0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in




















(১)

বৈশাখের রাত। বেশ গরম। শাঁখের ফুঁ তুলসীতলায় অনেক আগেই মিলিয়ে গেছে। প্রদীপের বুক জ্বলার গন্ধও হারিয়ে গেছে বাতাসে। ঝিঁঝিঁর ডাক ছড়িয়ে পড়ছে তরল অন্ধকারে।

দক্ষিণের বাতাস বইছে বটে, তবে তার জোর ততটা নেই। গাছের পাতায় তার কারুকার্য ঠিক বোঝাও যাচ্ছে না। এবাড়ির ওবাড়ির কেরোসিনের ল্যাম্প টিমটিম করে জ্বলছে।

পাল বাড়ির পুরুষরাও অন্যদিনের মতো আজও কেউ আগে, কেউ পরে মাদুর বগলদাবা করে সরকারি খেলার মাঠের দিকে গেছে। তা বেশ কিছুক্ষণ হবে। মাঠটা যদিও বেশি দূরে নয়। প্রায় সব পাড়ার ছেলেরা ও পুরুষরা অধিকাংশই আসে এই মাঠে। দখিনের হাওয়া এই মাঠে খিলখিল করে বয়। গরমে এই খোলা আকাশের নিচে তারা প্রায় সারা রাত ঘুমায়। যদিও গল্প গুজব কম হয় না। এখনও তাদের কথাবার্তার আওয়াজ গৌরীর কানে ভেসে আসছে সেদিক থেকে। পাল বাড়ির বউ গৌরী।

ঘাটে বসে বাসন মাজছে। ঘাটের উপরে বসে আছে তার শাশুড়ি। তার হাতের কাছে ল্যাম্প আলতো হাওয়ায় মাঝে মাঝে বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। কেরোসিনের কালো ধোঁয়া তাঁর নাকে এসে লাগছে ঘন ঘন। ল্যাম্পের সলতে পুড়ে কালো কালো গুলতি পাকিয়ে রয়েছে। তার শাশুড়ি সেই অল্প আলোয় কি একটা শক্ত মতো খুঁজে নিয়ে সেই গুলতি গুলোকে একটা একটা করে খোঁচা দিয়ে দিয়ে ফেলছে। কালো কালো গুলতিগুলো ফেলতে গিয়ে আলোটা গেল নিভে। হঠাৎ করে অন্ধকারটা ঘাটের আশপাশটাকে একেবারে নিবিড় কালো চাদরে ঘিরে দিল। কিন্তু গৌরী বাসন ঘষা বন্ধ দিল না। কোনো রকমে সেগুলো মেজে ঘষে নিতে পারলে হয়। আরো তাড়াতাড়ি করে জোরে জোরে ঘষছে। বাসন ঘষার শব্দ পুকর-ঘাটে কৃষ্ণপক্ষের রাতে মুখর হয়ে উঠল।

ঠিক তখনই ঝপাস করে কি একটা পড়ল পুকুরে। বেশ জোরালো শব্দ। ভাদ্র মাসে যেমন তাল পড়ে, ঠিক তেমনি। জল উঠল কেঁপে। ঢেউ আছড়ে পড়ল ঘাটে।

-মাগোওওওও...!

বলে হুড়মুড়িয়ে গৌরী উঠে পড়ল ঘাট ছেড়ে ডাঙার উপর। থরথর করে কাঁপছে। ল্যাম্প রইল পড়ে।

বাসন ফেলে শাশুড়ি-বৌয়ে দিল দৌড় কুন্তীদের বাড়ির দিকে। তাদের চিৎকার কানে আসতেই কুন্তী ও তার মা হকচকিয়ে গেল। দুজনে সবেমাত্র খেতে বসেছিল। একটু আগেই তো তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে তার বড়ো জেঠি জগাদার বউকে নিয়ে ঘাটে গেছে। হাতে একগোছা বাসন। যাওয়ার সময় কথাও বলে গেল। কুন্তীর হাত ঠেকে রইল পাতে।

-মা, কিসের একটা আওয়াজ হল না? কে যেন ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল মনে হল?

তার মা মুখে গ্রাস তুলতে গিয়ে নামিয়ে নিল পাতেই।

-পুকুর ঘাট থেকেই এল মনে হচ্ছে। কিন্তু এত্ত জোরে আওয়াজটা কিসের বলতো? আর এত জোরে ওরা চেঁচিয়ে উঠল কেন?

-মা, পুকুরে বড় বড় মাছ ছিল না?

-আছে বটে, কিন্তু তত বড় মাছ নেই। যে পাঁচটা ছিল, তোর ঠাকুরদার ছেরাদ্দে তা গ্রামের লোকদের খাওয়ানোতে সে কটাকে জাল দিয়ে ধরা হয়েছিল। তোর ঠাকুরদা তো কোনোদিন কাউকে তার একটাও খেতে দেয়নি। তাই তাঁর কাজে ঐ মাছগুলো ধরে...

-ও সেজো, আমরা গেলুম রে! ও কুন্তী এদিকে আয় না রে!

চেঁচাতে চেঁচাতে কুন্তীর বড়ো জেঠিমা প্রায় তাদের বারান্দার কাছে এসে গেছে। পিছনে তাঁর বড়ো বউ গৌরী কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে

-তেঁ-তেঁ-তুল গাছের নিচটায় কি যেন ঝ-ঝ-ঝপাস করে পড়ল।

কুন্তী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে পড়ল।

-কোন দিকে বললে? তেঁতুল গাছের তলায়?

-হ্যাঁ ঐখানেই তো! হ্যাঁ, হ্যাঁ ওখানেই। আমি ঠিকই শুনেছি। ঐখানেই।

কুন্তীর বাপের বাড়িটা মাটির। আর তার ঐ দিকেই তো আছে ছোটো একটা বারান্দা। পাশেই রয়েছে নিমগাছ। তার হাত পাঁচেক দূরে খুব পুরনো একটা তেঁতুল গাছ। তিনজন পরস্পর হাত জুড়লে তবেই তাকে পাঞ্জা করে ধরতে পারে, এত মোটা। তার কোটরে লক্ষ্মী প্যাঁচার বাস। গাছের একটু দূরেই ঘাট। ঘাটে যাওয়ার আগেই ডানদিকে বেরিয়ে গেছে সরু রাস্তা।

কিন্তু পুকুরের পাড়ে তাল, খেজুর ও কলার ঝাড়।

এই তেঁতুল গাছ থেকে মাঝে মাঝে আধ-খাওয়া ফল, মাছ, নাড়ি-ভুঁড়ি বের হওয়া-আধ-খাওয়া ইঁদুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তাদের উঠোনে। কোনো কোনো রাতে কি যেন সব ডাল কাঁপিয়ে দাপিয়ে বেড়ায়। তাদের পূর্ব পুরুষরা নাকি ঐ গাছেই থাকে। গাছটাকে কাটার কথা উঠলেও ভয় আর ভয়ার্ত-শ্রদ্ধায় কেউ কাটতে সাহস দেখাতে চায় না।

কুন্তীর কী মনে হল, এঁটো হাতে খাওয়া ভাত ফেলে দৌড়ে গেল সেই বারান্দার দিকে। হ্যারিকেনের কাচে কালি পড়ে সেটা প্রায় অন্ধকার হয়ে আছে। ঝাপসা আলোয় দেখে... বারান্দায় পাতা বিছানাটা খালি। দোলনাটার দুলুনি প্রায় থেমে গেছে। সেটাও খালি। কাউকে কোথাও দেখতে না পেয়ে কুন্তীর সারা শরীর দিয়ে দরদরিয়ে ঘাম আসতে শুরু করল। কি যেন আশঙ্কায়-ভয়ে-বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল -মা, পরী কোথায়-য়-য়?

মেয়ের কথা কানে পৌঁছাতে কিসের একটা ভয় তার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। কোনো রকমে পাতে হাত ঝেড়ে কুন্তীর মা বলতে বলতে এল -দোলায় তো ছিল!

খালি দোলা দেখে চমকে ওঠে। চোখের পলক পড়ছে না। বিপদের আশঙ্কা করে বলল -জামাই কোথায়? জামাইও নেই, পরীও নেই! জামাই নিয়ে যায়নি তো?

-তোমার জামাই তো এখানে শুয়েছিল।

গৌরীর বুক ঢিপঢিপঢিপ করে ওঠে। কি বলতে গিয়ে মুখে আঁচলটা চেপে ধরে। তার শাশুড়ি বারান্দার খুঁটি ধরে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে -যখন আওয়াজ হল, তখন কালো মতো কি একটা ঐ দিকে পালিয়ে গেল। কি জানি বাবা কি দেখতে কি দেখেছি। আজকাল চোখে কম দেখি তো। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারিনি।

কুন্তী সেই আবছা অন্ধকারে বিছানার উপর আছড়ে পড়ল যেন। দোলনার দড়ি ধরে পা ছড়িয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল -ওলো, আমার কি হল গো! আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। ঠাকুর আমাকে নিল না কেন?

গৌরী একে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসছে। তার উপর কুন্তীর কান্না দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারল না। তারও চোখ দিয়ে জল পড়ছে টপটপ করে। ধীরে ধীরে বারান্দায় উঠে এল। কুন্তীর পাশে উবু হয়ে বসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল -শুধু শুধু কাঁদছ কেন ঠাকুরঝি? দেখ, ননদাই কোথাও নিয়ে গেল নাকি? ছোটো কাকাদের বাড়ি নিয়ে যায়নি তো?

এসব কথার রেশ ধরে কুন্তী তবুও সুর টেনে টেনে কাঁদছে -এত রাতে আর কোথায় নিয়ে যাবে গো? ওমা আমার সর্বনাশ হল গো!

মণ্ডল পাড়ার গির্জার ঘন্টা ঢং ঢং করে বেজে উঠল। ন'টা বাজে। বিদ্যুৎহীন পাড়াগাঁয়ে রাত ন'টা বাজা মানেই অনেক বাড়ির ল্যাম্প যেন অন্ধকারে হারিয়ে যায়। কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়ে।

গৌরী ভাবে, সত্যিই রাত হয়ে গেছে অনেক। এত রাতেই বা মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাবে কেন? তবু যেন বুকে মিথ্যে বল এনে বলে -কেঁদো না ঠাকুরঝি। কোথাও নিয়ে গেছে বুঝি। দাঁড়াও কাজলকে পাঠিয়ে তোমার দাদাকে ডাকি একবার।

সে কথায় কুন্তী কান দেয় না।

কুন্তী, কুন্তীর মা, গৌরীর শাশুড়ি এবার একসঙ্গে জোরে জোরে কাঁদতে সুরু করে।


(২)

পালেরা সাত ভাই। পাশাপাশি সব বাড়ি। বড়ো উঠোন ঘিরেই ঘরগুলো। সামনে বেশ বড় উঠোন। তারপর পুকুরের এপারে ওপারে পুকুর আর পুকুর। তবে বলতে গেলে কুন্তীর কাকা জ্যাঠাদের বাড়িগুলো পুকুর আর গাছপালায় ভরা। উঠোন থেকে ঢিল ছুঁড়লেই গ্রামের মূল রাস্তা। এই উঠোনের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক জুড়ে বড় লম্বা পুকুর। কুন্তীর বাপের বাড়ির দক্ষিণ দিকটা ঐ পুকুরের গায়ে। উঠোনের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ঐ বুড়ো ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ কবে থেকে রাজত্ব করছে কে জানে! তার একটু দূরেই ঐ ঘাট। দিনে-দুপুরে ঐ পুকুরে স্নান করা, বাসন মাজা সবই হয়। পাড়ের বড়ো বড়ো গাছের ছায়ায় জলের শীতলতা নলকূপের জলকে হার মানায়।

তবে এর গভীর নীল-কালো জলে নাকি জোঁকা বুড়ির বাস। জাল ফেললে মাঝে মাঝে জালের সঙ্গে মাছের কাঁটা উঠে আসে। গোটা গোটা শিরদাঁড়াসহ কাঁচা কাঁটার সঙ্গে মুন্ডুটাও থাকে। বাদ বাকি সুনিপুণ ভাবে খাওয়া। কেউ কেউ বলে ও নাকি ঐ জোঁকা বুড়ির কাজ। তাই কেউ একা একা ঘাটে বা জলে নামতে চায় না। একা একা নামলে যদি পা ধরে টেনে নিয়ে যায়!

কুন্তীদের কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে অন্য বাড়ির বউ-ঝি-শাশুড়িরা যে যেখানে ছিল তারাও এল যে যার মতো। কারো কারো কোলে বাচ্চা, কারো হাতে ল্যাম্প। কেউ জানতে চাইছে কি হল? কেউ কেউ কিছু না শুনেই কুন্তীদের দেখে কান্না শুরু করে দিল। কোলের বাচ্চারা তা দেখে তাদের গলায় গলা মিলিয়ে কাঁদতে শুরু করল। কান্নার রোল ভেসে গেল সারা পাড়ায়।

কান্না শুনে পাশের বাড়ির লোকজন-ছেলে-মেয়ে একে একে আসতে শুরু করল। এখন দল বেঁধে আসছে সব। সময়ও গড়ালো নিজের মতো। যে আসছে সে ঘটনা শুনছে আর ছোটো ছোটো দলে গিয়ে যোগ দিচ্ছে। কোনো দল উঠোনের মাঝখানে, কোনো দল ঘাটের কাছে, কোনো দল কুন্তীর কাছে, কোনো দল তার কাকা-জ্যাঠার বারান্দায়, কোনো দল তেঁতুল গাছের তলায়, কোনোটা বা গাদা ফেঁড়ে খড় টেনে নিয়ে এসে যেখানে পেরেছে সেখানে বসেছে।

বাড়ির পুরুষরা এবাড়ি ওবাড়ি সব তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে... না, কোথাও কুন্তীর মেয়ে নেই। জামাইকেও কেউ দেখতে পায়নি। সরকারি মাঠ থেকে প্রায় সবাই চলে এসেছে।

এদিকে অসিত মাতব্বরের নির্দেশে কয়েকটা দল উদ্ধার কার্যে নেমে পড়েছে।

কয়েকটা দল লাঠি-সোঁটা-দা নিয়ে বীর-বিক্রমে পাড়ের গাছ-পালা ঠেঙিয়ে তছনছ করে চলেছে। তিনটে দল টর্চ হাতে এপাশের পুকুরে, ওপাশের পুকুরে আলো ফেলছে। তাদেরও আশা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে।

একটা দল হো হো করতে করতে হাজরাদের জেনারেটর কাঁধে করে বয়ে নিয়ে এল। তার টাঙিয়ে এগাছে, ওগাছে, পাড়ের ভিতরে, ওদের উঠোনে টিউব লাইট জ্বালিয়ে দিল। সারা পাড়া ও পুকুরটা আলোয় আলো হয়ে গেছে। এমনকি অন্ধকারে সেই ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছে যতদূর সাহসে ভর করে উঠতে পারল, ততদূর টিউবলাইট দিল। তারা যেন শপথ নিয়ে লেগে পড়েছে, কুন্তীর মেয়ে যেখানেই থাক, তাকে তারা খুঁজে বের করবেই।

নাহ, কোথাও কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলছে -যদি শিয়াল-কুকুরে টেনে নিয়েও আসত, কোথাও না কোথাও কোনো চিহ্ন থাকত বা অন্তত কিছু পাওয়া যেত।

কয়েকজন ভয়ার্ত সাহসে তেঁতুল গাছে উঠে আবার নেমে এল।

অসিত মোড়ল কি করবে ঠিক করে উঠতে পারছে না। জলজ্ব্যান্ত মেয়েটা নেই বললে নেই হয়ে যাবে? সামান্য একটা মেয়েকে খুঁজে বের করতে পারবে না! যত না দুঃখ হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি না পাওয়ার ব্যর্থতায় আত্ম সম্মানে ভুগছে। হঠাৎ চেঁচাতে লাগল -ওরে, ও খগেন। আমাদের বাড়ি যা। কয়েক পাটা জাল নিয়ে আয় দেখি। যাবে কোথায়! পুকুরও ঘেঁটে ফেলব। দেখি শালীর দৌড় কতদূর! যা রে, যা, দেরি করিস না।

খগেন নির্দেশ শোনা মাত্র জালের উদ্দেশ্যে দিল দৌড়।


(৩)

জামাইকে পাওয়া যাচ্ছে না, মেয়েকেও না, তার উপর পুকুরে এমন আওয়াজ, আর ঐ মান্ধাতার আমলের ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ... সব কিছু ঘিরে এখন রহস্যে যেন দানা বেঁধে উঠেছে।

ওদিকে সেই রাত থেকে একদল মেয়ে কুন্তী ও তার মাকে ঘিরে রয়েছে। যখন থেকে তারা এসেছে তখন থেকেই তাদের রুচি-অভিমত-সহানুভূতি-সন্দিগ্ধতা-পরিহাস-আলোচনা-সমালোচনা ভিন্ন ভিন্নতায় পাল বাড়ির বাতাস ভারী করে তুলেছিল। কখন বা ফিসফিসিয়ে, কখন বা জোরে জোরে।

-সোড়েল নিয়ে গেছে, বুঝলি!

-না না! তা কি করে হয়? পাঁচ মাসের মেয়েকে এইভাবে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না।

-তাহলে ওর বাবাই নিয়ে গেছে হয়তো!

-মেয়েকে নিয়ে গেলে, বাবা কি বলে নিয়ে যেত না?

-অন্য কিছুও তো হতে পারে। হয়তো দোলা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গাছে উঠছিল। ভারি শরীর মুখে করে নিয়ে গাছে ওঠা সহজ নয়! তাই হয়তো মুখ ফসকে পড়ে গেছে জলে।

-এই তো গতরাতে আমাদের ডিম পাড়া হাঁসটা কিসে টেনে নিয়ে এই গাছেই উঠছিল। হাঁসের আওয়াজে আমরা এসে দেখি আর নেই! সবাই হতাশ হয়ে যে যার ঘরের দিকে ফিরব, তখনই দড়াম করে ওপর থেকে ঐ জায়গায় পড়ল। আমরা চমকে গেলাম।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, যে নিয়ে উঠেছিল সে সৎ কিনা, তাই ভাবল তোরা কত কষ্ট করে পুষেছিস, ফেরত দিয়ে দিল। শোন পলা, এমন সময় এমন গাল-গল্প না দিলে নয়!

-তোদের মাথা খারাপ নাকি? হাঁস আর ছেলে এক হল? ছেলেটাকে টেনে তুলে নিয়ে গেল, আর সে কাঁদল না মোটেও।

-অন্য কিছু হয়তো গাছ থেকে পড়েছে। গাছে তো দেদার পাখির বাসা। শুধু কি দেদার পাখি? যারা সেই আদ্দিকাল থেকে আছে ওখানে, তারাও কি কম নাকি? হয়তো ঘাড় মটকে দিয়ে...

-তুই থাম দিকি জগার বউ। মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিসনি। ঐ দেখো দিকি, অমন করে বারবার কপালে হাত ঠেকিয়ে আমাদের আর ভয় দেখাসনি? রক্ষে কর।

নিজেও কপালে কয়েকবার দুই হাত জড়ো করে ঠেকিয়ে আবার বলল -অন্য কেউ কিছু মুখে করে এনেছিল। খেতে গিয়ে গেছে পড়ে। রাতে জলে কিছু পড়লে জোরে আওয়াজ হয়। তাই গৌরী ভয়ে পালিয়ে এসেছে।

-পুকুরের তো বড়ো বড়ো গোসাপ রয়েছে। উঠোন থেকে, পাড় থেকে হাঁস-মুরগি টেনে নিয়ে যায়। গিলে গিলে খেয়ে ফেলে। ঐ টুকু বাচ্চাকে হয়তো ফাঁকা পেয়ে টেনে নিয়ে গেছে।

-না গো ছোটোমা। সে হলে অত উচু বারান্দায় উঠে, দোলনা থেকে নিয়ে যাবে, বাছা আমার একটুও কাঁদবে না। তাছাড়া সে হলে পাড়ের কাছেই তো পড়ত। কিন্তু তা ঐ গাছের তলায় পাড় ছেড়ে অনেক দূরে পড়েছে। খুব জোরে সে আওয়াজ। সঙ্গে কত জোরে জলের ঢেউ ঘাটের কাছে এল মনে হল। আলোটা নিভে গেল যখন, ঠিক তখনই ঐ কাণ্ড।

-কুন্তী বলছিল যে ওর বর মেয়ে হয়েছে বলে মেনে নিতে পারছিল না। তার উপর ও ঐ বাড়ির প্রথম বউ। বংশে প্রথম সন্তান মেয়ে বলে শ্বশুরবাড়ির থেকে ওকে নিতে আসতে চায় নি। ওকে নাকি আর ও বাড়িতে তুলবে না। এমনকি আজও পর্যন্ত ওর বর মেয়েটার মুখ দেখেনি।

-শ্বশুরবাড়ি! সে কি এইখানে? কোন না কোন ভাগাড়ে! যেন যমের দুয়ার! মেরে মেরে মেয়েটার কি হাল করেছিল দেখেছিলে তো, মনে নেই? অমন শ্বশুরবাড়ির ক‍্যেঁতায় আগুন!

-মনে হয় তুমি ঠিকই বলছ বড়ো মা। মেয়েটা হওয়ার আগে থেকেই তো ওকে এখানে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। মেয়েটা হওয়া শুদ্ধু একবার কেউ আসেনি ওবাড়ি থেকে। ওরা বাচঁল কি মরল, কেউ কোনো খবরও নেয়নি। হঠ্যাৎ আজ দুপুরে এই প্রথম মেয়েকে দেখতে নন্দাই এসেছিল। এসেই সে কি ঝগড়া? মুখের সে কি ভাষা! শুনলে না, তোমার মরে যেতে ইচ্ছে করবে। কিছুক্ষণ পরে

কুন্তীর কান্নার আওয়াজ কানে আসছিল।

-দুপুরে ওর বর নাকি কিছু খায়নি।

ওর বরই কিছু করেছে মনে হয়। ওই জলে ফেলে দি...

-দূর হতভাগী, যা নয় তাই মুখে আনছিস। বাবা হয়ে মেয়েকে জলে ফেলে দেবে?

খগেনের মা পাশেই বসেছিল। ঝংকার দিয়ে উঠল -কিন্তু তোমার সে বাবাজীবন গেল কোথায়, দিদি? শাক দিয়ে আর কত মাছ ঢাকবে শুনি? আমরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি?

এমন পরিস্থিতিতে আরো কত কথা যে কিভাবে উঠে আসে তা পাঠকের অগোচরে নয়। সে কথোপকথনের ইতিবৃত্ত নাই বা তুলে ধরলাম। শুধু সুযোগ আর সময়ের আলো-বাতাস পেলে নিজেদের মানসিকতার তাপে তা যে অঙ্কুরোদগম থেকে মহীরুহে পরিণত হয়... সে দৃষ্টান্ত আমাদের আশেপাশে ভুরি ভুরি।


(৪)

সারা গ্রাম যেন পুরোটাই এখানে উঠে এসেছে। শুধু এবাড়ির সেই নাতনি ও জামাইকে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। কেউ তাদের দেখেছে কিনা তাও কেউ বলতে বলছে না। তবে তাদের না পাওয়ায় জামাইকে নিয়ে জল্পনা উত্তরোত্তর বাড়ছে। কেউ কেউ রাগে ফেটে পড়ছে। কোনোক্রমে তার হদিস পেলে যেন সবাই মিলে তাকে পিষে মারবে। কিন্তু তাকে পেলে তো! যত সময় গড়াচ্ছে, তাকে না পাওয়ার জন্য আরো আরো বেশি করে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে কেউ কেউ। এখন তার উপরে পুরো সন্দেহ গিয়ে পড়ছে। এক প্রকারে সমবেত জনতা ঠিকই করে নিয়েছে... এ কাজ অন্য কারোর নয়, তারই কাজ। অশরীরী বা অন্য কোনো জীব জন্তুর উপর দোষ আরোপ করার মত যুক্তি কেবল হীন থেকে হীনতর হয়ে আসছে।

কচিকাঁচা, বউ-ঝি, বুড়ো-হাবড়া কেউ তার সমাধান না দেখা পর্যন্ত এক পাও সরছে না। কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠে এসেছে। খালি গা। কেউ কেউ হাই তুলছে, কেউ কেউ বিড়ির পর বিড়ি টেনে যাচ্ছে। কারো কারো মুখে তামাক। আঙুল দিয়ে চেপে চেপে ঘষছে। আঙুলের চাপে দাঁতের আওয়াজ বেরুচ্ছে... কচওওও... কচওওও...। থেকে থেকে তামাকের থু থু, ঠোঁটের কারুকার্য করে পুচ-চ-চ-চ করে ফেলছে পুকুরে। কারো কারো কোলে বাচ্চা ঘুমিয়ে নেতিয়ে পড়েছে। তবু কেউ সরছে না। রাত গড়াচ্ছে তরতর করে। জামাইয়ের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কে যেন চেঁচাচ্ছে -জাল এসেছে, জাল এসেছে।

খগেন আর উত্তম ঝপাস করে জালের গাট্টি ফেলল মাটিতে। পাটার পর পাটা জুড়ে জাল নামাল পুকুরে। কেউ সাহস করে নামতে চাইছে না। যাকে নামার কথা বলা হচ্ছে, সে পুকুরের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন সিঁটিয়ে যাচ্ছে।

কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে খগেন কাছা সেঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে -জয়-য়-য়-য় মা কালী!

কোথা থেকে কোন বল কাজ করল কে জানে! খগেনকে দেখে কেউ কেউ নামল তরতরিয়ে। কেউ কেউ দিল ঝাঁপ জলে। জল উঠল কেঁপে। টান পড়ল জালে। সবাই উৎসুক তাকিয়ে রইল সেদিকে।

সময় যত গড়িয়েছে কুন্তীকে দেখে কষ্ট আর সহ্য করা যাচ্ছে না। পড়ে আছে নিথর হয়ে। মেয়ের শোক যেন জগদ্দল পাথর হয়ে তাকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। কেঁদে কেঁদে গলার স্বর বসে গেছে। ঝিম মেরে পড়ে আছে। জাল নামাতেই কাত হয়ে পড়ে রয়েছে পুকুরের দিকে তাকিয়ে। চোখ থেকে জল কানের পাতা বেয়ে মাটিতে পড়ছে টপ টপ করে। মাটি ভিজে যাচ্ছে সেই বেদনার বিন্দুতে।

তার কান্নায় আগের মতো আর তেজ নেই, উথাল-পাথাল আছাড় খাওয়াও নেই। নেই সেই চুল ছেঁড়া, বুক চাপড়ানো হাহাকার। কান্নার শব্দরা গেছে হারিয়ে। শুধু তীব্র বেদনার অস্ফুট সমান্তরাল গোঁঙানি বেরিয়ে আসছে -আঁ-আঁ-আঁ-আঁ-আঁ...

গায়ের কাপড় আর গায়ে নেই, মাটিতে রয়েছে পড়ে। আলু থালু বেশ। সারা গায়ে ধুলো আর ধুলো। খোঁপা গেছে খুলে। লম্বা লম্বা চুলগুলো ধুলো মেখে ছড়িয়ে রয়েছে মাটিতে। কানের একটা দুল কোথায় গেছে পড়ে।

কুন্তীর পাশে বসে রয়েছে তার মা। মেয়ের এমন করুণ পরিণতি দেখে তার বুকটা হু হু করছে। ফুটিফাটা মাঠের মতো বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। শোকের বেদনাদীর্ন জোয়ার তার স্নেহের বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে অনবরত। জন্মের পর থেকেই নাতনিকে তিল তিল করে বড় করে তুলেছে। তার মুখটা যত মনে পড়ছে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। তারও ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু তা আর পারছে কোথায়?

উঠোনের শেষ প্রান্তে পুকুরে গায়ে মড়ায় বসে রয়েছে অসিত মাতব্বর। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে -খগেন, কানাই, জাল টেনে এদিকে নিয়ে আয়। আরে ঐ জগা গালাটা ভালো করে চেপে ধর। বেশি দূরে তো পড়েনি বলেছে। ফাঁক দেস না, পাঁকে চেপে ধরে টান।

কানাই আর খগেন পাড় ছেড়ে একটু দূরে সাঁতরে সাঁতরে জাল টেনে টেনে আনছে। সাঁতার কাটতে কাটতে মাঝে মাঝে মুখে জল ভরে আসছে। তা ফুঁউউউউ করে উপরের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। অসিত মোড়লের নির্দেশ শুনে কানাই খাবি খেতে খেতে বলল -যাই কাকা। জাল ভারী হয়ে উঠছে। টানতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে।

থেকে থেকে দু একটা মাছ লাফিয়ে উঠছে জলের উপর। কোনোটা এক লাফে জালের নাগাল পেরিয়ে ওপারে গিয়ে পড়ছে। জাল যত পাড়ের কাছে আসছে মাছেদের ছটফটানি, লাফালাফি ততই বাড়ছে। ছোটো, বড়, মাঝারি কত রকমের মাছ লাফিয়ে উঠছে উপরে। জেনারেটরের আলোয় সেগুলো বর্শার ফলার মত চকচক করে উঠছে।

জাল টেনে পাড়ের কাছে আনতেই সবাই ডাঙা থেকে ঝুঁকে পড়ল। দেখতে গিয়ে কেউ কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ল জলে। শোরগোল পড়ে গেল -এই মাথা নিচু কর। দেখতে পাচ্ছি না।

-আর একটু জালটা চাগা। তুলে ধর। তুলে ধর।

যারা জাল টেনে আনছিল হাঁপিয়ে গেছে। টানতে টানতে জোরে জোরে দম নিচ্ছে।

যারা ঢুলে ঢুলে ঘুমিয়ে পড়ছিল, তারা এখন সবার পিছনে পড়ে না দেখতে পাওয়ায় হা‍হুতাশ করছে।

অসিত মোড়ল গলা ফেঁড়ে বলছে -ওরে, মাছগুলোকে তাড়াতাড়ি ছাড়। ছাড়। জাল টেনে তোল ডাঙায়।

মাছ ছাড়তে ছাড়তে জাল জলের উপর টেনে তুলতেই সবাই চেঁচাতে লাগল -ঐ তো, ঐ দেখা যাচ্ছে।

জগা কাঁদতে কাঁদতে দুহাতে সেই নধর শরীরটা চাগিয়ে তুলল জাল থেকে।

সত্যিই তো, ছোট্ট মাথায় একরাশ কালো চুল। শরীরটা গায়ের লাবণ্য হারিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখের টানা টানা কাজল, কপালের টিপ এখন আরো জ্বল জ্বল করছে।

ছোট্ট ফ্যাকাশে মুখে হাত বোলাতে বোলাতে কে যেন কেঁদে কেঁদে বলেছে -সারা গা'টা কিসে কামড়ে কামড়ে খেয়েছে রে। শালা মানুষে এমন কাজ করে রে!

ভীড় ঠেলে ঠেলে পাগলিনীর মত কুন্তী এল সেখানে। ক্ষত বিক্ষত, নধর-নীথর-শীতল দেহটা বুকের মধ্যে জাপ্টে ধরে সারা শরীরে ঘন ঘন চুমু খাচ্ছে আর হাউ হাউ করে কাঁদছে।

মৃত সন্তান বুকে করে মায়ের এমন হাহাকারের দৃশ্য দেখে, কান্নায় সবার গলা ভিজে আসছে। বেদনায় বুকটা হু হু করে উঠছে সবার।

কুন্তীর বাবা আর নিজেকে আর সংবরণ করতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে বলল -ওরে কুন্তীকে কেউ এখান থেকে নিয়ে যা। নিয়ে যা রে। শোকে ও পাগল হয়ে যাবে। নাতনিটাকে তো হারালাম। আমি আমার মেয়েটাকে হারাতে পারবো না। তোরা নিয়ে যা ওকে, নিয়ে যাআআআআআ...

কারা জোর করে পরীর ফ্যাকাশে-নীথর-শীতল দেহটাকে কুন্তীর কোল থেকে কেড়ে নিল। কে যেন একটা মাদুর পেতে দিল উঠোনে সবার মাঝখানে। মাদুরে শুইয়ে দিল পরীকে।

কারা কুন্তীকে টানতে টানতে নিয়ে চলল তাদের বাড়ির দিকে। তার মর্মবিদারক কান্নার আওয়াজ সবাইকে কাতর করে তুলছে।

কুন্তীর বাবা পরীর মাথার কাছে বসে ছোট্ট মাথায় বারবার হাত বোলাচ্ছে। তার মনে পড়ছে... রোজ বিকেলে তাকে কোলে করে নিয়ে পাড়া ঘুরিয়ে আনতো। দোলনায় বসে দোল খেয়ে খেয়ে গান করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিত।

যত এসব কথা মনে পড়ছে, ততবার ঐ নিথর-শীতল মুখটায় চুমু খাচ্ছে।

এসব দেখে কেউ আর নিজেকে সামলাতে পারছে না। সবাই কাঁদছে। সবার চোখে জল অবাধে গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে।

সারা গ্রামটায় কেউ যেন নিমেষে শোকে ভরিয়ে দিয়েছে। বেদনার ভারে কারো মুখে কোনো কথা নেই। শুধু কুন্তীর বুকফাটা কান্না সবাইকে ছাপিয়ে, গ্রামের বাতাসে ভেসে দূরে দূরে চলে যাচ্ছে

-পরী রে। পরী-রী-রী-রী-রী-রী... মা আমার, কোথায় গেলি? পরী রে। পরী-রী-রী-রী-রী-রী...

0 comments: