প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ইন্দ্রনাথ সিংহ
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
কোনখানে রাখবো প্রণাম
বীরভূমের যে গ্রামে এই অধমের বাড়ি সেই গ্রামের এক রেঢ়ো বামুনকে তামাম বাংলা চেনে। সরস্বতীর খাস তালুকের মণ্ডল প্রজা সেই বামুনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন 'গ্রামকে গড়ে তোলো, নইলে ভারতবর্ষ বাঁচবে না'। অনেকদিন পরে 1971 সালে সেই বামুন, - কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর, বিশ্বভারতীতে নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি বক্তৃতামালার তৃতীয়বর্ষের আমন্ত্রিত বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল 'রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী'। বক্তৃতা মালায় তারাশঙ্কর চারটে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। চারটেই পড়েছি আর পড়তে গিয়ে দেখেছি তারাশঙ্কর কবি রবীন্দ্রনাথ এবং কর্মী রবীন্দ্রনাথের কথা বললেও মূলত তিনি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনা নিয়েই আলোচনা করেছেন, কর্মী রবীন্দ্রনাথ সেখানে প্রায় অনুপস্থিত বললে অত্যুক্তি হয় না। কর্মী রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধেও অনেকে অনেক আলোচনাই করেছেন, কিন্তু বিশেষ কিছু পড়া আর হয়ে উঠল কই! তাই সরাসরি রবীন্দ্রনাথের লেখা আর তার কর্মোদ্যোগের মাঝে যে পল্লী-সংগঠক রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি সেই রবিঠাকুরকে প্রণাম জানানোই এই লেখার উদ্দেশ্য।
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়
ভারতবর্ষ কবিকে দেখেছে ঋষি হিসেবে, মনীষী হিসেবে – ‘দুর্গৎ পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি’। ভারতের রত্নময় কবিকুলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন 'কোহ-ই-নূর'।
তরবোহপি জীবন্তি, জীবন্তি মৃগপক্ষিঃ।
স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবন্তি।।
অর্থাৎ ‘গাছপালাও বেঁচে থাকে, পশুপাখিও বেঁচে থাকে, কিন্তু সত্যি বাঁচা সেই বাঁচে যার মন মননের দ্বারা জীবন্ত’। বস্তুতঃ মানুষের যথার্থ জীবন হচ্ছে মনস্বিতারই জীবন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন,- ‘মানুষ শুধু জীব নহে, মানুষ সামাজিক জীব। সুতরাং জীবনধারণ করা এবং সমাজের যোগ্য হওয়া, এই উভয়ের জন্যই মানুষকে প্রস্তুত হইতে হয়’। তিনি বলতেন মানুষ মনোবান, এ কথাটি মনে রাখা চাই। ‘শুধু দিনযাপনের শুধু প্রাণধারণের গ্লানি’ কে তিনি ‘শরমের ডালি’ বলে ধিক্কার দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বড় সহৃদয় মানুষ, একাধারে একজন যুগপ্রবর্তক চিন্তানায়ক, ঈশ্বরবিশ্বাসী ভক্ত (অন্তত জীবনের উপান্তে উপনীত হবার আগে অবধি), জ্ঞানতপস্বী শিক্ষাব্রতী এবং কঠোর কর্মযোগী। তিনি নিখিল বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের আনন্দময় উপস্থিতি অনুভব করতেন, তাই সমাজ সংসারের সমস্ত দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় মুক্তিই ছিল তার কাম্য।
তাঁর মনের কথা ছিল ~ “আমরা যেমনই মনে করি, আমাদের ভাই, আমাদের প্রিয়, আমাদের পুত্র, আমাদিগকে একটি জায়গায় বাঁধিয়া রাখে নাই; যে জিনিসটাকে সন্ধান করিতেছি, দীপালোক কেবলমাত্র সেই জিনিসটাকে প্রকাশ করে তাহা নহে, সমস্ত ঘরকে আলোকিত করে — প্রেম প্রেমের বিষয়কে অতিক্রম করিয়াও ব্যাপ্ত হয়"। রবীন্দ্রনাথ বলতেন "জগতের মধ্যে আমি মুগ্ধ, সেই মোহেই আমার মুক্তিরসের আস্বাদন-
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।
অসংখ্যবন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারংবার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়।"
সেই কোন ছোটবেলায় তিনি যে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ' লিখেছিলেন তার মর্মকথা ছিল – “এই বিশ্বকে গ্রহণ করিয়া, এই সংসারকে বিশ্বাস করিয়া, এই প্রত্যক্ষকে শ্রদ্ধা করিয়া আমরা যথার্থভাবে অনন্তকে উপলব্ধি করিতে পারি। যে জাহাজে অনন্তকোটি লোক যাত্রা করিয়া বাহির হইয়াছে তাহা হইতে লাফ দিয়া পড়িয়া সাঁতারের জোরে সমুদ্র পার হইবার চেষ্টা সফল হইবার নহে”।
তাঁর চোখে ভারতবর্ষ ছিল 'গ্রামে-গাঁথা দুঃখী দেশ'। দেশের উন্নয়ন এবং গ্রাম পুনরুজ্জীবন ছিল তা&র চোখে সমার্থবোধক। আর তাই গ্রাম সংগঠনের মতো দুরূহ কাজের দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহন করেছিলেন। ভারতে গ্রামন্নয়নে তিনিই পথিকৃৎ।
জমিদার রবীন্দ্রনাথের অনুভব
বাল্যে-কৈশোরে দূর থেকে পল্লী প্রকৃতির শোভা দেখে কাব্যরচনার সুযোগ তার হয়েছে। কিন্তু গ্রামের লোকের দুঃখদৈন্য এবং বিবিধ সমস্যার সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়েছ অনেক পরে, পিতৃনির্দেশে জমিদারী পরিচালনার কাজে গিয়ে, উনত্রিশ বছর বয়সে।
“আমি শহরের মানুষ, শহরে আমার জন্ম। আমার পূর্বপুরুষেরা কলকাতার আদিম বাসিন্দা। পল্লীগ্রামের কোনো স্পর্শ আমি প্রথম-বয়সে পাইনি। এইজন্য যখন প্রথম আমাকে জামিদারির কাজে নিযুক্ত হতে হল তখন মনে দ্বিধা উপস্থিত হয়েছিল, হয়তো আমি এ কাজ পারব না, হয়তো আমার কর্তব্য আমার কাছে অপ্রিয় হতে পারে। জমিদারির কাজকর্ম, হিসাবপত্র, খাজনা-আদায়, জমা-ওয়াশীল— এতে কোনোকালেই অভ্যস্ত ছিলুম না; তাই অজ্ঞতার বিভীষিকা আমার মনকে আচ্ছন্ন করেছিল। সেই অঙ্ক ও সংখ্যার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েও প্রকৃতিস্থ থাকতে পারব এ কথা তখন ভাবতে পারি নি"।
ঠাকুর পরিবারের জমিদারী ছিল অবিভক্ত বাঙলার নদীয়া, পাবনা ও রাজশাহী জেলায় বিস্তৃত। দোর্দণ্ডপ্রতাপ নায়েব-গোমস্তা-পাইক-বরকন্দাজদের পেরিয়ে প্রজাবর্গের অভাব অভিযোগের ক্ষুদ্রাংশই তাঁর গোচর হতো। নগরবাসী তরুণ কবির পক্ষে সেসব অভাব অভিযোগের সত্যাসত্য নির্ণয় করাই ছিল কঠিন। আমলাদের অত্যাচার এবং অন্যায় আদায় থেকে দরিদ্র গ্রামবাসীকে রক্ষা ছিল যেমন দুঃসাধ্য ব্যপার, তেমনি, যারা নিজেদের ভাল বোঝে না, উপকার করতে গেলে নিঃস্বার্থ শুভার্থীকে মন্দ-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সন্দেহ করে, স্বজাতি বিদ্বেষে অন্ধ ‘নিজেদের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ’ করতে যারা পুরুষাণুক্রমে অভ্যস্ত, তাদের মঙ্গল সাধনও ছিল কঠিন। এসম্বন্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা খুব সুখকর ছিল না।
“আমার জমিদারিতে নদী বহুদূরে ছিল, জলকষ্টের অন্ত ছিল না। আমি প্রজাদের বললুম, ‘তোরা কুয়ো খুঁড়ে দে, আমি বাঁধিয়ে দেব'। তারা বললে, ‘এ যে মাছের তেলে মাছ ভাজবার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা কুয়ো খুঁড়ে দিলে, আপনি স্বর্গে গিয়ে জলদানের পুণ্যফল আদায় করবেন আমাদের পরিশ্রমে! আমি বললুম, ‘তবে আমি কিছুই দেব না'। এদের মনের ভাব এই যে, ‘স্বর্গে এর জমাখরচের হিসাব রাখা হচ্ছে— ইনি পাবেন অনন্ত পুণ্য, ব্রহ্মলোক বা বিষ্ণুলোকে চলে যাবেন, আর আমরা সামান্য জল মাত্র পাব!'
আর-একটি দৃষ্টান্ত দিই। আমাদের কাছারি থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত উঁচু করে রাস্তা বানিয়ে দিয়েছিলুম, রাস্তার পাশে যে-সব গ্রাম তার লোকদের বললুম, ‘রাস্তা রক্ষা করবার দায়িত্ব তোমাদের।' তারা যেখানে রাস্তা পার হয় সেখানে গোরুর গাড়ির চাকায় রাস্তা ভেঙে যায়, বর্ষাকালে দুর্গম হয়। আমি বললুম, ‘রাস্তায় যে খাদ হয় তার জন্যে তোমরাই দায়ী, তোমরা সকলে মিলে সহজেই ওখানটা ঠিক করে দিতে পারো। 'তারা জবাব দিলে, ‘বাঃ, আমরা রাস্তা করে দেব আর কুষ্টিয়া থেকে বাবুদের যাতায়াতের সুবিধা হবে!' অপরের কিছু সুবিধা হয় এ তাদের সহ্য হয় না। তার চেয়ে তারা নিজেরা কষ্টভোগ করে সেও ভালো। এদের ভালো করা বড়ো কঠিন।"
অসীম ধৈর্য এবং আন্তরিক মমতা নিয়ে তিনি ঐসব গ্রামের লোকের হৃদয় জয় করলেন। আমলাদের দাপট কমালেন, প্রতাপশালী দোষীকে শাস্তি দিয়ে, গুণী-দরিদ্রকে মান্য দিয়ে, অন্যায় আবদার বন্ধ করে। প্রত্যক্ষদর্শী প্রমথ চৌধুরী মশাই লিখে গেছেন, তিনি একবার আড়াই লক্ষ টাকার ‘ওজরী খাজনা’মুকুব করে দেন প্রজাদের দুরবস্থা বিবেচনা করে। এই রবীন্দ্রনাথকেই আমরা বভিন্ন নাটকে দেখতে পাই কখনও বা ধনঞ্জয় বৈরাগী রূপে, কখনও বা ঠাকুরদা। ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকের একটি অংশের উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে।
‘উদয়াদিত্য। আমার উপর মাধবপুর পরগনা শাসনের ভার মহারাজ রেখেছিলেন। জান তো, দু বৎসর থেকে সেখানে কীরকম অজন্মা হয়েছে— আমি তাই খাজনা আদায় বন্ধ করেছিলুম। মহারাজ আমাকে বলেছিলেন যেমন করে হোক টাকা চাই। --------
আমি মহারাজকে বললুম মাধবপুর থেকে টাকা আমি কোনোমতেই আদায় করতে পারব না। শুনে তিনি মাধবপুর আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন’।
আশ্চর্য্য হই না যখন দেখি ওই একই নাটকে অন্যত্র পাই
‘প্রতাপাদিত্য। দেখো বৈরাগী, তুমি অমন পাগলামি করে আমাকে ভোলাতে পারবে না। এখন কাজের কথা হোক। মাধবপুরের প্রায় দু-বছরের খাজনা বাকি— দেবে কি না বলো।
ধনঞ্জয়। না মহারাজ দেব না।
প্রতাপাদিত্য। দেবে না? এত বড়ো আস্পর্ধা!
ধনঞ্জয়। যা তোমার নয় তা তোমাকে দিতে পারব না।
প্রতাপাদিত্য। আমার নয়!
ধনঞ্জয়। আমাদের উদবৃত্ত অন্ন তোমার, আমাদের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়। যিনি আমাদের প্রাণ দিয়েছেন এ অন্ন যে তাঁর, এ আমি তোমাকে দিই কী বলে?’
রবীন্দ্রনাথ সমবায় ব্যাঙ্ক খুলে তার মারফত অল্প সুদে কৃষকদের ঋণ দিয়ে তিনি মহাজনদের চড়া সুদের ঋণ-জাল থেকে তাদের রক্ষা করেন। ক্রমে তিনি প্রজাদের পিতৃতুল্য শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র হয়ে দাঁড়ান। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন “আমাদের দেশে সকলের চেয়ে দরকার, হাতে ভিক্ষা তুলিয়া দেওয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া।" শিক্ষার অভাবে অনাহারে মৃত্যুই হোক বা অবস্থার গতিকে হীন হয়ে থাকা, কোনো কিছুর জন্যই তিনি ভাগ্যদোষের দোহাই দেবার বিরোধী ছিলেন। তিনি স্পষ্ট বলতেন অনেক স্থলেই এটা নিজের অপরাধ। দুর্দশার হাত হইতে উদ্ধারের কোনো পথই নাই, এমন কথা মনে করাই মানুষের ধর্ম নয়। মানুষের ধর্ম জয় করিবার ধর্ম, হার মানিবার ধর্ম নয়। মানুষ যেখানে আপনার সেই ধর্ম ভুলিয়াছে সেইখানেই সে আপনার দুর্দশাকে চিরদিনের সামগ্রী করিয়া রাখিয়াছে। মানুষ দুঃখ পায় দুঃখকে মানিয়া লইবার জন্য নয়, কিন্তু নূতন শক্তিতে নূতন নূতন রাস্তা বাহির করিবার জন্য। এমনি করিয়াই মানুষের এত উন্নতি হইয়াছে। যদি কোনো দেশে এমন দেখা যায় যে সেখানে দারিদ্র্যের মধ্যে মানুষ অচল হইয়া পড়িয়া দৈবের পথ তাকাইয়া আছে তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, মানুষ সে দেশে মানুষের হিসাবে খাটো হইয়া গেছে”।
রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতেন ~
“আমাদের দুঃখের লক্ষণগুলিকে বাহির হইতে দূর করা যাইবে না, দুঃখের কারণগুলিকে ভিতর হইতে দূর করিতে হইবে। তাহা যদি করিতে চাই তবে দুটি কাজ আছে। এক, দেশের সর্বসাধারণকে শিক্ষা দিয়া পৃথিবীর সকল মানুষের মনের সঙ্গে তাহাদের মনের যোগ ঘটাইয়া দেওয়া। ... আর জীবিকার ক্ষেত্রে তাহাদিগকে পরস্পর মিলাইয়া পৃথিবীর সকল মানুষের সঙ্গে তাহাদের কাজের যোগ ঘটাইয়া দেওয়া। ... অর্থাৎ শিকড়ের দ্বারা যাহাতে মাটির দিকে তাহারা প্রশস্ত অধিকার পায় এবং ডালপালার দ্বারা বাতাস ও আলোকের দিকে তাহারা পরিপূর্ণরূপে ব্যাপ্ত হইতে পারে, তাহাই করা চাই। তাহার পরে ফলফুল আপনিই ফলিতে থাকিবে, কাহাকেও সেজন্য ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতে হইবে না।”
আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও উত্তর ও পুর্ববঙ্গের পৈতৃক জমিদারীর গ্রামগুলিতে রবীন্দ্রনাথের গ্রাম সংগঠনের কাজ প্রথম আরম্ভ হয়েছিল। তাঁর কথাতেই এর স্বীকৃতি পাই ~ "আমি নগরে পালিত, এসে পড়লুম পল্লীশ্রীর কোলে-- মনের আনন্দে কৌতূহল মিটিয়ে দেখতে লাগলুম। ক্রমে এই পল্লীর দুঃখদৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল"। আর তাঁর মনে জন্ম নিল এই দুঃখদৈন্য দূর করার আকাঙক্ষা। তারপর থেকে তিনি চেষ্টা করতেন - "কী করলে এদের মনের উদ্বোধন হয়, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি নিতে পারে"। কিন্তু একটা ব্যপারে তাঁর মনে কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি মনে করতেন - "আমরা যদি বাইরে থেকে সাহায্য করি তাতে এদের অনিষ্টই হবে।" আর তাই কী করলে এদের মধ্যে জীবনসঞ্চার হবে, এই প্রশ্নই তখন তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করাছিলেন "এদের উপকার করা শক্ত, কারণ এরা নিজেকে বড়ো অশ্রদ্ধা করে"।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ হৃষ্টচিত্তে স্মরণ করেছেন যে 'পল্লীজীবনের আবেষ্টনীর মধ্য দিয়ে'' তাঁর জীবনের 'জীবনের আনন্দ উৎসাহ সাহিত্য' গড়ে ওঠার কথা। ''নগরের বাইরে পল্লীগ্রামের সুখদুঃখের ভিতর দিয়ে' কাটানো দিনেই তিনি 'আমাদের দেশের সত্যিকার রূপ কোথায় তা অনুভব করতে' পেরেছেন। আর উপলব্ধি করেছেন যে গ্রামের লোকরা 'কতবড়ো অভাগা'। 'তখন পল্লীগ্রামের মানুষের জীবনের যে পরিচয়' তিনি পেয়েছিলেন তাতে অনুভব করেছিলেন যে, 'আমাদের জীবনের ভিত্তি রয়েছে পল্লীতে'। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন "আমাদের দেশের মা, দেশের ধাত্রী, পল্লীজননীর স্তন্যরস শুকিয়ে গিয়েছে। গ্রামের লোকদের খাদ্য নেই, স্বাস্থ্য নেই, তারা শুধু একান্ত অসহায়ভাবে করুণ নয়নে চেয়ে থাকে।" 'তাদের সেই বেদনা, সেই অসহায় ভাব' রবীন্দ্রনাথের 'অন্তরকে একান্তভাবে স্পর্শ করেছিল'।
মনে হয় সেই সময়েই তাঁর মনে হয় সমাজের রাষ্ট্র নির্ভরতা কমানোর কথা। তিনি লিখেছেন "তখন কেবলই মনে হত জনকতক ইংরাজি-জানা লোক ভারতবর্ষের উপর— যেখানে এত দুঃখ, এত দৈন্য, এত হাহাকার ও শিক্ষার অভাব সেখানে কেমন করে রাষ্ট্রীয় সৌধ নির্মাণ করবে। পল্লীজীবনকে উপেক্ষা করে এ কী করে সম্ভব হয় তা ভেবেই উঠতে পারি নি।...আমার জীবনের মধ্যে পল্লীগ্রামের দুঃখ-দুর্দশার যে চিত্রটি গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল, আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছিল, বিচলিত করেছিল, আমার সেই হৃদয়ের কাজ সেখান হতেই শুরু করবার একটা উপলক্ষ পেয়েছিলাম"।
তাঁর চিত্রা, চৈতালি এবং বিসর্জন ওই সময়কার রচনা। কিন্তু গরীব প্রজার শ্রমের অন্নে ভাগ বসিয়ে অলস জীবন যাপনে তাঁর ধিক্কার এসেছিল, তাদের আর্থিক ও সামাজিক দূর্গতি মোচনের জন্য কী করা যায় এই ছিল তাঁর দুশ্চিন্তা। তাঁর ঐ সময়কার লেখাতে আমরা পাই ~
এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা — এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা —
-------
বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা — সম্মুখেতে কষ্টের সংসার
বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু,
সাহসবিস্তৃত বক্ষপট। এ দৈন্যমাঝারে, কবি,
একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি”।
জমিদার রবীন্দ্রনাথের পল্লী-উন্নয়ন প্রয়াস
গ্রামসংগঠনের আর্থিক সঙ্গতি রবীন্দ্রনাথের ছিল না। ওরই মধ্যে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পূর্বে তিনি আশ্রম বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে, তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এবং বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে, আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন আধুনিক উন্নত প্রথায় 'কৃষিবিদ্যা আর গোষ্ঠবিদ্যা শিখে আসতে'। উদ্দেশ্য 'পল্লীর কাজ করতে হবে'। গ্রামসংগঠনের কাজ কোথা থেকে আরম্ভ হবে তা একরকম ঠিক ছিল কেবল অভাব ছিল কর্মীর এবং প্রাথমিক খরচ চালাবার টাকার।
পল্লী উন্নয়নে তাঁর প্রথম উদ্যোগ ছিল একক; 1899 সালে তিনি শিলাইদহে উন্নত কৃষিকাজ প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জমিদারের কুঠিবাড়ির আশপাশে কৃষিজমিতে তিনি নতুন ধরনের ধান, আমেরিকান ভুট্টা, নৈনিতালের আলু, পাটনার মটর, ভিন্ন ধরনের আখ এবং কপির চাষ করেছিলেন। এ বিষয়ে নিজেই নিজের ব্যররথতাকে পরিহাস করে লিখেছেন - "শিলাইদহে কুঠিবাড়ির চার দিকে যে জমি ছিল প্রজাদের মধ্যে নতুন ফসল প্রচারের উদ্দেশ্যে সেখানে নানা পরীক্ষায় লেগেছিলেম। এই পরীক্ষাব্যাপারে সরকারি কৃষিবিভাগের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা অত্যধিক পরিমাণেই মিলেছিল। তাঁদের আদিষ্ট উপাদানের তালিকা দেখে চিচেস্টরে যারা এগ্রিকালচারাল্ কলেজে পাস করে নি এমন-সব চাষিরা হেসেছিল; তাদেরই হাসিটা টিঁকেছিল শেষ পর্যন্ত।" তার এই 'বহুব্যয়সাধ্য ব্যর্থতার প্রহসন' নিয়ে বন্ধু জগদীশচন্দ্র উপহাস করতেন। কিন্তু তাঁর নিজের মনে হয়েছিল 'শিক্ষার অঙ্গরূপে এই ব্যর্থতাও ব্যর্থ নয়'।
আজ বাংলাদেশে মহম্মদ ইউনুসের হাত ধরে যে মাইক্রোফাইনান্সিং বিশ্বের দরবারে সমাদর লাভ করেছে তার বীজ কিন্তু রবীন্দ্রনাথই বপন করেছিলেন। পাতিসরে তিনি স্থাপন করেছিলেন কৃষিব্যাঙ্ক। উদ্দেশ্য ছিল চাষিরা যাতে সহজে ঋণ পায়।
আমেরিকা থেকে ফিরে এসে রথীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠিতে একটি কৃষি গবেষণাগার খুলেছিলেন, ভালো বীজ ও সার দিয়ে চাষীদের কিছু আয়বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছিলেন। কুঠিবাড়ি সংলগ্ন প্রায় আশি বিঘা জমিতে তিনি কৃষি খামারও গড়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়নের দ্বিতীয় পর্বে উল্লেখযোগ্য অভিমুখ পরিবর্তন ঘটে। এই পর্বে তাঁর মূলমন্ত্র ছিল "দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজনসাধনক্ষম করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। কতকগুলি পল্লী লইয়া এক-একটি মণ্ডলী স্থাপিত হইবে। সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের এবং অভাবমোচনের ব্যবস্থা করিয়া মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করিয়া তুলিতে পারে তবেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা দেশের সর্বত্র সত্য হইয়া উঠিবে। নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাঙ্ক্ স্থাপনের জন্য ইহাদিগকে শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করিতে হইবে। প্রত্যেক মণ্ডলীর একটি করিয়া সাধারণ মণ্ডপ থাকিবে, সেখানে কর্মে ও আমোদে সকলে একত্র হইবার স্থান পাইবে এবং সেইখানে ভারপ্রাপ্ত প্রধানেরা মিলিয়া সালিশের দ্বারা গ্রামের বিবাদ ও মামলা মিটাইয়া দিবে।"
তাঁর উদ্যোগ এবার সমাজের লোকেদের সামিল করে। আর এই উদ্যোগে তাঁর পাশে সহযোগী হিসেবে এলেন শচীন্দ্রনাথ অধিকারী, কালীমোহন ঘোষ এবং আরো কয়েকজন। এই পর্বে তাঁর লক্ষ্য ছিল গ্রামকে স্বনির্ভর করে তোলা এবং সমাজ জীবনে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এই পর্বেই আমরা দেখি যান্ত্রিক চাষের প্রয়াস; পাতিসরে 'কলের লাঙল' দিয়ে শক্ত এঁটেল মাটি চষার ব্যবস্থা করা হয়।সামাজিক সংহতি বিধানের লক্ষ্যে গ্রামগুলিতে মণ্ডলীতে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি মণ্ডলীতে একজন অধ্যক্ষ নয়োগ করা হয়। রবীন্দ্রনাথের জমিদারী অন্তর্ভুক্ত বিরাহিমপুর পরগনাকে পাঁচটি এবং কালিগ্রাম পরগনাকে তিনিটি মণ্ডলীতে ভাগ করা হয়। এই পর্বে যে সমস্ত কাজ হাতে নেওয়া হয় সেগুলিকে মোটামুটি এভাবে ভাগ করা যেতে পারে - 1) চাষীদের জন্য স্বল্পসুদে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা; 2) কৃষিকে আধুনিক অবস্থায় উন্নীত করা; 3) সর্বজনীন সুযোগ সুবিধা, যেমন রাস্তা, কুয়ো, ইত্যাদির বিস্তার এবং রক্ষণাবেক্ষণ; 4) প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; 5) স্বাস্থ্যবিধি ও সুলভ চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন; এবং 6) সালিশি বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন।
শান্তিনিকেতন – শ্রীনিকেতন - বিশ্বভারতী
তাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিতে ধরা পরেছিল, বহুযুগের অনভ্যাসে দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে ভুলে গেছে বলেই তাদের এই দুর্গতি। দেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত, তাই প্রথমেই চাই সুশিক্ষার ব্যবস্থা; শুধু অক্ষরজ্ঞান নয়, যে শিক্ষায় মন মুক্তি পায় সেই শিক্ষা দিতে হবে তাদের। কিন্তু তার জন্য চাই অন্যত্র আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা, যেখানে গুরু শিষ্য নিভৃতে তপস্যা করবেন সমবেত ভাবে। তাঁর গ্রাম সংগঠনের কাজে শহরের সভায় বক্তৃতা দিয়ে প্রবন্ধ লিখে দেশের যুবকদের গ্রামসেবার জন্য আবেদন জানিয়ে যখন ফল হল না, তখন নিজেই অতীতের তপোবনের আদর্শে ভারতের পুনরুজ্জীবনের জন্য মানুষ গড়ার কাজে নামলেন। এ সম্বন্ধে তাঁর মনে হয়েছিল "ছেলেদের মানুষ করে তোলবার জন্যে যে-একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে, যার নাম ইস্কুল, সেটার ভিতর দিয়ে মানবশিশুর শিক্ষার সম্পূর্ণতা হতেই পারে না। এই শিক্ষার জন্যে আশ্রমের দরকার, যেখানে আছে সমগ্রজীবনের সজীব ভূমিকা”।
শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত হল ব্রহহ্মচর্যাশ্রম (১৯০১ খ্রীঃ)। রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কয়েকজন আদর্শ অধ্যাপকও এলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে তখন পর্যন্ত কাজে না লাগলেও জমিদারীর অভিজ্ঞতার মত এই আশ্রম বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতাও রবীন্দ্রনাথের গ্রামসংগঠনের কাজে লেগেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত হল বিশ্বভারতী (১৯১৮ খ্রীঃ)। বিশ্বভারতীর মুখ্য উদ্দেশ্যগুলির একটি ছিল শিক্ষাকে দৈনন্দিন সমাজের সাথে যুক্ত করা।
"ভারতবর্ষে যদি সত্য বিদ্যালয় স্থাপিত হয় তবে গোড়া হইতেই সে বিদ্যালয় তাহার অর্থশাস্ত্র, তাহার কৃষিতত্ত্ব, তাহার স্বাস্থ্যবিদ্যা, তাহার সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে আপন প্রতিষ্ঠাস্থানের চতুর্দিকবর্তী পল্লীর মধ্যে প্রয়োগ করিয়া দেশের জীবনযাত্রার কেন্দ্রস্থান অধিকার করিবে। এই বিদ্যালয় উৎকৃষ্ট আদর্শে চাষ করিবে, গো-পালন করিবে, কাপড় বুনিবে এবং নিজের আর্থিক সম্বল-লাভের জন্য সমবায়প্রণালী অবলম্বন করিয়া ছাত্র শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত হইবে”।
১৯২১ খ্রীঃ রবীন্দ্রনাথ যখন আমেরিকায় বক্তৃতা দিতে যান তখন তাঁর সঙ্গে গ্রামোন্নয়নে উৎসাহী ইংরেজ যুবক লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট-এর পরিচয় হয়। ডরোথি স্ট্রেট নামে এক আমেরিকান মহিলা এল’মহার্স্টকে গ্রামোন্নয়নের কাজ শুরু করার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে তিনি সুরুল-এ এসে গ্রামোন্নয়নের কাজ শুরু করেন।রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “এই কাজে আমার বন্ধু এল্ম্হার্স্ট্ আমাকে খুব সাহায্য করেছেন। তিনিই এই জায়গাকে একটি স্বতন্ত্র কর্মক্ষেত্র করে তুললেন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে একে জড়িয়ে দিলে ঠিক হত না। এল্ম্হার্স্টের হাতে এর কাজ অনেকটা এগিয়ে গেল”। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন "গ্রামের কাজের দুটো দিক আছে। কাজ এখান থেকে করতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাও করতে হবে। এদের সেবা করতে হলে শিক্ষালাভ করা চাই"। ... "সমগ্র দেশ নিয়ে চিন্তা করবার দরকার নেই। আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না। আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি ছোটো গ্রাম। এদের মনকে পেতে হবে, এদের সঙ্গে একত্র কাজ করবার শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। সেটা সহজ নয়, খুব কঠিন কৃচ্ছ্রসাধন। আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোটো আদর্শ তৈরি হবে।" "তোমরা কেবল কখানা গ্রামকে এইভাবে তৈরি করে দাও। আমি বলব এই কখানা গ্রামই আমার ভারতবর্ষ। তা হলেই প্রকৃতভাবে ভারতকে পাওয়া যাবে।"
বিশ্বভারতী সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সময় যার নাম ছিল ‘সুরুল কৃষি সমিতি’ ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শ্রীনিকেতন গ্রামোন্নয়ন সমিতি’। শ্রীনিকেতন নামটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যে আকাঙ্খা ব্যক্ত হয়েছিল তা শুধু কৃষির উন্নতির মত কোন সীমিত অর্থে নয়, পল্লীজীবনের সর্বাঙ্গীন উন্নতি করে গ্রামে গ্রামে লক্ষ্মীশ্রী ফিরিয়ে আনবার শুভপ্রয়াস।
গ্রামোন্নয়ন চিন্তা
গ্রামোন্নয়ন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার প্রথম সম্পূর্ণ প্রকাশ তাঁর ‘স্বদেশি সমাজ’ প্রবন্ধে। প্রবন্ধটি দীর্ঘ এবং তাতে নানা বিষয়ের অবতারনা করা হয়েছিল। এই প্রবন্ধটি তিনি পাঠ করেছিলে ১৯০৪-এ। প্রবন্ধটি রচনার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল প্রদেশব্যপী অনাবৃষ্টি ও জলকষ্ট, কিন্তু এর বিষয়বস্তু ছিল ব্যপক এবং একটি স্বয়ংক্রিয় কার্যসূচীর প্রস্তাবও এতে ছিল। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন জলকষ্ট ও অন্যান্য সমস্যার নিরাকরণে স্বেচ্ছাসেবামূলক স্বাবলম্বী প্রচেষ্টা। প্রবন্ধের সূচনাতেই তিনি লিখেছিলেন "আমাদের চিন্তার বিষয় এই যে, পূর্বে আমাদের যে একটি ব্যবস্থা ছিল, যাহাতে সমাজ অত্যন্ত সহজ নিয়মে আপনার সমস্ত অভাব আপনিই মিটাইয়া লইত—দেশে তাহার কি লেশমাত্র অবশিষ্ট থাকিবে না”? রবীন্দ্রনাথ বরাবরই চেয়েছের সমাজের রাষ্ট্রনির্ভরতা কমাতে। তাঁর উপলব্ধি ছিল যে এতে সমাজের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ে। তিনি লিখেছেন ~
"আমাদের দেশে যুদ্ধবিগ্রহ রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকার্য রাজা করিয়াছেন, কিন্তু বিদ্যাদান হইতে জলদান পর্যন্ত সমস্তই সমাজ এমন সহজভাবে সম্পন্ন করিয়াছে যে, এত নব নব শতাব্দীতে এত নব নব রাজার রাজত্ব আমাদের দেশের উপর দিয়া বন্যার মতো বহিয়া গেল, তবু আমাদের ধর্ম নষ্ট করিয়া আমাদিগকে পশুর মতো করিতে পারে নাই, সমাজ নষ্ট করিয়া আমাদিগকে একেবারে লক্ষ্মীছাড়া করিয়া দেয় নাই। ... সমাজ বাহিরের সাহায্যের অপেক্ষা রাখে নাই এবং বাহিরের উপদ্রবে শ্রীভ্রষ্ট হয় নাই। ... নিশ্বাস লইতে যেমন আমাদের কাহাকেও হাতে-পায়ে ধরিতে হয় না, রক্তচলাচলের জন্য যেমন টৌনহল-মিটিং অনাবশ্যক — সমাজের সমস্ত অত্যাবশ্যক হিতকর ব্যাপার সমাজে তেমনি অত্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে ঘটিয়া আসিয়াছে। আজ আমাদের দেশে জল নাই বলিয়া যে আমরা আক্ষেপ করিতেছি, সেটা সামান্য কথা। সকলের চেয়ে গুরুতর শোকের বিষয় হইয়াছে, তাহার মূল কারণটা। আজ সমাজের মনটা সমাজের মধ্যে নাই। আমাদের সমস্ত মনোযোগ বাহিরের দিকে গিয়াছে।”
রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আমৃত্য এক আশাবাদ কাজ করে গেছে। 'স্বদেশী সমজ'-এ তিনি লিখছেন ~ “আমি স্বদেশকে বিশ্বাস করি, আমি আত্মশক্তিকে সম্মান করি। আমি নিশ্চয় জানি যে, যে উপায়েই হউক, আমরা নিজের মধ্যে একটা স্বদেশীয় স্বজাতীয় ঐক্য উপলব্ধি করিয়া আজ যে সার্থকতালাভের জন্য উৎসুক হইয়াছি, তাহার ভিত্তি যদি পরের পরিবর্তনশীল প্রসন্নতার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়, যদি তাহা বিশেষভাবে ভারতবর্ষের স্বকীয় না হয়, তবে তাহা পুনঃপুনই ব্যর্থ হইতে থাকিবে”।
তিনি চেয়েছিলেন সমাজপতিরা মিলিত হয়ে “কোনো প্রকার নিষ্ফল পলিটিকসের সংস্রব না রাখিয়া বিদ্যালয়, পথঘাট, জলাশয়, গোচরভূমি’ প্রভৃতি সম্বন্ধে কর্মসূচী গ্রহণ করবেন।” অন্যত্র তিনি একথার প্রতিধ্বনি করেছেন ~ “আমার প্রস্তাব এই যে, বাংলাদেশের যেখানে হোক একটি গ্রাম আমরা হাতে নিয়ে তাকে আত্মশাসনের শক্তিতে সম্পূর্ণ উদ্বোধিত করে তুলি। সে গ্রামের রাস্তাঘাট, তার ঘরবাড়ির পারিপাট্য, তার পাঠশালা, তার সাহিত্যচর্চা ও আমোদ-প্রমোদ, তার রোগীপরিচর্যা ও চিকিৎসা, তার বিবাদনিষ্পত্তি প্রভৃতি সমস্ত কার্যভার সুবিহিত নিয়মে গ্রামবাসীদের দ্বারা সাধন করবার উদ্যোগ আমরা করি”।
প্রেক্ষিত ও প্রয়োগ এর সীমাবদ্ধতা
গ্রামীণ কুটির শিল্প সম্বন্ধে মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ প্রায় একই রকম মত প্রকাশ করতেন, কিন্তু বৃহত শিল্প বা আধুনিক যন্ত্রশিল্পের একেবারেই কোনো প্রয়োজন নেই এ-কথা রবীন্দ্রনাথ মানতেন না। যান্ত্রিক সভ্যতা রবীন্দ্রনাথের মনঃপূত ছিল না, কিন্তু তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে যন্ত্রভিত্তিক উৎপাদন ছাড়া কোনো দেশই সমৃদ্ধ হতে পারে না।
"চাকা অসংখ্য শূদ্রকে শূদ্রত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে। এই চাকাই চরকায়, কুমোরের চাকে, গাড়ির তলায়, স্থূল সূক্ষ্ম নানা আকারে মানুষের প্রভূত ভার লাঘব করেছে। এই ভারলাঘবতার মতো ঐশ্বর্যের উপাদান আর নেই, এ কথা মানুষ বহুযুগ পূর্বে প্রথম বুঝতে পারলে যেদিন প্রথম চাকা ঘুরল। ইতিহাসের সেই প্রথম অধ্যায়ে যখন চরকা ঘুরে মানুষের ধন উৎপাদনের কাজে লাগল ধন তখন থেকে চক্রবর্তী হয়ে চলতে লাগল, সেদিনকার চরকাতেই এসে থেমে রইল না। এই তথ্যটির মধ্যে কি কোনো তত্ত্ব নেই। ... বিজ্ঞান মর্তলোকে এই বিষ্ণুচক্রের অধিকার বাড়াচ্ছে এ কথা যদি ভুলি, তা হলে পৃথিবীতে অন্য যে-সব মানুষ চক্রীর সম্মান রেখেছে তাদের চক্রান্তে আমাদের মরতে হব।
"বড়ো কলের দ্বারাও মানুষকে ছোটো করা যায়, ছোটো কলের দ্বারাও করা যায়। এঞ্জিনের দ্বারাও করা যায়, চরকার দ্বারাও। চরকা যেখানে স্বাভাবিক সেখানে সে কোনো উপদ্রব করে না, বরঞ্চ উপকার করে– মানবমনের বৈচিত্র্যবশতই চরকা যেখানে স্বাভাবিক নয় সেখানে চরকায় সুতা কাটার চেয়ে মন কাটা যায় অনেকখানি। মন জিনিসটা সুতার চেয়ে কম মূল্যবান নয়।"
রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব খুব সীমিত ক্ষেত্রের বাইরে কার্যকর হয় নি। পতিসর-এ তাঁর নিজের জমিদারীতে স্বদেশী সমাজ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন এবং পরে শ্রীনিকেতন থেকে বোলপুর অঞ্চলে কিছুটা কাজ হয়। কিন্তু সারা দেশে ব্যপকভাবে শিক্ষিত সমাজের নেতৃত্বে কোনো কর্মধারা গৃহীত হয় নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রস্তাব দিয়েছিলেন 1904-এ আর জমিদারি প্রথার বিলোপ হয় 1955য়। মাঝের পঞ্চাশ বছরে গ্রামের নেতৃত্ব যারা নিতে পারতেন তাঁরা শহরে চলে এসেছিলেন। গ্রাম থেকে উদবৃত্ত অর্থ শহরে এসে ব্যয়িত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনাতে জমিদারদের নেতৃত্বের আশা ছিল কিন্তু জমিদারি প্রথা সম্বন্ধে তখনো তিনি কিছু বলেন নি।
ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ মূলত সারস্বত সাধক, - চিন্তা, চেতনা, নীতি, নৈতিকতা, রুচি, সংস্কৃতির বাগদানই সে সাধনার লক্ষ্য। কিন্তু চিন্তায় মননে রবীন্দ্রনাথ তো মনুষয়ত্বের পরপূর্ণতারও সাধক। তাই কর্মে প্রবৃত্ত না হয়ে তার নিস্তার ছিল না। রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়নের চিন্তার প্রতি পরতে মিশে ছিল দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা। আর সেই দেশের অধিকাংশ মানুষইতো গ্রামবাসী এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কৃষিনির্ভর। তাই পাতিসরে, শিলাইদহে, শ্রীনিকেতনে তাঁর প্রশিক্ষণের অভিমুখ ছিল কৃষি ও গবাদি পশুপালন। গ্রামীন শিল্প যার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শ্রীনিকেতন ছাড়া শান্তিনিকেতন অপরিপূর্ণ অবাস্তব। আর তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন -
'বিজ্ঞান মানুষকে মহাশক্তি দিয়েছে। ... আজ মানুষকে বলতে হবে, "তোমার এ শক্তি অক্ষয় হোক; কর্মের ক্ষেত্রে, ধর্মের ক্ষেত্রে জয়ী হোক।' ... মানুষের শক্তির এই নূতনতম বিকাশকে গ্রামে গ্রামে আনা চাই। এই শক্তিকে সে আবাহন করে আনতে পারে নি বলেই গ্রামে জলাশয়ে আজ জল নেই, ম্যালেরিয়ার প্রকোপে দুঃখশোক পাপতাপ বিনাশমূর্তি ধরছে, কাপুরুষতা পুঞ্জীভূত। চার দিকে যা দেখছি এ তো পরাভবেরই দৃশ্য। ...এ যুগের শক্তিকে যদি গ্রহণ করতে পারি তা হলেই জিতব, তা হলেই বাঁচব।
এইটেই আমাদের শ্রীনিকেতনের বাণী।'
0 comments: