0

someপ্রতীক - ওমর কায়সার ও খালেদ হামিদী

Posted in

নবজাগরণের মানুষ

‘আব্বা আমাদের চাচাতো–মামাতো ভাইদের নাম রেখেছিলেন নিজের নামের মতো দীর্ঘ করে। সবার বড়ো আমার মামাতো ভাই সৈয়দ আবুল ফজল মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। তারপর আমার অগ্রজ আবুল কালাম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। ততদিনে আব্বার নাম ইংরেজিতে সংক্ষিপ্ত হয়ে ডা.এ টি এম মোয়াজ্জেমে পরিণত হয়েছে। তখন থেকে আমাদের সবার নামে যেন এ টি এম থাকে, এটাই হয় তাঁর লক্ষ্য। অতএব আমার নাম রাখা হয় আবু তৈয়ব মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান। আমার ভাইয়ের আবু তালেব মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান।......আমার প্রথম গল্প বেরিয়েছিল এ টি এম আনিসুজ্জামান স্বাক্ষরে। তারপর এ টি এম বর্জন করি। পত্রিকার পাতায় তা দেখে আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এ টি এম লেখনি কেন?” বললাম, ‘‘ওটা বাদ দিয়েছি।’’ আব্বা একটু চুপ করে থেকে বললেন,‘আমার ছেলে হিসেবে চেনা যাবে না’’

স্যারের আত্মজীবনী কাল নিরবধির প্রথম পর্ব জন্মের আগের শেষ স্তবকে এইভাবে উঠে এসেছে তিনি কীভাবে আনিসুজ্জামান হলেন। চিকিৎসক বাবা আক্ষেপ করেছিলেন— নামের বাড়তি অংশ বাদ দেওয়ায় তাঁর ছেলে হিসেবে চেনা যাবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনিসুজ্জামানকে চেনা গেল একটা জাতির বাতিঘর হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন নবজাগরণের মানুষ। পরপার থেকে তাঁর বাবা কি সেটা টের পেয়েছেন? 

বাংলাদেশের দেশের প্রতিটি নাগরিক যেমন আনিসুজ্জামান স্যারদের মতো মানুষের কাছে অনেক ঋণ, তেমনি আমারও আছে।কিন্তু তাঁর সরাসরি ছাত্র হিসেবে আমার কিছু বাড়তি ঋণ আছে।

আজ আমার মনে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোর কথা, খুব কাছ থেকে শোনা স্যারের বক্তৃতাগুলোর কথা।

স্যার ছিলেন তুখোড় বক্তা। পরিমিত ও যথাযথ শব্দ প্রয়োগ করে কথাগুলো এমনভাবে বলতেন যেন কোনো কথাশিল্পীর লেখা গদ্য তিনি পাঠ করে শোনাচ্ছেন। যেন অনেক আগে ভেবেচিন্তে কথাগুলো আগে থেকে লিখে রেখেছেন। কোনোদিন তাকে অযাচিত শব্দ উচ্চারণ করতে দেখিনি।

তাঁর বক্তব্যে সাহিত্য রাজনীতি, ভাষা, সমাজ তা যে কোনো বিষয় হোক না কেন তা উপস্থিত শ্রোতাদর্শকদের উপভোগ্য হয়ে উঠত সুন্দর পরিবেশনের কারণে।বিষয় যতই গুরুতর হোক স্যার তা তুলে ধরতেন রসপূর্ণ করে।

চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে একবার শিল্পী মুর্তজা বশীরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্যার বক্তৃতা দিতে উঠে বলেছিলেন — মুর্তজা বশীরকে সামনে রেখে আমরা কি তাঁর শোকসভা করছি? সবাই কেমন গুরুগম্ভীর হয়ে তার গুনগান আর স্মৃতিতর্পন করছি।তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় মুহূর্তেই পুরো অনুষ্ঠান উৎসবে পরিণত হলো। মুর্তজা বশীরের হাতে আংটি পরা থেকে শুরু করে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের মজার মজার সব গল্প বলতে বলতে কখন যে শিল্পী মুর্তজা বশীরের মূলশিল্পকর্ম এবং লেখালেখির জগতে তিনি প্রবেশ করিয়ে দিলেন উপস্থিত দর্শকশ্রোতাদের।একধরনের মোহাবিষ্ট হয়ে শুনতাম তাঁর কথামালা। এমন শিল্পশোভন বক্তব্য বাংলাদেশে সত্যিই বিরল।

সংবাদপত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে একটি বক্তব্যর কথা বলি। স্যারের বক্তৃতার প্রতি আকর্ষণতো ছিলই, তার উপর সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টির প্রতি আমার আগ্রহ থাকাতে এটির কথা বেশ মনে আছে। সেদিন স্যার সংবাদপত্র এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে ভাষার ভুল ব্যবহারের উদাহরণ দিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিলেন। আপাত দৃষ্টিতে যে ভুলগুলো কারও চোখে পড়ে না তাই তিনি দেখিয়ে দিলেন আঙুল তুলে। দেখিয়ে দিলেন শব্দের ভুল প্রয়োগের কারণে কীভাবে বাক্য মূল ভাবনা হারিয়ে বসে। সেদিনের বক্তব্যে ছিল তীব্র ব্যঙ্গ আর হাস্যরস। স্যার সেদিন বলেছিলেন, ‘উইমেন ওপেন টেনিস টুর্নামেন্ট’কে বাংলা করতে গিয়ে কেউ যদি লেখেন— ‘উম্মুক্ত মহিলা টেনিস টুর্নামেন্ট’ লেখেন, তবে এই বয়সেও মনটা কেমন হয়ে যায় বটে।বাংলা ভাষার পত্রিকাগুলোর জন্য সেদিনের ভাষণ ছিল এক অনন্য দিকনির্দেশনা।

এমনিতে বাংলা ভাষার অপব্যবহার ও প্রমিত বাংলার বিকৃতি নিয়ে স্যার চিন্তিত ছিলেন। নানা বক্তৃতায় তিনি এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলতেন, পঞ্চাশের দশকে প্রমিত বাংলার চর্চা ছিল। মানুষ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতো ঠিক, কিন্তু সাহিত্যে, নাটকে, লেখায় এবং নাগরিক জীবনের আলাপে সালাপে প্রমিত বাংলার চর্চা হতো। আজকাল অনেকেই এই প্রমিত ভাষা স্বীকার করেন না।

মূলত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর আমাদের স্বাধীনতার সকল মূল্যবোধ পায়ের তলায় পিষে দিয়ে যখন হন্তারক শাসকগোষ্ঠী এই দেশটিকে আরেকটি পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল তখন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রমিত বাংলাকে বিকৃত করা হচ্ছিল।

একটি বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, বায়ান্ন সালে যে ভাষার জন্য বাঙালি প্রাণ দিয়েছে, সেই মাতৃভাষাকে আমরা হত্যা করছি। ভাষা বিকৃতির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে স্যার উল্লেখ করেছিলেন – ৭৫ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজেরা নিজেরা নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এইসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবহৃত ভাষায় আরবির প্রভাব দেখা দেয়। পাশাপাশি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো ভাষাকে বিকৃত করেছে। সেই সময় বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে প্রয়োজনে আরও একটি বায়ান্নর প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

একদিন স্যার ক্লাসে বঙ্কিম পড়াচ্ছিলেন। ক্লাস শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কিশোর নামে আমার এক বন্ধু স্যারকে বোকার মত অপ্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। সে জানতে চেয়েছিল শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদের মধ্যে কে বড় কবি। এই প্রশ্নে আমিও বিব্রত হয়েছিলাম। কারণ কথাটা সে এমনভাবে স্যারকে বলেছিলো যে, এই ব্যাপারে আমারও জানার আগ্রহ আছে।

স্যার একটু অবাক হয়ে কপালে ভাঁজ তুলে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, পড়ালাম বঙ্কিমচন্দ্র, বুঝালাম বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের কী অবদান। আর তোমরা জিজ্ঞেস করছ শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ নিয়ে।

তখন কিশোর বলেছিল, অনেকেই আমাদের এই প্রশ্ন করে।

স্যার তখন বললেন, নজরুল বড় নাকি রবীন্দ্রনাথ বড়। এই প্রশ্নও তো কেউ কেউ করে নিশ্চয়ই।

আমরা দুজন একে অপরের দিকে হাসলাম।

স্যার বললেন, কেউ কারো চেয়ে ছোট নয়, আবার কেউ বড়ও নয়। জাম ভালো নাকি জামরুল ভালো, এরকম প্রশ্ন করা বোকামির কাজ। এক একটার এক এক রকমের স্বাদ। কবিদের ব্যাপারে তুলনামূলক বিচারটা করে কেউ কেউ কাউকে সামাজিকভাবে উপরে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। তাদের মধ্যে অন্য একটা রাজনীতি খেলা করে।

স্যার প্রশ্ন করলেন- তুমি শামসুর রাহমান পড়নি, আল মাহমুদ পড়নি? ওদের পড়ো। তখন তুমি নিজেই বুঝে নেবে কে তোমার প্রিয় কবি।

আরেকবার শামসুর রহমানের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কোনো এক অনুষ্ঠানে স্যার বলেছিলেন, শামসুর রাহমান আমাদের ইতিহাসের পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছেন। কবিতায় নিজের কালকে তুলে এনেছেন বলে তিনি কালোত্তীর্ণ কবি।

স্যারের মতে শামসুর রাহমান ইতিহাসের পাশাপাশি হেঁটে গেছেন। কিন্তু তিনি নিজে বাঙালির ইতিহাসের অংশ। তার আত্মজীবনী কাল নিরবধি শুধু একটি মানুষের ব্যক্তি জীবনের স্মৃতি গাঁথা নয়। শুধু অসাধারণ গদ্যশৈলীর উদাহরণ নয়। একজন মানুষ একটি পরিবার একটি সমাজ একটি জনপদ ও রাষ্ট্রের সদস্য। মানুষ যত বড় হয় তার প্রেক্ষাপট ততো বড় হয়। আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী তাই হয়ে উঠেছে বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৪৭ এর পরে বাঙালির জীবনে কতশত ঘটনা ঘটে গেল। ‌ কত পরিবর্তন, রাষ্ট্র বদল। সময়ের পদে পদে তিনি সেসবে সংযুক্ত ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। একাত্তরের যুদ্ধে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রের বাংলা সংবিধান লিখতে করলেন কঠোর পরিশ্রম। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসন, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। মোটকথা সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রত্যেকটা জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাঁর।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার বিচারের দাবিতে ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এক গণআদালতের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই গণআদালতে আনিসুজ্জামান গণহত্যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী গোলাম আযমের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। সেই অভিযোগটা আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

স্যারের লেখা যে বইটি আমি প্রথম পড়েছি সেটি হলো মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য । এটি তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। এই বইতে বাঙালি মুসলমান সমাজে মানসিকতার বিবর্তনের কথা বর্ণিত আছে। বিপুল পরিশ্রম, সাধনা এবং মেধা না থাকলে এইরকম গ্রন্থ রচনা সম্ভব হয়ে উঠত না।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য স্যার নীরবে কাজ করে দূর–প্রসারী অবদান রেখে গেছেন। আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। একদিন আমাদের কাছে গোলাম মোস্তফা স্যার এসে বললেন, তোমরা সবাই থেকো। আনিস স্যার আজ একটা নতুন বিষয়ে বক্তব্য দেবেন। স্যারের নির্দেশে মিলনায়তনে আমরা সবাই জড়ো হয়েছিলাম। বাংলা বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক ছিলেন সঙ্গে। বাংলা গদ্যের উদ্ভব নিয়ে স্যারের সাম্প্রতিক এক গবেষণা নিয়ে কথা বললেন সেদিন। আমরা জানতাম বাংলা কবিতার বহু বছর পর, ইংরেজ শাসনামলে, তাদেরই পরিচর্যায় বাংলা গদ্যের জন্ম হয়েছে। এই তথ্য ভুল প্রমাণ করলেন আনিসুজ্জামান। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় গ্রন্থাগার, আর্কাইভ ঘুরে, দলিল সংগ্রহ করে প্রমাণ করলেন- মূলত ইংরেজ আমলের বহু আগে বাংলা গদ্যের প্রবর্তন হয়েছে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার একজন সাক্ষী হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।

মনে পড়ছে- আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবদারের আন্দোলনের কথা। ‌ চোখে ভাসছে স্যারের বাসার সামনে অবস্থানরত তরুণ-তরুণীদের ছবি। তাঁদের একটাই দাবি- প্রিয় আনিস স্যারকে কোথাও যেতে দেবেন না। একজন স্যারকে ধরে রাখতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম আন্দোলন আর হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই।

এখন স্যার এই পৃথিবীটাই ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর কাছেতো সময়ের অনেক দাবি ছিল। এই দুঃসময়ে, একটি নতুন পৃথিবীর উত্থানের সময় আনিসুজ্জামানের মতো একজন অভিভাবকের খুব তো প্রয়োজন ছিল।

মনে পড়ছে- চবিতে তাঁর বিদায়ের দিন এক ছাত্রী কাঁদতে কাঁদতে গেয়েছিলেন- শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে.....। সেদিন স্যারকে দেখেছিলাম ভেজা চোখে গানটি আকুল হয়ে শুনতে।

আজ সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটছে আমার ভেতরে। মনে হচ্ছে কারা যেন সমস্বরে গাইছে সেই গান। আর স্যার মেঘের ওপার হতে তা শুনতে কান পেতে আছেন।

-ওমর কায়সার
******************************************************


আনিসুজ্জামানের দেহাবসান

বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান এই অকল্পিতপূর্ব করোনাকালে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগে, শেষে ওই অণুজীব-আক্রান্ত হয়ে, ১৪ মে ২০২০ তারিখে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কারো কারো ধারণা, বাড়িতে নয়, হাসপাতালেই তিনি করোনাক্রান্ত হন যা জাতির চিত্তকে অভাবনীয়রূপে ভারাক্রান্ত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ সালে, ব্রিটিশশাসিত ভারতের পশ্চিমবংগের উত্তর চব্বিশ পরগণায়, এক উচ্চশিক্ষিত পরিবারে। কলকাতায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হলেও কৈশোরেই তিনি পিতৃপরিবারের সাথে চলে আসেন খুলনায়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাবি থেকে তিনি পিএইচডি শুরু করেন এবং ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি লাভ করেন।

আনিসুজ্জামান জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সংগে। তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের বংগানুবাদক। মনে পড়ে, ভি. আর. আম্বেদকর ভারতের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা, যিনি 'হিন্দু বৌদ্ধ ও মার্ক্সবাদ' নামে একটি ছোট অথচ শক্তিশালী ব্যতিক্রমী বই লিখে অনেক কৌতূহলী পাঠককে চমকে দেন। এদিকে আনিসুজ্জামান লেখেন 'বাংলাদেশে পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙঘন', 'আমার একাত্তর' এবং 'প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম'-এর মতো মাইল ফলকতুল্য গ্রন্থ।

তাছাড়াও তিনি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে, আরেক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কুদরাত-ই-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে সক্রিয় থাকেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর গবেষণাও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। 

আনিসুজ্জামান অনেক পুরস্কারেও ভাস্বরতর হয়ে ওঠেন। সেগুলোর মধ্যে অবশ্যউল্লেখ্য ০১. প্রবন্ধের জন্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০); ০২. শিক্ষায় অবদানের জন্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক (১৯৮৫); ০৩. শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্যে ভারত সরকার কর্তৃক তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ; ০৪. সাহিত্যে অবদানের জন্যে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৫); ০৫. আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক দুবার আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৩ ও ২০১৭)

০৬. রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি (২০০৫) এবং ০৭. কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক (২০১৮)। তাছাড়াও, বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালের ১৯ জুন তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করে। তাঁকে শিক্ষকের শিক্ষকও বলা হয়।

তাঁর সাহিত্যকৃতির মধ্যে 'স্বরূপের সব্ধানে'; 'সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি' এবং 'বিপুলা পৃথিবী' গ্রন্থত্রিতয় অবশ্যউল্লেখ্য।

প্রতিক্রিয়াশীলতাবিরোধী আনিসুজ্জামান ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রসহ প্রাগ্রসর জীবনচেতনার প্রতি, একই সংগে দায়বদ্ধ ও উন্মুখ থাকেন।

তাই জাঁ পল সার্ত্রর প্রয়াণে সীমন দ্য বোভোয়ার যেমন বলেন, তেমনি আজ বলতে হয়, আনিসুজ্জামান তাঁর মতোই আছেন, শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস নেই।

-খালেদ হামিদী

0 comments: