4

গল্প - অনির্বাণ জানা

Posted in


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা হ'ল। শুধু বাঘেতে কেন, সবকিছুতে দ্বৈপায়নের তুমুল ভয়। বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, ভূত, প্রেত, পুলিশ, সাংবাদিক, মেয়েমানুষ... কিসে না ভয় নেই! করোনা মহামারীতে তো ভয় দুগুণে ভয়ংকর হয়ে গেছে। দ্বৈপায়ন ডাক্তারি পড়ার সময়ই বুঝতে পেরেছিল "হেথাকে তুরে মানাইছেনা রে"। কাটাছেঁড়া, রোগ নাড়া - মানুষের কষ্ট চোখে দেখা যায়না। ডাক্তারিটা কোনওরকমে পাস করে স্পেশালাইজেশনের জন্য বই নিয়ে বসে গিয়েছিল। এমন একটা সাবজেক্ট বেছে নিয়েছিল যাতে ডাক্তারি করতে হবেনা। সেইমত ফিজিওলজিতে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করে শিক্ষকতায় ঢুকে গিয়েছিল দই। ভয়ে কাদা হয়ে থাকতো বলে কলেজের এক বিশ্ববখাটে ছেলে ওর নিকনেম দিয়েছিল দই। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, দুনিয়া শুদ্ধ সবাই ওকে এখন দই বলে ডাকে। এমনকি যে ডাক্তারি কলেজে ও পড়ায়, সেখানকার সদ্য জয়েন্ট টপকে আসা ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত আড়ালে ওকে দই বলে ডাকে। নবদ্বীপের একটা মিচকে ছেলে বাড়ি থেকে ওর জন্য লাল দই নিয়ে এসেছিল। নবদ্বীপের লাল দই বিখ্যাত। ছেলেটাকে বকতে গিয়েও চুপ করে গিয়েছিল দ্বৈপায়ন। বকলে যদি আরো পেছনে লাগে! ভয় হয় যে বড়ো!

বছরখানেক হলো চাকরিতে ঢুকেছে দ্বৈপায়ন। মূল গল্পে যাওয়ার আগে আরো কিছু কথা জানিয়ে রাখা ভালো। দ্বৈপায়ন বাবা-মার একমাত্র সন্তান। বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন এবং সদ্য রিটায়ার করেছেন। শহরতলিতে ওদের বাড়ি। বাবা কলকাতার পাটুলি অঞ্চলে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন। মা বিয়ে পাগল, মানে দ্বৈপায়নের বিয়ের জন্য ক্ষেপে উঠেছে। ও বিয়ে করবেনা জানিয়ে দেওয়ার পর আরো বিগড়ে গেছে। এখন মেয়েদের স্কুলের ছুটির সময় একপাল গোল্লায় যাওয়া ছেলেপুলেদের ভিড়ে মাও দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুটা মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আর কিছুটা যাতায়াতের সুবিধার জন্য দ্বৈপায়ন কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকে। মাকেও ও বেশ ভয় পায়।

লকডাউনের সময় থেকে দই ফ্ল্যাট বন্দী। দু'বেলা বাবা-মার সাথে ভিডিও কলে কথা বলে। বাকি সময়টা মোবাইল ঘেঁটে, টিভি দেখে আর গল্পের বই পড়ে কাটায়। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, মুখে মাস্ক পরা আর মুহুর্মুহু হাত ধোয়া নিষ্ঠার সাথে মেনে চলে। কলেজ থেকে হেড ডিপ দু'চারবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন, কায়দা করে এড়িয়ে গেছে। রান্নার মাসি আর কাজের মাসিকে সবেতন ছুটিতে বসিয়ে দিয়েছে। নিজে অধিকাংশ দিন ডিম ভাত করে নেয়। বেশ একটা ব্রিগেড চলো, ব্রিগেড চলো উত্তেজনা লাগে। সপ্তাহে একটা দিন বাজারে বেরোয়। রাস্তাঘাটে কুকুরের ভয়ে পিপিই কিট পরেনা। খেয়াল করে দেখেছে, একটু অন্যরকম পোশাকপরিচ্ছদ পরা দেখলে কুকুররা ঠিক সহ্য করতে পারেনা। যতটা সম্ভব ঢাকাঢুকি দিয়ে, হাতে গ্লাভস পরে বাজার করে ঘরে ঢুকে পড়ে দই। বেরোবার সময় একটা ওয়েস্ট বক্স দরজার সামনে রেখে বেরোয়। ফিরে এসে দরজা লাগিয়েই আগে ওয়েস্ট বক্সে জামাকাপড়গুলো ছেড়ে রাখে। মোট কথা, করোনা ভাইরাস কোনোভাবেই দ্বৈপায়নকে ছুঁতে পারবেনা।

আবাসনের বাকিদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ নেই ওর। ছ’টা ফ্যামিলি থাকার কথা। ওপরের দুটো ফ্ল্যাটে এনআরআইদের বাস। তারা বছরে একবার করে দেশে আসে। এখন ফাঁকা পড়ে আছে। ওকে ছাড়া বাকি তিনটে ফ্ল্যাটের একজন বাবার বন্ধু, একই সাথে কাজ করতেন। কলকাতায় ফ্ল্যাট রেখে দিয়েছেন প্রয়োজনে আসবেন বলে। ওঁরা কৃষ্ণনগরের আদি বাড়িতে রয়েছেন। ফার্স্টফ্লোরে স্কুল টিচার স্বামীস্ত্রী লকডাউনের আগে আগে কোথায় যেন চলে গেছেন। থাকার মধ্যে কেয়ারটেকার ভোলাদা আর ১/বির মা আর মেয়ে। তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেনা দ্বৈপায়ন। কেয়ারটেকার ভোলাদা একজন সার্থকনামা মানুষ। বয়স হয়েছে আর ভীষণ ভুলো মন। অবশ্য ভুলোমনের বহিঃপ্রকাশটা দুর্বোধ্য কারণে দই বাথরুমে ঢুকলে হয়। প্রায়ই জলের পাম্প চালাতে ভুলে যায় আর দ্বৈপায়নকে সাবান মেখে বসে থাকতে হয়। সকালের দিকে পাম্প চালাতে ভুললে তো আরো কেলেংকারিতে পড়ে। ইদানিং টয়লেটে টিস্যু পেপার রাখছে দ্বৈপায়ন।

কিন্তু বিপদটা ঘটলো ১/বির মা-মেয়েকে নিয়ে। মিসেস অ্যান্ড মিস এ. বিশ্বাস। এটুকু পরিচয় দ্বৈপায়ন জেনেছে বাইরে ঝোলানো নেমপ্লেট দেখে। এ দিয়ে 'অ'ও হতে পারে 'আ'ও হতে পারে। তবে দ্বৈপায়নের মনে হয় 'অ' দিয়েই নামটা হবে। মা-মেয়ে দুজনকেই বিশ্বাস করা যায়না। সারাক্ষণই টোটো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই করোনার বাজারেও দিব্যি দুজনকে রাস্তাঘাটে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে দ্বৈপায়ন বারান্দায় বেরোয়। সেখান থেকে ওদের দুজনকে প্রায়ই আবাসনে ঢুকতে বা বেরোতে দেখে।

রাত তখন বারোটা হবে। দ্বৈপায়ন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ছিল। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে ভেবেছিল উপন্যাসের নায়ক কোনো একটা মন্দিরে এসে ঘন্টা বাজাচ্ছে। দ্বিতীয়বার বেল বাজতেই গলা শুকিয়ে কাঠ। সাধারণ মানুষের ধারণা ডাক্তারদের বোধহয় ভূতের ভয় থাকেনা। একদম ভুল কথা। দ্বৈপায়নের দৃঢ় ধারণা ভূত ছিলো, আছে এবং থাকবে। কিন্তু এই মুহূর্তে কি ধরনের ভূত বেল বাজাচ্ছে সেটা নিয়ে বেশ দ্বন্দ্বে পড়ে গেল ও। নিশির ডাকে ভূত চেনা মানুষের গলা করে ডাকে। আর বাকি অশরীরী আত্মাদের তো বেল বাজাবার প্রয়োজনই হয়না। মুণ্ডুবিহীন অবস্থায় বা অ্যানাটমি ক্লাসে রাখা শুধু কঙ্কালটা এসে বিছানার সামনে হাজির হলেই তো হয়েছে! দরজা তো তাদের আটকাতে পারে না। আবার বেল বাজতে উঠতেই হলো।

আইহোলে চোখ দিয়ে বুঝতে পারে ফার্স্টফ্লোরের জুনিয়র বিশ্বাস দাঁড়িয়ে আছে। সরাসরি কখনো তাকে দেখেনি দ্বৈপায়ন। ওপরের বারান্দা থেকে কিছুটা বার্ডস আই ভিউতে দেখা আর রাস্তাঘাটে হালকা চোখে পড়ে যাওয়ার মতো করে দেখা। বিপজ্জনক বয়সের মেয়েদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার রিস্ক নেয়না ও। একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলে দ্বৈপায়ন। ভূতপ্রেত আর চোর-ডাকাতের সম্ভাবনাটা মোটামুটি বাদ দেওয়া গেলো। কিন্তু আরেকটা কথা ভেবে আবারও থমকে যায়। যদি ঘরে ঢুকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনে? জেল হাজত, মানসম্মান, পয়সাকড়ি - সব যাবে। একটাই বাঁচোয়া, ঘরেতে একটা সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজা খোলে দই।

মুখের মাস্ক ঠিক করে নিতে নিতে মেয়েটি বলে "আমি অপরাজিতা বিশ্বাস, ফার্স্টফ্লোরে থাকি।" রাত বারোটায় মহিলা প্রতিবেশী নিশ্চয়ই আলাপ করতে আসেনি। দ্বৈপায়ন "খুশি হলাম" আর "ও, আচ্ছা" র মাঝামাঝি একটা "খুও" বলে আওয়াজ করে। অপরাজিতাও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হড়বড় করে বলে ওঠে "আসলে আমার মা খুব অসুস্থ বোধ করছে। আপনি তো ডাক্তার, তাই যদি একটু দেখতে যান।" বোঝা যায় মেয়েটা খুব ঘাবড়ে আছে। কিন্তু দ্বৈপায়নও কম ঘাবড়ে যায়নি। তার ছাত্রজীবনের একটা স্টেথোস্কোপ আছে বটে, কিন্তু সেটাতে আদৌ কিছু শোনা যায় কিনা সেব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ আছে।

"আমি তো প্রাইভেট প্র্যাকটিস করিনা।" কাটিয়ে দেওয়ার শেষ চেষ্টা করে দ্বৈপায়ন।

"আসলে ভোলাদা ডাক্তার খুঁজতে বেরিয়েছিল, কাউকে খুঁজে পায়নি।"

দ্বৈপায়ন ভাবে ও নিজেই ডাক্তারের খোঁজে বেরোবে কিনা। ভোলাদাকে বিশ্বাস নেই, ও হয়তো মুদির দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছে ডাক্তার আছে কিনা। শেষ পর্যন্ত উপায়ন্তর না দেখে দ্বৈপায়ন ঘরে ঢোকে। স্টেথোস্কোপটা ডাঁই করে রাখা জঞ্জালের ভেতর থেকে বেরলো। একটা আরশোলা বেশ বিরক্তির সাথে উড়ে গেলো। আরশোলাটা বোধহয় ওদের সমাজের ডাক্তার।

অপরাজিতাদের ঘরটা বেশ সাজানো-গোছানো। অপরাজিতার মা ডিভানে বসে রয়েছেন। একপাশে ভ্যান গখের একটা পেইন্টিং অন্যদিকে মানানসই একটা বুককেস। ভদ্রমহিলা বেশ হাঁপাচ্ছেন। পালসে হাত রেখেই চমকে ওঠে দ্বৈপায়ন, বেশ জ্বর। সেই বাঘের ভয় আর সন্ধ্যা হয়ের ঘটনাটা ঘটেই গেলো। ঢোক গিলে বলে "সিম্পটম তো করোনার।"

"সেকি কথা!" কাঁদো কাঁদো গলায় অপরাজিতা বলে ওঠে।

আর অপরাজিতার মুখ থেকে মাস্ক খুলে পড়ে। দ্বৈপায়ন, যে দ্বৈপায়ন মেয়েদের মুখের দিকে তাকায় না কে কি ভাববে বলে, সে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। রূপকথার গল্পে রাজকন্যার যে ডেসক্রিপশন দেওয়া থাকে, সেটা অপরাজিতার ক্ষেত্রে কপি-পেস্ট করে বলে দেওয়া যায়। শরতের ভোরের শিউলিফুল দিয়ে, শীতের রাতে লেপের উষ্ণতা দিয়ে, বর্ষাদিনের প্রথম কদমফুল দিয়ে মেয়েটা তৈরি। ঈশ্বর ওকে তৈরি করার সময় হাতের অন্য সমস্ত কাজ সরিয়ে রেখেছিলেন। নিজের হাতে এঁকে দিয়েছিলেন ওর চোখ ঠোঁট নাক। দ্বৈপায়নের বুকের ভেতর এক অজানা শূণ্যতা চিনচিন করে ওঠে।

দ্বৈপায়ন ওর মোবাইল থেকে বাইপাসের ধারের এক বেসরকারি হাসপাতালে ফোন করে। ওখানে ওর বন্ধু আছে। সামনে ভেঙে পড়া অপরাজিতাকে সান্ত্বনা দেয় "ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।"

একে তাকে ফোন করে মাসিমাকে যখন ভর্তি করা যায়, তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। বাড়ির লোকদের এখন হাসপাতালে থাকতে দিচ্ছেনা বলে ফিরে আসে। অপরাজিতা আবার মাস্কে মুখ ঢেকেছে। বেশ বিনয়ের সাথে দ্বৈপায়নকে ধন্যবাদ জানায় সাহায্য করার জন্য। আর জানায় যে প্রয়োজন হলে আবারও বিরক্ত করতে পারে।

দ্বৈপায়ন বুঝতে পারে অপরাজিতা ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। বুদ্ধিমান ছেলে, সঙ্গে সঙ্গে "ঠিক আছে" বলে ঘরে চলে আসে। ইসস, বড্ড হ্যাংলামো হয়ে গেছে।

অস্থির অপেক্ষা কাকে বলে দ্বৈপায়ন বুঝতে পারছিল। তিনদিন কেটে গেছে। ফোন আসলেই বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। তারপর অপরাজিতার ফোন নয় দেখে একটা অকারণ হতাশা চেপে ধরছিল। মাসিমার খবর হাসপাতালের বন্ধুদের কাছ থেকে পাচ্ছিল। এখন ভালো আছে, শ্বাসকষ্ট কমেছে। কিন্তু মারাত্মক খবরটা পেলো তিনদিনের দিন বিকেলের দিকে - মাসিমা করোনা পজিটিভ। হারিয়ে যাওয়া ভয়টা আবার হামাগুড়ি দিয়ে দ্বৈপায়নের ভেতর ঢুকে পড়ে। টেস্ট, আইসোলেশন ইত্যাদি শব্দগুলো ওকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। ডাক্তার বলে সবথেকে খারাপ পরিণতিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে - ও কোভিড হাসপাতালে গলায় নল ঢোকানো অবস্থায় শুয়ে আছে। পাখা চালিয়ে গায়ে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ে। মনে হয় তেড়ে জ্বর আসছে। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে আসে। বুকের ভেতর বাতাস যেন নেই, গুমোট হয়ে আছে ভেতরের আবহাওয়া।

আবার ফোন বাজে। বিরক্ত লাগে। ভেবেছিলো ধরবেনা। যদি বাড়ি থেকে হয় তাহলে বাবা-মা টেনশন করবে। অনিচ্ছার সাথে ফোন ধরে দ্বৈপায়ন। ফোনটা ধরেই লাফিয়ে ওঠে। ও প্রান্তে কান্নাভেজা গলা - অপরাজিতা।

"আরে টেনশনের কি আছে। আবাসনটা কোয়ারান্টাইনে পাঠাবে আর আপনার, আমার আর ভোলাদার করোনা টেস্ট হবে।" কিছুক্ষণ আগের উপসর্গগুলো কোথায় হাওয়া। তবু ওপ্রান্ত থেকে কান্নার আওয়াজ।

"ঠিক আছে আমি যাচ্ছি" - বলে প্রায় লাফিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পুরনো দ্বৈপায়ন ওর কানে কানে যেন বলে ওঠে "একটা মেয়ের কাছে একা যাওয়া কি উচিত হবে?" শেষ পর্যন্ত ভোলাদাকে সাথে নিয়ে অপরাজিতার ফ্ল্যাটে যায়।

সত্যিই খুব ভেঙে পড়েছে অপরাজিতা। "আপনি যদি মাঝেমাঝে আসেন তাহলে একটু সাহস পাই।" কাঁদতে কাঁদতে বলে অপরাজিতা।

দ্বৈপায়ন কথা দেয় দুবেলা দেখা করে যাবে। তারপর কয়েকটি ঘটনা বেশ তাড়াতাড়ি ঘটে যায়। ভোলাদা আর ওদের দুজনের গলা থেকে সোয়াব নিয়ে পরীক্ষায় যায়। ওদের ফ্ল্যাটটাকে কন্টেনমেন্ট জোন করে ঘিরে দেওয়া হয়। মাসিমা সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে কদিন হাসপাতালে রাখবে ঠিক হয়েছে। সকালের দিকে দ্বৈপায়ন ফোন করে নেয় আর বিকেলের দিকে অপরাজিতাদের ফ্ল্যাটে যায়।

ভ্যান গখের সৃষ্টির তলায় অপরাজিতা বসে থাকে। চা খাওয়ায়। এখন অনেক কথা হয়। সাহস করে দ্বৈপায়ন সেই কথাটা জিজ্ঞেস করেই বসে। "নিশ্চয়ই বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হচ্ছেনা বলে কষ্ট হচ্ছে!"

"নাহ্, শুধু মা পুরো সুস্থ হয়ে গেলে আর আমরা নেগেটিভ বেরোলে ভালো লাগতো।"

দ্বৈপায়ন বুঝতে পারে প্রশ্নটা বোঝেনি ও। আর কিকরে জিজ্ঞেস করা যায় ভাবার সময় অপরাজিতা প্রশ্ন করে বসে "বাড়িতে আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই খুব চিন্তায় আছে।"

হাঁ হাঁ করে ওঠে দ্বৈপায়ন - "স্ত্রী মানে? কারোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক পর্যন্ত নেই।"

এবার কথাটা বলার সুযোগ পেয়ে যায় দ্বৈপায়ন - "আপনি কি মানে...ইয়ে… কাউকে পছন্দ করেন?"

আবছা হাসে অপরাজিতা। দ্বৈপায়নকে খান খান করে ভেঙে অপরাজিতা বলে "হ্যাঁ"।

সত্যিই তো এরকম একজনের জন্য দেবদূতরা পর্যন্ত এগিয়ে আসতে পারে। সেই ঘন, জমাট অন্ধকারটা দ্বৈপায়নকে আবার ঘিরে ধরে। হাওয়ায় অক্সিজেন কমে যায়। বুকের ভেতর একদলা মেঘ কান্না হয়ে আটকে থাকে। আকাশজোড়া একাকিত্ব ওর মধ্যে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকতে থাকে। গলার কাছটা ব্যথা করে ওঠে। মনে হচ্ছিল করোনা হয়ে মারা যাওয়াও ভালো।

প্রায় টলমল পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় দ্বৈপায়ন। পেছন থেকে অপরাজিতা বলে ওঠে "কাকে পছন্দ করি জিজ্ঞেস করলেন না তো?"

কথাটার মাঝখানে ভোলাদা প্রায় লাফাতে লাফাতে এসে বলে "আমাদের তিনজনেরই নেগেটিভ এসেছে দাদাবাবু, দিদিমণি।" কাগজটা ওদের দেখিয়ে আবার ছিটকে বেরিয়ে যায়। বোধহয় রেডিও, টিভি, সংবাদপত্রকে জানাতে গেলো।

অপরাজিতাও হাততালি দিয়ে নেচে ওঠে।

একদম বেমানান ভাবে দ্বৈপায়ন বলে "কাকে?"

দইয়ের চোখে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী মহিলার মুখে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে ওঠে।

অপরাজিতা ওর হাতটা ধরতে দ্বৈপায়ন ভাবতে থাকে চুমু খাওয়া কি উচিত হবে? দুজনেই তো নেগেটিভ।

দুজনের ঠোঁট খুব বিপজ্জনক দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে, আশা নিয়ে।

4 comments:

  1. খুব ভাল কিন্তু শেষটা খুব আকস্মিক, আর-ও একটু বাড়ানো যেতো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাকিটুকু পাঠক যেযার নিজের মতো শেষ করবে দাদা। 😃

      Delete
  2. খুব ভাল কিন্তু শেষটা খুব আকস্মিক, আর-ও একটু বাড়ানো যেতো।

    ReplyDelete
  3. খুব ভাল কিন্তু শেষটা খুব আকস্মিক, আর-ও একটু বাড়ানো যেতো।

    ReplyDelete