাই পড়ে ফেলেছি। যেতে তো পারতামই, কিন্তু কেন যাব, এই অজুহাত খুঁজতে খুঁজতে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল।
২০০০ সালের গোড়ার দিকেই হবে, আমার পরম বন্ধু সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায় দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল। ওঁর চিকিৎসার জন্যে অর্থ সংগ্রহ করতে সাত জন বিশিষ্ট মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত আবেদনপত্র বিভিন্ন সংবাদপত্রে মুদ্রিত হয়। পুরো ব্যাপারটিই ছিল আমার মস্তিস্কপ্রসূত। ওই আবেদনপত্রে সানন্দে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বাদল সরকার, তরুণ সান্যাল এবং দেবেশ রায়। শুধু স্বাক্ষর করা নয়, সেদিন দু’হাজার টাকার একটা চেকও আমাকে দিয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে তাঁর ওখানে নিত্য যাতায়াতের শুভ সূচনা হল। যতই যাই, টের পাই বৌদির কাছে আমার একটা স্থায়ী ঠাঁই তৈরি হয়ে গেছে। এক দিন দেবেশদা বলেই ফেললেন, ‘আপনি আসবেন বলে আপনার বৌদি একটা স্পেশাল জিনিস রান্না করে রেখেছে।’ এ যে কত বড় পাওয়া তা কেবল আমিই জানি।
একটা ব্যাপার তত দিনে বুঝে গেছি যে বড় মাপের মানুষদের কাছে অকারণে গিয়ে বিব্রত বা বিরক্ত করা উচিত নয়। তাঁরা ব্যস্ত মানুষ, কাজের মানুষ। তাঁদের সমস্ত সময়টাই সৃজনের। তাঁরাও যে আড্ডা দিতে ভালবাসেন, কিছুটা সময় রাখেন প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কাটাতে, সেটা তখনও মাথায় আসেনি। শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষদের দেখেছি কী ভাবে প্রশ্রয় দেন অজস্র মানুষকে। অগণিত সভা সমিতি নাটক দেখার মধ্যেই তিনি কাজ করে যান নিরলস ভাবে। কিন্তু দেবেশবাবু তো আর শঙ্খদা নন। তাই ওঁর কাছে যেতে দ্বিধাবোধ করতাম। তত দিনে ওঁর লেখা ‘যযাতি’, ‘মানুষ খুন করে কেন’, ‘মফস্বলি বৃত্তান্ত’, ‘সময় ও সমকাল’ ইত্যাদি পড়েছি। যত পড়েছি, ততই নানা প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি মেরেছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই যখন দেখি তাঁর সম্পাদনায় জীবনানন্দের নানা অপ্রকাশিত লেখা গ্রন্থাকারে ‘প্রতিক্ষণ’ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। সাহিত্য অকাদেমি থেকে তাঁর সম্পাদনায় ‘রক্তমণির হার’ শিরোনামে দেশভাগ ও স্বাধীনতা বিষয়ে দুটি গল্প সংকলন বেরিয়েছিল। বাংলা-সহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় লেখা অনন্য সংকলন। দেবেশদার লেখা ভূমিকাটি ছিল অসাধারণ। তাঁর জহুরির চোখ আর অসামান্য মেধা ও মননের সংযোগে সেই সংকলন দুটি বাংলা ভাষার অনন্য সম্পদ। পরবর্তীকালে দেশভাগ নিয়ে যে কাজগুলো নিজে করেছি, সেগুলোর ক্ষেত্রে এই বইটাকেই সামনে রেখে এগিয়েছি। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার পথপ্রদর্শক।
পরে তাঁর সঙ্গে নানা সভা-সমিতিতে দেখা হয়েছে। দেখা হলেই অনুযোগ করতেন, কেন যাই না তাঁর কাছে! বৌদি অনেক দিন ওঁর কাছে আমার খোঁজ করেছেন জেনে মনে অপরাধবোধ হয়। তবু যাওয়া হয় না। কারণ খুঁজতে খুঁজতে একবার সত্যি সত্যি তাঁর কাছে যাওয়ার একটা কারণ ঘটল। আমার একান্ত প্রিয়জন, ঢাকার নিশাত জাহান রানা বাদল সরকারের ‘রক্তকরবী’ পাঠের একটি সিডি বার করেছে। ও চায় কলকাতায় সাড়ম্বরে ওর একটা প্রকাশ অনুষ্ঠান করার। এই অনুষ্ঠানে দেবেশবাবুকে আনার প্রস্তাব দিলাম। দেবেশদা সানন্দে রাজি হলেন। তিনিই সিডি উদ্বোধন করবেন। বাদলবাবুর উপস্থিতিতে অভিনীত হবে পথসেনা-র নাটক ‘রক্তকরবী’। গান গাইবেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় ও অর্ঘ্য সেন। বেশ একটা জমজমাট অনুষ্ঠান। শিয়ালদহ লোরেটো স্কুল চত্বর সেদিন উপচে পড়েছিল কৌতূহলী মানুষের ভিড়ে। দেবেশদা বললেন চমৎকার। অনুষ্ঠান শেষ হলে একান্তে ডেকে বললেন ওঁর বাড়িতে যাওয়ার জন্যে। এই ডাক কী অগ্রাহ্য করা যায়! গেলাম একদিন। তাঁর ও বৌদির পরম সমাদরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম। একটা ব্যাপার সহজেই বুঝে গিয়েছিলাম, অপরিসীম মেধা ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে বৌদি তাঁর মনপ্রাণ ঢেলে পরম যত্নে দেবেশদাকে আগলে রেখেছেন। সংসার সামলে দুই ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন, পাশাপাশি নিজের সংগীতপিপাসা মিটিয়েছেন অজস্র ছাত্রছাত্রী তৈরি করে। গান শেখা যে কেবল গান গাওয়ার জন্যে নয়, অনুভবের, সেটা স্পষ্ট বোঝা যেত তাঁর হাতে তৈরি সংগীতায়তন ‘গান্ধার’-এর সুচারু অনুষ্ঠান বিন্যাসে, ধারাভাষ্যের সুমিত প্রয়োগে।
দেবেশদার কাছে নিয়মিত যাওয়ার সুযোগ ঘটল তাঁর একটি বই প্রকাশের কারণে। তখন আমি প্রকাশক মারুফ হোসেনের অভিযান পাবলিশার্স-এ যোগ দিয়েছি। মারুফের অত্যাগ্রহে ওঁকে একদিন প্রস্তাব দিতে যাই এবং অত্যন্ত ভরপুর আনন্দ নিয়ে ফিরে আসি। তিনি সানন্দে সম্মতি দিয়েছেন। অভিযান থেকে প্রথমে তাঁর একটি প্রবন্ধ সংকলন বেরোয়। বইয়ের শিরোনাম ‘অল্প কিছু আলো, আমাদের ভালো থাকা নিয়ে কথা বলা’। এই বইয়ের নির্মাণপর্বের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে লেখাগুলো মন দিয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম, এবং ঔপন্যাসিক ও গল্পকার দেবেশ রায়কে নতুন ভাবে আবিষ্কার করলাম। সেই সময়ে তিনি তাঁর সুবৃহৎ উপন্যাস ‘বরিশালের যোগেন মন্ডল’ নিয়ে মগ্ন হয়ে আছেন। প্রায়ই আমাকে নানা নথিপত্র দিয়ে তার সত্যতা যাচাই করতে বলতেন। অনেক সময় খবরের কাগজের কাটিং দিয়ে তার উৎস সংগ্রহ করার কাজ দিতেন। নানা রকম বই, বিশেষ করে বাংলাদেশের বই সংগ্রহ করে দিতে বলতেন। সেগুলো তাঁর হাতে দিতে পেরে খুব আনন্দ পেতাম। তাঁর চোখেমুখেও ফুটে উঠত মহাতৃপ্তি। সেই সময় তিনি আমাকে তাঁর অভিভাবক হিসেবে আখ্যা দেন। অনেকের সামনে এই ব্যাপারটি ব্যক্ত করতে দেখলে খুব লজ্জা পেতাম। কিন্তু তিনি যে কতখানি আন্তরিক ছিলেন তাঁর অকপট ভাষণে তার প্রমাণও পেয়েছি। এই সময় ‘অভিযান’ থেকে আমার সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের অন্য সিনেমা’ গ্রন্থের ছ’টি খণ্ড একসঙ্গে বেরোয়। বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান হয় গোর্কি সদনে মহা সমারোহে। অতিথি হিসেবে আসেন বাংলাদেশের সম্মাননীয় চিত্রপরিচালক তানভীর মোকাম্মেল ও মোরশেদুল ইসলাম এবং অবশ্যই তিনি। সেদিন তাঁর ভাষণে খুব উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। লেখক হিসেবে, সম্পাদক হিসেবে মনে হয়েছিল যেন পায়ের তলায় যেন একটু একটু করে জমি পাচ্ছি। দেবেশদা একদিন বাড়িতে ডেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিমত দিয়েছিলেন ওই বই সম্পর্কে। তাঁর উৎসাহে অনতিবিলম্বে আর একটি বইয়ের কাজ করি। বইয়ের নাম ‘ছেড়ে আসা মাটি’। বেশ ক’টি মূল্যবান লেখার সংকলন। সব ক’টিই স্মৃতিচারণ। এই বইয়ের জন্যে তাঁর কাছে থেকে একটি লেখা পাই। বইটি বেরোলে তিনি পরমাদরে নানা কথায় অভিনন্দিত করেছিলেন। এই লেখাটি পরে ‘খড়ি’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত আমার সম্পাদিত ‘দেশের বাড়ি’ গ্রন্থে সংকলিত করি। বই হাতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন।
তত দিনে বাংলাদেশের অভিজাত মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’-এর সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটেছে। এই কাগজের সূত্র ধরেও দেবেশদার বাড়িতে ঘন ঘন যাবার সুযোগ ঘটল। মূলত লেখা চাইতেই যেতাম। কখনওই খালি হাতে ফিরিনি। কত রকম লেখাই না তিনি দিয়েছেন! গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এমনকি ধারাবাহিক উপন্যাসও লিখে দিয়েছেন। পত্রিকাটা খুব পছন্দ করেছিলেন তিনি। কলকাতা থেকে যখন এর একটি সংস্করণ বেরোতে শুরু করে তখন এর সম্পাদক ছিলেন শ্রদ্ধেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। পত্রিকার সৌকর্যে মুগ্ধ হয়ে দেবেশদা একবার আমার কাছে তাঁর মনের একটি গভীর ও গোপন ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বিনা সম্মান দক্ষিণায় এই কাগজের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, নীরেনদা যেমন আছে থাকবেন। সহকারী হিসেবে তিনি আমাকে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন দুই বাংলার মুখপত্র হিসেবে এই কাগজটাকে তিনি তৈরি করে দেবেন। খুবই লোভনীয় এই প্রস্তাব, অন্তত আমার কাছে সেদিন মনে হয়েছিল। তাঁর এই প্রস্তাব আমি যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলাম। যদিও তার কোনও সদর্থক জবাব পাইনি। অবশ্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ‘সেতুবন্ধন’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন এবং বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটা সীমিত পরিসরে বহুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এর সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র ছিল আমৃত্যু।
নিয়মিত বাগুইআটির বল্মীক আবাসনের বাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে একদিন বৌদিকে বললাম একটা স্মৃতিকথা লেখার জন্যে। আমাকে অবাক করে তিনি জানালেন, ওটা নাকি ইতিমধ্যেই তিনি অনেকটা লিখে ফেলেছেন। একটা চমৎকার নামও দিয়েছেন— ‘জীবন জুড়ে গান’। যে মানুষটা রাতদিন গৃহকর্মের পাশাপাশি কেবল গান নিয়েই থেকেছেন, তাঁর বইয়ের নাম তো এমনই হওয়া সঙ্গত। যথাসময়ে একদিন দেবেশদার নির্দেশে বৌদির স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপি ‘এবং মুশায়েরা’ প্রকাশনার সুবল সামন্তকে দিয়ে আসি। বৌদি কেবলই আক্ষেপ করতেন, ‘এই বই একটাও বিক্রি হবে না’। তাঁর ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে বইয়ের প্রথম সংস্করণ দ্রুত শেষ হয়ে যায়। যথারীতি বইটির একটি কপি আমি উপহার পেয়েছিলাম। এর বইয়ের যে কদর হবে, সেই বিশ্বাস আমার ছিল এবং তা প্রমাণিতও হয়ে যায়। বইটা হাতে পেয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি, ‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় একটি দীর্ঘ রিভিউও লিখি। পত্রিকা হাতে আসার পর পরই দেবেশদা-বৌদির কাছে যাই, সসঙ্কোচে পত্রিকাটা দিই। ভেবেছিলাম দিয়েই চলে আসব। কিন্তু তা হল না। আমাকে বসিয়ে রেখে পুরো রিভিউটা দুজনে পড়লেন। দেবেশদা পিঠ চাপড়ে দিয়ে একটা কথাই বলেছিলেন, ‘বাহ’। বৌদি খুব খুশি হয়েছিলেন, তাঁর দু’একটা কথাতেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম, তাঁর না বলা কথাগুলো যেন আবার লিখতে শুরু করেন। রাজিও হয়েছিলেন। ঠিক করেছিলেন বইয়ের আর একটি সংস্করণ বেরোলে তাতে তিনি কিছু সংযোজন করে দেবেন। শেষ পর্যন্ত তা আর সম্ভব হয়নি। হঠাৎ করেই একদিন তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
বৌদির মৃত্যুর কিছু দিন বাদে সল্ট লেকের রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবনে গান্ধার-এর একটি অনুষ্ঠান হয়। প্রতি বছরই ওই সংস্থার উদ্যোগে একটি করে অতি উচ্চমানের অনুষ্ঠান হত। রবীন্দ্রনাথের গানের ডালি দিয়ে নানান ভাবনাসমৃদ্ধ অনুষ্ঠান। দেবেশদার সক্রিয় প্রভাব থাকত সেই সব আয়োজনে,অবশ্য সবটাই তিনি করতেন আড়াল থেকে। এই আয়োজনে আর এক জনের অবদানের কথা না বললেই নয়, তিনি শঙ্খ ঘোষ। বহু যত্নে তিনি এক-একবার এক-একটি বিষয় নির্বাচন করে দিতেন। শুধু তাই নয়, সেই বিষয়ের অনুকূলে রবীন্দ্রনাথের গানও বাছাই করে সাজিয়ে দিতেন। সেই সব অনুষ্ঠান যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন তার উচ্চতা কোন পর্যায়ের! বৌদির অবর্তমানে গান্ধার-এর অনুষ্ঠান শেষ হল তাঁরই গাওয়া ‘পথে চলে যেতে যেতে’ গানটি পর্দার আড়াল থেকে ভেসে আসার মধ্য দিয়ে। কেমন একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হল আমার।
তত দিনে দেবেশদা তাঁর শ্রবণশক্তি অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর মতো মানুষ কথা শুনতে পাচ্ছেন না, এ বড় কষ্টের ব্যাপার তখন। মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠাই, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর আসে। দেখা করি। কানে মেশিন লাগিয়ে আমাদের কথা বোঝার চেষ্টা করেন, কথা বলেন। আমাদের ঠোঁট নাড়া দেখে কথা কিছুটা বুঝতে পারেন। সে এক প্রাণান্তকর ব্যাপার। তবু আমার যাওয়া বন্ধ হয় না। বিশেষ করে পরিচিত তেমন কেউ কলকাতায় এলে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় ওঁর কাছে। সময়টা কেমন উড়ে যায়। সারা বাড়িতে বৌদির স্মৃতিমাখা অনুভূতি। দেবেশদা হয়তো বুঝতে পারতেন, কিছু বলতেন না।
ওঁর মতো মানুষের সান্নিধ্য পাওয়াটাই ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা পাওয়া। কিন্তু সব পাওয়াকে ছাপিয়ে গেল তাঁর একটি উপহারে। এক দিন আমাকে ডেকে হাতে তুলে দিলেন তাঁর একটি সদ্যপ্রকাশিত বই ‘তিনটি নভেলা’। বইটি তিনি আমাকেই উৎসর্গ করেছেন। বিস্ময়ের পরে বিস্ময়। লিখেছেন, ‘সুশীল সাহা দুই বাংলার স্বনির্মিত সেতু প্রীতিভাজনেষু’। এ যে আমার জীবনের কত পাওয়া, সে কথা আমি কী করে বোঝাই। সেই সত্তর সালে দেশ ছাড়ার পর থেকে নিরন্তর ছেড়ে আসা দেশটার জন্যে যে নানান রকম কাজকর্মে লিপ্ত থেকেছি একেবারে নীরবে নিভৃতে, তার যেন এক অন্য স্বীকৃতি এই উৎসর্গপত্রের লেখা। এমন করে অনেকেই মূল্যায়ন করেছেন পরবর্তী কালে, কিন্তু দেবেশদার এই ঘোষণা যেন আমাকে অনেক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। জন্মভূমির জন্যে এই আকুতি আমার আজও ফুরায়নি, হয়ত ইহজীবনে ফুরাবেও না।দেবেশদা কী ভাবে যেন বুঝতে পেরেছিলেন।
তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা এতই ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল যে যখনই তাঁর কাছে যে কাজেই গিয়েছি, তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা থেকে শুরু করে লেখালিখির ব্যাপারে সহযোগিতায় আমাকে ভরিয়ে দিয়েছেন। প্রিয় বন্ধু ও ভাই কৌশিক জোয়ারদার আর বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম গোর্কি সদনে গত বছর। আসার কথা ছিল শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, অরুণ সেন আর দেবেশদার। অনিবার্য কারণে সে দিন আসতে পারেন নি শঙ্খদা, পবিত্রদা আর অরুণদা। আমরা খুব আশাহত হয়ে পড়েছিলাম। তবে সেদিন দেবেশদা সবার অভাবকে ছাপিয়ে আমাদের পূর্ণ করে দিয়ে গিয়েছিলেন। শরীর ভাল যাচ্ছিল না, মধুসূদন মঞ্চে নাটক দেখে ফেরার পথে সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছিলেন। তবু আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি, করেননি।
এত মধুর সম্পর্কের মধ্যেও একটা আক্ষেপ আজ মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা দিয়েই এই আত্মকথন শেষ করব।
হাসান আজিজুল হক সাহেবের ছোট উপন্যাস ‘বিধবাদের কথা’ একটু অন্য রকম ভাবে বার করেছিলাম বছর কয়েক আগে। কিন্তু সেই বই পাঠক সমীপে আসার আগেই প্রকাশক সোমনাথের অকালমৃত্যু হয়। বইটা তাই নতুন করে প্রকাশ করার জন্যে দে’জ পাবলিশার্স-এর শরণাপন্ন হই। ওঁরা সাগ্রহে রাজি হন। আগের সংস্করণের কিছু কিছু বিচ্যুতি সংশোধন করে একটা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করি। এই বইয়ের কথা জানতে পেরে দেবেশদা ওই উপন্যাস সম্পর্কে একটি মননঋদ্ধ লেখা আমাকে দেন। এই বইয়ে মূল উপন্যাসের সঙ্গে কয়েকজন আলোচকের লেখা সংযোজিত হয়েছিল। এই লেখকদের মধ্যে ছিলেন অশ্রুকুমার সিকদার, দেবেশ রায়, সাধন চট্টোপাধ্যায়, পৃথ্বীশ সাহা এবং ইমতিয়ার শামীম। এই কারণেই বইয়ের নামকরণ করা হয় ‘বিধবাদের কথা: নানা পাঠে’। গত বছর পুজোর পরে বইটি প্রকাশিত হয়। বইটি আমার হাতে আসে একটু দেরিতে। দেবেশদাকে বই প্রকাশের খবরটা এক মোবাইল বার্তায় জানাই। তিনি বইটি দেখতে চান। কিন্তু কিছুতেই সেটা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। প্রধান কারণ, বইয়ের কপি তেমন বেশি পাইনি। যা পাই তার সিংহভাগ পাঠিয়ে দিই হাসানভাইকে। দেবেশদা-সহ অন্যান্য লেখকদের বই দেওয়া হয়নি। যা হোক বই যখন হাতে এল তখন সারা পৃথিবী করোনা-কবলিত। আমাদের জীবনেও নেমে এল ‘লকডাউন’। আমার আর যাওয়া হল না বল্মীক আবাসনে। দেওয়া হল না বইটা।
এবং এক দিন এসে পড়ল ১৪ মে। সে দিন বিকেলে চলে গিয়েছেন আমার আর এক প্রিয়জন, আনিসুজ্জামান। তার পর একটু রাতের দিকেই চলে গেলেন দেবেশদা। খবর পেলাম পরদিন সকালে। চোখের সামনে নেমে এল স্বজন হারানোর এক কালো ছায়া। হৃদয় জুড়ে বেজে উঠল একটি গান, ‘ঝরাপাতা গো ঝরাপাতা গো, আমি তোমার দলে’।
কেন এই গান ? কে জানে !
ধন্যবাদ
ReplyDeleteধন্যবাদ । সত্যজিত বন্দ্যোপাধ্যায ।
ReplyDeleteএকটা প্রবন্ধ শুধু তথ্য বা স্মৃতিই পরিবেশন করে না। সেখান থেকে পাওয়া যায় লেখকের মনন, রচনাশৈলী, মাটিচাপা বহু কথার সংসার। জানতে ইচ্ছা করে বহু স্বল্পপরিচিত ব্যক্তি ও সাহিত্যকে, সর্বপরি প্রাবন্ধিককেও।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল
ReplyDeleteঅসামান্য। দেবেশ রায় এবং এক বড় সময় জুড়ে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক পরিসরের স্মৃতিমেদুর ইতিহাস ; লেখকের সমর্থ ভাষায়, আন্তরিকতায় তা হয়ে উঠেছে আখ্যান। অনেক ধন্যবাদ সুশীলদা। স্বপন পাণ্ডা।
ReplyDeleteঅসামান্য। দেবেশ রায় এবং এক বড় সময় জুড়ে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক পরিসরের স্মৃতিমেদুর ইতিহাস ; লেখকের সমর্থ ভাষায়, আন্তরিকতায় তা হয়ে উঠেছে আখ্যান। অনেক ধন্যবাদ সুশীলদা। স্বপন পাণ্ডা।
ReplyDelete