0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















 

২২ 

ফ্রান্সেস্কো ব্যাকুল আর্তিতে একান্ত প্রার্থনায় ডুবে যেতে লাগলো। যদিও তার প্রার্থনায় একবারও বলেনি যে সে আগাথার থেকে দূরে যেতে চায় কিম্বা আগাথা যেন সরে যায়। আসলে এই প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সে আগাথার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে একেবারেই চায়নি। বরং সে মাতা মেরীর করুণা চাইছিল। সে চাইছিল যে মাতা মেরি যেন তার আত্মার যন্ত্রণা বুঝতে পেরে তাকে ক্ষমা করেন, প্রকারান্তরে মাতা মেরীর সমর্থন চাইছিল সে। হঠাৎ তার মনে হল যদি আগাথা চলে গিয়ে থাকে। এই ভাবনা মাথায় আসামাত্রই উপাসনা বন্ধ করে, ঈশ্বরের আসন থেকে দূরে ছিটকে সরে গেলো সে। দৌড়ে ভেতরে দেখতে গেলো। নিশ্চিন্ত হল দেখে যে আগাথা ভেতরে বসে আছে এবং পেট্রোনিলা তার কাছেই আছে। 

‘সব ঠিক হয়ে যাবে; আমি নালিশ জানিয়ে এসেছি। গির্জায় ঈশ্বরের কাছে এবং পুরোহিতের কাছে সবার দ্বার উন্মুক্ত। যে কেউ আসতে পারে এখানে। আমার উপরে বিশ্বাস রাখো। যা ঘটেছে, আমি নিশ্চিত যে তার আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।’ যথেষ্ট দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করলো সে। ফ্রান্সেস্কোর মনে হচ্ছিল যে সে ঠিক পথেই আছে এবং বিচ্যুত হবার প্রশ্নই ওঠেনা। পেট্রোনিলাকে কাছের আরেকটি গির্জার পুরোহিতের কাছে পাঠাতে হল প্রশাসনিক কাজেই, কারণ যে দেখাশোনা করে, অর্থাৎ গৃহসহায়ক অথবা সহায়িকা, তার বিবৃতি এই ধরণের সমস্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। অতএব তার হাতেই জরুরি কাগজপত্র দিয়ে তাকে পাঠালো ফ্রান্সেস্কো। না, দুর্ভাগ্যবশত, পরে গেলে চলবে না। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে জবানবন্দি নথিবদ্ধ করবার নিয়ম। আজই যাওয়া প্রয়োজন। ‘তোমার সঙ্গে যদি কারো দেখা হয়, তুমি বলবে যে তুমি প্রশাসনিক কাজে যাচ্ছ!’ ফ্রান্সেস্কো পেট্রোনিলাকে বোঝাতে থাকে... ‘বলবে যে আল্পস উপত্যকার আগাথা এখানে গির্জায় আমার সঙ্গেই রয়েছে। তাকে ধর্মবিষয়ক শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ আছে আমার উপরে। কেউ যদি বাধা দিতে আসে, তাহলে ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে আসবে তার উপরে। ওরা গির্জার সামনে দল পাকিয়ে হাঙ্গামা বাধাতেই পারে, সে ওদের ব্যাপার। ওরা আরেকজন খ্রিস্টানকে আক্রমণ করতেই পারে, সে ওদের অভিরুচি। কিন্তু ওদের ছুঁড়ে দেওয়া পাথরগুলোর আঘাত আমি সইবো, আগাথা নয়। কারণ, তাকে আমি ধর্মশিক্ষা দেওয়ার ভার আমি নিয়েছি ঈশ্বরের নির্দেশে। অন্ধকার হয়ে গেলে পাহাড়ি রাস্তায় আমি নিজে তাকে বাড়ির পথে এগিয়ে দেবো।’ 

পেট্রোনিলা চলে যাওয়ার পরে, অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলেনি। গম্ভীর নীরবতা বিরাজ করছিল ঘরে। সাদা দেয়ালের সামনে চেয়ারে বসেছিল আগাথা কোলের উপরে হাতদুটো রেখে; প্রস্তরবৎ বসে থাকলেও তার ভিতরে ভিতরে যে ক্রমাগত ভাঙচুর চলছে, তা তার চোখমুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট ছিল। চোখদুটো ভীষণ কষ্টে কুঁচকে ছিল তার। আঘাত খেয়ে চাপা রাগ, ক্ষোভ যেন সে অতিকষ্টে চেপে রেখেছে। ম্যাডোনার ভাস্কর্যের মত কাটা কাটা মুখের সীমানা ভেসে যাচ্ছিল অসহায় অশ্রুধারায়। ফ্রান্সেস্কো তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বাইরের জানালায় চেয়ে বসে ছিল। সোয়ানা উপত্যকার দৈত্যাকার পর্বতশ্রেণীর প্রাকারের উপর থেকে তার দৃষ্টি নেমে আসছিল নিচের হ্রদের উপকূল অবধি। আঙুরখেতে খেলা করছিল যে বালকেরা, তাদের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল জলপ্রপাতের কলতান। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আগাথা সত্যিই এখানে রয়েছে। সে ভেবে পাচ্ছিলো না, যে, এখনই যদি সে পেছন ফেরে, সে কি আগাথাকে দেখতে পাবে? আগাথা ওখানে বসে রয়েছে। কী হবে, যদি সে এখনই আগাথার দিকে ফিরে তাকায় একটিবার? তার ফিরে দেখাটা কি একটা বিশাল সিদ্ধান্ত, যেটা এখনই নেওয়া প্রয়োজন? সে বুঝতে পারছিল না। প্রথম যেদিন লুসিনো স্কারাবোটা এসেছিল, এই ঘরেই এসেছিল, সেদিন থেকে শুরু করে আজকের এই মুহূর্ত অবধি ঘটনাপ্রবাহ সে পরপর সাজিয়ে নিয়ে চিন্তা করছিল। তার চিন্তার সময়টুকুর মধ্যে স্থাণু হয়ে অনুভব করছিল নিজের অস্তিত্ব। সেই সময়ের মধ্যে তার চোখে ভেসে উঠছিল সেই ‘লাস্ট জাজমেন্‌ট’ এর( শেষ সিদ্ধান্ত) ছবি, যেখানে পরম পিতা, তার সন্তান এবং পবিত্র আত্মার মূর্তি বিধৃত আছে স্বর্গের দৃশ্যপটে। জেনারাসো পর্বতের শিখরের আকাশে যেন সে এই ছবি দেখতে পাচ্ছিল। সে যেন মেঘের আড়াল থেকে শুনতে পাচ্ছিল দেবদূতদের শিঙ্গার আওয়াজ। জেনেরাসোর শিখরে এক পা এবং হ্রদের ওপারে আরেকটা পাহাড়ের চুড়ায় অন্য পা দিয়ে খোলা তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন আর্কেঞ্জেল মাইকেল এবং আল্পসের সোয়ানার পর্বতপ্রাকারের পিছনে লুকিয়ে আছে শিং এবং থাবাওয়ালা ধূর্ত শয়তান। তরুণ যাজক সেই দৃশ্যের সব চরিত্রগুলিকে দেখতে পাচ্ছিল আকাশে। কালো পোশাক পরা, মুখ অবগুণ্ঠনে ঢাকা এক নারীর অবয়বও দেখতে পেলো সে, যে হাত জোড় করে ব্যাকুল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। সে হয়তো মরিয়া হয়ে ছেলের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মাতৃমূর্তি। 

ফ্রান্সেস্কো দুই হাতের পাতায় নিজের চোখমুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিল কতক্ষণ, বোধহয় তা সে নিজেই জানে না। ধীরে ধীরে জানালার দিক থেকে সে মুখ ফেরালো। মুখ ফেরালো সেই নির্যাতিতার দিকে। সেই কন্যার মুখ ধুয়ে যাচ্ছিল তার চোখের জলে, বেগুনি হয়ে যাওয়া ঠোঁট কাঁপছিল ব্যথায়। চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল এক আতঙ্ক। যেন এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে সদ্য ফিরে এসেছে, এমন মানসিক আঘাতে পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল সে। ফ্রান্সেস্কো টলতে টলতে এগিয়ে গিয়েছিল তার দিকে। তার কণ্ঠ থেকে উঠে আসছিল হাল্কা গোঙানির আওয়াজ। কিছুক্ষণ আগে যেভাবে সে মাতা মেরীর মূর্তির সামনে বসেছিল, ঠিক সেভাবেই যেন হাঁটু গেড়ে সে বসে পড়ল আগাথার সামনে। ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে সে বাড়িয়ে দিল হাত। তারপর আগাথার হাতে নিজের দুহাতের মুঠি গুঁজে দিয়ে ভেঙে পড়ল প্রবল আর্তিতে। 

ফ্রান্সেস্কো নিজের প্রবৃত্তির এতখানি বশীভূত কোনোদিনই ছিলনা যে সে আগাথার সামনে এভাবে ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু আগাথার প্রতি গ্রামবাসীদের এই অন্যায় অপরাধ সংগঠিত হওয়ার কারণেই স্বাভাবিক ভাবে তার মনে এক অদম্য সহানুভূতির সঞ্চার হয়েছিল। সমবেদনায় তারও কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল এক বোবা গোঙানি। সে অনুভব করেছিল যে ঈশ্বর আগাথাকে এক অদ্ভুত মোহিনী সৌন্দর্য উপহার দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, অথচ এই কন্যা সম্পূর্ণভাবে রক্ষকহীন। আগাথাকে রক্ষা করবার জন্য এই পৃথিবীতে কেউ নেই। পরিস্থিতির বিপাকে আজ সে তাকে রক্ষা করেছে, নাহলে হয়তো বা গ্রামবাসী উন্মত্ত জনতা তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলতো। সে যেন নিজের অজান্তেই আগাথার সমস্ত সত্তার রক্ষক হয়ে উঠেছে। যদিও সেই মুহূর্তে সবকিছু সে সচেতনভাবে করছিল এমন নয়, তবুও তার মন থেকে ধীরে ধীরে বাধা, লজ্জা এবং ভয় দূর হয়ে গিয়েছিল। আগাথার হাত থেকে হাত সরিয়ে নেবার কথা তার মনে আসেনি তখন। যেন ঈশ্বর একদিকে এবং এই নির্যাতিতা আরেকদিকে দাঁড়িয়েছিল সেই মুহূর্তে। আগাথাকে স্পর্শ করবার পরে তার আবেগের নদী কূল ছাপিয়ে নতুন বেগে ধাবমান হয়েছিল। 

এই মুহূর্ত অবধি তরুণ যাজকের আচার- ব্যবহার কোনো কিছুকেই অসমীচীন কিম্বা পাপাচার এরকম কিছু বলা যাবেনা। প্রতিটি মুহূর্ত যেন অসহায় পরিস্থিতির প্রতিফলন। সে কেন এবং ঠিক কী করবে, কিম্বা কী বলবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলো না। সত্যি বলতে কি, সে নিজে থেকে কিছুই করছিল না। তার সঙ্গে ঘটনাপ্রবাহ বয়ে চলেছিল। এবং আগাথাও প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও, একথা ভুলে গিয়েছিল যে সেই অর্থে ফ্রান্সেস্কোকে সে একেবারেই ভালোভাবে চেনে না। কতটুকু দেখেছে সে তাকে? সে ভুলেও গিয়েছিল যে সে একজন যাজক। অবশ্য যাজক বিষয়েই বা সে কতটুকু জানে? তার মনে হয়েছিল যে ফ্রান্সেস্কোর উপরে বড় ভাইয়ের মতো ভরসা করা যায়। তার কান্না ফোঁপানিতে বদলে গিয়েছিল। তার তখন কিছুই মনে হয়নি, যখন ফ্রান্সেস্কো তাকে আলিঙ্গন করেছিল। সে সান্ত্বনা খুঁজবার জন্য তার কান্নাভেজা মুখ চেপে ধরেছিল তরুণ যাজকের বুকের উপর। 

আগাথা যেন শিশুর মত এবং সে যেন সান্ত্বনারত এক পিতা। ফ্রান্সেস্কো আগাথাকে শান্ত করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এর আগে সে কোনো নারীশরীরের এত ঘনিষ্ঠ স্পর্শ পায়নি। কাজেই তার সহানুভূতি এবং সমবেদনার প্রকাশ সম্পূর্ণ পিতাসুলভ রইল না। তার মনে হতে লাগলো যে এই কন্যার ফোঁপানির আওয়াজে যেন অনেকখানি অনুতাপ, হাহুতাশ মিশে রয়েছে। ফ্রান্সেস্কো যে জানে তার অস্তিত্বের উৎসে রয়েছে এক পাপাচার, একথা কি এই কন্যা জানে? এই কন্যা কি সেই কষ্টের সাগরে সাঁতরে সাঁতরে এসে ফ্রান্সেস্কোকেও তার ভাগ দিতে চায়? তার যন্ত্রণা, কষ্ট, বেদনা, সবকিছুর বোঝা সে বয়ে নিয়ে এসেছে। তার কষ্ট দিয়ে সে যাজককে ছুঁতে চায়, স্পর্শ করতে চায় তার আত্মাকে। ফ্রান্সেস্কো তার ম্যাডোনা আনন তুলে ধরলো নিজের দিকে, স্পর্শ করলো তার স্কন্ধের উপরিভাগ। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ফ্রান্সেস্কোর চোখের দৃষ্টিতে মিশছিল অদ্ভুত উন্মাদনা। সহসা বাজপাখির মত নেমে এলো তার ঠোঁট আগাথার লবণাক্ত অশ্রুসিক্ত ঠোঁটের উপরে এবং কোনোভাবেই বিযুক্ত করা যাবেনা, এমন ভঙ্গিতে মিলে রইলো কিছুক্ষণ। জাগতিক সুখ উপভোগের কিছু মুহূর্তে বধির হয়ে যাওয়া অনন্ত আনন্দের সীমানা অতিক্রম করে ফ্রান্সেস্কো নিজেকে ছিঁড়ে সরিয়ে নিলো আগাথার স্পর্শ থেকে। নিজের দুই পায়ে স্থির দাঁড়ালো সে। তার ঠোঁটে রক্তের স্বাদ। 

‘চলো’ বলে উঠলো সে... ‘একা বাড়ি ফিরতে পারবে না তুমি কাউকে ছাড়া। আমি তোমার সঙ্গে যাবো।’ 

-------------- 

(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 

0 comments: