অনুবাদ সাহিত্য - সুলগ্না মুখোপাধ্যায়
Posted in অনুবাদ সাহিত্য
মুল গল্পঃ Der Heiland
ত্রাতা
এতদ্বারা আমি গটলিব মাউরার-এর অবিভাকত্বের বিষয়ে খবর এবং বিবরণ তোমার সামনে পেশ করতে চলেছি। এতাই আমার মক্কেলের ব্যাপারে শেষ খবর। একজন প্যারিশের-এর কেরানি হিসেবে তুমি জানঃ গটলিব গত বছরের শেষ দিকে মারা গিয়েছে। আমার প্রাথমিক রিপোর্ট সবসমই সংক্ষিপ্ত আর তাতে নথিভুক্তে করা আছে যে, এই প্রতিবেদনের সময় গটলিব-এর শারীরিক অবস্থার খুব তাড়াতাড়ি অবনতি ঘটেছিল আর ২২শে ডিসেম্বরের সকালে তাকে বৃদ্ধাশ্রমের কংক্রিটের প্যানেলের ওপরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রাথমিক রিপোর্টের পরে আছে নগদ লেনদেনের আট পাতার এক বিবরণ, সম্পত্তির হিসেব, ব্যাল্যান্স শিট এবং সম্পদের এক তুলনাভিত্তিক রিপোর্ট। এই রিপোর্টের সঙ্গে জমা দেওয়া হচ্ছে সব নথিপত্র, যার মধ্যে তার দুটো ব্যাঙ্কের একাউন্টের তথ্য আছে। গটলিবের সেখানে সামান্যই টাকা ছিল।
গটলিব এই বৃদ্ধাশ্রমের যে ঘরটায় থাকত, সেই ঘর ওর বোন আর আমি পরিষ্কার করি। ঘর পরিষ্কারের সময় ওর বোন বৃধবাশ্রমের সামনের বেঞ্চে দেখতে পায়ঃ “ এই গটলিব লোকটা … এর বাবার উচিত ছিল তাঁর বীর্যটা সেপটিক ট্যাঙ্কে ফেলার।” আমাদের অনেক সময় লেগেছে ওর ঘর থেকে সমস্ত ইঁট এবং প্যানেল পরিষ্কার করতে। ছটা প্যানেলকে এমনভাবে কাটা ছিল যেন সেগুলোকে কলা রাখার বাক্সে রাখা যেত। যখন গটলিবকে মানাসিক চিকিৎসালয়ে বা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সে ওগুলোকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।
গটলিব-এর ঘরে ঢুকলে প্রথমেই যেটা চোখে পড়বে, সেটা হল খোদাই করা এবং আঁকা প্যানেলগুলো। একদিকে আঁকা আছে একটা গরু, একটা পাত্র থেকে জল খাচ্ছে, একটা মোরগ, যে দানা খুঁটে খাচ্ছে আর পপলার গাছের সারি দেওয়া রাস্তা, যেগুলো বাতাসে দুলছে।অন্যদিকে রয়েছে সমুদ্রের ধারে একটা পাম গাছ, একটা ব্যাজার সমেত একটা বনের ঝাড় আর একটা প্যানেল যেখানে বড় হরফে লেখা “এফা” আর ছোট হরফে লেখা “ ৩২-টা দুধসাদাদাঁত।” আমি জানিনা, কে এই “এফা”, আমি জানিনা আদৌ এই নামে কেউ আছে কিনা। কিন্তু এটা আমি জানি , যে গটলিব-এর খালি একটা দাঁত ছিল, হলুদ, নিকোটিনের ছোপ লাগা দাঁত।
মাটিতে দুটো প্যানেলের ওপরে গটলিব শুতো। ও সেটাই চাইত। একটা আলুর বস্তা ছিল তার বালিশ। তার মধ্যে বেড়াতে যাওয়ার সব ক্যাটালগ সে জমিয়ে রাখত, যেগুলো বেশিরভাগই সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাওয়ার। আমি নিশ্চিত যে গটলিব কখনও সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যায়নি। গটলিব বলত,“ক্যাটালগগুলোর ওপরে মাথা রেখে আমি স্বপ্ন দেখি।”
দিনেরবেলা ওই খালি আলুর বস্তাটা নিয়ে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। উপত্যকার লোকেরা ওকে এইভাবে চিনতঃ লম্বা কালো কোট, রবারের জুতো, কাঁধে আলুর বস্তা। প্রায়শই দোকানের সামনে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে থাকা আবর্জনা তুলে সে তার আলুর বস্তায় রাখত, তারপর সেগুলো নিয়ে দোকানে ঢুকে দেখিয়ে একটা কুড়ি টাকার নোট পাওয়ার আশা করত। গটলিব-এর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বেশ কিছু টাকা তারা দিয়ে দিত। এইভাবে সে তার ইঁট আর প্যানেলের টাকা রোজগার করেছিল।
গটলিব-এর শোয়ার জায়গাটা ঘরের ভেতরেই একটা দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা ছিল। ডানদিকে ছিল একটা ছোট প্যাসেজ, যেটা দিয়ে লোকে তার ঘরে ঢুকত। শোয়ার ঘরের পিছনের দেওয়ালটাও ছিল ইঁট দিয়ে ঢাকা। “যাতে আমার ঘরের জানালা দিয়ে আলো না ঢোকে”, গটলিব আমাকে এই কারণ দর্শে ছিল। সব ইঁটগুলোর ওপরে তার হিজিবিজি হাতের লেখায় ভর্তি ছিল। বৃদ্ধাশ্রমের কর্তারা গটলিব-এর এই স্ব-নির্মাণকে সহ্য করে নিয়েছিলেন। সেটা দেখে একই সঙ্গে আমি বিস্মিত ও খুশি। এই ইঁটগুলো যে গটলিব-এর মাথায় পড়েছিল, সেটা নিয়ে লোকের কোনও সংশয় ছিল না। কারণ সে ছিল প্লাস্টারবিহীন একজন অতি বিচক্ষণ মাউরার।
অনেক কমবয়সেই গটলিব “উপত্যকার ত্রাণকর্তা”, এই ডাকনামটা পেয়েছিল। সেই সময় ও ঢেউয়ের মতন চুল নিয়ে ওই পাড়ায় দুলে দুলে ঘুরে বেড়াত। তখনও পুরুষেরা কেউই লম্বা চুল রাখত না। সেটা তোমার প্যারিশের কেরানি হিসেবে কাজ করার অনেক আগে, তাই তোমার সেটা জানার কথা নয়। গটলিব এখানে ওখানে কাজ করত, প্যারিশের হয়েও ও কাজ করেছে। কোথাও যদি একটা কবর খোঁড়ার দরকার হত, তো গটলিব –এর মতন সুযোগ্য লোক আর ছিল না। তার শরীরের ওপর দিকটা ছিল ভারোত্তোলকের মতন। যদি কোনও কাজ তার ক্ষমতানুযায়ী হত, তখন সে ভালুকের মতন তীব্র গতিতে সেই কাজ সুসম্পন্ন করত। গটলিব একদিনে খুঁড়ে ফেলেছিল নতুন কর্মশালা থেকে রাস্তা পর্যন্ত যে নিকাশীটা ছিল, সেটাকে। সে একা! আর যদি কোনও কাজ তার নাপসন্দ হত, তাহলে কিছুতেই সেই কাজটা সে করত না। যদি ওর মাথায় সেটা গেঁথে যেত, সেই ব্যাপারে কোনও আলোচনাতেই ও ঢুকত না। তুমি কি জানতে, আমি ওর অভিভাবকত্ব নেওয়ার আগে, ও নিজের একটা কুঁড়ে ঘরে থাকত? পাশের উপত্যকার পিছনদিকটায়, ভ্যুএস্ট্মাট-এর বিপরীতে, তিন, চার মিটার বনের ভিতরে। সেখানে সে বনের মধ্যেই তার ঘরটা নির্মাণ করে এবং বালিপাথর দিয়ে সেটাকে খোদাই করে তলে। এমনকি সে ওই পাথরের মধ্যে শক্ত লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়।
ওই বনের মধ্যেও সে সব অদ্ভুত জিনিস ওই ইঁটগুলোর ওপরে লিখে রেখেছিল, যেগুলো সে পরে বৃদ্ধাশ্রমেও লিখেচিলঃ ৩০ থেকে ৮০ কিলমিটার-এর মধ্যে সব কোম্পানির নামের লিস্ট, যেখানে লোকেরা ইঁট কিনতে পারবে। আরেকটা লিস্ট ছিল সব গুল্মলতার এবং বন্যফুলের, আরকাসিয়া থেকে শুরু করে কাঁটাগাছ পর্যন্ত। আরকাসিয়া গুল্মলতার চা ও একবার গলাব্যাথার জন্য খেয়েছিল। দু-বার ও কাপড়ও গলায় ধকাবার চেষ্টা করে দেখেছে।অবশ্য তখন ও আমাকে ওর অভিভাবক হিসেবে জিজ্ঞেস করেছিল, সেটা আমি তোমাকে বলতে পারি। গটলিব কোনওসময় নিজের থেকে হাসপাতালে যেত না। দ্বিতীয় অপারেশনটার আগে ও নিজের গলায় একটা পাতলা নল ঢুকিয়ে ছিল, যাতে গলায় অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও ও খিদেয় না মরে। ওই নল দিয়ে ও কফির সঙ্গে সরু সসেজ ঢুকিয়ে দিত।
এটা আমাকে অবাক করত, যে গটলিব বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত খুবই বলিষ্ঠ ছিল। বৃদ্ধাশ্রমে সে স্যারভেলাট-এর সসেজ মজুত রাখত। পোকামাকড় টার ওপরে ঘুরে বেড়াত। আমি ওকে বলেছিলাম, ওই সসেজগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেলে দিতে। ও শুধু হাসতো আর বলতঃ “আমি চামড়াটা তুলে ফেলে দিই, আর তাতেই ওই স্যারভেলাটগুলো খাওয়া যায়।” এটা আর কাউকেই অবাক করে না, যে গটলিব-এর এক্তাই মাত্র দাঁত ছিল, ডান দিকের মাংস খাওয়ার দাঁতটা। যদিও সে হাসপাতালে সহজে যেতে চাইত না, কিন্তু তার নিজের ডাক্তার ডক্টর কেলার-এর ওপরে ওর ছিল অগাধ বিশ্বাস। প্রত্যেক মাসে এই ডাক্তার ওকে একটা করে ইনজেকশন দিতেন।খুব সসম্ভবত ওর “মানসিক রোগের জন্য এই বিশেষ ওষুধটি ওকে দেওয়া হত, মিউনিসিপালিটির অভিভাবকত্বের নথিতে সেইভাবেই বিবরণ দেওয়া আছে। খোলা রাস্তার ওপরেই গাড়ি থেকে নেমে ডক্টর কেলার গটলিবকে টার পিছনদিকে একটা ইনজেকশন দিতেন, যখন দৈবাৎ তাঁদের দুজনের দেখা হয়ে যেত। এই ইনজেকশনগুলো তাকে এমন ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলত; সে তখন্ আর সহজে ঘর থেকে বেরত না। বেশ কয়েকদিন পরে আবার সে তার পরিচিত বৃত্তে বেরত। সেইজন্য গটলিব প্রথমদিকে ইনজেকশন থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইত। তবে কখনওই হিংস্র হয়ে উথত না, কারণ ডক্টর কেলার-এর প্রতি গটলিব-এর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে গিয়েছিল।
গটলিব-এর পঁচাত্তর বছরের জন্মদিনে আমাদের গ্রামের সঙ্গীত সমিতি তার উদ্দেশে সঙ্গীত পরিচালনা করে। গটলিব অবশ্যই আশা করেনি যে আমরা আসব। আরও এটা ওর মনে হয়েছিল, কারণ এই বৃদ্ধাশ্রমটি আমাদের গ্রামে অবস্থিত নয়, বরং উপত্যকার অনেক নীচের দিকে। আমরা দুটো পোল্কা আর একটা আধুনিক সঙ্গীতের সুর বাজিয়েছিলাম। তারপর সঙ্গীত সমিতির সভাপতি গটলিবকে অভিনন্দন জানান। যখন সমবেত স্বরে জন্মদিনের গান হচ্ছিল, তখন গটলিব তার চোখের জলকে থামাতে চেষ্টা করছিল, আর “ওল্ড কমরেড” গান্তার সময় সে দুরগের কুকুরের মতন চীৎকার করছিল। ওই একবারই আমি গটলিব-কে কাঁদতে দেখেছিলাম। কনসার্ট শেষ হওয়ার পরে কী ভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে হয়, সে তা জানত না। কুড়ি জনের ওপরে যে সঙ্গীতশিল্পীরা ছিলেন, সঙ্গীত পরিচালকেরা এবং লেফটেন্যান্ট, গটলিব ভয়াতুর ভঙ্গীতে তাঁদের প্রত্যেকের কাছে গেল। হটাৎ সে দ্রুত বাড়ির মধ্যে চলে যায়, ইঁটগুলো বের করে আনে বাইরে, আর যাঁরা ওখানে উপস্থিত ছিল, তাঁদের প্রত্যেককে একটা করে ইঁট দেয়।
সভাপতি খুব সুন্দর শব্দচয়নের মাধ্যমে গটলিব-কে ধন্যবাদ জানালেন। আমরা ইঁটগুলো আমাদের গাড়িতে তুলে বাড়ির উদ্দেশে রাওনা হই। আজকাল অনেকেই ‘উপত্যকার ত্রাণকর্তা’-র এই উপহার নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে, কিন্তু আমার যতদূর জানা আছে, কেউই সেগুলো ফেলে দেয়নি। কারণটা হতে পারে এই যে, গটলিব-কে তার পঁচাত্তর বছরের জন্মদিনের পরের দিনই ওই প্যানেলের ওপরে মৃতাবস্থায় পাওয়া যায়। সেই থেকে আমাদের এই উপত্যকার দু-ডজন ঘরে রয়েছে ইঁটের স্তূপ, জার উপরে কাঁপা হাতে লেখাঃ
“২৪ ঘণ্টা”
“সমুদ্রেরপ্রতিভালবাসা”
“ঘৃণ্যএফা”
“ব-সন্ত”
“৩৬৫ দিন”
“ট্রাকেরচাকা”
“কালোকাঁটারমুকুট”
“প্রকৃতিরআত্মা”
আমার “পঁচাত্তর বছরে”
0 comments: