someপ্রতীক - রানা পাল
Posted in someপ্রতীকসঠিক সালটা এই মুহূর্তে মনে নেই। আশির দশকের শেষ, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক। আনন্দবাজার গ্রুপের একটি পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় একটি উপন্যাস প্রকাশিত হলো, নাম ‘বাৎসরিক’। নতুন লেখক। নাম আগে দেখিনি। পড়বো কি পড়বো না ভেবে পড়তে শুরু করি, আর সেই পড়া ছেড়ে উঠি সোজা লেখার শেষে। প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেছিলাম, এবং বলা বাহুল্য, মুগ্ধ হয়েছিলাম। এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, যেন প্রতিটি দৃশ্য চোখের সামনো পরিস্কার দেখা যায়। একটি দৃশ্যের পর আরেকটি দৃশ্য – এরকমভাবেই ভাগ করা ছিলো লেখাটি। উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত হলেও আদপে ওটি ছিলো একটি চিত্রনাট্য। লেখকের নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ। এই চিত্রনাট্যই যে পরবর্তীকালে ১৯শে এপ্রিল নামক চলচ্চিত্রের রূপ নেবে, এবং সেই চলচ্চিত্রের নির্মাণযুদ্ধে যে আমিও একজন সৈনিক হিসেবে শামিল থাকবো, সেদিন সে কথা জানা ছিলো না।
ঋতুর সঙ্গে উমার পরিচয় উনিশশো বিরানব্বইতে। আমার তখন তিনটে ছবি এবং একটি অতি জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে কাজ করা হয়ে গেছে। আমাদের এক প্রোডাকশন সহকারী বন্ধু গৌর গাঙ্গুলী এক সন্ধ্যায় আমায় নিয়ে গেছিলো ঋতুপর্ণর সঙ্গে আলাপ করাতে। ঋতু তখন কাজ করতো একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায়। তখনও চাকরিটা ছাড়েনি। ছেড়েছিলো ১৯শে এপ্রিলের সাফল্যের পর। আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য নানান জিনিসের বিজ্ঞাপনে ঋতুর লেখা কালজয়ী সব ক্যাপশন আজও জ্বলজ্বল করে। তার কিছু যেমন – বোরোলীন চিরদিন। বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। আলু চিপসের ‘ফান মাঞ্চ’ নামটি ঋতুর দেওয়া। এরকম আরও কত! সব তো আমার জানা নেই, কারণ আমি বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। তবে ঋতুর সঙ্গে দুটি উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞাপন ছবিতে ওর সহকারী থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
ঋতুর সঙ্গে প্রথম যখন আমার পরিচয় হয়, তখন ওর প্রথম ছবি হীরের আংটি করা হয়ে গেছে। এই অসাধারণ ছবিটি তৈরি হয়েছিলো চিল্ড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটির প্রযোজনায়, তাই এর বাণিজ্যিক মুক্তি ঘটেনি। দূরদর্শনে এখনও দেখানো হয় প্রায়ই।
আমি চিরকালই একটু মুখচোরা, কম কথা বলা মানুষ। কিন্তু ঋতুর গুণেই প্রথম দিন থেকেই কাছের মানুষ হয়ে গেলাম ওর। শুধু আমি নয়, পরবর্তী সময়ে দেখেছি, শুটিং দলের সকলের সঙ্গেই ওর একান্ত সখ্যতা ছিলো। পরিচালক হিসেবে কোনও আলাদা রাশভারী ইমেজ ওর তৈরী করার দরকার পড়েনি কোনওদিন। সকলেই ওর মেধার কাছে, কাজের কাছে, বশ্যতা স্বীকার করতো, মানতো, সম্মান করতো, ভালোবাসতো।
ঋতু প্রায় সবাইকেই তুই বলে সম্বোধন করতো। তাই নিয়ে নানা মহলে নানা কথা হয়েছে বটে, কিন্তু আমি জানি, সেটা ছিলো ওর মানুষকে আপন করে নেওয়ার প্রথম ধাপ। এই কারণে বয়স্ক অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ওর সঙ্গে কাজ করতে এসে প্রথমটা একটু তটস্থ থাকতেন বটে, কিন্তু অচিরেই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতেন ওর সঙ্গে। সুপ্রিয়া দেবী, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়... এঁদের সবাইকেই ঋতু দিদি এবং তুই বলতো। তাঁরাও ওকে তুই সম্বোধনই করতেন, এবং এর মধ্যে কোথাও কোনও অসম্মান ছিলো না। ছিলো শুধু ঋতুর মানুষকে আপন করে নেওয়ার ইচ্ছা ও ক্ষমতা।
ঋতুর প্রায় সব ছবিতেই যখন চিত্রনাট্য লেখা শুরু হতো, ডাক পড়তো আমার। আমি ওর প্রায় সব ছবির চিত্রনাট্য লেখার সাথী ছিলাম। ওর লেখার পদ্ধতিটা ছিলো অদ্ভুত। ও ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে করতে বলে যেত, আর আমি লিখে যেতাম। লিখতে লিখতে আমার কোনও কিছু প্রস্তাব থাকলে ওকে বলতাম, কখনও কখনও পছন্দ হলে সেটা রাখতো। ওর অনেক চিত্রনাট্যতে আমার সামান্য ছোঁয়া থেকে গেছে, আমি গর্বিত।
অসুখ ছবির চিত্রনাট্য লেখার সময় বেশ মজা হয়েছিলো। ও তখন একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক। সকালবেলা ওর বাড়ি পৌঁছতাম, সম্ভব হলে তখন কিছুটা লেখা হত। তারপর ওর সাথে গাড়িতে অফিস যেতে যেতে কিছুটা লেখা হত। তারপর ওর অফিসে বসে, ও ওর সম্পাদনার কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমায় বলে যেত, আর আমি লিখে যেতাম। এইভাবে শেষ হয়েছিলো অসুখ-এর চিত্রনাট্য। গল্পটাও ওর মাথায় এসেছিলো অদ্ভুতভাবে। সেই সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে ঋতু একসময় মুম্বই যায় কিছু প্রথম সারির অভিনেতাকে নিজেই ইন্টারভিউ করতে। সেই সময় ওকে কিছুদিন মুম্বইতে থাকতে হয়। ইতিমধ্যে মাসিমা, মানে ঋতুর মা, অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঋতুকে খবর পাঠানো হয়। প্লেনে ফিরতে ফিরতে অসুখের গল্পটা ওর মাথায় আসে এবং প্লেনে বসেই স্ক্রিপ্টটা লিখতে আরম্ভ করে। তখন ইটিভি থেকে পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একটা লাল মোটা ডায়রি বছরের প্রথমে উপহার দেওয়া হতো। ঋতুর কাছে সেটা ছিলো। সেটাতেই ও লিখতে শুরু করেছিলো। ফিরে এসেই আমায় ডাকে এবং আমি যেতেই সেই লাল ডায়রি আমার হাতে তুলে দেয়। আমিও ওর লেখার পর থেকে লিখতে আরম্ভ করি।
তখন ক্যাসেটের যুগ। ঋতুর একটা পুঁচকে রেকর্ডার ছিলো। তার ক্যাসেটগুলোও ছোট। সেই রেকর্ডারেই ও বন্দী করে এনেছিলো মুম্বাইয়ের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জবানী। তার ট্রান্সকৃপশনের ভার পড়লো আমার উপর। সেই তালিকাটি বিশাল না হলেও ছিলো মোক্ষম। শাহরুখ খান, দেব আনন্দ, জ্যাকি শ্রফ। তাঁদের সেই সব ইন্টারভিউয়ের সব কথা ছাপা হয়নি, ছাপা যায় না। সেই সময় ওঁদের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সুখ-দুঃখ-অভিমানের কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল এসেছে। অবাক হয়ে ভেবেছি, কি সাবলীল অন্তরঙ্গতায় ঋতু ওঁদের মনের গভীর থেকে সে সব কথা তুলে এনেছে!
আমি তো বাঙাল। আমার পূর্বপুরুষরা বরিশালের ঝালোকাঠির বাসিন্দা ছিলেন। তো পাঁচ, সিঁড়ি, এসব কথায় আমার চন্দ্রবিন্দু লাগতো না। ঋতু আমায় ক্ষেপিয়ে ক্ষেপিয়ে, সেই উচ্চারণ শুদ্ধ করিয়েছে। এই শেষ দিন পর্যন্তও ওর সামনে ওই শব্দগুলি ব্যবহার করার সময় সতর্ক থাকতাম। আর ও সেটা উপভোগ করে, আমার দিকে তাকিয়ে মুচ্কি মুচ্কি হাসত। চোখে চোখে কথা হতো, হুম্ম্, বুঝেছি।
বয়ে শূণ্য র আর ডয়ে শূণ্য ড়’এ আমার খুব বানান ভুল হতো। দিনের পর দিন আমায় ধরিয়ে দিয়েছে, আমার বানান শুদ্ধ করে দিয়েছে। কত দিন কোনও লেখা লিখতে বসে আটকে গেলে, ওকে ফোন করে বা মেসেজ করে জেনে নিয়েছি, অমুক বানানটা কি হবে। এখনও আটকে গেলে অভ্যাসবসত ফোনে হাত চলে যায়। তারপর মনে পড়ে, ওপারের মানুষটাই তো নেই।
এই ওপারের মানুষটার না থাকাটা যে আমার জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলেছে, তা বলে বোঝাতে পারবো না। প্রথম ধাক্কাই হল, আমার প্রতিটি কবিতার প্রথম পাঠক ছিলো ঋতু। ওর প্রুফ দেখা অভ্যেস ছিলো বলে ও ওভাবেই ঠিক করে দিতো আমার বানান, শব্দ বন্ধের বাঁধুনী বা জিজ্ঞেস করতো, এই শব্দটা কেন ব্যবহার করেছিস, এটাই চাস তুই, ইত্যাদি। সে আর কেউ করবে না আমার জন্য। এখন মনে হচ্ছো এই লেখাটাও ওকে একবার দেখিয়ে নিলে ভালো হতো। নিশ্চয়ই ও ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলতো এইভাবে লেখ।
একসময় শুরু হলো ১৯শে এপ্রিল ছবির শুটিং। তার আগে আমার আরও তিনটি ছবিতে কাজ করা হয়ে গেছে। একইরকম প্রতিটি স্তর পেরিয়েছিলাম – শুটিং, এডিটিং, ডাবিং, সাউন্ড মিক্সিং, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ১৯শে এপ্রিল করার সময় আমার নতুন অভিজ্ঞতা হলো। বিশেষত ডাবিং-এর সময়। যতদিন ধরে ছবিটার শুটিং হয়েছিলো, প্রায় ততদিন ধরেই ডাবিং হয়েছিলো, যা সাধারণত হয় না। শুধু ডাবিং যে অভিনয়কে সমৃদ্ধ করে কোন স্তরে নিয়ে যেতে পারে, ঋতুর কাজ না দেখলে সেটা বোঝা কঠিন। ওর ছবি তৈরি ছিলো প্রতিমা বানানোর মতন – কাঠামো বাঁধা, খড় জড়ানো, মাটি লেপা, রং চড়ানো, গর্জন তেল লাগানো, গয়না পরানো... ঠিক যেভাবে সেজে ওঠে প্রতিমা।
ঋতুর এই খুঁতখুঁতুনি, ছবি তৈরীর প্রতিটি স্তরে এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত একেকটা সীন তার মনমতো হচ্ছে, চেষ্টা করে যাওয়া – এ সকলের মধ্যে থাকে না। অনেকেই দেখি আপোষ করে, মেনে নিয়ে অবস্থাটার সাময়িক সামাল দেন। এও বুঝি যে অধিকাংশ সময়েই তাঁরা অসহায়, নিরুপায়। কিন্তু ঋতুকে কোনও অবস্থাতেই আপোষ করতে দেখিনি। যদি সময়ের নিদারুণ তাড়ণায় কখনও কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে, সেই পরিবর্তনের জন্য নতুন প্রেক্ষিত তৈরি করে তাকেও শৈল্পিক উৎকর্ষে পৌঁছে দিয়েছে ঋতু।
সব চরিত্র কাল্পনিক ছবির শুটিং চলছিলো। সেদিন ফ্লোরে উপস্থিত বিপাশা বসু। হঠাৎ দেখি ঋতু স্টুডিও থেকে গটগট করে বেরিয়ে এসে ওর গাড়িতে উঠে পড়লো এবং হুশ করে চলে গেলো। কি ব্যাপার খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, আর্টের ছেলেদের বলা ছিলো একটি বিশেষ ধরণের স্কুলব্যাগের কথা। হলুদ ক্যানভাসের পুরনো দিনের স্কুলব্যাগ। সেটা পায়নি বলে শুটিং বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি চলে গেলো! বিপাশা মুম্বই থেকে এসে পাঁচতারা হোটেলে আছে। তার বাড়তি একদিনের ব্যায়ভারও অনেক। আমরা ভেবেছিলাম সে সব বিচার করে ঋতু হয়তো সেদিন ফিরে আসবে শুটিং-এ। অপেক্ষাও করেছিলাম। এলো না। পরদিন সেই ব্যাগ এলে তবে ও সেই শট নেয়। সেই ব্যাগটির কিন্তু শটে ব্যবহার ছিলো না। নানান জিনিসের সাথে এক কোণে পড়েছিলো। তবু ও যা দেখাবে, সঠিক দেখাবে। এটাই ছিলো ওর শিক্ষা, ধর্ম, গুণ।
ঋতুর মনের মতন হওয়ার জন্য প্রত্যেকটা স্ক্রিপ্টকে অন্তত তিন থেকে পাঁচটা ধাপ পেরোতে হতো। করমাগত কাটাকুটি আর নতুন করে লেখা। এই পরীক্ষায় সব থেকে বেশি বেগ পেতে হয়েছিলো ‘খেলা’ ছবির স্ক্রিপ্টকে। প্রায় কুড়ি বার কেটে নতুন করে লেখা হয়ছিলো। পুরনো স্ক্রিপ্টগুলোর খুব একটা খোঁজ করতো না ঋতু। কিন্তু আমি রেখে দিতাম গুছিয়ে। তার ফল পেলাম উত্তর বাংলার এক জঙ্গলের মধ্যে।
জঙ্গলের মধ্যে খেলা ছবির শুটিং চলছে। হঠাৎ আমার তলব। গেলাম। ঋতু বললো- শোন, একটা সীন লিখেছিলাম মনে আছে? শঙ্কর বুম্বাকে বকছে, যখন জানতে পারে বাচ্চাটাকে না বলে নিয়ে আসা হয়েছে? বললাম হ্যাঁ, মনে আছে। বললো, সেটা এই স্ক্রিপ্টে বাদ দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে রাখলে ভালো হতো। তোর কাছে আছে সীনটা? দেখছি বলে সহকর্মী শুদ্ধকে নিয়ে গেলাম সেই ট্রাকটার কাছে, যেটাতে আমাদের পরিচালনা বিভাগের ট্রাঙ্কটা রাখা ছিলো। ধরাধরি করে নামিয়ে ট্রাঙ্ক হাটকে খুঁজে বার করলাম সেই সীন। সে সীন শুট হলো এবং ছবিতেও থাকলো।
এই যে এমন একজন গুণী পারফেক্টশনিস্ট-এর সাথে কাজ করার আনন্দ, তা বোধহয় আর পাবো না। তাই আর কাজ করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আমি দিন আনি দিন খাই মানুষ তো, কাজ না করলে খাবো কি? অতএব বাধ্য হয়ে কাজ করে যেতে হচ্ছে।
সব চরিত্র কাল্পনিক ছবির শুটিং চলা কালীন একদিন আমার জন্মদিন ছিলো। আমাকে জানতে না দিয়ে ঋতু সেদিন বিশাল আয়োজন করে আমার জন্মদিন পালন করেছিলো। শুটিং থামিয়ে কেক কাটা থেকে শুরু করে হৈ চৈ, সব। সেটি আমার একটি বিশেষ জন্মদিন বলে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
আটানব্বই সালে হঠাৎই আমার জীবনে আকস্মিক বজ্রপাত হয়। আমার স্ত্রী দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চলে যান। আমার দুটি কন্যা তখন সবে দশ আর সাড়ে চার। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। সেই সময় মনে আছে একটি বিকেলের কথা। ঋতুর বসার ঘরে আমরা দুজন দুটো সোফায় বসে আছি, আর ও আমায় বুঝিয়ে যাচ্ছে, কি ভাবে একাকিত্বকে জয় করতে হয়, কি ভাবে ও তা করেছে। সেদিন ঘন্টার পর ঘন্টা ও আমায় অনেক কথা বলেছিলো। আমি নির্বাক হয়ে হয়তো শুনিনি, হয়তো আমিও কিছু বলেছিলাম, মনে নেই। কিন্তু মনে আছে সেই সময়টার কথা। তখন আমায় এমন করে সাহস জুগিয়ে, আবার নতুন করে বাঁচার, এগিয়ে যাবার পথ ঋতুই দেখিয়েছিলো। কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে, আমরা টের পাইনি। সে দিনটার কথা আমি আমার মনকে ভুলতে দিইনি। যখনই মন দুর্বল হয়েছে, ঋতুর সেদিনের বলা কথাগুলি মনে মনে আউড়েছি। সেদিন সত্যি আমার কাছে একলা ঋতুর প্রকাশ ঘটেছিলো। বুঝেছিলাম, ওর একাকিত্বের কাছে আমার একাকিত্ব সিকি ভাগও না। নতুন করে বাঁচার উদ্যম পেয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু সেই উদ্যম যে মানুষটা আমায় জুগিয়েছিলো, সে নিজেই শেষ পর্যন্ত একাকিত্বের কাছে হেরে গেলো।
আমার জীবনের এই ঘটনার পর পরই বাড়িওয়ালি ছবির শুটিং হয়। কিছুটা শুটিং হয়েছিলো তারকেশ্বরের দশঘরা জমিদারদের বাড়িতে। সেই বাড়িতেই ঋতু ওর প্রথম ছবি হীরের আংটি-র অনেকখানি শুট করেছিলো। আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে সব জায়গা দেখিয়ে তখনকার গল্প বলতো অনেক। তো, সেই সময় দিন সাতেক আমাদের তারকেশ্বরে থাকতে হয়েছিলো। বাইরে শুটিং করতে গেলে যা হয়... সারাদিন শুটিং সেরে হোটেলে ফিরে সবাই ফ্রেশ হয়ে জমাটি আড্ডা হয়, গান হয়। ওই ছবিতে ঋতুর সহযোগী ছিলো মন্টুদা, মানে আমাদের বন্ধু অভিনেতা সুমন্ত মুখোপাধ্যায়। মন্টুদার দারুণ গানের গলা। সেদিন মন্টুদা গান ধরলো, ও জীবন ছাড়িয়া যাস্নে মোরে, তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে, আদর করবে কে, জীবন রে...
আমি তখন শোকে পাথর, ব্যোম মেরে আছি। এই গান শোনা মাত্র ব্যস, আমি হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললাম। ঋতু দৌড়ে এসে আমায় জাপটে ধরলো। আমি ওর বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতেই থাকলাম, কাঁদতেই থাকলাম। কানে এলো, ওকে কাঁদতে দাও, বারণ কোরোনা।
আমি আজীবন ওর সহকারীই থেকেছি। সে আমার গর্বের। কিন্তু কোনওদিনই আমাদের সম্পর্কটা পরিচালক আর সহকারীর ছিলো না। আমার বন্ধু, আমার জীবনযাপনের কাণ্ডারী, আমার পথপ্রদর্শক... সব ছিলো ঋতু। ইংরিজিতে যাকে বলে ফ্রেন্ড, ফিলোজ়ফার অ্যান্ড গাইড। এমন বন্ধুকে হারানো জীবনের এক অপূরণীয় ক্ষতি। ঋতুর প্রথম ছবিতে কাজ করার সুযোগ আমার হয়নি। কিন্তু ওর শেষ ছবি অবধি সঙ্গে থাকতে পেরেছি, এটাই আমার বিরাট প্রাপ্তি।
ওর শেষ পরিচালিত ছবি, সত্যান্বেষী। সে ছবির শেষ দিনের শুটিং ছিলো কলকাতা থেকে অনেক দূরে, ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়িতে। সেদিন ওর শরীরটা ভালো ছিলো না। মেক আপ ভ্যানে শুয়েছিলো। শট প্রস্তুত করে ওকে ডাকা হলো। ওর মুখটা দেখে আমি চমকে উঠলাম! এত অস্বাভাবিক লাগছিলো! সহকর্মী বন্ধুদের বললামও সে কথা। শট শেষ হওয়ার পর আমি প্রত্যেকবার যেটা করি, সেবারও করলাম। ওর সামনে গিয়ে বরিশালী ভাষায় বললাম – আরেকখান ছবি শ্যাষ হইয়া গ্যালো। ও মুচ্কি হাসলো। মনে হলো, ভিতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ধীর পায়ে হেঁটে গাড়ির দিকে চলে গেলো। ওই চলে যাওয়াটা আমার স্মৃতিতে পেরেকের মতন গেঁথে আছে, কারণ সেই আমার জীবিত ঋতুপর্ণকে শেষ দেখা।
তুমি ভাগ্যবান, ওঁর সকল সৃজনশীল কাজে সঙ্গী ছিলে। বেশ ভালো লাগলো তোমার এই স্মৃতিচারণ।
ReplyDeletedarun mon chuye jaoa lekha. tui sotti bhagoyaban erokm ekjoner sannidho peyechis.
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteসমৃদ্ধ হলাম পড়ে। রানা'দা তুমি খুব ভাগ্যবান তাই এমন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছিলে।
ReplyDeleteঅনবদ্য লেখা। এমন লোকের সাথে যুক্ত হওয়া সত্যিই কপাল গুনে হয়।ভালো লাগলো --- অনেক অজানা কথা জানলাম। লিঙ্কটা পাঠানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ReplyDeleteদাদা, তোর লেখা পড়তে পড়তে পুরোনো সময়গুলো জীবন্ত হয়ে উঠল আবার। জীবনে বিশেষ বিশেষ সান্নিধ্য চলার পথে যে কতখানি শক্তি যোগান দেয়— এরকম লেখা পড়লে উপলব্ধি করা যায়। আরো কিছু লিখিস ঋতুকে নিয়ে— মানুষটা সত্যিই যেমন ছিল একাই এক কোটি, আবার তেমনই কোটি মানুষের মধ্যেও একা।
ReplyDeleteখুব সুন্দর লিখেছেন রানাদা।
ReplyDelete"বাৎসরিক" প্রকাশিত হয়েছিল ১৪০০ বঙ্গাব্দের শারদীয়া পত্রিকাতে। মানে ১৯৯৩ সালে।
Khub mon chhuye jaoya lekha.chokhe jol bhore elo.
ReplyDeleteরোদ্দুর, পুরো লেখাটা পড়লাম। তোমার কলম কথা বলেছে প্রতিটি বাক্যে। আমি যেন সঙ্গেই ছিলাম, তোমার জীবনের গল্পের এক অনিবার্য সঙ্গী হ য়ে উঠেছিলাম। এর পুরো কৃতিত্ব তোমার। বলার দারুণ এক ক্ষমতায় আমি বিস্মিত হয়েছি। তোমার আরো গদ্য পড়তে চাই।
ReplyDeleteফার্স্ট পারসন পড়তে পড়তে উপলব্ধি হচ্ছিল কী বিশাল ব্যাপ্তি ছিল ওনার চিন্তার, কত গভীর ছিল বোধ। আপনার এই লেখাটা পড়ে ঋতুর আরেকটি দিক ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
ReplyDeleteতোমার লেখায় প্রতিবারই এই মানুষটি কে আরো নতুন করে জানতে পারি। আরও অনেক কিছু জানার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteরাণাদা। এরকম অভিজ্ঞতা এরকম সঙ্গ ভাগ্যবানেরাই পায়! তোমার জীবনের বিপর্যয় এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার লড়াইও রয়ে
ReplyDelete