0

প্রবন্ধ - ধীমান চক্রবর্তী

Posted in


তারপর আমরা হাঁটতে শুরু করেছিলাম। পোদ্দার কোর্ট থেকে কলেজস্ট্রীটের দিকে। মঞ্জুষ দাশগুপ্তর সাথে মাঝে মধ্যেই। কেউ না কেউ তাঁর সাথে থাকতই। কুমারেশ চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন হীরা, রামকিশোর ভট্টাচার্য, আমি এবং আরও কেউ কেউ। বিশেষত শুক্রবার পোদ্দার কোর্টে মঞ্জুষদার অফিসের সেই বিখ্যাত আড্ডার পর একটু হেঁটে যাওয়া। মঞ্জুষদার মতো অত বড় মাপের মানুষের সঙ্গে হেঁটে যাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ ছিল।

‘আরেকটি দিন শেষ হল। কথা তুলে রাখা বারান্দায় সন্ধ্যাচিক নেমে এলো। পর্যটন প্রিয় নক্ষত্রকে স্থির দেখি।’

‘একসাদা ভূতকাপড়ের মতো আবছা চাঁদ। ভাঙাসেতুর উপর উড়তে থাকে।’

বললাম বটে অত বড়মাপের মানুষ – কিন্তু তাঁর আচার আচরণে কোনোদিন তা প্রকাশ হতে দেননি। মাঝে মাঝে তো আমাদের সাথে শিশুর মতো মিশতেন। বড় মাপের মানুষদের যা চরিত্র আর কি! পা থেকে মাথা পর্যন্ত একজন ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলেন মঞ্জুষদা। তাঁর স্নেহ, বন্ধুত্ব ও ইতিবাচক চিন্তাভাবনা আমাদের মধ্যে চারিয়ে যেতো এবং প্রাণবন্ত করে তুলতো। এতো বড় মাপের দিলখোলা হৃদয়বান মানুষের সাথে আমি অন্তত খুব কমই মিশেছি। তাঁর সঙ্গে গভীরভাবে মিশলে যে কোনও মানুষই এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন।

‘তোমার মুসাফির গন্ধ ঘুরে বেড়ায়। মৃদুচুড়ি বিলম্বিত লয়ে রিণরিণ। কে তোমাকে বেশি খায়। নিঃশব্দ অন্ধকার নাকি আমি!’

‘তুমি একটি না-মানুষপাথর। এখন। সে ঘুমোয়। কাদাপাথর। প্রিয়কে কথা বলার এইতো সময়। ছুঁড়ে দাও নিজেকে। পাথরের গায়ে। পাথরের লাগে না। শব্দ হয়।’

মঞ্জুষদার সঙ্গে এইসব যাতায়াতের পথে খরচ বলতে প্রায় কিছুই হতো না। উনিই প্রায় সব খরচ করতেন, কেউ দিতে গেলে তাকে স্নেহভরে ধমকে দিতেন। কদাচিৎ আমরা খরচ করার সুযোগ পেতাম। কোনো কোনো দিন দামুরস্‌-এ যাওয়া হতো। মঞ্জুষদার প্রিয় জায়গা ছিল। তবে মদ আর সিগারেটের খরচ প্রত্যেকের নিজস্ব। এ তো কলকাতার মধ্যে। কলকাতার বাইরেও অঁর সাথে একাধিকবার বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ গেছি। গেছি পার্বতীনাথ দে-র আহ্বানে চন্দ্রকোণায়। অচিন্ত্য নন্দীর ডাকে গেছি মেদিনীপুর, তো কবিতা পাক্ষিকের অনুষ্ঠানে দুর্গাপুর। সে সব স্মৃতি আজও অমলিন। ওঁর মতো স্নিগ্ধ অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সাথে সময় কাটানো এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল।

‘মেঘ জানে না। কোথায় যে যেতে হয়! কেন যাওয়া! মানুষও জানে না। তবু যায়। যেতে থাকে। গাছ জানে কোথাও যাবার নেই।’

‘পেরেক ঠোকার শব্দ। মেধাকোষে। বারেবারে ছিটকে আসে। একসময় ঠিক ভোর হয়। বৃষ্টি থামে। পালিশ লাগানো সবুজের মধ্যে। তোমাকে উপুড় করে রাখি।’

‘একটি অণুগল্পের শেষে আরো একটি অন্ধকার দিন আসে। টাইরেসিয়াস জানে। আলো শুধু মিথ্যে কথা বলে।’

শুক্রবার ছাড়াও কোনো কোনো দিন পোদ্দার কোর্টে মঞ্জুষদার অফিসে কেউ কেউ চলে যেতাম। তবে বেলাআ তিনটের আগে নয়। এ ছাড়াও দেখেছি অল্প, জানতে পেরেছি বেশি যে বহু মানুষকেই প্রয়োজনে উনি আর্থিক সাহায্য করতেন। বিপদে পড়ে কেউ কাছে এসে সাহায্য চাইলেই হলো। লক্ষ্য রাখতেন, এই সাহায্যের কথা যেন কেউ জানতে নাআ পারে। অজস্র লিটিল ম্যাগাজিনের সঙ্গে ওঁর ছিল নিবিড় সখ্যতা। সেখানে কত কত কবির অসংখ্য কবিতা উনি ছেপে দিয়েছেন তা আর বলার নয়। তাঁর ওখানে তরুণ আর বয়েসি কবিদের যাতায়াত লেগেই থাকতো। তারা বহু সময়েই কবিতা পড়তো বা মঞ্জুষদাকে তাদের কবিতা পড়াতো। মজার বিষয় হলো, কারোর কবিতাকেই তিনি খারাপ বলতেন না। ভালো হয়েছে, চমৎকার – তিনি এমনই বলতেন। আসলে তিনি মনে করতেন, একজন তরুণ যত খারাপ কবিতাই লিখুন না কেন, প্রশংসা করলে হয়তো একদিন সে ‘কবিতা’ লিখে উঠতে সক্ষম হবে।

‘কখনো কি পূর্ণ উন্মোচিত হয়। প্রতিফলন প্রতিমায়! আরো ভিতরের অচেনা ভাষালিপির জন্যে সে অপেক্ষা করে। আরো একটি ট্রেন শূন্য কাঁপিয়ে চলে গেল।’

‘আকাশ গাছ। তারাপাতা ঝরে যায়। রুপোরঙ। কারো চোখজল ঝরে। মাঝে মাঝে। মানুষ কত কম দেখে। কম মানুষই দেখে। নাকি কেউ না!’

‘একটানা ট্রেন যায়। অস্থির আঙুলে শুধু সিগারেট পোড়ে। একসময় ডানাশব্দ বন্ধ করে পাখি। শিউলির ঝরে পড়া দেখি।’

যখনি পোদ্দার কোর্টে মঞ্জুষদার অফিসে আড্ডায় যেতাম, দেখতাম ওঁর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। পকেটে বা সামনের টেবিলে ফিল্টার উইলসের প্যাকেট পড়ে আছে। প্রায়শই আড্ডার মধ্যে তিনি কাউকে কাউকে কবিতা পড়তে বলতেন। ওই আড্ডায় নিয়মিত কবিতা পাঠ হত। খুবই মনোযোগ দিয়ে তিনি কবিতা শুনতেন এবং তাঁর যা মনে হত, সেই মন্তব্য করতে তিনি যথেষ্ট সপ্রতিভ ছিলেন। অনেক সময়ই বলতেন, বিশেষত সমসাময়িকদের, যে কবিতায় প্রত্যেকের স্বর যেন আলাদা করে চিনতে পারা যায়। মঞ্জুষদার অফিসেই গঠিত হয়েছিল অন্তর্বৃত্ত নামে একটি সংস্থা, যা প্রত্যেক সদস্য কবিদের জন্মদিন পালন করতো। সে একটা লম্বা ব্যাপার। এখানে নয়, এ নিয়ে আলাদা ভাবে লেখা প্রয়োজন।

‘কেবলি যাবার কথা। ভাবি। অনড়পাথর। রাত হয়। অন্ধকার। ঝিঁঝিস্বর। চোখনৌকা কিছুই শোনে না। দেখে। সময় মুচকি হাসে। চলে যেতে থাকে।’

‘বরফের উপর আমার আত্মার লাল লিখে রাখি। আমার রক্ত কখনো কালো ছিল না। বিনীত ছিলাম বলে ভুল ভেবেছিলে। প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করিনি কোনোদিন।’

‘অন্ধকারে ছায়াডাক। বহুদিন শুনিনি তারপর। মৃত সূর্য অনাদৃত রাত। সুশ্রুষা নদীর সাথে দেখা হল। সেইদিন। ডাক ভেঙে পড়ে। শুনি।’

বাঙলা দেশের বহু কবি মঞ্জুষদার অফিস পোদ্দার কোর্টে আসতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা। আমরাও অংশগ্রহণ করতাম। ত্রিপুরা থেকেও অনেক কবিকে আসতে দেখেছি। আসলে উনি খুব ভালো সংগঠক ছিলেন। প্রচুর কবিতা পাঠের আসর, কবিতা-গদ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন একাধিকবার তিনি আয়োজন করেছিলেন।

ভালো মানের চা খেতে খুব ভালোবাসতেন। তবে যেখানে সেখানে চা পেলেই হলো। বহু মঙ্গলবারই তিনি দক্ষিণ কলকাতার দিকে আসতেন। এলে আমার বাড়িতে এসে ঢুঁ মেরে যেতেন এবং এক কাপ চা বরাদ্দ থাকতই তাঁর জন্য। এখনো মাঝে মাঝেই বিশ্বাস করতে মন চায় না যে তিনি নেই। স্বপ্ন দেখি হাত ধরাধরি উনি আর আমি জেব্রাক্রসিং পার হচ্ছি। ওঁর হাতে ‘জন্মহীন সাদা লাঠি।’


[রচনাটিতে উল্লিখিত কাব্যাংশগুলি কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তের ‘অন্ধকার অন্ধ নয়’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া]

0 comments: