প্রচ্ছদ নিবন্ধ - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধপলাশীর প্রান্তরে সিরাজের ভাগ্য বিপর্যয়ের পরবর্তী ৫০ বছরে বণিক ইংরেজ ছলে-বলে-কৌশলে বাংলা তথা ভারতের শাসক হয়ে উঠলো। শাসক ইংরেজের প্রবলতর শক্তির প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষা , ভাব ও সংস্কৃতি বাঙালির জীবনে ও মননে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল। তার অনুকূল ও প্রতিকূল উভয় পরিণামই দেশ ও জাতিকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলেছিল। মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা ও সমাজ ব্যবস্থার অচলায়তনে আবদ্ধ বাঙালির শ্লথগতি জীবনযাত্রা সহসা নবচেতনার বেগে বলীয়ান হয়ে উঠল। বাঙালি উদ্যমে ও জীবনবোধে মধ্যযুগ অতিক্রম করে নবযুগের অংশীদার হল। ১৯শতক বাঙালির নবজাগরণের মাহেন্দ্রক্ষণ। এই নবজাগরণের একটি গভীর ও ব্যাপক তাৎপর্য আছে। সেই গভীরতা ও ব্যাপকতার উৎস থেকে তৎকালীন সাহিত্য প্রচেষ্টা উৎসারিত। শুধুমাত্র একটি নবসাহিত্য রচনার উদ্যমই নবজাগরণের পরিপূর্ণ রূপ নয়। রাষ্ট্রজীবন, সমাজজীবন, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্প, শিক্ষা, সভ্যতা ---এক কথায় সমগ্র জীবন সাধনার সমন্বয ও ঐক্যের মধ্যেই বিধৃত ও স্পন্দিত হয় নবজাগরণের চিৎশক্তি। এই ইতিহাস ধারার সন্ধান না করলে আমরা নবজাগরণের মর্মবাণীকে অনুভব করতে পারবোনা।
এই নবজাগরণের কালেই ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে। (বীরসিংহ তখন সম্ভবত হুগলি জেলার অন্তর্গত ছিল)। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগবতী দেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র অল্প বয়সেই তাঁর বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে এসেছিলেন শিক্ষালাভের জন্য। শাস্ত্র অধ্যয়ন করে সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ ক'রে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান পণ্ডিত হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও, ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন ইশ্বরচন্দ্র। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৩০ বছর বয়সে ঐ কলেজের অধ্যক্ষের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। সমাজসংস্কারক ও শিক্ষাবিদ্ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা এবং শিশু পাঠ্যবই রচনার পাশাপাশি যে সংস্কৃত হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন, তার মূলে ছিল নব জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ বাঙালির জাগ্রত চিত্তের জিজ্ঞাসা। জীবন ও জগৎ-কে নুতন আলোয় দেখার আগ্রহ থেকেই অনুবাদ সাহিত্যের সূচনা হয় উনিশ শতকে।অনুবাদের মাধ্যমে শুধু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হওয়াই নয়, স্বদেশের প্রাচীন শাস্ত্র ও রসসাহিত্যের অনুধাবন ও আস্বাদনের সুযোগও বাঙালি পাঠক পেল।
উনিশ শতকের অনুবাদ ধারার অচ্ছেদ্য অংশরূপে বিদ্যাসাগরের অনুবাদ গ্রন্থ রাজিকে তালিকাবদ্ধ করলে দেখা যায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রসশাস্ত্র উভয় বিষয়ে তাঁর দক্ষতা অতুলনীয় ----
প্রকাশ কাল গ্রন্থ নাম মূল ভাষা
১৮৪৭ --বেতাল পঞ্চবিংশতি -- হিন্দি
১৮৪৮ -- বাঙ্গালার ইতিহাস -- ইংরেজি
১৮৪৯ -- জীবনচরিত --- ঐ
১৮৫১ -- বোধোদয় --- ঐ
১৮৫৪ -শকুন্তলা -- সংস্কৃত (কালিদাস)
১৮৫৬ -- কথামালা -- ইংরেজি
১৮৫৬-- চরিতাবলী --- ঐ
১৮৬০ -- সীতার বনবাস-- সংস্কৃত(ভবভূতি)
১৮৬০-- মহাভারতের উপক্রমণিকা --- সংস্কৃত
১৮৬৯-- ভ্রান্তিবিলাস -- ইংরেজি ( শেক্সপিয়ার )
এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় হ'লো - মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ নাটকের বিদ্যাসাগর প্রণীত গদ্যানুবাদ ।
বিদ্যাসাগরের কোন অনুবাদই হুবহু পরানুসরণ নয়,আলোচ্য শকুন্তলা নাটকের গদ্য অনুবাদ এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাত অঙ্কে বিন্যস্ত অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ এর গৌড়ীয় সংস্করণ ও উত্তর ভারতীয় সংস্করণ এর পাঠ অনুসরণ করে বিদ্যাসাগর মহাশয় সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত গদ্য উপাখ্যান "শকুন্তলা "রচনা করেছিলেন।
মূল নাটক অনুযায়ী মহারাজ দুষ্মন্তের মৃগয়া প্রসঙ্গের উল্লেখ করেই গদ্য কাহিনী সূচনা হয়েছে । প্রতিটি চরিত্রের সংলাপ অনূদিত হয়েছে বাংলা গদ্যে । অবশ্য সংলাপ উদ্ধৃতি চিহ্নের বন্ধনে আবদ্ধ নয়। উত্তর ভারতীয় তথা দেবনাগরী সংস্করণের তুলনায় গৌড়ীয় সংস্করণে তৃতীয় অঙ্ক দীর্ঘতর। বিদ্যাসাগর মহাশয় এর গদ্যানুবাদে গৌড়ীয় সংস্করণের এই অতিরিক্ত অংশ সংযোজিত হয়েছে। যেমন মাধবীলতা য় ফুল ফুটলেই শকুন্তলা র বর আসবে এই উপাখ্যান গৌড়ীয় সংস্করণ থেকেই বিদ্যাসাগর গ্রহণ করেছেন। গদ্য কাহিনীর শেষাংশে মূল নাটকের সঙ্গে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। মূল নাটকের সপ্তম অংকে বর্ণিত হয়েছে, রাজা দুষ্মন্ত সর্ব দমনের রক্ষাকবচ স্পর্শ করলেও তা সর্পে রূপান্তরিত হল না দেখে আশ্রমের তাপসী রা শকুন্তলাকে সংবাদ দিলেন। শকুন্তলা আপন সৌভাগ্য সম্পর্কে আশান্বিত না হয়েই অকুস্থলে এসে স্বামী দুষ্মন্তের দেখা পেলেন। অথচ বিদ্যাসাগরের অনুবাদের সপ্তম পরিচ্ছেদ এর শেষাংশে মূল নাটকে বর্ণিত মারীচ আশ্রমের অন্যান্য ঘটনা উল্লেখিত হলেও অপরাজিতা কবচের প্রসঙ্গ বর্জিত হয়েছে । বিদ্যাসাগর বর্ণনা করেছেন, বহুক্ষণ অদর্শনের ফলে উৎকণ্ঠিতা শকুন্তলা পুত্রকে অন্বেষণ করতে করতে হঠাৎ দুষ্মন্তের দেখা পেয়েছিলেন।
প্রয়োজন বুঝে মূল বক্তব্য থেকে বিচ্যুত না হয়েও সংলাপের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন বিদ্যাসাগর। যেমন ,
মূল নাটকের তৃতীয় অংকের শেষাংশে কণ্ব মুনির ভগিনী গৌতমী বিরহ কাতর শকুন্তলাকে অসুস্থ মনে ক'রে তার কুশল কামনা করছেন , এই প্রসঙ্গটি বিদ্যাসাগর অসামান্য দক্ষতায় চিত্রিত করেছেন ।
মূল নাটকের সংলাপ এর বঙ্গার্থ এইরকম :
"( জলে র পাত্র নিয়ে গৌতমীর প্রবেশ, সঙ্গে দুই সখী)
গৌতমী: বৎসে , তোমার শরীরের তাপ কিছু কমেছে কি?
শকুন্তলা : আজ একটু ভালো মনে হচ্ছে।
গৌতমী : এই কুশোদকে তোমার সব অসুখের শান্তি হবে।বৎসে,দিন শেষ হয়ে এসেছে। চল, আমরা কুটীরে ফিরে যাই।"
বিদ্যাসাগর কৃত গদ্য অনুবাদ :
"কিয়ৎক্ষণ পরেই শান্তি জলপূর্ণ কমণ্ডলু হস্তে লইয়া গৌতমী লতা মণ্ডপে প্রবেশ করিলেন এবং শকুন্তলার শরীরে হস্ত প্রদান করিয়া কহিলেন, বাছা! শুনিলাম আজ তোমার বড় অসুখ হয়েছিল, এখন কেমন আছ, কিছু উপশম হয়েছে? শকুন্তলা কহিলেন, হাঁ পিসি! আজ বড় অসুখ হয়েছিল, এখন অনেক ভালো আছি। তখন গৌতমী কমণ্ডলু হইতে শান্তিজল লইয়া, শকুন্তলার সর্ব্ব শরীরে সেচন করিয়া কহিলেন, বাছা! সুস্থ শরীরে চিরজীবিনী হয়ে থাক। অনন্তর, লতা মণ্ডপে, অনসূয়া অথবা প্রিয়ংবদা, কাহাকেও সন্নিহিত না দেখিয়া, কহিলেন, এই অসুখ তুমি একলা আছ, কেউ কাছে নাই। শকুন্তলা কহিলেন, না পিসি! আমি একলা ছিলাম না অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা বরাবর আমার নিকটে ছিল,এইমাত্র, মালিনীতে জল আনিতে গেল। তখন গৌতমী কহিলেন, বাছা! আর রোদ নাই! অপরাহ্ন হয়েছে, এস কুটীরে যাই।"
গার্হস্থ্য জীবন রসসিক্ত এই কথোপকথন যথেষ্ট বাস্তবানুগ মনে হয়েছে বাঙালি পাঠকের কাছে। অনুবাদকের পর্যবেক্ষণশক্তি ও জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতার পরিচয় মেলে অনুবাদ এর বিভিন্ন অংশে, উদ্ধৃতাংশটি তার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
আলোচ্য অংশে আর একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটিয়েছেন অনুবাদক। মূল শ্লোকে গৌতমী বলেছেন, দিন শেষ হয়ে এসেছে, সন্ধ্যা আসন্ন, তাই তিনি শকুন্তলাকে একাকিনী না রেখে কুটিরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। বিদ্যাসাগরের অনুবাদে গৌতমী বলছেন, আর রোদ নেই তাই এখন কুটিরে ফিরে গেলে শকুন্তলার আর কোন কষ্ট হবে না।
নাট্যগুণ বজায় রেখে এমন সুন্দর সরল অনুবাদ সৃষ্টি করা যে সম্ভব তা বিদ্যাসাগর প্রমাণ করে গেছেন। বাংলা ভাষা শৈলীকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন বিদ্যাসাগর এই অনুবাদের মাধ্যমে। বাংলা গদ্যের যথার্থ পদবিন্যাস রীতির তিনিই নির্মাতা। সংস্কৃত পদান্বয় পদ্ধতির অনুসারী এক বিচিত্র পদবিন্যাস বাংলা গদ্যের বিকাশকে ব্যাহত করছিল, বিদ্যাসাগরের প্রতিভা স্পর্শে বাংলা গদ্য তার নিজস্ব গতিপথের পথের সন্ধান পেল।
১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে স্যার উইলিয়াম জোন্স অভিজ্ঞান শকুন্তলম এর ইংরেজি অনুবাদ করেন, শিরোনাম, "The Fatal Ring"। এই ইংরেজি গদ্যানুবাদের জার্মান অনুবাদ পড়ে মহাকবি গ্যেটে ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে মন্তব্য করেছিলেন,
" Willst du den Himmel ,die Erde ,mit einem,Namen begriefen,/ Nenn'ich Sakontala dich , und so ist alles gesagt"
"একটি নামে যদি স্বর্গ আর মর্ত্যকে মেশাতে চান তাহলে , শকুন্তলা আমি তোমারই ,নাম করছি আর তাহলেই সব কথা বলা হয়ে যায়।"
এক ই ভাবনার প্রতিধ্বনি শোনা যায় ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনায়---
১৮৫৩খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে 'সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব ' গ্রন্থে কালিদাসের নাটক আলোচনা প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন," কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তল অপূর্ব্ব পদার্থ।.....মনুষ্যের ক্ষমতায় ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট রচনা সম্ভবিতে পারে না ।...
যদি শতবার পাঠ কর ,শত বার ই অপূর্ব্ব বোধ হইবে।"
সংস্কৃত অনভিজ্ঞ অথচ রসজ্ঞ পাঠকদের সামনে অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটকের অনাস্বাদিতপূর্ব রসের আধারকে উপস্থিত করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
ড.পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগযোগমায়াদেবী কলেজ
0 comments: